×

জাতীয়

ফেরিঘাটে বিলম্বে মাঝপথেই মৃত্যু হচ্ছে অসুস্থ যাত্রীদের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০১৯, ১১:৫৭ এএম

ফেরিঘাটে বিলম্বে মাঝপথেই মৃত্যু হচ্ছে অসুস্থ যাত্রীদের
ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচলকারী এসি বাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফেরি পারাপার বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন গুরুতর অসুস্থ রোগী ও যাত্রীরা। দ্রুত ফেরি পার হতে না পারায় গত ৮ জুন নূর আলম নামের এক ক্যান্সারের রোগীর পথেই মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফেরি পারাপার বিলম্বিত হওয়ায় রোগীরা সময়মতো কলকাতায় পৌঁছতে না পারায় অগ্রিম টিকেট হাতে থাকার পরও দিল্লি, মুম্বাই ও চেন্নাইয়ের প্লেন ও ট্রেন ধরতে পারছেন না। ঢাকা-কলকাতা আন্তর্জাতিক রুটের বাস দ্রুত ফেরি পার করতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও বিআইডব্লিউটিসি আমলে নিচ্ছে না। ফেরিঘাটে পুলিশেরও কোনো ভূমিকা নেই। জানা গেছে, গত ৮ জুন ক্যান্সারের রোগী নূর আলম উন্নত চিকিৎসার জন্য গ্রিন লাইন পরিবহনের এসি বাসে কলকাতা যাচ্ছিলেন। নূর আলমের ভাই ফরিদ জানান, বাসটি রাত সাড়ে ৮টায় কল্যাণপুর থেকে ছাড়ার পর রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে ফেরি পার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফেরিঘাটে দীর্ঘ সময় আটকে থাকার ৪ ঘণ্টা পর ভোর সাড়ে ৫টায় ফেরি পার হয় এবং সকাল ১০টায় বেনাপোল গিয়ে পৌঁছে। বেনাপোল ও পেট্রাপোলে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পার হয়ে আবার তারা বাসে ওঠেন। বিকেল ৫টায় কলকাতায় পৌঁছার পথেই নূর আলমের অবস্থার চরম অবনতি হয়। বাস থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নামিয়ে ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে জানান, পথেই নূর আলমের মৃত্যু হয়েছে। ফরিদ আরো বলেন, পাটুরিয়া ফেরিঘাটের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তাদের কাছে রোগীর কথা বলে দ্রুত বাসটি পারাপারের অনুরোধ জানানোর পরও তারা বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখাননি। একটু মানবিকতা দেখালে আমার ভাইকে রাস্তায় মরতে হতো না। এ ছাড়া যাত্রার শুরুতেই ঢাকায় এবং কলকাতায় পৌঁছার পর ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কার্যক্রম সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেয়া হলে যাত্রীদের হয়রানি কমবে এবং সময় কিছুটা হলেও বাঁচবে। কলকাতাগামী ওই বাসটি কেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফেরি পার করা হলো না জানতে চাইলে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এনএসএম শাহাদাত হোসেন বলেন, অ্যাম্বুলেন্সগুলো আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করি। যেহেতু রোগী অ্যাম্বুলেন্সে ছিল না তাই এর দায়দায়িত্ব আমাদের নেই। তা ছাড়া পণ্যবাহী ট্রাক মালিক ও চালকদের বাধার কারণে কলকাতাগামী বাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফেরি পারাপার করা সম্ভব হয় না। তাই এখানে মানবিক দিক বিবেচনার কোনো সুযোগ ছিল না। সব যাত্রীবাহী বাস একইভাবে পার করা হয়। যাত্রী ও বাসচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন নূর আলমের মতো কলকাতাগামী অসংখ্য রোগী ও যাত্রী ফেরিঘাটে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বাসচালক মিজান জানান, ঢাকা-কলকাতা রুটের প্রতিটি এসি বাসের যাত্রীদের মধ্যে অর্ধেক থাকে নানান বয়সী ও গুরুতর অসুস্থ রোগী। প্রতিদিনই তাদের ফেরিঘাটে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেক যাত্রীর দিল্লি, মুম্বাই ও চেন্নাই যাওয়ার জন্য বিকেলের প্লেনের ও ট্রেনের টিকেট অনলাইনে কেটে রাখে। দেরি হলেই যাত্রীদের বলতে শোনা যায়, তারা প্লেন মিস করবেন, ট্রেন ধরতে পারবেন না। তাদের অনেক টাকা গচ্ছা দিতে হয়। কখনো কখনো বেনাপোল পৌঁছতে দেরি হলে ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওপারে যেতে পারে না। বেনাপোলেই হোটেলে থাকতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঢাকা-কলকাতা রুটের সব এসি বাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফেরি পারাপারের জন্য বিআইডব্লিউটিসিকে নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশ অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিসি এই আন্তর্জাতিক রুটের এসি বাসগুলো পারাপার করে আসছিল। অন্যদিকে ২০১৬ সালের ২২ জুলাই গ্রিন লাইন পরিবহনের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা-কলকাতা রুটে সব এসি বাস ফেরিঘাটে পৃথক লাইনে পারাপারের ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দেয়া হয়। এই নির্দেশের পর ওই বছরের ২৪ নভেম্বর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজিকে ঢাকা-কলকাতা রুটের এসি বাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপারের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। তখন ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি মানিকগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার পুলিশ সুপারকে (এসপি) এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলেন। পুলিশ তখন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে পৃথক লাইন করে প্রতিটি ফেরিতে ঢাকা-কলকাতা আন্তর্জাতিক রুটের দুটি করে বাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপারের ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু হঠাৎ করেই ট্রাক মালিক-চালকরা এতে বাদ সাধে। তাদের চাপের কারণে এক পর্যায়ে বিআইডব্লিউটিসি ও ঘাট পুলিশ ঢাকা-কলকাতা রুটের বাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফেরি পারাপার বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা-কলকাতা আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী বাসের মালিকরা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভোগান্তির বিষয়টি তুলে ধরে ঢাকা-কলকাতা রুটের ৩০টি বাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপারের জন্য তৎকালীন নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। নৌ-পরিবহনমন্ত্রী যাত্রীদের সুবিধার্থে বিষয়টি বিবেচনার জন্য বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা সংক্রান্ত চিঠি দেন। কিন্তু বিআইডব্লিউটিসি রহস্যজনক কারণে এখন পর্যন্ত এই ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাস মালিক সমিতির সভাপতি রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, অভ্যন্তরীণ রুটের বাসের সঙ্গে কলকাতাগামী বাসের তুলনা করা বোকামি। কলকাতাগামী বাসে বিদেশি পর্যটক ও আমাদের দেশের রোগীরা থাকেন। যাদের বিমানে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের বাসে কলকাতা পৌঁছে বিভিন্ন গন্তব্যের বিমান, ট্রেন ধরতে হয়। অনেকেই অনলাইনে টিকেট কেটে রাখে। সময়মতো পৌঁছতে না পারলে সব বিফলে যায়। নতুন টিকেটের জন্য সময় ও অর্থের দণ্ড দিতে হয়। তিনি নূর আলমের মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ করে বলেন, ভারতে যারা চিকিৎসার জন্য যায় তারা সবাই বাঁচবে এমনটা নয়। তবে তাদের বাঁচানোর জন্য সবার সহযোগিতা করা উচিত। শত শত বাসের জন্য বাস মালিকরা সুবিধা চায় না। শুধু আন্তর্জাতিক রুটের বাসগুলোর জন্য ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অভিযোগ রয়েছে, ঘাট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিসির কর্মচারী ও পুলিশ ট্রাকপ্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার বিনিময়ে পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার করছে। ট্রাক মালিক-চালকরা টাকা দিয়েও দ্রুত ফেরি পার হতে চায়। বিআইডব্লিউটিসির কর্মচারী ও পুলিশ এই সুযোগটি নিচ্ছে। তারা ট্রাক চালকদের উস্কে দিয়ে চাপের মুখে আন্তর্জাতিক রুটের এসি বাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপার বন্ধ করে দিয়েছে। বাস মালিকরা এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন মহলে দেনদরবার করেও সুফল পাননি। পুলিশের অসহযোগিতার ব্যাপারে জানতে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি হাবিবুর রহমানের সঙ্গে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App