×

সাময়িকী

যাপিত জীবন : মুদ্রিত কালের আখ্যান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০১৯, ০৪:২৬ পিএম

যাপিত জীবন : মুদ্রিত কালের আখ্যান
ব্যক্তি, ভূখণ্ড এবং ভাষা যাপিত জীবন উপন্যাসের প্রধান বিষয়। যদিও কাহিনীর পটভ‚মিতে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ (১৯৭৪) সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম মুখর উত্তাল সময়টি উঠে এসেছে চমৎকারভাবে। সোহরাব আলীর তিন পুত্র-মারুফ, জাফর, দীপু এবং স্ত্রী আফসানা খাতুনকে কেন্দ্র করে মূল কাহিনী আবর্তিত। তবে ঘটনা কেন্দ্রে প্রাধান্য লাভ করেছে সোহরাব আলীর দ্বিতীয় পুত্র জাফরের সঙ্গে সহপাঠী আঞ্জুমের প্রেম। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলে অংশগ্রহণ করা ও পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়া জাফরের চরিত্র। দেশ বিভাগের পর সোহরাব আলীর পরিবার ভারতের বহরমপুরের বাড়ি একচেঞ্জ করে ঢাকার বংশাল রোডে এক বাগান বাড়িতে উঠে আসে। বন্ধু দীপনের সহযোগিতায় বাড়ি বিনিময়ের কাজটি সহজে হয়ে যায়। সোহরাব আলী বহরমপুরে একটা স্কুলের বোটানির শিক্ষক হিসেবে কাজ করলেও ঢাকায় এসে তিনি আয়ুর্বেদ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। ছেলে মারুফ একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নেন। বহরমপুরে মারুফের প্রেম ছিল একটা হিন্দু মেয়ের সঙ্গে। মারুফ কিছুতেই বহরমপুরের স্মৃতি ভুলতে পারে না। ছোট ছেলে দীপু আরমানিটোলা স্কুলে ভর্তি হয়। মেজ ছেলে জাফর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি সে প্রগতিশীল রাজনীতি-সংস্কৃতিতে যোগ দেয়। সহপাঠী আঞ্জুমের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা-সংগ্রামের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ একটি পুস্তিকা জাফর এবং আঞ্জুমকে প্রেরণা জোগায়। দেশত্যাগের যন্ত্রণা জাফরের মধ্যে উন্মূলিত বৃক্ষের মতো কাজ করে। জাফর মাতৃভাষা আর মাতৃভ‚মির প্রেমে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হয়। আন্দোলনের পথে তার সঙ্গী হয় আঞ্জুম। দুজনের চলার পথ একই সরল রেখায় এসে মিশে চমৎকার এক রোমান্টিক মুহূর্ত তৈরি করে। সেলিনা হোসেন অসাধারণ দক্ষতায় ভাষা আন্দোলনের এই প্রেক্ষাপটে উপন্যাসের জাফর চরিত্রকে তুলে ধরেছেন। সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং পরবর্তীতে গড়ে ওঠা ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল চিত্র কাহিনীতে উঠে আসে। যেমন আবুল হাশিম, কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অজিত গুহ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখকে আমরা উপন্যাসের বাস্তবতায় প্রত্যক্ষ করি। উপন্যাসের মূল চরিত্র জাফরের সঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সরাসরি কথপোকথন হয় ‘পরদিন প্রশান্তর সঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাসায় যায় জাফর। তাঁকে প্রণাম করে। তিনি মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। বলেন, প্রশান্তর কাছে তোমার কথা শুনেছি। আমি জেনে খুশি যে, মায়ের ভাষার মর্যাদার জন্য তোমরা লড়াই করছ। আমাদের তো তা করতে হবে কাকু। আপনি গণপরিষদে দাঁড়িয়ে করেছেন। আমরা রাজ পথে করবো।’ ভাষা আন্দোলনের এক সভায় অন্য বক্তারা বক্তৃতা দিচ্ছেন। সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সেলিনা হোসেন নিপুণ দক্ষতা সে সভাকে কাহিনীর মধ্যে দৃশ্যমান করে তুলেছেন এভাবে ‘একটুক্ষণ পরেই সভাপতির ভাষণ দিতে ওঠেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। জাতীয় সাহিত্য, হরফ সমস্যা, শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি বলেন। এমনকি উর্দু শিক্ষার ওপরও জোর দেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা শ্রোতারা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। ঘরে পিনপতনের নিস্তব্ধতা। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমরা হিন্দু ও মুসলমান যেমন সত্য, তারচেয়েও বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। যা প্রকৃতি নিজ হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ মিছিল, মিটিং, হরতাল, পিকেটিং সব কাজেই জাফর এবং আঞ্জুম একসঙ্গে চলে। জাফর একদিন আঞ্জুমকে বলে, ‘তুমি আমার ভেতর সাংঘাতিক বোধ ঢুকিয়ে দিয়েছ, যাতে দেশ, জাতি, ভাষা সংস্কৃতি সবকিছুর মধ্যে আমি আমার ভালোবাসা প্রসারিত করতে পারি। জানো আঞ্জুম, প্রয়োজন হলে আমি ভাষার জন্য প্রাণও দেবো।’ বায়ন্নর একুশে ফেব্রুয়ারি তারা দুজন একসঙ্গে মিছিলে হাঁটার কথা ছিল, কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ হয় না। ছাত্রীরা আলাদা, ছাত্ররা আলাদা হয়ে দশজন করে নির্দেশ মতো ১৪৪ ধারা ভেঙে বের হতে গিয়ে আঞ্জুম আলাদা হয়ে যায়। প্রথমে ছাত্রীদের দশজনের দলে আঞ্জুম বের হলে পুলিশ তাদের গ্রপ্তার করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। উপন্যাসের ভাষায় ‘জাফর আঞ্জুমের কাছে আসে। তোমার সঙ্গে আমার হাঁটা হলো না আঞ্জুম। মেয়েদের যে দশজন মিছিলে বেরুচ্ছে তুমি তার সঙ্গে যাও।... মেয়েদের প্রথম মিছিল গ্রেপ্তারি বরণ করেছে। আঞ্জুম চলে গেছে ট্রাকে করে। জাফরকে রেখেই ওকে যেতে হয়েছে। গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছিল ও। জাফর শুধু অবাক হয়ে দেখছে যে আঞ্জুমের চেহারায় ওর প্রিয় স্বদেশ। যেখানে শ্যামল ছায়ার সঙ্গে বারুদের মাখামাখি। টিয়ার গ্যাসের যন্ত্রণায় অস্থির হয়েও জাফর মনে মনে বলে, তোমার জন্য আমার সব ভালোবাসা আঞ্জুম।’ ব্যক্তি প্রেম আর ভাষা প্রেম, আন্দোলনের অগ্নিময় মুহূর্ত যাপিত জীবন উপন্যাসের কাহিনীকে ভিন্ন এক শিল্পমাত্রা দিয়েছে। জেলখানায় মেরিনা ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে, আঞ্জুম, শুনেছিস? মিছিলে গুলি হয়েছে। চমক ভাঙে আঞ্জুমের, গুলি? তারপর পারিপার্শ্বিকতা ভুলে তারা জেলখানার ভেতরেই স্লোগান দেয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। যাপিত জীবন উপন্যাসে সমাপ্তিতে দেখা যায়, ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলির প্রতিবাদে পুরো দেশ যেন বিস্ফোরণের মতো জ্বলে ওঠে। শহীদের লাশের মিছিলে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। শহীদ জাফরের রক্তমাখা জামাকাপড় পতাকার মতো শোভা পাচ্ছে মিছিলে। জাফরের প্রেমিকা আঞ্জুমের ভাবনায় জেগে ওঠে বিস্ময়কর চেতনা ‘ও জানে, যে বিন্দুতে মিছিলের শুরু, সে বিন্দুতেই জাফরের অবস্থান। ও বিড়বিড় করে বলে, তোমাকে আমি কিছুতেই মরতে দেব না মিছিল। আমি কোনোদিন মা হলে সে সন্তানের নাম রাখবো জাফর।’ আঞ্জুমের এই উপলব্ধি এই ভাবনা-বেদনাতে মাতৃভাষা আর মাতৃভ‚মি একাকার হয়ে যায়। যে চেতনা সঞ্চারিত হয় প্রতিটি বাঙালির দেহে এবং ধমনিতে। প্রতিবাদ প্রতিরোধের বহ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের শরীরে। কারণ, এর নেপথ্যে রয়েছে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু মানুষের শেকড়-ছেঁড়া যন্ত্রণা। উত্তরকালে যা মতৃভাষা প্রেম থেকে মাতৃভূমি প্রেমে রূপান্তরিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় রূপ লাভ করে। বাঙালি সংঘবদ্ধ শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং স্বাধীনতা লাভ করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App