×

জাতীয়

এক বছরে মামলাই হয়নি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০১৯, ১১:১৯ এএম

এক বছরে মামলাই হয়নি
‘একরামকে যে পরিকল্পিতভাবে গুলি করা হয়েছে তা ঘটনার পর প্রকাশিত অডিও রেকর্ডেই স্পষ্ট বোঝা যায়। যেটা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হওয়ায় আমাদের ওপর হুমকি আসতে থাকে। এক পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের দুই মন্ত্রী আমাকে ফোন করে বলেন ‘ভুল হয়েছে’। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনার দেখা করিয়ে দিব। তাকে সব খুলে বলবেন। প্রধানমন্ত্রীই সব ব্যবস্থা নেবেন। এরপর চুপ করে গিয়েছিলাম। কিন্তু আর কত? চলেতো গেল এক বছর। মামলা করতে পারলাম না। প্রধানমন্ত্রীর দেখাও পেলাম না। তার মানে আমার স্বামী হত্যার বিচার পাব না? রাষ্ট্রের কাছে জানতে চাই, কেন কেড়ে নেয়া হলো নির্দোষ একটি জীবন? জানি উত্তর দেয়ার কেউ নেই। তবুও যতদিন বেঁচে আছি, এ ঘটনার বিচার চেয়ে যাব।’ গত বৃহস্পতিবার টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী পাড়া এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত একরামের বাড়িতে গেলে তার স্ত্রী আয়েশা খাতুন আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ভোরের কাগজকে এসব কথা বলেন। আয়েশা খাতুন বলেন, বর্তমানে দেখছি টেকনাফে ইয়াবা ডনদের বাড়ি জব্দ করছে পুলিশ। কিন্তু আমার স্বামী কোথায় কি রেখে গেল। আমাদেরতো কিছু নেই। উল্টো একরামের মৃত্যুর পর অন্যের ঘরে একটি রুমের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। আজো আমার দুই মেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। ২০১৮ সালে রোজার মধ্যে মারা যায় একরাম। এ বছর প্রতি রোজায় সেহরি ও ইফতারে বাবার জন্য চিৎকার করে কেঁদেছে দুই মেয়ে তাহিয়াত ও নাহিয়ান। আজো ওর বাবার কাপড়গুলো জড়িয়ে ধরে বাবাকে খোঁজে। কিন্তু কোথায় পাব ওদের বাবাকে। বিনা দোষেই কারো চক্রান্তে চলে গেছে মানুষটা। একটি বার তার চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাই আমরা, বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের নোয়াখালী পাড়ায় গত বছরের ২৬ মে রাতে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের ৩ বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর, উপজেলা আওয়ামী লীগ সদস্য ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুল হক (৪৬)। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা, একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ওয়ান শুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি ও ৫টি খালি খোসা উদ্ধার করা হয় বলে দাবি করে র‌্যাব। কিন্তু ঘটনার পর ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ড নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় সারা দেশে। এদিকে ১ বছর পেরিয়ে গেলেও আলোচিত এ ঘটনার রহস্যের জট এখনো খোলেনি। ফলে একরাম সত্যিই ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলেন নাকি কোনো মহল পরিকল্পিতভাবে তাকে বন্দুকযুদ্ধে ফাঁসিয়েছে- অনেকের মনেই রয়ে গেছে সেই প্রশ্ন। একরাম নিহতের পর কঠিন সময় পার করতে হয়েছে জানিয়ে আয়েশা খাতুন বলেন, একরামের মৃত্যুর পর থানায় মামলা নেয়নি। আদালতে মামলা করতে গেলে র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে কোনো আইনজীবী আইনি পরামর্শ ও মামলার কাগজপত্র তৈরি করে দিতে রাজি হননি। তাই শেষ পর্যন্ত মামলা করতে পারলাম না। এর কয়েক মাস পর ঘটনায় জড়িত বাহিনীর এক কর্মকর্তা অডিও রেকর্ডের মোবাইলটি চেয়েছিলেন। দিতে না চাইলে তিনি পরোক্ষভাবে হুমকিও দিয়েছিলেন। এমনকি ২০ লাখ টাকাও দিতে চান। কিন্তু আমরা দেইনি। কারণ মোবাইলের ওই ভয়েস রেকর্ড যাচাই করলেই প্রমাণিত হবে, বন্দুকযুদ্ধ নয়; একরামকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ঘটনার পর দুই মন্ত্রীর আশ্বাসে আমি মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলিনি। কিন্তু বিনিময়ে কি পেলাম। ঘটনার দিন একরামের কাছে থাকা দুটি মোবাইল ও একটি ঘড়ি আজ পর্যন্ত ফেরত পেলাম না। উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাতে হচ্ছে। কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। সবাই বলছে কিছু করতে গেলে পরিবারের অন্যদের ক্ষতি হয়ে যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রীই একমাত্র ভরসা। আমার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীকে সবকিছু খুলে বললে তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। একরামের মা হাফেজা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভোরের কাগজকে বলেন, সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা করি, এ ঘটনায় জড়িতদের যাতে একই পরিণতি ভোগ করতে হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা একরামের বাড়িতে গিয়ে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। হয়তো পরিস্থিতির শিকার হয়ে মামলা করেননি তারা। তবে, একরামের পক্ষে একটি মামলা হওয়া উচিত ছিল। সেটি সরকার অথবা কোনো এনজিও করতে পারত। কারণ রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অবশ্যই এ ধরনের ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, এ ধরনের ঘটনায় যদি কেউ জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই তার বিচার হওয়া উচিত। না হলে নিহতের পরিবারের অন্যরা একই ধরনের কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। র‌্যাব হেডকোয়ার্টার্সের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার পরই তদন্ত হয়। আমার জানা মতে একরামের ঘটনাতেও এ ধরনের তদন্ত হয়েছে। আর যে অডিও ক্লিপ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া যায়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App