×

মুক্তচিন্তা

প্রজ্ঞার সৌন্দর্যে অহংকারের দ্যুতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০১৯, ০৯:৩৪ পিএম

জ্ঞান ঋদ্ধ হলেই আপনার সঙ্গে যুক্ত হবে ‘অহংকার’। যে অহংকারে সৌন্দর্য থাকবে, শিষ্টতা থাকবে, পরিমার্জনা থাকবে। আর জ্ঞানের যতই ঊণতা থাকবে, ততই তার সঙ্গে যুক্ত হবে অশ্লীলতা, অভব্যতা, অশিষ্টতা ইত্যাদি। বিষয়টিকে আরো সহজ করে বুঝতে আমরা লোকবাংলার প্রবাদটির দিকে দৃষ্টি দিতে পারি; ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী, জুতারে কয় আলমারি’।

‘অহংকার পতনের মূল’ কথাটি বহুল প্রচলিত; কিন্তু সেই অহংকার যখন সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়, তখন সে দ্যুতি ছড়ায়। বিশ্ব যখন প্রযুক্তির দাপটে কম্পমান; যখন কর্পোরেট পুঁজি কিনে নিয়েছে স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর মাথা; ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের গোলামেরা যখন প্রশ্ন তুলছে পৃথিবীর মানুষের জন্য আগামীর অত্যাধুনিক বিশ্বে ‘বই’য়ের আবশ্যিকতা আছে কিনা; অথবা বই আগামীতে কেবলই জাদুঘরে সংরক্ষণের অনুষঙ্গ হবে কিনা? তেমন সময়ে ‘বই’ নিয়ে কথা বলাটা কতটা স্পর্ধার অথবা অদূরদর্শিতার, ঠিক বুঝতে পারছি না। তারপরও নিজের বিশ্বাসের কথাটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলে যাওয়াটাই সততা বিবেচনা করে আমাদের পাঠাভ্যাস আর ‘বই’-এর আবশ্যিকতা নিয়ে কতিপয় পঙ্ক্তি উচ্চারণ করতে চাই, সঙ্গে যোগ করতে চাই অহংকারের কথাও। গ্রিক দার্শনিক বলেছিলেন, জ্ঞানীজন আর শিল্পী-সাহিত্যিকের অহংকার থাকে, থাকতেই হয়। অবশ্য এ কথাও বলে রাখা ভালো, অহংকারের সৌন্দর্য থাকা চাই; অহংকার যদি পরিমিতি হারায়, তাহলে সে অহংকার সৌন্দর্য হারিয়ে ‘অশ্লীল’ হয়ে পড়ে। ‘ভালোবাসা’ আর ‘ঘৃণা’ খুব কাছাকাছি থাকে, যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ; ‘অহংকার’ আর ‘ঔদ্ধত্যের অবস্থানও অনেকটা তেমনি। ‘জ্ঞান’ আর ‘প্রতিভা’ এক কথা নয়। প্রতিভাবান জ্ঞানী না-ও হতে পারেন; কিন্তু জ্ঞানী মাত্র প্রতিভাবানও। প্রতিভা জন্মগত হতে পারে, কিন্তু জ্ঞান অর্জন করতে হয়। সমাজ-সংসার দেশ-জাতি-পৃথিবীর জন্য জ্ঞান আবশ্যক। পৃথিবীতে সবচেয়ে বোকা তারা, যারা অন্যের প্রজ্ঞার জোরে সুখ্যাতি কিনতে চায়। প্রতাপ-প্রতিপত্তির দাপটে তারা হয়তো কিছু আপাত-বাহবা পেয়েও যায়; কিন্তু সময়ের বাটখাড়ায় উঠলে শেষ পর্যন্ত তারা কিন্তু শূন্যই পায়। অজ্ঞানের সমাজে কখনো অগ্রগতি থাকে না; আমাদের পরিপার্শ্বে তাকালে এ সত্যটি আজ খালি চোখেও নজরে আসে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? সেই সত্য আবিষ্কারই বর্তমান রচনার লক্ষ্য। জ্ঞানের সূত্রটা কী? স্থূল মেধায় বুঝি, একমাত্র ‘পাঠ’ই জ্ঞানের আধার। সে পাঠ কেবল পাঠ্য বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়, সে পাঠ প্রকৃতি-মানুষ আর পরিপার্শ্ব পাঠ। দুর্ভাগ্য আমাদের, সমাজে পাঠপ্রবণতা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে; ফলে সমাজে প্রাজ্ঞজনের সংখ্যাও দিন দিন কমে আসছে। করপোরেট পুঁজি নিজেদের মুনাফা আর প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থান্ধ প্রতিযোগে আমাদের যে পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা সহজ কথায় মানব ইতিহাসের জন্য আশঙ্কাজনক। আজ আমরা যাই করছি, কোনোটারই ব্যাকরণ-প্রকরণ জানবার আবশ্যিকতা বিবেচনা না করেই করছি; ‘অভিনিবেশন’ শব্দটির কথা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি। ছাত্র এবং অভিভাবকরা ভাবছেন, কোনো প্রকারে একটা উচ্চতর সনদ হস্তগত করাই তাদের লক্ষ্য; শিক্ষকরা ভাবছেন, সচ্ছলতা হস্তগত করাই তাদের উদ্দেশ্য; ব্যবসায়ীরা যেমন মুনাফা অর্জনকেই জীবনের ব্রত ভাবছেন; পেশাজীবীরা মাস শেষে মোটা মাইনে আর উৎকোচেই মনোযোগী; কবি-শিল্পীরা বাহবা আর করতালিতেই তুষ্ট। জীবনের গভীরতর বেদনা, নিবিড়তম গ্রন্থি উন্মোচন যে প্রত্যেকেরই অধিগত হওয়া আবশ্যক, সে সত্যটি কেউ মনেই রাখছেন না। জাতির এই সংকট মোকাবেলায় পাঠবিমুখ জাতিকে পাঠে ব্রতী করতে হবে, এর বিকল্প আপাতত কিছুই নেই। আর পাঠে ব্রতী হওয়ার সঙ্গে বইয়ের যোগ। এবার বই নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। অপেক্ষাজনিত কারণে আপনি যদি প্রশ্ন তোলেন, বই নিয়ে আলোচনা, অথচ বই নিয়ে কোনো কথাই তো হলো না। আমি জীবন থেকে পাঠ নেয়া সামান্য অভিজ্ঞতার কথা বলব। আপনি কি দেখেছেন ঘেরজাল দিয়ে জলাশয়ে মাছ ধরার দৃশ্য? সে দৃশ্য যদি দেখে থাকেন, দেখবেন জেলেরা জলাশয়ের এক প্রান্ত থেকে জাল নামিয়ে সমস্ত জলাশয় ছেকে অন্যপ্রান্তে সমস্ত মাছ জালের সীমাবদ্ধতায় এনে প্রযোজনীয় মাছগুলোকে কীভাবে ধরে নেয়? আমিও তেমনটি করতে চেয়েছি মাত্র। বই অনুসন্ধানী মানুষের আহরিত প্রজ্ঞার সঞ্চয় ভাণ্ডার। পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন সবই আপনি পেয়ে যাবেন বইয়ে; আপনার কেবল পাঠশ্রমে জেনে নেয়ার অপেক্ষা; তাতেও যদি আপনি শৈথিল্য প্রদর্শন করেন, তাহলে আপনি দুর্ভাগা, জীবনে আপনি কূপমণ্ডূক হয়েই বাঁচলেন, সমুদ্র দেখার স্বপ্ন আপনার কোনোদিনই পূর্ণ হবে না। আপনার পাঠসীমা যতটা বিস্তৃত আর গভীর হবে, জ্ঞানভাণ্ডারও ততটাই ঋদ্ধ হবে; জ্ঞান ঋদ্ধ হলেই আপনার সঙ্গে যুক্ত হবে ‘অহংকার’। যে অহংকারে সৌন্দর্য থাকবে, শিষ্টতা থাকবে, পরিমার্জনা থাকবে। আর জ্ঞানের যতই ঊণতা থাকবে, ততই তার সঙ্গে যুক্ত হবে অশ্লীলতা, অভব্যতা, অশিষ্টতা ইত্যাদি। বিষয়টিকে আরো সহজ করে বুঝতে আমরা লোকবাংলার প্রবাদটির দিকে দৃষ্টি দিতে পারি; ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী, জুতারে কয় আলমারি’। গ্রন্থালোকিত জীবন, বরং বলতে পারি পাঠালোকিত জীবন শিষ্ট হবে। এই ‘শিষ্টতা’কে বুঝতে অন্তরালোকিত হওয়া চাই। স্কুলজীবনে অনেকদিন গ্রন্থাগারে বসে অজস্র রঙিন বইয়ের পাতা উল্টেছি এবং আত্মীয়-পরিজনের কাছে প্রমাণ করেছি, আমার বিকেল- অবসর কাটে পাকিস্তান কাউন্সিল লাইব্রেরিতে (আজকের গণ-গ্রন্থাগারের তখনকার নাম ছিল এই)। গ্রন্থাগারে অনেক সময় পড়ে থাকলেও বইয়ের আলোকিত সান্নিধ্যলাভ হয়নি। রাজনীতিক দাদার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে ‘হোয়াট ইজ ডেমোক্রেসি’ নামের একটা চমৎকার বাঁধাই করা অজস্র ছবি সংবলিত বই বারবার উল্টেপাল্টে ভেতরের ছবি, বিশেষ করে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রাম আর আমেরিকান বাহিনীর অত্যাচারের ছবি দেখে কখনো শিহরিত হয়েছি কিন্তু আলোকিত হতে পারিনি। অনেক পরে জেনেছি বইয়ের আলোকিত সান্নিধ্য পেতে একটি গ্রন্থের অন্দর দর্শন করা চাই। বইটির অন্তর উপলব্ধি করা চাই। বইয়ের অন্তর উন্মোচন না করা গেলে তা থেকে রসাস্বাদন অসম্ভব। আলোচনাটিকে সহজ করতে আমি ‘খুঁটির জোর’ হিসেবে একটু আশ্রয় চাই, যেমন বইপীতির জন্য প্রিয় লেখকের নামের তালিকা চাই; নিজের প্রিয়তার সব নাম তো উচ্চারণ করবার সুযোগ নেই, তবু আশ্রয় হিসেবে সবার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রিয়তার প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ এতটাই প্রিয়, যা অনেকটা নিশ্বাসের মতো। রবীন্দ্রনাথ প্রিয়তার প্রবাল দ্বীপ, অন্যরা বিচ্ছিন্ন প্রবাল; কেউ অযুত-নিযুত প্রবালগুচ্ছ, আর রবীন্দ্রনাথ সহস্রকোটি প্রবালের মিলিত উচ্চারণ- যে উচ্চারণ উত্তাল সমুদ্রেও খুঁজে নিতে পারে নিজের ঠিকানা; যে ঠিকানা সহস্রকোটি প্রবালকে দিতে পারে অস্তিত্বের আশ্বাস। সেই শৈশবে পড়া ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি’ পদ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথে যে প্রিয়তা যোগ হয়েছে, যৌবনে পড়া গল্পগুচ্ছ, চার অধ্যায়, শেষের কবিতা, অচলায়তন, বিসর্জন, রথের রশি কিংবা রক্তকরবী; অথবা পরিণত বয়সে পড়া রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ এবং প্রতিদিনের আচ্ছন্ন করা রবীন্দ্রসঙ্গীত; কেউ কোনো দিনও মুহূর্তের জন্য রবীন্দ্রনাথকে পুরনো হতে দেয়নি- রবীন্দ্রনাথ কখনো মলিন হয়ে যাননি। প্রেয়সীর নামের মতো যদি একজন প্রিয় লেখকের নাম উচ্চারণ করতে হয় সে নাম অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘মানুষ’ পাঠের কথা বললেন, যখন ‘প্রকৃতি’ পাঠের কথা বললেন, জীবনে তখন নতুন পাঠ্যসূচি যোগ হলো; যখন জানা হলো নিজের জীবনকে সর্বোত্তমভাবে রচনা করাই মানুষের জীবনের প্রধান সাফল্য, তখন প্রতিটি মানুষের ‘জীবন’ পাঠই হয়ে উঠল নিজের আত্মাকে আলোকিত করার অনিবার্য অনুষঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ প্রাত্যহিক, রবীন্দ্রনাথ জীবন ধারণের জন্য অনিবার্য। সকালে ঘুম ভেঙে রবীন্দ্রনাথ-সারাদিন রবীন্দ্রনাথ-ঘুমাতে গেলে রবীন্দ্রনাথ-স্বপ্নেও রবীন্দ্রনাথ। নিজেকে শুদ্ধ করতে রবীন্দ্রনাথ-পূর্ণ করতে রবীন্দ্রনাথ-সম্পন্ন করতে রবীন্দ্রনাথ। ‘যতক্ষণ রবীন্দ্রনাথে সমর্পিত থাকি ততক্ষণ অন্দরের কোত্থাও শূন্যতা থাকে না’ এই প্রতীতিতে মগ্ন থাকি- ভালো থাকি। এভাবেই প্রিয় লেখকদের প্রিয় রচনা-প্রিয় গ্রন্থগুলো আমাদের আলোকিত করে যাচ্ছে প্রতিদিন; সম্পন্ন মানুষ হতে সহায়তা করছে, যে ব্রতী নিয়ে একজন মানবসন্তানের মগ্ন থাকা আবশ্যক প্রতিদিন। সাধারণের প্রাজ্ঞজন হয়ে ওঠার সব আয়োজনই পাঠকেন্দ্রিক-বইকেন্দ্রিক। শুদ্ধ হয়ে ওঠা, প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠা, পবিত্র হয়ে ওঠা, সহিষ্ণু হয়ে ওঠা, নির্লোভ-মহত্তম হয়ে ওঠা এবং পূর্ণ হয়ে ওঠার একমাত্র অবলম্বন পাঠে অভিনিবেশন, বইয়ের সঙ্গে আত্মীয়তা করে নেয়া। যার বিকল্প নেই, তার সঙ্গে দূরত্ব রাখার মূর্খতা কেন আর?

ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও লেখক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App