×

মুক্তচিন্তা

২২ বছর ধরে মাগুরছড়ার ক্ষত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুন ২০১৯, ০৯:১৭ পিএম

২২ বছর ধরে মাগুরছড়ার ক্ষত
২২ বছর ধরে মাগুরছড়ার ক্ষত

বাংলাদেশের সব বনের মালিক জনগণ। বন বিভাগ দেশের সব বনের রাষ্ট্রীয় প্রহরী। কিন্তু বন বিভাগকে ছাপিয়ে এক মার্কিন এজেন্সি আজ জনগণের পাবলিক বনের ওপর মাতবরি করছে। লাউয়াছড়ার বৃক্ষগুল্ম, তরুলতা, বননির্ভর আদিবাসী, চা-বাগান শ্রমিক, প্রাণিকুল সবাই বহন করে চলেছে একের পর এক অন্যায় বহুজাতিক আঘাত। রাষ্ট্রকে দেশের প্রাণ ও প্রকৃতির জানমাল সুরক্ষায় দাঁড়াতেই হবে, সব বহুজাতিক বাহাদুরিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিস্মৃতি বা অস্বীকার কোনোভাবেই জবাবদিহিতার বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

১৯৯৭ সালের ১৪ জুন অক্সিডেন্টালের অবিবেচক পরিচালনায় একসঙ্গে সপরিবারে নিহত হয় লাউয়াছড়া বনভূমির লাখো হাজার প্রাণ। একই সঙ্গে বৃক্ষ-পতঙ্গ-পাখি-পাহাড়ি ছড়া-মাটি-অণুজীব-ছত্রাক-পরাশ্রয়ী লতা গুল্ম-মাছ-সরীসৃপ-বন্যপ্রাণী-ব্যাঙ-পানজুম প্রশ্নহীনভাবে নিহত হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ হত্যার ইতিহাসে এত লাশের মিছিল লাউয়াছড়া ছাড়া আর কোথাও সমকালে দেখা যায়নি। হয়তো দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটিই জানা মতে দেশের সবচেয়ে বড় পরিবেশ-গণহত্যা। বনভূমির পাশাপাশি খাসিয়া-ত্রিপুরী এবং চা-বাগান শ্রমিকরা আহত হন, চেনাজানা জীবনজীবিকা হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে যান অনেকেই। দীর্ঘ ২২ বছরেও বাংলাদেশ মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণের তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারেনি। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে মাগুরছড়া বিস্ফোরণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। অক্সিডেন্টাল, শেভরণ কী ইউনোকল কোনো বহুজাতিক কোম্পানিদের কাছ থেকেই এই ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি রাষ্ট্র। নিশ্চিত করতে পারেনি লাউয়াছড়া অরণ্যের ন্যায়বিচার। বহুজাতিক এজেন্সিগুলো মাগুরছড়ার স্মৃতিকে বেমালুম উধাও করে দেয়ার উন্মাদনা চালিয়েই যাচ্ছে। প্রাকৃতিক বন ও সৃজিত বাগান মিলেমিশে এক জটিল মিশ্র চিরহরিৎ বর্ষারণ্যের বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠেছে লাউয়াছড়ায়। দেশের সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ১০টি জাতীয় উদ্যানের ভেতর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানই বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক গিবনের সবচেয়ে বড় বিচরণ এলাকা। মৌলভীবাজার রেঞ্জের ২ হাজার ৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ঘোষণা করা হয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের মাধ্যমে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় লাউয়াছড়া বনের প্রতিবেশ ও জীবন ব্যবস্থা। পরবর্তী সময়ে আরেক মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন বসায়। ফলে এই সংবেদনশীল বনভূমির বাস্তুসংস্থান অনেকটাই উল্টেপাল্টে যায়। মাগুরছড়া পরিবেশ-গণহত্যার পর ২০০৮ সালে রাষ্ট্রের অনুমোদন নিয়ে ভূতাত্ত্বিক গ্যাস জরিপের নামে মার্কিন কোম্পানি শেভরণ লাউয়াছড়া বনভূমিতে প্রশ্নহীন বোমা বিস্ফোরণে ঝাঁঝরা করে দেয় বনের মুমূর্ষু শরীর। মার্কিন নানা বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে এসব নিপীড়ন সংঘটিত হলেও আবারো প্রশ্নহীন কায়দায় মার্কিন সরকারের সহায়তায় এই বনভূমিতেই চালু হয়েছে নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প এবং তার লেজ ধরে আইপ্যাক কর্মসূচি এবং তারও লেজ ধরে ক্রেল প্রকল্প। নিসর্গ, আইপ্যাক ও ক্রেল কী করেছে? পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার নামে লাউয়াছড়া বনকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। নির্দয়ভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে চালু করেছে বাণিজ্যিক পর্যটন। ১৯৯৭ সাল থেকে ঘটে চলা লাউয়াছড়া বনের ওপর নানা বিচারহীন বহুজাতিক আঘাত সমূলে ঢেকে ফেলছে। বাণিজ্যিক পর্যটনের নামে জনগণের স্মৃতি থেকে লাউয়াছড়ার ওপর লাগাতার বহুজাতিক জখমের দাগ মুছে দিতে একের পর এক উন্নয়ন-উন্মাদনা তৈরি করছে। আজ নতুনভাবে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ বাংলাদেশের এক ব্যস্ত পর্যটন অঞ্চল হয়ে উঠেছে। লাউয়াছড়া-মাগুরছড়া এই পর্যটনের এক অবশ্য গন্তব্য ও দর্শনীয় স্থান। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে মাগুরছড়া বিস্ফোরণের স্মৃতি জোর করে মুছে দেয়া হচ্ছে। যাতে তরুণ প্রজন্ম করপোরেট অন্যায়কে প্রশ্ন না করতে শেখে। মাগুরছড়ার দগদগে সেই স্মৃতি থেকে সরিয়ে রাখা এই তরুণ প্রজন্মদের একজন ফুটন্ত পদ্মফুলের ছবি দিয়ে অনলাইনে মাগুরছড়ার গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণস্থলটির কথা লিখেছে, ‘একসময়ের মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র এখন পদ্মফুল ফুটছে।’ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম জানছে না, বুঝছে না কীভাবে তার নিজ মাটির রক্তমাংস করপোরেট দস্যুতায় ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়েছে ২২ বছর আগে। তাহলে সত্যটা কী? আসলে গভীর খাদ হয়ে টিলার ভেতর বসে যাওয়া জায়গাটি একটি গ্যাসকূপ। এখানে ছিল দুটি ঘাড় উঁচু টিলা। বিস্ফোরণের পর তড়িঘড়ি হরে সব পোড়া দাগ, কংকাল আর ছাই সরিয়ে অক্সিডেন্টাল এই খাদে পদ্ম আর শাপলা ফুল আনে। চারপাশে দ্রুত বর্ধনশীল সবুজ গাছ আর ঘাসে ভরে দেয়। যেন কোনো দাগ না থাকে। যেন বহুজাতিক অন্যায় আর এলোপাতাড়ি আঘাতের কোনো চিহ্ন না থাকে। কিন্তু অক্সিডেন্টাল, বন বিভাগ এবং রাষ্ট্রের জানা দরকার প্রাণ ও প্রকৃতি কাল থেকে কালে সব আঘাতের চিহ্ন বয়ে নিয়ে চলে ঝলসানো কলিজায়। এ চিহ্ন, এ দাগ মুছে ফেলার শক্তি কারো নেই। লাউয়াছড়ার খাসি আদিবাসীদের বনবিজ্ঞান অনুযায়ী, বনের নিচের স্তরে মানে বনতলে থাকে সেমখচু, মেকরিয়াৎ, লৎঅঁৎ, সেমখ্রুৎ নামের নানান পাখি। লাউয়াছড়া বনের সর্বাধিক সংবেদনশীল বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের ভেতর তেঙা হনরঅ নামের এক হলুদ কচ্ছপ, ডং চেলতিয়া নামের এক গাছশামুক, খ্র ছেরঙ্গান নামের এক সবুজ ব্যাঙ, ক্রালাহিড ও ক্রামুসুরি নামের ঔষধি গাছগুলোর আবাসও বনতল। আগুনে বনতল পুরো ঝলসে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কী পরিমাণে সাপ, ব্যাঙ, সরীসৃপ, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে তার কোনো উপাত্ত নেই। রাষ্ট্র জোর করেই এসব চিহ্ন মুছে ফেলতে চাইছে। এই অন্যায়-জুলুমের সাক্ষী মুছে দিয়ে নয়, ন্যায়পরায়ণতার হদিস রেখেই রাষ্ট্রকে গণপ্রজাতন্ত্রের ব্যাকরণ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণ হলো সমসাময়িককালের বৃহৎ ‘পরিবেশ গণহত্যা’। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে এ গণহত্যা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে টেনে চলেছে। পাশপাশি যুক্ত হয়েছে অস্বীকারের নির্দয় চাপ। এ বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বায়ুদূষণ’। মাগুরছড়া বিস্ফোরণ বায়ুদূষণকে কতটা ত্বরান্বিত করেছে এবং এর ফলে প্রাণ ও প্রকৃতিতে কী ধরনের প্রভাব তৈরি হয়েছে তার কি কোনো নথি বা দলিল আছে আমাদের চারধারে? নেই। ধীরে ধীরে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ সবাই মাগুরছড়া বিস্ফোরণকে অনেক আগের দিনের স্মৃতিকথা হিসেবে আড়াল করে দিয়েছে। মাগুরছড়া বিস্ফোরণের পরের ১০ বছর এ নিয়ে কিছু তৎপরতা ছিল, গণমাধ্যমেও ছিল সরব আওয়াজ। কিন্তু বিগত ১০ বছরে এ নিয়ে যেন কোনো রা নেই, কোনো প্রশ্ন নেই। ২০১০ সালের পর থেকে মাগুরছড়া বিস্ফোরণ নিয়ে গণমাধ্যমে কেবল ১৪ জুন একটি বক্স কলামে স্মরণ জাতীয় খবর প্রকাশ ছাড়া আর কোনো লেখাই নজরে আসেনি। হয়তো এ সময়টা জাতীয় বাজেট নিয়ে ব্যস্ত থাকে রাষ্ট্র ও সময়। কিন্তু মাগুরছড়া গণহত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করে কি কোনোভাবেই আমরা আমাদের বাজেট ও রাজনৈতিকতার বিকাশ ঘটাতে পারি? ঝলসানো জঙ্গল থেকে আবারো ঘাড় তুলে দাঁড়িয়েছে এক নতুন লাউয়াছড়া বন। কিন্তু নির্দয়ভাবে এ বনটি আবারো আরেক মার্কিন দাতা সংস্থা ইউএসএইডের খবরদারি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। অক্সিডেন্টাল, ইউনোকল ও শেভরণের পর ইউএসএইড। বাংলাদেশের সব বনের মালিক জনগণ। বন বিভাগ দেশের সব বনের রাষ্ট্রীয় প্রহরী। কিন্তু বন বিভাগকে ছাপিয়ে এক মার্কিন এজেন্সি আজ জনগণের পাবলিক বনের ওপর মাতবরি করছে। লাউয়াছড়ার বৃক্ষগুল্ম, তরুলতা, বননির্ভর আদিবাসী, চা-বাগান শ্রমিক, প্রাণিকুল সবাই বহন করে চলেছে একের পর এক অন্যায় বহুজাতিক আঘাত। রাষ্ট্রকে দেশের প্রাণ ও প্রকৃতির জানমাল সুরক্ষায় দাঁড়াতেই হবে, সব বহুজাতিক বাহাদুরিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিস্মৃতি বা অস্বীকার কোনোভাবেই জবাবদিহিতার বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

পাভেল পার্থ : গবেষক ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App