×

সাময়িকী

সেলিনা হোসেনের শিশুসাহিত্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০১৯, ০৪:২০ পিএম

সেলিনা হোসেনের শিশুসাহিত্য
সেলিনা হোসেনের শিশুসাহিত্য
বাংলা সাহিত্যে প্রথম সারির কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বড় মাপের একজন শিশুসাহিত্যিক। কথাসাহিত্যিক ও শিশুসাহিত্যিককে আলাদাভাবে দেখার প্রবণতা আছে বিধায় অনেক সময় অনেক বিষয়ে একজন লেখকের যথাযথ মূল্যায়নও হয় না। সেদিক থেকে মনে করি সেলিনা হোসেন ভাগ্যবান। ভাগ্যবান এই কারণে যে, তিনি শিশুসাহিত্য রচনার জন্যও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। পেয়েছেন শিশুদের ভালোবাসা। যদিও শিশুসাহিত্য রচনায় তিনি অনেক পরে মনোনিবেশ করেন তবুও সুখ্যাতির ক্ষেত্রে এখানেও তাঁর জয়জয়কার অবস্থান। ‘জলোচ্ছ্বাস’ তুলে আলোড়ন সৃষ্টি করে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ দিয়ে বুক কাঁপিয়ে ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ বাজিয়ে হৃদয় ভরিয়ে দিয়েছেন পাঠককুলকে। এভাবে যাপিত জীবন, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, গায়ত্রী সন্ধ্যা, কাঠ কয়লার ছবি, কাঁটাতারে প্রজাপতি, নীল ময়ূরের যৌবন, ঘুমকাতুরে ঈশ্বর, মাটি ও শস্যের বুনন, যমুনা নদীর মুশায়ারা, ভ‚মি ও কুসুম, হেঁটে যাই জনমভর, সোনালি ডুমুর, নিঃসঙ্গতার মুখর সময় ইত্যাদি গ্রন্থে জীবন, জীবনবোধ, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, নিম্নবর্গ মানুষের নিরন্তর দুঃখ-কষ্ট, সর্বোপরি বাংলাদেশের অস্তিত্বকে জানান দিয়েছেন সেলিনা হোসেন। এখানে সেই দীর্ঘ আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু শিশুসাহিত্য রচনায় সেলিনা হোসেনের ভ‚মিকা বা অবদানের কথা বলব। গল্প-উপন্যাসে দক্ষ বা পারদর্শী ব্যক্তি তাঁর সাহিত্য সাধনার দীর্ঘকাল পরে শিশুসাহিত্য রচনা শুরু করেন যা সংখ্যায় ও গুণে-মানে এতটাই সমৃদ্ধ যে তিনি শুধু এই শিশুসাহিত্যের জন্যও বিশেষ আসন দখল করার যোগ্যতা রাখেন। সেলিনা হোসেনের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে যে সকল বই রয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘সাগর’, ‘জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা ছবি’, ‘কাকতাড়–য়া’, ‘বর্ণমালার গল্প’, ‘যখন বৃষ্টি নামে’, ‘মেয়রের গাড়ি’, ‘এক রুপোলী নদী’, ‘আকাশপরী’, ‘চাঁদের বুড়ির পান্তা ইলিশ’, ‘নীলটুনির বন্ধু’, ‘নদীটির ঘুম ভেঙেছে’, ‘ফুলকলি প্রধানমন্ত্রী হবে’, ‘আমার স্কুল’, ‘বায়ান্নো থেকে একাত্তর’, ‘সোনারতরীর ছোটমণিরা’, ‘গল্পটা শেষ হয় না’, ‘মুক্তিযোদ্ধারা’, ‘কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ’, ‘অন্যরকম যাওয়া’ ইত্যাদি। ‘সাগর’ উপন্যাসটি দিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখার সূত্রপাত করেন সেলিনা হোসেন, যে বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। অর্থাৎ বড়দের বই জলোচ্ছ্বাস প্রকাশের ২০ বছর পর। মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মিতে লেখা সাগর উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি জীবনযুদ্ধকেও তুলে ধরা হয়েছে। শিক্ষক হুমায়ুন তার স্ত্রীকে বলেছে, ‘নিজের দেশকে জানা যে কত গভীর সাগরকে দেখে বুঝতে পারো না?’ এমন চমৎকার একটি কাহিনীর সমাপ্তি টানা হয়েছে সাগরের আত্মাহুতি দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা আরিফ ও হারুন সাগরের প্রস্তাব শুনে ‘অসম্ভব’ বললেও শেষে হারুন সাগরের বুকে-পিঠে মাইন বেঁধে দেয়। কনভয়ের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সাগর ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আরিফ ভাই বাবা-মাকে বলবেন যে সাগর হারিয়ে যায়নি। ও বাবুই পাখির বাসা খুঁজতে গেছে।’ সাগরের এমন চলে যাওয়ার ঘটনা যুদ্ধকালীন সময়ের একটি নির্মম সত্য। সেই সত্যকে সেলিনা হোসেন প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। কিশোর পাঠকদের মনে দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলো সম্পর্কে ধারণা জন্মাবে নিঃসন্দেহে। অরেকটি উপন্যাস ‘জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা ছবি।’ এটি আমার কাছে বিশেষভাবে ভালো লেগেছে। ভালো লাগার অন্যতম কারণ ঘরের জড় পদার্থের জীবজন্তু বা আসবাবপত্রের সাথে কথোপকথন। শিশুদের মনের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক সেলিনা হোসেন। ব্রাসেলস বিমানবন্দরে ছোট্ট নেহার সাথে পরিচয় হয় লেখকের। মজার খুনসুটিও হয় নেহার পা দোলানো নিয়ে। পরে জানা গেল লেখকের নেহা নামে একটি মেয়ে আছে। বাংলাদেশের নেহা আর নিউইয়র্কে বাস করা ভারতীয় নেহার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা কঠিন। শিশুদের স্বভাব সর্বদা সুন্দরই হয়, তবে বেড়ে ওঠার সময় উঠতি বয়সে একটু বিপরীতমুখী আচরণ লক্ষ করা যায় যেটা লেখকের ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে নাদিমের জন্য প্রযোজ্য। এটা অনেক পরিবারেই দেখা যায়। নাদিম সিগারেট খায়। তার সিগারেট খাওয়া বন্ধ করতে নেহা অনেক কৌশল অবলম্বন করে। ক্যান্সারের বিষয়টি অবগত করলেও কোনো কাজ হয় না। লেখকের মনও মুষড়ে পড়ে। তবু শেষ পর্যন্ত নেহার জয় হয়। সুপথে ফেরানোর কৌশলের মধ্যে লেখকের মুন্সিয়ানা লক্ষ করার মতো। ‘মেয়রের গাড়ি’ পড়ে সেলিনা হোসেনকে আবিষ্কার করি একজন সমাজ বিশ্লেষক হিসেবে। নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টিতে অন্যরকম এক রাজনৈতিক বা সামাজিক পটভ‚মি বর্ণিত হয়েছে এই গ্রন্থে। মূল চরিত্রের নাম সুধাময়-এর পাশাপাশি অন্য চরিত্রগুলোর নামও ব্যতিক্রম, যেমন নক্ষত্র, নদী, রোদ, পাখি, বৃষ্টি ইত্যাদি। শহর থেকে সন্ত্রাস, শিশুপাচার, অপহরণ ইত্যাদি হটানোর জন্য বড়দের বিরুদ্ধে ছোটদের মিটিং, মিছিল, পোস্টারিং করা একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। এই ব্যতিক্রম ঘটনা দিয়ে সংস্কারকের ভূমিকা নিয়েছেন লেখক সুধাময় চরিত্রের মাধ্যমে। সুধাময় নিজেও গরিব ঘরের সন্তান কিন্তু তার মেয়র হয়ে যাওয়ার অভিনব পদ্ধতিটি শিশুদের মনে শুধু আনন্দের উদ্রেকই করে না, পাশাপাশি সুন্দর, শৃঙ্খল পথে চলার অনুপ্রেরণাও পাবে। শস্য জাদুকর নামের চরিত্রটি দিয়ে দিনের মেয়রকে যেভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে সেখানেও নতুনত্ব। শস্য জাদুকর বড়দের দিনের বেলা ঘুমিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে এবং সেই ফাঁকে মেয়রের গাড়ি ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে উন্নয়ন ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত হয়। সকল শিশু একযোগে কাজ করে অনেক সমস্যার সমাধানও করতে পারে। সন্ত্রাসীদের চিরতরে নিশ্চিহ্নও করা হয়। এই গল্পটি থেকে বড়দেরও শিক্ষা নেয়ার সুযোগ আছে। সবশেষে বলা হয় মেয়রের গাড়ি হবে শহরের অন্য নাম। বড়দের দোষারোপের পাশাপাশি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও দোষারোপ করা হয় এই বলে যে তিনি সরাসরি সন্ত্রাসী না হলেও সন্ত্রাসী পালন করেন। সন্ত্রাসী আসলাম এবং জাহাঙ্গীরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে কৌশলে, তাতে বুঝতে বাকি থাকে না সুইডেন আসলাম আর কালা জাহাঙ্গীরের কথা বলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শহরকে ঠিকঠাক করে দায়িত্ব ছেড়ে মেয়র সুধাময় গাড়িটিকে জাদুঘরে রাখার ব্যবস্থা করে। বড়দের উদ্দেশ্য করে বলা হয় এই শিক্ষা যদি তারা কাজে লাগাতে না পারে এরপর শুধু দিনে নয় রাতেও ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। এই রকম বিচিত্র খেয়ালিপনার গল্পে সেলিনা হোসেন আমাদের বাংলাদেশেকে যে সন্ত্রাসমুক্ত, নিয়মশৃঙ্খলাপূর্ণ, স্বচ্ছ, সুন্দর দেখতে চান তার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। বিস্ময় প্রকাশ করে বলতে পারি, এরকম মেয়রের গাড়ি যেন বাঙালি জাতির দুয়ারে দুয়ারে কড়া নাড়ে। এবার আসা যাক ‘কাকতাড়–য়া’ উপন্যাসের কথায়। মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মিতে লেখা এই গ্রন্থে লেখক সেলিনা হোসেন বুধা চরিত্রের মাধ্যমে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার জীবনযুদ্ধ বর্ণনা করেছেন। ছেলেটির কাকতাড়–য়া সাজার অভ্যাস। অনেক কিছু বুঝেও না-বুঝার ভান করে কৌশলে তার যৌক্তিক কর্মটি সম্পাদন করে। একই সাথে মা-বাবা ও চার ভাইবোন কলেরায় মারা যাওয়ায় বুধার কষ্টের শেষ নেই। থাকা-খাওয়ার ঠিক নেই। এই অবস্থায় বাড়ন্ত ছেলেটি অবশেষে পাকিস্তান সৈন্যদের বাঙ্কারে মাইন পেতে আসে। এটা কত বড় দুঃসাহসের কাজ তা বুঝতে পারবে তারাই যারা যুদ্ধকালীন সময়ে এমন দুঃসাধ্য কাজটি করতে পেরেছে। কাহিনীর ইতি টানা হয়েছে এভাবে ‘চারদিকের মাঠ, বাড়ি, ধানক্ষেত, নদী, আকাশ, গাছগাছালি জুড়ে ছেলেটি এক আশ্চর্য বীর কাকতাড়–য়া। রুখে দিচ্ছে শত্রু র গতি। বুকের ভেতর ধরে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধ।’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখতে পাই সেলিনা হোসেনের লেখায়। শিশুদের জন্য তাঁর অধিকাংশ লেখাতেই মুক্তিযুদ্ধ ঘুরেফিরে এসেছে। তিনি হয়তো একটি শিশুর মধ্যে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করিয়েই শিশুটিকে বড় হতে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন প্রতিটি লেখায়। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সেলিনা হোসেনের ‘বর্ণমালার গল্প’ বইটি অসাধারণ মনে হয়েছে। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সবক’টি বর্ণ দিয়ে প্রতিটি গল্প সাজানো হয়েছে। অহিউল্লাহ থেকে শুরু করে জয়নুল, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, সূর্যসেন এরকম খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নিয়ে স্বল্প পরিসরে গল্প লিখেছেন। বাদ যায়নি পশু-পাখির কথাও। প্রতিটি গল্পে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। একটি বর্ণ থেকে একটি গল্প পড়ে শিশুরা আনন্দ পাবে, পাশাপাশি জানার পরিধিটাও বৃদ্ধি পাবে। গল্প পড়ে মনে হবে খুবই সহজ ব্যাপার। কিন্তু সেলিনা হোসেন এসব গল্প লিখতে আলাদা কৌশল অবলম্বন করেছেন। এরকম দক্ষতা একজন শিশুসাহিত্যিকের জন্য জরুরি যা সেলিনা হোসেনের মধ্যে পুরোটাই বিদ্যমান। সেলিনা হোসেনের লেখা ছোটদের জন্য কিছু ছোটগল্প পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃতভাবে ‘অপেক্ষা’ গল্পটি খুব ভালো লেগেছে। রুমা আর রুবা মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে হারায়। পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা কোনো কোনো রাতে ওদের বাড়িতে আসে। ভাত খেয়ে যায় অথবা বিশ্রাম নিয়ে যায়। দুবোন অপেক্ষা করে আবার কোনো মুক্তিযোদ্ধা এসে ডাক দেবে বলে। ‘রক্তে ভেজা একুশ’ গল্পে অহির করুণ মৃত্যু ভাবিয়ে তোলে। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাওয়ার অপরাধে বাঙালির কত ক্ষতি হয়েছে তারই একটি চিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে। গল্পের শেষে লেখক একটি কল্পনার জগতে নিয়ে যেতে পেরেছেন। মৃত অহির প্রশ্ন শুনে অবাক হতে হয়। ‘আমার মা কেমন আছে বুলুদা? তোর আর এখন কোনো মা নেই। তুই এখন সব মায়ের ছেলে।’ দেশ বা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিলে সে প্রাণ সর্বজনীন হয়ে যায় এটা তার প্রমাণ। ‘ইলিশ’ গল্পে জাটকা নিধন প্রসঙ্গে একটি শিশুর মাধ্যমে জ্ঞানদান করেছেন লেখক যে, সবাই যেন জাটকা না ধরার আইন মানে। ‘কাঁঠাল’ গল্পটি দিয়ে কাঁঠাল ও কাঁঠালগাছ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ উঠে এসেছে এই গল্পে। কাঁঠালের আদি নিবাস পর্যন্ত বলা হয়েছে। ছোট্ট লারা কাঠবিড়ালির সাথে গল্প করতে করতে কাঁঠাল সম্পর্কে অনেক তথ্য দিতে পেরেছে পাঠককে। একইভাবে ঋষি-ঋতুর যুদ্ধ, শৈশব, কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি গল্পগুলো সুখপাঠ্য এবং শিশুদের মনে কখনো আনন্দদান করবে আবার কখনো দাগ কেটে থাকবে। অন্যরকম যাওয়া, আকাশপরী, যখন বৃষ্টি নামে, এক রূপোলী নদী, চাঁদের বুুড়ির পান্তা ইলিশ ইত্যাদি উপন্যাসগুলো সুখপাঠ্য ও সমৃদ্ধ। আলাদাভাবে ব্যাখ্যা না দিয়ে একটি কথাই বলতে পারি, এগুলো পড়ে আমি মুগ্ধ। একটি ব্যতিক্রম লেখা স্মৃতিচারণমূলক বলা যায় ‘আমার স্কুল’। সেলিনা হোসেন বগুড়ার লতিফপুর প্রাইমারি স্কুল নিয়ে অসাধারণ স্মৃতিচারণ করেছেন। আনন্দ আর দুঃখের মিশেল দেয়া লেখাটি পড়ে সকল পাঠকেরই মনে হবে তারও জীবনে এমন একটি স্কুল আছে। মূলত সকলেরই এমন স্কুল থাকে তবে অনেকেই এভাবে সাজিয়ে লিখতে পারে না। স্কুলের সঙ্গে কীভাবে বন্ধুত্ব হয়, কীভাবে পাতার উৎসব হয়, কীভাবে দপ্তরির ঘণ্টা বাজানো হয়, কীভাবে বন্ধুদের সাথে মনোমালিন্য ও ভাব হয়, হেডস্যার কেমন হয় ইত্যাদি বিষয় এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন, পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে যেন আমি এই স্কুলের ছাত্র। শিশুর কল্পনাজগৎ ও মনোজগৎকে ভরিয়ে তুলতে এবং শিশুদের মেধা বিকাশে সহায়তা করতে সেলিনা হোসেনের কলম শিশুবান্ধব হয়ে ওঠে। তাঁর লেখায় মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, ভাষাপ্রেম তো থাকেই, প্রকৃতিপ্রেমেও যে তিনি কতটা মুগ্ধতা ছড়ান তা বলে শেষ করা যাবে না। তা বুঝতে ‘আকাশপরী’ উপন্যাসের কয়েকটি বাক্য এখানে তুলে ধরা হলো, ‘মা ক্ষণিকের জন্য উৎফুল্ল হয়। উৎফুল্ল হয়ে নিজের শোবার ঘরের দরজা খুলে দাঁড়ায়। বর্ষায় আতা গাছটা দারুণ সবুজ হয়েছে। গাছভর্তি পাতা। শীতকালে এইসব পাতা ঝরে যায়। বসন্তে আবার গজায়। এইসব চেনা দৃশ্যে মা টুনটুনিটাকে খুঁজতে থাকে। নেই। ওটা এই মুহূর্তে নেই। মায়ের মনে হয় ওটা কি তাহলে মেঘপরী হয়ে গেল? তাই হবে। কখনো মানুষ পরী হযে যায়, কখনো পাখি, কখনো গাছ। আতা গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়ের মনে হয় প্রতিটি পাতা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মা বিড়বিড় করে বলে, তোমার এত চোখ কেন মেঘপরী? কেন এমন করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকো?’ সেলিনা হোসেনের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডার অনেক বিশাল, ব্যাপক ও বৈচিত্র্যময়। সবগুলো লেখার উদাহরণ এই ছোট্ট পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়। এককথায় বলতে পারি তিনি শিশুদের জন্য যা লিখছেন তা সংখ্যায় যেমন ঢের, তেমনি পরিশীলিত, পরিমার্জিত এবং শিশুদের উপযোগী তো বটেই। এবং সে কারণে তিনি বড় মাপের একজন শিশুসাহিত্যিক। পূর্বেই উল্লেখ করেছি সেলিনা হোসেন অনেক পরে এসে শিশুদের জন্য লেখা শুরু করেছেন। না হলে আমরা তাঁর কাছ থেকে আরো বেশি সংখ্যক শিশুপাঠ্য বই পেতাম। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘ছোটদের জন্য আমি লিখতে পারবো, এমন ভরসা আমার ছিল না, সাহসও না। সেজন্য চেষ্টাও করিনি আমার লেখালেখি জীবনের দীর্ঘ সময়ে। কাজটি ভীষণ কঠিন, এই ধারণায় আমি ভীত ছিলাম।’ কথাটি সঠিক, ছোটদের জন্য লেখা ভীষণ কঠিন। কিন্তু এই কথাটি যিনি ভাবতে পারেন তিনি অবশ্যই ছোটদের লেখায় সিদ্ধহস্ত হবেন সন্দেহ নেই। কঠিন ভাবা মানেই কাজটি সহজ করার উপায় তাঁকে খুঁজে বের করা। সেলিনা আপা কঠিন কাজটিতে হাত দিয়ে সফল হয়েছেন তার প্রমাণ পুরস্কার ও প্রশংসার ঝুড়ি দেখলেই বুঝা যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App