×

মুক্তচিন্তা

সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুন ২০১৯, ০৯:১৮ পিএম

সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

প্রস্তাবের বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সর্বোচ্চ মহলের রাজনৈতিক সততা এবং অঙ্গীকারের ওপর। যেহেতু জাতীয় সংসদে এবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিরোধী দল অনুপস্থিত এবং ৬৪ শতাংশ সাংসদই হচ্ছেন ব্যবসায়ী সেজন্য এ ধরনের অঙ্গীকারের কোনো রাজনৈতিক বাস্তবতা নেই। শাসকশ্রেণির পক্ষে-বিপক্ষে সংগ্রামে শ্রেণি শক্তির ভারসাম্য জনগণের কিছুটা অনুকূলে না এলে বা নতুন অঙ্গীকারসম্পন্ন নতুন শাসকশ্রেণির ন্যূনতম ক্ষমতায়ন না হলে এ ধরনের পরিবর্তন বা সংস্কারও সম্ভব হবে না।

নতুন অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল হিসেবে খ্যাত। তিনি এবার বাজেটে চমক প্রদান করবেন বলে উচ্চ প্রত্যাশা করেছিলেন অনেকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ‘বাজেট পাঠ’ এটাই ছিল এবারের চমক! অন্য সব দিক দিয়েই বাজেট হয়েছে একান্তই গতানুগতিক। বাজেটের আয়তন ২০১৭-১৮ সালে ছিল জিডিপির ১৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে হয়েছিল ১৮.৩ শতাংশ। এবার যদিও বাজেট সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। তবু সেটা প্রক্ষেপিত জিডিপির সেই আগের মতোই ১৮.১ শতাংশই হবে। এবার বাজেটের সব টাকা সরকার আয় করে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। ধরে নেয়া হয়েছে বিশাল ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি তৈরি হবে। কিন্তু সরকার ভাবছে তাতে অসুবিধা নেই, কারণ সেটাও প্রক্ষেপিত জিডিপির ৫ শতাংশের সমানই হবে। অবশ্য এখানে ধরে নেয়া হয়েছে যে আমাদের জিডিপি ২০১৯-২০ সালে ৮.২০ শতাংশ হারে বাড়বে। যদি তা না হয়, তাহলে বাজেট ঘাটতি প্রচলিত হার জিডিপির ৫ শতাংশেরও বেশি হয়ে যাবে। যেহেতু ২০১৭-১৮ সালে ঘাটতির আপেক্ষিক প্রস্তাবিত মাত্রা ছিল ৫ শতাংশ, ২০১৮-১৯ সালেও ছিল ৪.৯ শতাংশ, সেহেতু এবার ৫ শতাংশ প্রস্তাবিত ঘাটতিকেও গতানুগতিকই বলা যাবে। সুতরাং কী বাজেটের আয়তন, কী ঘাটতির আপেক্ষিক মাত্রা উভয়ই হচ্ছে গতানুগতিক। এ ছাড়া খাতওয়ারি বরাদ্দের অগ্রাধিকারের প্যাটার্নও আগের মতোই গতানুগতিক রয়ে গেছে। বরং কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে যে উল্লম্ফনের প্রয়োজন ছিল তা মোটেও হয়নি। (দেখুন বাজেট বক্তৃতা (ইং)-এর Table-6 Sectoral allocation in Budget)।

ঘাটতি পূরণ না ইচ্ছাপূরণ? সরকার এবার চেষ্টা করেছে সবাইকে সন্তুষ্ট রেখে বাজেট তৈরি করতে। তাই কারো ওপরই বড় করের বোঝা চাপাতে চায়নি। ভ্যাট নিয়ে ব্যবসায়ীরা যেসব সংশোধনী ও আপত্তি দিয়েছিলেন তা মেনেই বাজেট তৈরি হয়েছে। আবার ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের ব্যাপারে সরকারের এবার প্রস্তাব হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। গত বছর প্রস্তাব ছিল ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে সরকার ১২.৯১ শতাংশ আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সরকারের বিশাল আয় আসবে প্রধানত অপ্রত্যক্ষ কর ও নানা ধরনের করবহির্ভূত আদায় থেকে, যার ভার মূলত বহন করবেন অধনীরা। ২০১৮-১৯ সালে অপ্রত্যক্ষ করের প্রস্তাবিত মাত্রা ছিল ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ এনবিআরের মোট আয়ের প্রায় ৬৭ শতাংশ। এবার সরকার প্রস্তাব করেছে অপ্রত্যক্ষ কর মাত্রা ১০ শতাংশ বাড়িয়ে করা হবে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। তার ফলে এনবিআর লব্ধ মোট আয়ে অপ্রত্যক্ষ করের প্রস্তাবিত অনুপাতটি দাঁড়াচ্ছে ৬৬.১৭ শতাংশ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে অপ্রত্যক্ষ কর নির্ভরতাও অটুট থাকছে (৬৭ শতাংশ থেকে খুবই সামান্য কমে ৬৬.১৭ শতাংশ হচ্ছে।) যদি আমরা ধরেও নেই যে এনবিআর এসব আয় ঠিকমতো করতে পারবে তাহলেও সরকারের বিশাল বাজেটে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। সরকারের ইচ্ছা হচ্ছে এই ঘাটতির প্রায় অর্ধেক (৬৮ হাজার কোটি) বিদেশি ঋণ দিয়ে পূরণ করবে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৪৭ হাজার কোটি টাকা) পূরণ করবে ব্যাংকিং খাত থেকে ধার নিয়ে। আর বাদবাকিটা (৩০ হাজার কোটি টাকা) সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ অন্যান্য নানা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পূরণের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল। এখানে সবচেয়ে বিপজ্জনক ইচ্ছাটি হচ্ছে ব্যাংকিং খাত থেকে আরো ৪৭ হাজার কোটি টাকা ধার নেয়ার ইচ্ছা। এই ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতা বর্তমানে খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের নেই। এমনকি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাও ইতোমধ্যেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন যে ব্যাংকের ওপর এ রকম চাপ দিলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ পাবেন কম। পেলেও সুদের হার হবে অনেক উচ্চ। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা নাও কাটতে পারে। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন ৮ শতাংশ নাও বাস্তবায়িত হতে পারে। তখন আবার ভ্যাটের প্রসারও কিছুটা কমে যেতে পারে। এই যুক্তিক্রম অনুসারে অনেকেই মনে করছেন যে লোটাস কামাল সাহেবের এবারের বাজেট প্রস্তাব আপাতদৃষ্টিতে গতানুগতিক মনে হলেও এর বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে অনেক ইচ্ছাপূরণের (Wishfulness) বিষয় রয়েছে। রয়েছে উচ্চতর ঝুঁকির মাত্রা।

প্রতিশ্রুতিতে ভরপুর বাজেটে জনগণ কী পেল? গরিবের বা সাধারণদের জন্য ছোটখাটো যেসব প্রস্তাব এই বাজেটে রয়েছে সেগুলো হচ্ছে : ১। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১২ হাজার টাকা করা হবে। ২। এছাড়া বৃদ্ধ, বিধবা, নির্যাতিত নারী, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, মা ও শিশুদের জন্য প্রদত্ত ভাতা না বাড়লেও তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এসবের পরিমাণ অল্প। গত বছর যে জায়গায় ব্যয় হয়েছিল ৬৪ হাজার কোটি টাকা, এবার ব্যয় হবে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার হচ্ছে ১৫ শতাংশ। আমাদের সমগ্র বাজেট ব্যয় এবার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। সুতরাং গতানুগতিকভাবেই এই বৃদ্ধির হার হতো ১৩ শতাংশ। দয়ালু অর্থমন্ত্রী এবার তা ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করেছেন। তবে যেহেতু এখানে গত সংশোধিত বরাদ্দের সঙ্গে বর্তমান প্রস্তাবিত বরাদ্দের তুলনা করা হয়েছে সেহেতু ১৫ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব সংশোধনের পর কী দাঁড়ায় তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এবার প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোকে উৎসাহিত করার জন্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা পাবেন তারা যারা বৈধ পন্থায় রেমিট্যান্স পাঠাবেন। আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী যে, ‘To bring the expatriate workers under the insurance scheme which will be implemented shortly’ (বাজেট বক্তৃতা, ইংরেজি, সংস্করণ, পৃ.-৩৪) উপরোক্ত ধরনের সময়সীমাহীন অনেক অনির্দিষ্ট ভালো প্রস্তাব এই বাজেটে রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড থেকে শ্রমিকদের সাহায্য বিতরণ (২০১২-১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০৫২ জন শ্রমিককে এই ফান্ড থেকে মোট ২৮ কোটি টাকা প্রদানের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী- বাজেট বক্তৃতা (ইং.), পৃ-৩৬ দ্র. প্রস্তাব করা হয়েছে গ্রামে শহরের মতো সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সেজন্য বলা হয়েছে, ‘We will make necessary allocation for the relevant ministries’ [বাজেট বক্তৃতা (ইং.), পৃ-৫০ দ্র.] এটিও সাধারণ অনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি। পাট খাতের সোনালি ভবিষ্যতের কথা পুনর্ব্যক্ত করে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন- ‘The Jute Act 2019 and National Jute policy, 2018 have been formulated to resolve the problems that exist in the Jute Sector’ [বাজেট বক্তৃতা (ইং.) পৃ.-৫৩] এটা থেকেও পরিষ্কার নয় যে পাট খাতে সত্য সত্যই প্রয়োজনীয় পুঁজি বিনিয়োগ, পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ এবং বহুমুখীকরণ সম্পন্ন হবে কিনা।

সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবার সবাই বলে আসছিলেন যে আর্থিক খাতের সংস্কার প্রয়োজন এবং সেটার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বাজেটে থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে আমরা বাজেট বক্তৃতায় যে প্রস্তাবনাগুলো পাচ্ছি তা হচ্ছে : ১। ব্যাংকগুলোর পুঁজি বৃদ্ধির পদক্ষেপ সরকার নেবে (প্রকারান্তরে এটার অর্থ দাঁড়াবে Bailing Out!) ২। ব্যাংকগুলো যাতে একীভূত হতে পারে সেজন্য ব্যাংক আইন সংশোধন করা হবে। (প্রকারান্তরে এর অর্থ দাঁড়াবে ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা হ্রাস ও ফিন্যান্স পুঁজির অধিকতর কেন্দ্রীভবন) ৩। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে (এই কাজ এতদিন হয়নি কারণ তাদের প্রচণ্ড রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। বিশেষ করে কে ‘ইচ্ছাকৃত’- কে ‘ইচ্ছাকৃত নয়’ তা নির্ণয় কি পক্ষপাতিত্বহীনভাবে হবে?) ৪। সুদের হার ‘একক সংখ্যায়’ নামিয়ে আনার জন্য সরকার চেষ্টা করবে। (চেষ্টা তো করছেই, কিন্তু ব্যাংকাররা তা শুনছেন কই? ব্যক্তিমালিকানাধীন বাজার অর্থনীতিতে সুদের হার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি?) এ ছাড়া দুর্নীতি কমানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় সেবা কর্মের ক্ষেত্রে কিছু আমলাতান্ত্রিকতা ও কাগজপত্রের ব্যবহার কমিয়ে ই-পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন নিরাপত্তা খাতের ভাতা সরাসরি ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে হস্তান্তরের পদ্ধতি আরো জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। বাজেটে দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্সের’ নীতি পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। বাজেটে সরকারের স্লোগান হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়েছে, ‘বন্ধ হলে দুর্নীতি, উন্নয়নে আসবে গতি।’ এসব প্রস্তাবের বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সর্বোচ্চ মহলের রাজনৈতিক সততা এবং অঙ্গীকারের ওপর। যেহেতু জাতীয় সংসদে এবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিরোধী দল অনুপস্থিত এবং ৬৪ শতাংশ সাংসদই হচ্ছেন ব্যবসায়ী সেজন্য, এ ধরনের অঙ্গীকারের কোনো রাজনৈতিক বাস্তবতা নেই। শাসকশ্রেণির পক্ষে-বিপক্ষে সংগ্রামে শ্রেণি শক্তির ভারসাম্য জনগণের কিছুটা অনুকূলে না এলে বা নতুন অঙ্গীকারসম্পন্ন নতুন শাসকশ্রেণির ন্যূনতম ক্ষমতায়ন না হলে এ ধরনের পরিবর্তন বা সংস্কারও সম্ভব হবে না।

এম এম আকাশ : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App