×

মুক্তচিন্তা

প্রস্তাবিত বাজেটে গবেষণা বরাদ্দ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০১৯, ০৮:২৫ পিএম

নিরাপত্তাহীনতার দারিদ্র্য, মতপ্রকাশের দারিদ্র্য, মানবিক দারিদ্র্য ইত্যাদি নিরসন কতটুকু সম্ভব বিশেষ করে আমাদের মতো সমাজ কাঠামোতে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ হয়নি। তারপরও প্রশ্ন থাকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা কত? আমরা এখনো দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে কবে পরিত্রাণ পাব তাও বলা যায় না। তবে গবেষণা তথা পরিসংখ্যানবিদরা বলছেন অবস্থার ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে, মোট জনসংখ্যার দারিদ্র্যের হার কমছে কিন্তু ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে যা অনেকটা চিন্তার কারণ।

বাংলাদেশে গবেষণায় কম বরাদ্দের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে এবার প্রস্তাবিত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বাড়তি ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধি উচ্চতর রাখার শর্ত হলো নলেজভিত্তিক গবেষণা ও উন্নয়ন। এ ছাড়াও নতুন ধারণা বের করতে পারলেও সেখানে প্রণোদনা দেয়া হবে। বাংলাদেশে উদ্ভাবনী সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার আগামীতেও কাজ করে যাবে। দারিদ্র্য নিয়ে বাংলাদেশে অতীতে গবেষণা হয়েছে অগণিত এবং সরকারসহ বিদেশি উদ্যোক্তারাও প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে এই খাতটিতে। কিন্তু টেকসই উন্নয়নে দারিদ্র্য নিরসন বা বিমোচন কতটুকু শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ একজন দারিদ্র্য গবেষক ও একজন দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের (পুরুষ কিংবা মহিলা) মধ্যে দারিদ্র্য নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে যার শান্তিপূর্ণ সমাধান জরুরি। একজন গবেষক তাত্ত্বিকভাবে দারিদ্র্যকে বিশ্লেষণ করেন সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে আর দরিদ্রজন একে বিশ্লেষণ করেন ব্যবহারিক অনুশীলনের গুণগত তত্ত্বের ভিত্তিতে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুন্যার ম্রিডেলের তিন খণ্ডে রচিত এশিয়ান ড্রামা বইটি দারিদ্র্য গবেষণার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অনুশীলনের এক মহামিলন বলে খ্যাত। জনাব ম্রিডেল ১৯৭৪ সালে তার এই গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন যা তার সারা জীবনের একমাত্র প্রকাশনা। তার মৃত্যুর পর লন্ডনভিত্তিক প্রচার মাধ্যম ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি) থেকে নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় এই গুণী অর্থনীতিবিদের জীবন ও কর্মের ওপর একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল। সংবাদটি এরকম ছিল যে, এই গবেষক তার গবেষণা কাজে দক্ষিণ এশিয়া থেকে দূরপ্রাচ্য এশিয়ার দশটি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন এগারোটি বছরে এবং তিনি দেখিয়েছেন সেসব দেশের গ্রামীণ সমাজের দারিদ্র্য ও সমাজব্যবস্থার স্বরূপ। এর বিভীষিকা রূপ দেখে ঘুমের ঘোরে তিনি যখন চিৎকার করে উঠতেন তখন তার স্ত্রী এসে জিজ্ঞাসা করতেন তোমার কী হয়েছে? তিনি তখন বলতেন একটি কলম ও কাগজ দাও। তারপর তিনি লিখতেন সেসব সমাজের চিত্র সেটাই এশিয়ার ড্রামার মূল বিষয়। এর থেকে মূল শিক্ষা হলো দারিদ্র্য গবেষক হতে হলে নিজেকে দরিদ্র হতে হবে, দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করতে হবে এবং তখনই বোঝা যাবে এর ব্যবহারিক রূপটি কী? দারিদ্র্য বহুমুখী, বহুরূপী এবং দারিদ্র্যকে দেখতে হবে সর ধরনের দারিদ্র্যের পরস্পর সম্পর্কিত যৌথ রূপ হিসেবে যেখানে প্রতিটি রূপ ভিন্ন ভিন্নভাবে দারিদ্র্যের নির্দিষ্ট অংশকে প্রতিফলিত করে মাত্র। এটাও সত্যি যে দারিদ্র্যের কোনো একটি রূপ অন্য রূপের তুলনায় অধিক গুরুত্ব বহন করে যাকে বলা হয় তুলনামূলক ও নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য। তাই দারিদ্র্য বিমোচন বলতে বুঝতে হবে তুলনামূলক হ্রাস অথবা নির্মূল কিন্তু দ্বিতীয়টি প্রথমটির তুলনায় যথেষ্ট কঠিন বলে প্রতীয়মান হয় যার জন্য কাঠামোগত সংস্কারই স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ হতে পারে। এসব চিন্তার লালন পালনে তাত্ত্বিক গবেষণায় রয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং ব্যবহারিক গবেষণায় রয়েছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)। দারিদ্র্য গবেষণার ফল বলছে, যে পরিবারে কন্যাসন্তান বেশি সেই পরিবারই দারিদ্র্য। আবার যে পরিবারের প্রধান মহিলা সেই পরিবারই দারিদ্র্য। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও সামাজিক ভিত্তি রয়েছে বিধায় সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে নারীর গতিবিধি ও যৌতুকপ্রথা তাদের উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান বাধা। এই সত্যটি উপলব্ধি করেই গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্যোক্তা তাদের গ্রাহক হিসেবে নারীদেরই প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ঋণ পাওয়া তাদের মৌলিক অধিকার যা দিয়ে দারিদ্র্য নিরসন কিছুটা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের একক কোনো মডেল নেই এবং যা আছে তা হলো গঁষঃর অমবহপু অঢ়ঢ়ৎড়ধপয যার মধ্যে আছে সরকারি, বেসরকারি ও দাতা সংস্থার অংশগ্রহণ। তাদের ঈৎবফরঃ খরহব ভিন্ন ও সুফলভোগীও ভিন্ন এলাকা ভেদে। অনেকেই বলেন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন হবে তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ঋণ কেবল আয়বর্ধনমূলক কাজ সৃষ্টি করতে পারে যা দিয়ে কেবল আয় দারিদ্র্য নিরসন করা যায় কিন্তু বহুমাত্রিক দারিদ্র্য যেমন পরিবেশ বিপর্যয়ের দারিদ্র্য, রাজনৈতিক দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতার দারিদ্র্য, মতপ্রকাশের দারিদ্র্য, মানবিক দারিদ্র্য ইত্যাদি নিরসন কতটুকু সম্ভব বিশেষ করে আমাদের মতো সমাজ কাঠামোতে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ হয়নি। তারপরও প্রশ্ন থাকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা কত? আমরা এখনো দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে কবে পরিত্রাণ পাব তাও বলা যায় না। তবে গবেষণা তথা পরিসংখ্যানবিদরা বলছেন অবস্থার ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে, মোট জনসংখ্যার দারিদ্র্যের হার কমছে কিন্তু ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে যা অনেকটা চিন্তার কারণ। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সর্বশেষ দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালের প্রক্ষেপণ হিসাব দাঁড়িয়েছে ২১.৮ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ মনে করে তিনটি কারণে দেশের দারিদ্র্য ধারাবাহিকভাবে কমছে যথা : ১। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ধরা হয়েছে সেটা পূরণ হওয়ায় কর্মসংস্থান বেড়েছে যার প্রভাব পড়েছে দারিদ্র্য নিরসনে; ২। ব্যাপকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে; ৩। গ্রামাঞ্চলে সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে কৃষি ও অকৃষি খাতে কার্যক্রম বেড়েছে। বিবিএস আরো বলছে থানাপ্রতি মাসিক আয় বেড়েছে, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে, বিল্ডিং বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে ও সামাজিক নিরাপত্তারও অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু মানবিক দারিদ্র্য কিংবা নিরাপত্তাহীনতার দারিদ্র্যের কিংবা গুণগত দারিদ্র্যের চলকগুলোর কী অবস্থা এ নিয়ে এই রিপোর্টে কোনো উল্লেখ নেই। নিরপেক্ষ গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসের একটি মূল কারণ গ্রামের গরিব মানুষের অর্জিত রেমিটেন্স যা গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরের একটি বড় নিয়ামক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশে মোট বিনিয়োগের মাত্র শতকরা ৫ ভাগ পল্লী খাতে গেছে এবং বিভাগওয়ারী বরিশাল বিভাগ ও রংপুর বিভাগে সবচেয়ে কম বিনিয়োগ হয়েছে। আবার রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলা ও নবগঠিত ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর জেলায় দারিদ্র্যের প্রকোপ সবচাইতে বেশি। তারপর প্রধান কারণ প্রাকৃতিক নদীবেষ্টিত এলাকা বিধায় প্রতি বছরই ভাঙনের শিকার হচ্ছে অনেক পরিবার। তারপরও সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় দেশের দারিদ্র্যের হার কমেছে প্রতি বছর ১.২ শতাংশ করে কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার তার চেয়ে বেশি হওয়ায় দারিদ্র্য কি কমছে? আবার জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার বাড়ার সঙ্গে দারিদ্র্য হ্রাসের একটা সম্পর্ক থাকলেও তা নিম্নমুখী কেন? কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগতভাবে কমে যাওয়ায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১.৯৬ শতাংশ এবং বর্তমান বছরে এই সংখ্যাটি কমবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত। এখন কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির যে নিম্নগতি তা দারিদ্র্য বিমোচনে কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখতে পারবে না। ২০১৬ সালের হায়েসের প্রাথমিক রিপোর্টে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ কোটিতে যা মোট জনসংখ্যার ২৪.৩ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট বাজেটের ৭.২%। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবারের আকার দেশের গড় আকারের চেয়ে অনেক বেশি। কেবল শিক্ষা সচেতনতার অভাবে যা দারিদ্র্য হ্রাসের পথে একটি বড় অন্তরায়। তাই দারিদ্র্য গবেষকদের এবং এসব গবেষণা ফলাফলের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর যেসব বিষয়ে নজর দিতে হবে তা হলো- দরিদ্রজনের পরিবার ছোট করার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক শিক্ষা চালু; আয়বর্ধনমূলক কর্মসংস্থান সৃষ্টি অধিক হারে; কৃষিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো বিশেষত কৃষিপণ্যের মূল্য নিশ্চিতের মাধ্যমে; সামাজিক বেষ্টনী কর্মসূচিতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো ও ধর্মীয় অনুশাসনে জীবন পরিচালনা ও ছোট পরিবার গঠনে উদ্বুদ্ধকরণ। তাই এ খাতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়ানো ও গবেষকদের সম্মানী বাড়ানোর দাবি রইল।

ড. মিহির কুমার রায় : অর্থনীতিবিদ, ডিন; সিটি ইউনিভার্সিটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App