×

জাতীয়

মাদক ব্যবসায়ীদের মহাজোট ঢাকায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০১৯, ১২:১৭ পিএম

মাদক ব্যবসায়ীদের মহাজোট ঢাকায়
রাজনীতির আদলে এবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন রাজধানীর মাদক ব্যবসায়ীরা। ব্যবসার পুঁজি সংগ্রহ ও নির্বিঘ্নে ব্যবসা পরিচালনার জন্য তারা গঠন করেছেন ‘মাদক ব্যবসায়ী মহাজোট’। রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে গত ঈদুল ফিতরের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদক মহাজোট আত্মপ্রকাশ করেছে। আর ব্যাংকের আদলে সমবায় সমিতি গঠন করে ব্যবসার পুঁজি সংগ্রহ করছে এই মহাজোট। এলাকার একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানায়, চমকে ওঠার মতো এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে পুরান ঢাকার চারটি থানার মাদক ব্যবসায়ীরা। গেল ঈদের আগের রাতে রাজধানীর এসব এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা এক হয়ে বিশেষ মাদক মহাজোট করে। আর এই মহাজোটকে তাদের ব্যবসায় চড়া সুদে অর্থ সহায়তার দায়িত্ব নিয়েছে স্থানীয় একটি বহুমুখী সমবায় সমিতি। লালবাগ থানার আজিমপুর নিউপল্টন এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ঈদের আগের রাতে আজিমপুর কবরস্থানের পাশে একটি মার্কেটের ২য় তলায় উল্লিখিত চার থানার মাদক ব্যবসায়ীরা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে এই মহাজোট গঠন করে। পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আনু ওরফে ব্ল্যাক আনুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ও বৈঠকে চার থানা এলাকার মাদক সিন্ডিকেট সুন্দর বাবু গ্রুপ, জোসনা গ্রুপ, রাসেল গ্রুপ, আবুল গ্রুপ, ফরিদ গ্রুপ, বিজিবি পুরাতন ২ নম্বর গেটের ইয়াবা মামুন গ্রুপ, মাইকেল-সুকানী গ্রুপ, জেএন সাহা রোডের টিক্কা গ্রুপ, হাজারীবাগের বীনা-মুন্নী গ্রুপ, কালা মানিক গ্রুপ, বুদ্দীন-অসীম গ্রুপ, কামরাঙ্গীরচরের খলিল গ্রুপসহ মোট ২৮টি গ্রুপের প্রতিনিধিরা অংশ নেয়। আজিমপুর নিউপল্টন এলাকার বাসিন্দা জহিরুল আলম বাদল জানান, আজিমপুর বটতলা এলাকায় বাদল নামে আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন যিনি সুদ বাদল বা ব্যাংক বাদল নামে পরিচিত। নাম বিভ্রাটের কারণে প্রায়ই তাকে নানান সমস্যায় পড়তে হয়। গত ২০ বছর ধরে ব্যাংক বাদল এলাকায় একটি সমিতি গঠন করে বছরের পর বছর সুদ আর হুন্ডি ব্যবসা পরিচালনা করছেন। সাইনবোর্ডহীন তার এই অবৈধ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় একটি মার্কেটের দোতলায়। নাম দিয়েছেন আজিমপুর বহুমুখী সমবায় সমিতি। বাদল এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বোতল ওসমান ওরফে মদারু সভাপতি। এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। প্রত্যেক সদস্যই এখানে পুঁজি খাটিয়ে বিনিময়ে মোটা অঙ্কের লাভ পান। সমিতির টাকা বা সদস্যদের পুঁজির পুরোটাই খাটানো হয় মাদক ব্যবসায়। এই ব্যবসাকে আরো লাভজনক করে তুলতে বাদল নিজেই চার থানা এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে মহাজোট গঠন করেছেন। সঙ্গে আছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কয়েকজন অসৎ কর্মকর্তা আর পুলিশের সোর্স ও লাইনম্যান। তদন্তের স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান, মাদক ব্যবসায়ীদের মহাজোট গঠন ও এই ব্যবসায় জনৈক বাদলের সমিতি বা আজিমপুর বহুমুখী সমবায় সমিতির অর্থায়নের বিষয়টির তদন্ত চলছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতাও আছেন। সূত্র জানায়, শুধু লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, চকবাজার আর হাজারীবাগ থানা নয়, পুরো ঢাকাতেই মাদক ব্যবসায় পুঁজি জোগাচ্ছে এই বহুমুখী সমবায় সমিতি। গত এক বছরে তাদের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী লালবাগের জয়নাল, আলমগীর, জাহাঙ্গীর, আসাদ, বাবু, মাসুদ, ইক্কা, রিয়াজ, সুজল, আবু, আনু, ইমরান, সজল, মামুন, মনোয়ারা, ইসলামবাগের ছাফি, মুন্নি, টগর, তামান্না ও ময়ূরী, আনন্দবাজার বস্তির বানু, নিমতলী বস্তির সাবিনা ও পারুল, পাইন্যা সর্দার বস্তির রেণু, গণকটুলীর মনোয়ারা, নাছিমা, শ্যামপুরের ফজিলা, রানী বেগম ও পারুলী, শাহীনবাগের পারভীন, তেজকুনিপাড়ার সনি, হিরা, রাজেদা, হাজারীবাগের স্বপ্না, কলাবাগানের তুলি, চানখাঁরপুলের পারুল, বাড্ডারসুমি, রামপুরের সীমা, শাহজাহানপুরের মুক্তা, মহাখালীর ইভা ও রওশন আরা, বনানীর আইরিন, কড়াইল বস্তির রিনা, জোসনা, বিউটি, গুলশানের মৌ, জ্যোৎস্না, জবা, লিপি, রূপা, তানিয়া, শোভা, জয়া, মলি, বিউটি, রিতা, ন্যান্সি-কুমকুম, মনি ওরফে হাসি, বারিধারার নাদিয়া, সাহিদা, মাহমুদা, নীলা, জরিনা, মিনা ও কুট্টি, উত্তরার গুলবাহার, মুক্তি, সূত্রাপুরের আনসারী, রহিমা, আঙ্গুরী, সায়েদাবাদের শাহজাদী, করাতিটোলার হোসনে আরা, শাহনাজ, গোপীবাগের দুই বোন আয়শা ও ম্যাগী, ডেমরার পারুল, খোদেজা, রাজিয়া, পারভীন, ফারজানা, মর্জিনা, রহিমা, পুষ্পরুপা, তেজগাঁওয়ের মাকসুদা, মাহফুজা, সালমা, নাছিমা, সখিনা, মিরপুরের নাসিমা, হাওয়া, শাহানুর, বানু, মনি, মুন্নী, আমেনা, মনু, পল্লবীর ময়না, সালমা, রহিমা, হাছিনা ও হাজেরা প্রত্যেকে এই সমিতি থেকে ২ লাখ করে টাকা নিয়েছে। সমিতি থেকে সুদে টাকা নিলে প্রতি ১ লাখ টাকায় মাসে ২০ হাজার করে লাভ দিতে হয়। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তা বলেন, মৌখিক অভিযোগ থাকলেও মাদক ব্যবসায় অর্থ লগ্নির ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। সব লেনদেন হয় ব্যক্তিগত খাতে ধার দেখিয়ে। চুক্তিতে কোনো লাভ বা সুদের কথা উল্লেখ থাকে না। আবার এই সমিতিটিও শুধু সাইনবোর্ড সর্বস্ব। ফলে মন্ত্রণালয়ও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। একমাত্র ব্যবস্থা নিতে পারে পুলিশ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ এই সমিতি থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের মাসোহারা পাচ্ছে বলে তারাও নীরব। তিনি বলেন, মূলত এই সমিতিটি একটি ব্যাংকে রূপ নিয়েছে। প্রতিদিনই টাকা জমা পড়ছে। টাকা উত্তোলন হচ্ছে। মাসে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হলেও রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। তবে মোটা অঙ্কের লাভের টাকা গুনছে সমিতির কর্মকর্তা আর মাদক ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে আজিমপুর বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাদল এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সমিতি পরিচালনা করে আসছেন, তবে মাদক ব্যবসায় কোনো টাকা পুঁজি খাটানো হয় না। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নানান ঝামেলার কারণে সমিতির সরকারি অনুমোদন নেয়া হয়নি। সমিতির সদস্যদের জমানো টাকা কোন খাতে ব্যবহার করে মুনাফা বা লাভ দেয়া হয় সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. নাজির খান ভোরের কাগজকে বলেন, এ ধরনের কোনো বিষয় আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। এছাড়াও বহুমুখী সমবায় সমিতির বিষয়টি আমাদের আওতাধীন নয়। তবে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অবশ্যই আমরা খতিয়ে দেখব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App