×

অর্থনীতি

গ্রামীণ উন্নয়নে নজর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০১৯, ১০:৫২ এএম

গ্রামীণ উন্নয়নে নজর
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ এবং সর্বশেষ ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ স্লোগানকে সামনে রেখে টানা তিনবার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ জনগণকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ার। এ লক্ষ্যে ৮৫ হাজার পল্লী এলাকায় ধারাবাহিকভাবে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণের বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। ক্ষমতাসীনরা বলছেন, বাজেটের এই সুফল পৌঁছাবে গ্রামীণ মানুষের দোরগোড়ায়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নয়ন হতে হবে পরিকল্পিত এবং বিজ্ঞানসম্মত। অন্যথায় সুফল মিলবে না। বুমেরাংও হতে পারে। কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন শুধু অর্থ ও শ্রমের অপচয়ই নয়, দেশের জন্যও ক্ষতিকর। মূলত ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘গ্রাম হবে শহর’ ধারণাটি সারা দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ইশতেহারে বলা হয়, প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগরসুবিধা সম্প্রসারণ, আগামী পাঁচ বছরে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেয়া, পাকা রাস্তার মাধ্যমে সব গ্রামকে জেলা-উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা, উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি, সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের জন্য জেলা-উপজেলায় কলকারখানা গড়ে তোলা, সর্বত্র ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার, সুপেয় পানি এবং উন্নতমানের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের পর এ ধারণা বাস্তবায়নে নতুন বাজেটে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর পক্ষে বাজেট উত্থাপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সব বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখেই গ্রাম হবে শহর। গ্রাম যেন উন্নত হয়, তারা যেন শহরের সুবিধা পায়, সে জন্য আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচির আলোকে পল্লী এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ খাতে আগামী অর্থবছরে ৬৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি জানান, নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে গ্রাম পর্যায়ে কৃষিযন্ত্র, সেবাকেন্দ্র ও ওয়ার্কশপ স্থাপন করা হবে। উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান তৈরি, হাল্কা যন্ত্রপাতি তৈরি ও বাজারজাতকরণে ঋণ সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হবে। এ ছাড়া পল্লী এলাকায় উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামো স্থাপন, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ তৈরি, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানো, কম্পিউটার ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়াসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া হবে। কিছু কিছু গ্রাম ইতোমধ্যে শহর হয়ে গেছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সারোয়ার জাহান ভোরের কাগজকে বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেয়া সম্ভব। তবে সব গ্রামে শহরের নাগরিক সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব নয়। গ্রামে বিভিন্ন ক্যাটাগরির মানুষ বসবাস করেন। এখানে কৃষিকাজ, মৎস্যচাষসহ গ্রামীণ অনেক পরিবেশ রয়েছে যা শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না। এ ছাড়া দেশে এমনিতেই সাড়ে পাঁচশোর মতো শহর রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে শহরের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে মনে করেন এই নগরবিদ। বাজেটে গ্রামীণ জনগণের উন্নয়নে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের ধারাবাহিকতা থাকছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে এক লাখ এক হাজার ৪২টি সংগঠনের আওতায় ৬০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে সুসংগঠিত করে দেশ থেকে স্থায়ীভাবে দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পল্লী অবকাঠামো উন্নয়নের নানা উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে পল্লী এলাকায় পাঁচ হাজার ৫০০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ, ৩০ হাজার ৫০০ মিটার ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ, ১৩ হাজার কিলোমিটার পাকা সড়ক এবং তিন হাজার ৭০০ মিটার ব্রিজ বা কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণ, ১৯০টি গ্রোথ সেন্টার বা হাটবাজার উন্নয়ন, ৬৪টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ বা সম্প্রসারণ, ১৩০টি সাইক্লোন শেল্টারসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। তিন পার্বত্য জেলাসহ সারা দেশের পল্লী এলাকায় চলমান সেবা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতার পাশাপাশি ‘পল্লী জনপদ’ নামে আধুনিক আবাসন তৈরি করা হবে। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। বরাদ্দকৃত অর্থ পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করা হলে উন্নত গ্রাম তৈরি সম্ভব। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, গ্রামে শহরের নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া মানে রাস্তাঘাট নির্মাণ, নিরাপত্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি, ব্যাংকিং সুবিধা, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তির সেবা পৌঁছানো। এর অনেকটাই আমরা অর্জন করেছি। বিশ্বের উন্নত দেশেও তাই হচ্ছে। কৃষিকাজ, মাছচাষও হচ্ছে পাশাপাশি নাগরিক সুবিধাও রয়েছে। তিনি বলেন, আগে গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। এখন প্রায় সব গ্রামেই বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুলের ব্যবস্থা না থাকায় মেয়েদের ঝরে পড়ার সংখ্যা অনেক বেশি ছিল, এখন প্রতিরোধ হয়েছে। রাস্তাঘাট হয়েছে। গ্রামে এখন গাড়ি চলে। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, তবে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের আত্মীয়স্বজনই দেশের বাইরে থাকেন এবং তাদের পাঠানো টাকা দিয়ে কোনো নিয়ম না মেনেই রাস্তার পাশে, ক্ষেতের মাঝে যত্রতত্র দালানকোটা বানানো হচ্ছে। এগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুসলেহউদ্দীন হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে প্রক্রিয়াটি বৈজ্ঞানিক উপায়ে না হয়ে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হলে বুমেরাং হবে। পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিশেষজ্ঞ মতামত প্রয়োজন। এই নগরবিদ বলেন, গ্রামকে শহর নয়; বরং গ্রামে শহরের কিছু সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। আর গ্রামকে যদি শহর করা হয় তাহলে তো আশঙ্কার কথা। নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে বিপর্যয় ঘটবে। এ ছাড়া ৮৫ হাজার গ্রামের মধ্যে কোন কোন গ্রামে কী পর্যায়ে সুবিধা পৌঁছানো হবে এসব নিয়ে বিশদভাবে পরিকল্পনার প্রয়োজন। তবে গ্রামে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন সুবিধাও বাড়াতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App