×

মুক্তচিন্তা

বাজেট নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০১৯, ০৯:২৮ পিএম

আওয়ামী যদি সুস্পষ্টভাবে দেখাতে পারত কোন কোন পয়েন্টে, কোন কোন যুক্তিতে এই বার্ষিক বাজেট আগামী পাঁচ বছরে ইশতেহারের লক্ষ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছে এবং দল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যপথেই রয়েছে, তবে হতো ওই বিরূপ সমালোচনার যোগ্য জবাব। জনগণের কাছে বাজেট আলোচনার সুযোগে আর সেইসঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত দলের লক্ষ্য সুস্পষ্ট করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথরেখা জনগণের চোখের সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারলে ভোটের সময় আওয়ামী লীগকে হন্যে হয়ে কিছু করতে হবে না।

বাজেট আসছে বছরের সরকারি আয় ও ব্যয়ের বার্ষিক হিসাব-নিকাশ হলেও এর মধ্যে যে রাজনীতি রয়েছে, এটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যে কোনো সরকার তথা সরকার পরিচালনাকারী দলের রয়েছে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক আশু ও চূড়ান্ত লক্ষ্য, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের বার্ষিক পরিকল্পনাই হলো বাজেট। যা দিয়ে বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ওই দুই লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়া যায়। এমনটা হওয়ার কারণেই বাজেট ঘোষিত হওয়ার পরই রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ তর্ক-বিতর্ক লেগে যায়। যখন সরকারি দল বাজেট দিচ্ছে, তখন বিরোধী দল কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেবে, তা আগে থেকেই অনুমান করা যায়। এখনো মনে পড়ে পাকিস্তান আমল কিংবা বাংলাদেশ আমলের স্বৈরশাসনের দিনগুলোতে বাজেট ঘোষণার দিন বিকেলে বাজেটের বিরুদ্ধে মিছিল করার জন্য জমায়েত রেডিই থাকতো। ‘গরিব মারার বাজেট’, ‘গণবিরোধী বাজেট’ স্লোগানও ঠিক করাই থাকতো। বাজেট পড়া বা জানার আগেই এমন কত মিছিল যে অর্গানাইজ করেছি বা যোগ দিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। এবারে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে টানা এগারোবারের মতো বাজেট দিচ্ছে, তখন বিএনপি, জাতীয় পার্টি থেকে শুরু করে গণসমর্থনহীন ছোট ছোট বাম-মধ্য-ডান রাজনৈতিক দলগুলো কোন ধরনের অবস্থান হবে বা প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। এই ধরনের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া পূর্ব নির্দিষ্ট। বাজেট নিয়ে যারা ভাবেন বা চিন্তা করেন, তাদের কাছে এই ধরনের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়ার তেমন কোনো মূল্য বাস্তবে নেই। তবে তারা গবেষণা সংস্থাগুলো থেকে ভালো-মন্দ দিক বিবেচনা তথা গভীর ও যথাযথ মূল্যায়ন আশা করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই ওই আশায় গুড়ে বালি পড়ছে। যেমন বাজেটের আগে যে কোনো রাজনৈতিক মতের মানুষের কাছে যদি প্রশ্ন করা হতো, আওয়ামী লীগ সরকার বাজেট ঘোষণার পর গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি কোন ধরনের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তবে ধারণা করি শতভাগই উত্তর দিত চরম অবস্থান নিয়ে বিপক্ষে বলবে। কেন এমন আগাম বক্তব্য মানুষ দেবে, তা বোধকরি জাতির থিংকট্যাঙ্ক তথা বিবেক হতে ইচ্ছুক ওই গবেষণা সংস্থার কর্মধাররা ভেবে দেখতে পারেন। নতুবা মানুষ ১/১১ পরবর্তী সময়ের কথা স্মরণে নেবে। সঙ্গে সঙ্গে দেশের দ্বিধাবিভক্তির রাজনীতির ঘোরটোপে আরো জড়িয়ে তাদের জাতির বিবেক হওয়ার পথ আটকে দেবে। প্রসঙ্গত, বাজেট ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর বিবৃতি বিবেচনায় নিলেই দেখা যাবে যার যার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, ‘এই বাজেট জনবান্ধব, বাস্তবসম্মত, ভারসাম্যপূর্ণ ও গণকল্যাণমুখী।’ বিপরীতে বিএনপি বলেছে, ‘গণবিরোধী সরকারের মদদপুষ্ট একটি শ্রেণিকে এই বাজেটে সুবিধা দেয়া হয়েছে।’ সংসদে প্রধান বিরোধী দল হলেও জাতীয় পার্টির অবস্থান রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের দিকে ঝুঁকে। তাই দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের কোনো কোনো খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি তুলে ধরে বলেছেন, ‘এই প্রস্তাবিত বাজেট ইতিবাচক ও জনবান্ধব।’ বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ গণফোরাম বলেছে, ‘এই বাজেট হতাশাজনক। ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের স্বার্থে।’ চরমভাবে সরকারবিরোধী সিপিবি বলেছে, ‘সা¤্রাজ্যবাদ ও লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার গণবিরোধী দলিল।’ ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান রাশেদ খান মেনন, যিনি সরকারি জোট থেকে এমপি হলেও এবারে মন্ত্রী হননি, তিনি বলেছেন, উপরতলার পাঁচ ভাগ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের হবে এই বাজেটে, বৈষম্য বাড়াবে। জানি না তিনি মন্ত্রী থাকলে কী বলতেন! রাজনৈতিক দলগুলোর উল্লিখিত বিবৃতি দেখিয়ে দিচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর বাজেট বিবৃতির মধ্যে কোনো গভীর মূল্যায়ন নেই। এগুলো পূর্বনিধারিত, গতানুগতিক ও একঘেয়ে। বিরোধী দলগুলো এ ধরনের অর্থহীন সমালোচনা না করে বিকল্প বাজেট দেয়ার ধারায় গেলেই পারে! প্রসঙ্গত, সিপিডির পক্ষ থেকে বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অভিযোগ তুলে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, সমাজ হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষম। ইশতেহারটি সুলিখিত ও সুচিন্তিত। আমি সেটা বিবেচনায় নেই। যারা লিখেছেন তারা সেটা বিবেচনায় নেন কিনা জানি না।’ অর্থাৎ অভিযোগ হচ্ছে বাজেটে দলটি ইশতেহারের উল্টোপথে হাঁটছে। আওয়ামী যদি সুস্পষ্টভাবে দেখাতে পারত কোন কোন পয়েন্টে, কোন কোন যুক্তিতে এই বার্ষিক বাজেট আগামী পাঁচ বছরে ইশতেহারের লক্ষ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছে এবং দল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যপথেই রয়েছে, তবে হতো ওই বিরূপ সমালোচনার যোগ্য জবাব। ক্ষমতায় আবারো আসার পর প্রথম প্রদত্ত বাজেটের সঙ্গে যে আগামী পাঁচ বছরের লক্ষ্য বাস্তবায়নের সরাসরি যোগাযোগ ও সম্পর্ক রয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যদি কোনো শ্রেণিকে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়, তবে তা যে দেয়া হচ্ছে দুপা পিছিয়ে একপা অগ্রসর হওয়ার জন্যই এটা জনগণকে বুঝানোটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সংগঠন ও নেতাকর্মীদের প্রধান কাজ। জনগণের কাছে বাজেট আলোচনার সুযোগে আর সেইসঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত দলের লক্ষ্য সুস্পষ্ট করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথরেখা জনগণের চোখের সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারলে ভোটের সময় আওয়ামী লীগকে হন্যে হয়ে কিছু করতে হবে না। প্রকৃত বিচারে সরকারের জন্য যেমন বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ, ঠিক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য এই সংযোগটা দেখানো হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। নতুবা প্রচারের ধাক্কায় জনগণের মনে এমনটা বাসা বেঁধে যেতে পারে, ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বছরেই আওয়ামী লীগ পথভ্রষ্ট হয়েছে। এই হতাশাজনক পরিস্থিতি ন্যূনতমভাবে সৃষ্টি হোক এটা কাম্য নয়। প্রসঙ্গত, বাজেট নিয়ে সিপিডির তীব্র বিরূপ সমালোচনার মধ্যে দেশের অপর কোনো গবেষণা সংস্থার কোনো প্রতিবেদন তেমনভাবে চোখে পড়েনি। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নাননীন আহমেদ বাজেট বাস্তবায়নে বেশ কিছু বিষয় জটিলতা তুলে ধরে বলেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এই বাজেটের কোনো বিকল্প নেই। নানা বাস্তবতায় কিছুটা সমঝোতার বাজেট এটা। এই বাজেট ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।’ সিপিডি ও বিআইডিএসের মূল্যায়নে যেমন আকাশ-পাতাল পার্থক্য, তেমনি দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়নেও রয়েছে তেমন ধরনেই পার্থক্য। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের বক্তব্যের হেডিং দেখলেই বুঝা যাবে, কতটা বৈপরীত্য রয়েছে বাজেটের মূল্যায়নে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হাসান বলেছেন, ‘সংস্কার না হলে ফল মিলবে না।’ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘সমস্যা চিহ্নিত, দরকার সমাধানের সদিচ্ছা।’ অধ্যাপক সেলিম রাহয়ান বলেছেন, ‘মূল সমস্যা বাজেট বাস্তবায়ন।’ সাবেক আমলা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, ‘স্বল্প মেয়াদি এটি জনবান্ধব।’ ১/১১-এর জরুরি আইনের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির নির্দেশনা নেই।’ এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেছেন, ‘রাজস্ব আদায় হবে চ্যালেঞ্জিং।’ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেছেন, ‘সঠিক সময়ে রাজস্ব আদায়ই বড় চ্যালেঞ্জ।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন কিছু নেই। মধ্যবিত্তের জন্য কিছু নেই।’ আর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, ‘বাজেট বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ।’ অর্থনীতির অঙ্গনের বিশিষ্টজনদের উল্লিখিত এককথার মন্তব্য থেকে সহজেই এমনটা বুঝা যায় যে, বাজেট মূল্যায়নে তাদের বক্তব্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। উল্লিখিত বিশিষ্টজনদের অনেকেই অতীতে ছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতার উচ্চাসনে। এফবিসিসিআই বলেছে, ‘এই বাজেট বিনিয়োগমুখী।’ বাজেট নিয়ে ভাবিত মানুষ কোন মূল্যায়নকে সঠিক বলে ধরে নেবে, তা বলার বোধকরি কোনো অপেক্ষা রাখে না। আবার কেউ যখন বলছেন, সুবিধাভোগীদের জন্য এই বাজেট, তখন দেখা যাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। নতুন করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আরো ১৪ লাখ উপকারভোগী সামজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওয়তায় আসছে। সব মিলিয়ে সুবিধা পাচ্ছেন ৮৯ লাখ গরিব মানুষ। বাস্তবে এসব মানুষকে ঘিরে আছে কত পরিবার, কত মানুষ! প্রসঙ্গত বলতেই হয়, ধনবৈষম্য বাড়ছে ঠিকই, এ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণেরও জরুরি প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু গরিবি যে ক্রমান্বয়ে ঈর্ষণীয়ভাবে কমছে, এটা কিন্তু বাজেট আলোচনায় অনেক বিশিষ্টজনই সামনে আনছেন না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বলা হয়েছিল যে, ‘এই পরিকল্পনায় অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০১৯-২৩ সময়কালের লক্ষ্যমাত্রা ও কর্মসূচির সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রাকে এমনভাবে সমন্বয় করা হবে, যাতে দেশ লক্ষাভিমুখে অগ্রসর হয়।’ বলাই বাহুল্য, এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে শুরু থেকেই সরকার যে ছাড় ও টাইট দেয়া সমন্বয় করে অগ্রসর হচ্ছে, তা বাজেটে অর্থিক খাত সংস্কার ও জবাবদিহিতার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলেই সুস্পষ্ট হবে। প্রবাদ বলে, ফলেই বৃক্ষের পরিচয়। তাই বাজেট পাসের আগে আওয়ামী লীগের সব আলোচনা-সমালোচনাই বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। কবিগুরু তো বলেছেনই, ছাইভস্মের মধ্যেও থাকতে পারে অমূল্য রতন। সমস্যা তো বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছেই। বেশ সংকটও দানা বেঁধে ওঠে কখনো কখনো। যেমন এ বছর কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য পেলেন না। বিদ্যমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ বাজেটে কতটা সমালোচনা গ্রহণ বা জবাব দিতে পারবে, অর্থিক খাত সংস্কার কতটা হবে, বাস্তবায়নে কতটুকু জবাবদিহিতা থাকবে, বাস্তবায়ন কতটুকু হবে; তা দিয়েই স্থিরিকৃত হবে আগামী ৫ বছর আওয়ামী লীগ ইশতেহার বাস্তবায়নের পথে কতটুকু অগ্রসর হতে পারবে।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App