×

সাময়িকী

রুদ্রের সেই বিখ্যাত গান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৯, ০৪:৩৮ পিএম

রুদ্রের সেই বিখ্যাত গান
আশির দশকের শেষ দিকে তখনো প্রযুক্তি এতটা আগ্রাসী হয়নি। পরস্পরের যোগাযোগের বড় বাহন ছিল চিঠি বা টেলিগ্রাম। টেলিফোন ছিল বনেদি ব্যাপার। যাদের ঘরে টেলিফোন ছিল তাদের এলিট শ্রেণি মনে করা হতো। সেই সময় কোনো প্রিয়জনের খবরাখবর নিতে চিঠি ছিল বড় মাধ্যম। আর এই বিষয়ে আমার আলস্য ছিল পাহাড় সমান। রুদ্র এই কাজটি মন দিয়ে করতো। ঢাকায় থাকলে মাকে নিয়মিত চিঠি লিখতো। সেই রুদ্র ৬ মাসের অধিক ঢাকার বাইরে অথচ তার কোনো খবর নেই। এই লাইন চিঠি লিখেও জানাচ্ছে না, ও কোথায় কেমন আছে। মিঠেখালি গেলে বরাবরই ও লম্বা সময় সেখানে অবস্থান করে। কিন্তু তাই বলে এত লম্বা সময় আমি ওকে নিয়ে অন্যরকম আশঙ্কা করছিলাম। ৬ মাস পর একদিন আকস্মিকভাবে রুদ্র এসে হাজির। আমিতো ভ‚ত দেখার মতো চমকে উঠলাম। একটা কমন গাল ছিল আমাদের হঠাৎ দেখা হলে যা দিয়ে আমরা পরস্পরকে সম্বোধন করতাম। সেই গালটা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাচ্ছি না। সেটা আমার এবং রুদ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাক। ‘কি ব্যাপার বলতো, কোন খবর নেই। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি?’ আমার কড়া প্রশ্নে রুদ্র স্বভাবসুলভ দাড়ি হাতিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, ‘খবর আছে। জব্বর খবর।’ ‘কি খবর?’ মৃদু হেসে বলে, ‘বলবো। সব বলবো।’ এতদিন না দেখায় জমে থাকা কথাগুলো সব ছুটে সামনে এসে দাঁড়াতে লাগলো। অথচ তার কিছুই বলা হলো না। রুদ্র বললো, ‘চল, বেরিয়ে পড়ি।’ তখন সন্ধ্যা আসি আসি করছে। আমরা নীলক্ষেতের খানের দোকানে ঢুকলাম। এটা তখন আমাদের নতুন আড্ডাখানা। খান আমাদের দেখে শিশুর মতো উচ্ছ্বস করে উঠলো। বাংলা খেতে খেতে রুদ্রের কথা শুরু হলো। বললো, ‘আমি একটা গানের দল করেছি, ‘অন্তর বাজাও’। তিনজন সংগীত কর্মী আছে ওই দলে। দলপতির নাম গোলাম মোহাম্মদ। বাকি দুজনের নাম শাহ আলম এবং ফারুক হোসেন। ভাবছি, ওদের কীভাবে ঢাকায় এনে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। ঢাকায় না থাকলে ওদের গান হারিয়ে যাবে।’ ‘কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। রুদ্র বললো, ‘মিঠেখালিতে ওদের করার কিছু নেই। কিছু করতে না পারলে ওদের কাছ থেকে এক সময় গান হারিয়ে যাবে।’ রুদ্রকে এই নিয়ে চিন্তিত দেখাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘ওদের ঢাকায় নিয়ে আয়। এলে এক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ রুদ্র বললো, ‘সে ধরনের কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম।’ ‘কারণ?’ আমি জানতে চাইলাম। ‘ওরা গান ছাড়া আর কিছু পারে না।’ ‘মজার কথা বলেছিস তো।’ আমি হেসে ফেললাম। রুদ্্র বললো, ‘এখন ওসব থাক। পরে ভাবা যাবে। তোকে আসল কথা বলি। গ্রামের বাড়িতে থেকে আমি কিছু গান লিখেছি। গানগুলো আমরা মিলে সুর করেছি।’ এই কথা শেষ না হতেই রুদ্র তার আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয় গানটি টেবিল বাজিয়ে গাইতে শুরু করলো। ‘আমার ভেতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে’। গানের বাণী শুনে আমি মুগ্ধ চোখে বোবার মতো তাকিয়ে আছি। রুদ্র হঠাৎ ধমকিয়ে বলে উঠলো, ‘হাঁ করে কি দেখছিস? তাল মেলাচ্ছিস না কেন?’ আমি ওর সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে গিয়ে বারবার তাল কেটে ফেলছিলাম রুদ্রের সেই বিখ্যাত গান আর ও গালাগাল করে আমাকে বারবার সুর এবং তাল বোঝাচ্ছিল। এক সময় গানটি আমার কণ্ঠস্থ হলে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে এই একটি গানই বারবার গাইতে থাকলাম। সেটা অবশ্য আমারই কারণে। গানটি আমার এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিল যে, আমি অন্য কোনো গানের কথা ভাবতেই পারছিলাম না। বাকি যে গানগুলো ও নিয়ে এসেছিল সেগুলোও অন্যরকম গান। ১। ‘দিন গেল দিন গেলরে ও দিন গেলরে, মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করা আর হইলো না।’ ২। ‘ছিঁড়িতে না পারি দড়াদড়ি, খুলিতে না পারি দড়াদড়ি, সমাজের শেকলে আটকা পড়েছে পা রান্না ঘরে খুন্তি নাড়ানাড়ি।’ ৩। ‘আমরা পাড়ি দেব রুদ্র সমুদ্র কালো রাত। আকাশে ভাসবে পাল ভালোবাসা, বাতাসে পাল ভালোবাসা।’ বাকি গানগুলো আমাদের আড্ডায় কোরাস কণ্ঠে নিয়মিত গাওয়া হতো। কিন্তু প্রথম দিন আমি ভেতর বাহির নিয়েই ডুবে থাকলাম। গানটি মুহূর্তে আমার পুরোপুরি কণ্ঠস্থ হয়ে গেল। গানটি আমার মুখ থেকে কিছুতেই সরছিল না। একাই গাচ্ছি। হেঁটে যাচ্ছি আর গাচ্ছি। মানুষ আমাকে তাকিয়ে দেখছে। আর মনে মনে হয়তো পাগল ভাবছে। খানের আড্ডা থেকে যখন বের হলাম তখন মধ্য রাত। তুমুল বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরছে। শুরু হলো আমাদের পাগলামি। কত যে পাগলামি আমরা করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। বলে-কয়ে একজন রিকশাওয়ালাকে রাজি করানো গেল, সে আমার পশ্চিম রাজাবাজার নিয়ে যাবে। আমরা রিকশায় বসেই হুড ফেলে দিলাম। ভিজছি। আর গাইছি, ‘ভালো আছো ভালো থেক, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ।’ রিকশাওয়ালা বারবার ঘাড় ফিরিয়ে আমাদের দেখছে। নিশ্চয়ই সে আমাদের পাগল ভাবছে। তাছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ তখন ছিল না। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে অন্যান্য রিকশায় যাত্রীরা পর্দা দিয়ে চারপাশ ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে সেখানে আমরা খোলা রিকশায় ভিজতে ভিজতে নির্বিকারভাবে গান গেয়ে যাচ্ছি। আমাদের রিকশার পাশাপাশি আরো কয়েকটি রিকশা যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের পাগলামি দেখে তারাও ভীষণ মজা পেয়েছে। তারাও চলছে আমাদের পাশাপাশি। তাদের নীরব উৎসাহে আমাদের পাগলামি দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমরা কিন্তু ওই একটি গানই বারবার গাচ্ছিলাম। তারপর আমাদের আড্ডায় এই গানটি নিয়মিত গাওয়া হতো। গানটি আড্ডায় জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়। আড্ডার শেষে এই গানটি গাওয়া হতো। এই গানের পর অন্য কোনো গান আর জমতো না। তাই এটা সবশেষে বিদায় সংগীত হিসেবে গাওয়া হতো। এটাই কিন্তু রুদ্রের প্রথম গান নয়। ১৯৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ টানবাজার পতিতা পল্লীতে শবমেহের নামের একজন কিশোরীকে জোর পতিতা বানাতে গিয়ে নির্মম অত্যাচারে মেরে ফেলে। মেয়েটির নাম শবমেহের। শবমেহেরকে নিয়ে ফকির আলমগীর একটি গানের ক্যাসেট বের করেন। সেখানে রুদ্রের চারটি গান ছিল। তার মধ্যে একটি গান খুবই হৃদয় ছোঁয়া। ‘জীবনডারে কোন জীবনে থুই ভাঙ্গাচোরা মন।’ এই লাইন দিয়ে সেই সময় একটি আলোচিত পোস্টার করেছিল কয়েকজন তরুণ। ১৯৮৭ সালে প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসবে উৎসব সংগীত রচনার করে রুদ্র। ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা।’ সেটি সুর করেন ফকির আলমগীর। কণ্ঠ দেয় ঋসিজ শিল্পী গোষ্ঠী। ১৯৮৮ সালে ফকির আলমগীর শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে একটি ক্যাসেট বের করেন। সেখানে রুদ্র একটি অসাধারণ গান রচনা করে। ‘নূর হোসেনের রক্তে লেখা আন্দোলনের নাম। আমরা আবার নতুন করে সেই ভোরে জানলাম।’ গানটি সুর এবং কণ্ঠ দিয়েছেন ফকির আলমগীর। দুঃখের বিষয় এই বিখ্যাত গানটি যে রুদ্রের বেশিরভাগ শ্রোতা তা জানে না। এখানে গায়কের অবহেলার প্রশ্নটি থেকে যায়। কারণ সংগীত পরিবেশনের সময় গায়কের দায়িত্ব গানটির বাণী এবং সুরকারের নাম বলা। সেক্ষেত্রে এটা অনেকাংশে ব্যত্যয় ঘটেছে। তবে গানটির অসাধারণ সুর ফকির আলমগীরের। গায়কীও ছিল চমৎকার। ১৯৮৯ সালে এসে পেলাম, ‘ভালো আছি ভালো থেক, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ’। মুত্যুর পূর্বে রুদ্র পুরোপুরি সংগীতের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। সে ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের ভ‚মিকা ছিল ব্যাপক। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের কথা ও প্রায়ই বলতো। সংগীতের কারণেই তাঁরা বাঙালির হৃদয়ে অনন্তকাল বেচে থাকবেন এবং ভেতরে ভেতরে তাঁদের মতো সংগীতকেই সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে তা সইলো না। অসাধারণ কিছু গীতি কবিতা থেকে প্রকৃতি আমাদের বর্ঞ্চিত করেছে। এই শূন্যতা পূর্ণ হওয়ার নয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App