×

সাময়িকী

রামু ট্র্যাজেডি ও মানবতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০১৯, ০৩:৩৭ পিএম

রামু ট্র্যাজেডি ও মানবতা
শামসুল আরেফীনের ‘রুবাইয়াত-ই-আরেফীন’ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে, চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন থেকে। এ কাব্যে রামু ট্র্যাজেডি ও মানবতা নিয়ে কিছু রুবাই অন্তর্ভুক্ত। ২৯ সেপ্টেম্বর রামু ট্র্যাজেডি দিবস। ২০১২ সালের এই দিনে, শুভ মধু পূর্ণিমার পূর্বের রাতে বৌদ্ধ ধর্ম, বৌদ্ধ সম্প্রদায়, তাদের পরিবার ও প্যাগোডার ওপর মুখচেনা ধর্মান্ধ মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসীরা ভয়াবহ আঘাত হানে। তখন কক্সবাজারের উখিয়া, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার লাখেরা ও কোলাগাঁও এলাকাতেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও প্যাগোডা নানা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রামুতে ৪০টিরও অধিক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বৌদ্ধবিহার, প্যাগোডা ও স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা হয়। স্বর্ণ-রৌপ্যের বুদ্ধমূর্তি, অর্থ ও নানা মূল্যবান সামগ্রী বৌদ্ধবিহার, প্যাগোডা ও বসতবাড়িসমূহ থেকে লুট করা হয়। সেই রাতে হাজার হাজার বৌদ্ধ নর-নারী-শিশুর আহাজারি-আর্তনাদেও সন্ত্রাসীদের মন গলেনি। রামুতে এই সহিংসতায় যে ক্ষতি হয়, তা সাধারণ ক্ষতি ছিল না। শত শত বছরের মধ্যে এ দেশে এমন সহিংসতার দৃষ্টান্ত আর নেই। রামুকে জানতাম, সাহিত্য-ইতিহাস-ঐতিহ্য-স্থাপনার ধারক-বাহক ও উর্বর ভ‚মি হিসেবে। নিকট-অতীতে এখানে অনেক জমিদার ছিলেন, যাঁরা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এরকম এক জমিদারের কথা বলি, নাম আলী হোসেন চৌধুরী। ‘রামু থানার মিঠাসরাই নামক গাঁয়ে এক জমিদার বংশে আলী হোসেন চৌধুরী ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কালাচাঁদ চৌধুরী নামেও পরিচিত। তিনি বিদ্যোৎসাহী ও রসজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। কবি সাহিত্যিকের পৃষ্ঠপোষকতায় যে ঐতিহ্য মুসলমান রাজা বাদশাহরা সৃষ্টি করেছিলেন আলী হোসেন চৌধুরী তা-ই অনুসরণ করেন। তিনি চারজন কবির পৃষ্ঠপোষকতা করেন।... (তাঁর) আশ্রিত কবি চারজনের নাম কবি তমিজী, কবি হাজি আলী, ফকির আসকর আলী ও লোকমান আলী’ [বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান/শাহেদ আলী]। বাংলা সাহিত্যে ও ইতিহাসে রামুকে পাওয়া যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনপদরূপে। মধ্যযুগের কবি নসরুল্লা খাঁ তাঁর ‘জঙ্গনামা’ পুঁথিতে রামুর অনেক কথা বলেন। অংশবিশেষ: রাম্ভুদেশ নরপতি নামে ফতে খান। যারে মান্য করি বসাইল বিদ্যমান\ রোসাঙ্গের নরপতি ভুবন বিখ্যাত। যেবা গিছিলেন দিল্লীশ্বরের সাক্ষাৎ\ গ্রামভ‚মি আপনার অধীন করিয়া। আনিলেক দিল্লীশ্বর ব্যুহে যেবা গিয়া\ হেনজনে যাহাকে করিয়া আগুয়ান। নামাজ করন্ত সঙ্গে যত মুসলমান\ ঐতিহ্য ও স্থাপনাকে কেন্দ্র করে প্রাচীন বাংলার সুনাম ছিল। ফলে এখানে ব্রিটিশ, ওলন্দাজ, আমেরিকান, চৈনিক, তুর্কি ও পর্তুগিজ পরিব্রাজকদের আগমন ঘটে। চৈনিক পরিব্রাজকদের মধ্যে ইৎ সিং, হিউয়েন সাং, ফা হিয়েন উল্লেখযোগ্য। তাঁরা রামুতেও আসেন বলে ধারণা করা যায়। সাদাচিং, লালচিং কাঠ দ্বারা নির্মিত রামুর সীমা বিহারের মতো আর একটিও বিহার এ দেশে পাওয়া যাবে না। রামুর লামাপাড়ার বৌদ্ধবিহার বিশ্বমানের ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, এক রাতেই সব শেষ! উল্লেখবাহুল্য, রামুর সহিংসতার পরে একে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে অনেক সংবাদ প্রচারিত হয়। এমনকি রচিত হয় অনেক গল্প-কবিতাও। অনাগত দিনে সহিংসতার সম্যক ইতিবৃত্ত জানার জন্য এসব গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে। এ লেখার শুরুতেই বলেছি, রামু ট্র্যাজেডি ও মানবতা নিয়ে কিছু রুবাই শামসুল আরেফীনের ‘রুবাইয়াত-ই-আরেফীন’ কাব্যে অন্তর্ভুক্ত। মূলত সহিংসতার পর পর রুবাইগুলো রচিত হয়। কাব্যটিতে শুধু রামু ট্র্যাজেডি নয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট থেকে শুরু করে সমকালীন দেশীয় ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতার অনেক কিছুও স্থান পেয়েছে। কাব্যটির এক আলোচনায় বলা হয় : “রুবাইগুলোতে আমাদের স্বাধিকার অর্জনের সময় থেকে শুরু করে সমকালীন দেশীয় ও বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মানবিক মূল্যবোধের সংকটের কথা উঠে এসেছে। যা লোকজ উপাদান ও উপকরণের সাথে দেশীয় ও বৈশ্বিক মেজাজ সুচারুভাবে যুক্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে শামসুল আরেফীনের রুবাইগুলো প্রচলিত রুবাইয়ের ভাষা থেকে বেরিয়ে এসে নবনির্মিতি লাভ করেছে। এইখানে শামসুল আরেফীনের সাথে সেন্ট লুইস দ্বীপের কবি ডেরেক ওয়ালকটের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ১৯৯০ সালে ডেরেক ওয়ালকটের মহাকাব্য ‘ঙগঊজঙঝ’ প্রকাশিত হয়। দুবছর পর ১৯৯২ সালে কাব্যগ্রন্থটির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। গ্রন্থটিতে তিনি প্রধান চরিত্রগুলো গ্রহণ করেন মহাকবি হোমারের মহাকাব্য থেকে। কিন্তু তিনি উপাদান, উপকরণ, ইতিহাস, মিথ, ঐতিহ্য, পুরাণ, লোককাহিনী ইত্যাদি নিয়েছেন তাঁর জন্মদ্বীপ থেকে, সমকালীন ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা করে। বিশ্বের পাঠকরা নতুন একটি মহাকাব্য পড়ে আশ্চর্য ও বিস্মিত হয়। ওয়ালকট তাঁর দেশীয় উপকরণ দিয়ে রচিত কাব্যগ্রন্থটির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যান! অনুরূপভাবে শামসুল আরেফীনও ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন নিজেদের বিষয়-আশয়কে সমকালীন প্রেক্ষাপটে আত্মস্থ করে রুবাইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করে। ‘ঙগঊজঙঝ’ পাঠ করে পাঠক ডবংঃ ওহফরধহ জনজীবনের কালচার ও বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা লাভ করতে পারে। আরেফীনের রুবাইয়ে আমাদের লোক-সংস্কৃতির নানাদিক উন্মোচিত হলো এবং প্রাণের সঞ্চার করলো নবশক্তিতে” [শামসুল আরেফীনের রুবাই : উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনায় বহমান/শাহিদ হাসান; শাঁখ; আগস্ট ২০১৪; পৃষ্ঠা ৬৪]। শূন্য দশকের প্রারম্ভে শামসুল আরেফীনের রুবাই রচনা শুরু। খৈয়াম এবং হাফিজের রুবাই পাঠে মুগ্ধ হয়ে, বিশেষ করে নজরুল কর্তৃক তাঁদের রুবাইয়ের অনুবাদে প্রভাবিত হয়ে তখন আরেফীন শতাধিক রুবাই রচনা করেন। তবে এ সময়ে হঠাৎ তাঁর মনে হয় : ‘খৈয়াম-হাফিজের অনুসরণ-অনুকরণে আরও অনেকে রুবাই রচনা করেছেন। এখন এ ধরনের রুবাই রচনা করার কোনো মানে নেই। রাজকীয় ও মোঘলীয় চিন্তা-চেতনা-আনন্দ-বেদনা-বিরহ, শরাব, শাকি, স্তুতি, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি পরিহার করে নতুন বিষয়ে রুবাই রচনা করা দরকার। যা একসময়ে পঠিত হতো রাজদরবারে রাজার সামনে, সেই রুবাইয়ে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে তাকে জনগণের সামনে আনা জরুরি। এভাবে রুবাইয়ের ইতিহাসও পরিবর্তন সম্ভব।’ এমনটি মনে হওয়ায় রচিত শতাধিক রুবাই বাতিল করে আবার নতুন করে রুবাই রচনা শুরু করেন আরেফীন। বাংলার ইতিহাস, মিথ, পুরাণ, লোককাহিনী ও লোকঐতিহ্য-এর ভেতর দিয়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি রচনা করেন অনেক রুবাই। ‘রুবাইয়াত-ই-আরেফীন’ কাব্য প্রকাশিত হয় বাছাইকৃত ২৫৯টি রুবাই নিয়ে। এখানে তিনটি পর্ব ‘রক্তঝরার কাল এসেছে’, ‘সোনাই বিবির সোনার দেশে’ এবং ‘মন তো আমার কৃষিভূমি’। রামু ট্র্যাজেডি ও মানবতা নিয়ে রুবাইগুলো ‘রক্তঝরার কাল এসেছে’ পর্বে। বলেছি, কেবল রামু ট্র্যাজেডি ও মানবতা নয়, সমকালীন দেশীয় ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতার অনেক কিছুও ‘রুবাইয়াত-ই-আরেফীন’ কাব্যে স্থান পেয়েছে। বস্তুত রুবাইয়ের পুরনো ঘরানা ও ইতিহাস পরিবর্তন করতে এসব বিষয়ের উপস্থাপনা অপরিহার্য ছিল। রামু ট্র্যাজেডি ও মানবতাভিত্তিক রুবাইগুলো : ১. রাচিদঙের গজারিরা মারীচ হয়ে মারছে পাখি; তিনশত ষাট অলির বনের গজারিদের দোষটা বা কী? দেখতে হলো, এখানটাতে ওদের ’পরে চললো তবু... অপমানে আর বেদনে সিক্ত হলো আমার আঁখি। ২. রক্তঝরার কাল এসেছে খুটাখালির কাঁটাবনে, জান বাঁচাতে মল্লাকুড়া কাঁদছে আহা ক্ষণে ক্ষণে। আসো নকুল-অর্জুনেরা চিতাবাঘের ছন্না ধরে, শিকারিদের বিনাশ করো লিপ্ত হয়ে মস্ত রণে। ওদের তুমি দাও না তবে নিমতলারই নিমের তিতা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App