×

সাময়িকী

নদীর ডাকঘর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০১৯, ০৩:৫০ পিএম

নদীর ডাকঘর
জায়গাটি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার দৌলতপুর। এর আগে আলিম এখানে আসেনি। তবে এবারের আসাটা অন্যরকম। সেহরি খেয়েই রওয়ানা দিতে হয়েছে। যদিও রাত সাড়ে এগারটার দিকে প্রথম টিভিতে লঞ্চ ডুবার খবর শুনে আলিম। সাধারণত এই ধরনের খবর সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিকরাই কভার করে। কিন্তু আজ সেহরির সময়ই নিউজ এডিটর শাখাওয়াৎ ভাইয়ের ফোন। এত রাতে ফোন আসতেই আলিমের মা লুৎফা খাতুনের কপাল খানিকটা কুঁচকে গেল ভয়ে। এত রাতে আবার কে ফোন করলো কী সংবাদ দিতে? -আলিম, সেহরি খাওয়া কী শেষ করছো ভাই? -না, শাখাওয়াৎ ভাই, এইতো এক্ষুনি খেতে বসবো। কেন? -তোমাকে একটু মুন্সীগঞ্জ যেতে হবে, লঞ্চডুবির খবরতো পেয়েছো? -জি ভাই। ওখানে তো জোবায়ের আছে। আমি এখন যা-বো? -তাতো আছেই। কিন্তু অনেক মানুষ নিখোঁজ। আর সম্ভবত নতুন বর-কনেসহ বিয়ে বাড়ির লোকজনও ছিল। -ঠিক আছে ভাই। আমি সেহরি খেয়েই রওয়ানা দিচ্ছি। পৌঁছে আপনাকে জানাবো। লুৎফা বেগম রুই মাছ দিয়ে বেগুন আলুর তরকারি গরম করছিলেন সেহরিতে খাবার জন্য। অন্য চুলায় জ্বাল দিচ্ছেন দুধ। কিন্তু সব ছাপিয়ে কান যেন টেলিফোনের দিকেই খাড়া ছিল। এই বাড়িতে তিনি আর তার ছেলে থাকেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, তাও হয়েছে পাঁচ-সাত বছর। আগে তিনি আর আলিমের বাবা নড়াইলে তাদের বাড়িতেই থাকতেন। দুই বছর আগে স্বামী মারা যাবার পর ঢাকায় ছেলের কাছেই পাকাপাকি চলে এসেছেন। এখন মা আর ছেলে এই দুজনেই এই বাড়িতে। খুব ইচ্ছে ছেলেকে শিগগিরই বিয়ে দেবার। কিন্তু এত রাতে কে ফোন করলো? কার আবার কী হলো? -অফিস থেকে ফোন মা। মুন্সীগঞ্জ যেতে হবে। লুৎফা বেগমের উদ্বিগ্ন কানকেই লক্ষ্য করেই যেন আলিম বললো কথাটা। -এখন? রাতে, সকাল যাস। -সকালে ভিড় বেড়ে যাবে, এইতো খয়েদেয়েই রওয়ানা দেব। লঞ্চ ডুবে গেছে। অনেক মানুষ মারা গেছে মা। মুখে সহানুভ‚তি দেখালেও কেন যেন খুব রাগ হলো আলিমের। কিছুতেই বের হতে ইচ্ছে করছে না। কোথায় ভাবলো সেহরি খেয়ে ঘুমাবে। তা আর হচ্ছে কই? আর তা ছাড়া কেন যেন মৃত্যুর রিপোর্ট করতে তার ভালো লাগে না। এক একটা লাশ, তারসঙ্গে স্বজনদের আহাজারি-মন কেমন যেন লাগে। তা ছাড়া তথ্যও ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। মৃত মানুষের পরিচয়, তার বাড়িঘর সব জানতে হয়। মত্যুর রিপোর্ট লিখতে গেলে কলম আগায়না। আলিম জানে কথা বাড়িয়েও লাভ হতো না। শাখাওয়াৎ ভাই যেহেতু যেতে বলছেন তার মানে ওখানকার স্থানীয় সংবাদদাতা জোবায়ের সহযোগিতা চেয়েছেন। মুখ কালো করেই আলিম ড্রইং রুমে গিয়ে টিভিটা অন করলো। সরাসরি দেখাচ্ছে লঞ্চডুবির ঘটনাটি। এ পর্যন্ত উদ্ধর হয়েছে বত্রিশটা লাশ। নিখোঁজ অনেক আছেন এখনো। টিভিতে এসব দেখে এবং তখনই বের হওয়ার তাড়ায় সেহরিতে ঠিকমতো খেতে ইচ্ছে করলো না আলিমের। মার জোরাজুরিতে একটু দুধ ভাত খেল। তারপর তার চির বন্ধু মোটর সাইকেল চেপে ছুটলো। কিছুটা আসার পর মনে হলো ভুল করে শাখাওয়াৎ ভাই থেকে জোবায়েরের মোবাইল নম্বরটা নেয়া হয়নি। সে যাই হোক, সেখানে নিশ্চয়ই ওকে খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না। এতক্ষণ থানায় ছিলেন। জোবায়েরও সঙ্গে ছিল। বেশ হালকা-পাতলা গড়নের কম বয়সী জোবায়ের মনে হয় কমই কথা বলে। স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে বছর দুয়েক আগে। এর আগে দুবার পত্রিকা অফিসেই দেখা হয়েছিল আলিমের সাথে, পরিচয় হয়েছিল কেবল। তবে এখানে আসার পর জোবায়েরকে দেখেই চিনলো। জোবায়ের তখন পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিল। তাকে দেখা মাত্রই জোবায়ের পুলিশের সাথে কথা বলায় কিছুটা লাগাম টেনে তার সঙ্গে হাত মেলালো। আলিমকে পুলিশের সাথে পরিচয় করে দিয়ে মনে হলো জোবায়ের কেমন যেন ভারমুক্ত হলো। থানাভর্তি মানুষ। এমনি প্রচণ্ড গরম। মানুষের আনাগোনা আর মৃত্যুর কাতরতায় গরম আরো দমবন্ধ হয়ে যাওয়া পরিবেশ। কিন্তু কারোরই যেন কিছু মনে হচ্ছে না। সবাই যে মৃতদের আত্মীয়-পরিজন তা নয়, কিন্তু কেমন যেন আত্মীয় চেহারায় ঘুরছেন। আসলে এই ধরনের ঘটনায় হয়তো সবাই সবাইক আপনজন ভাবে। সবাই সহযোগিতা করতে চায়। যে লাশগুলা পাওয়া গেছে সেগুলোর পরিচয় শনাক্তকরণ চলছে। এর মধ্যে আটজন শিশু। তাদের পরনে ঝলমলে পোশাক। তার মধ্যে আট/দশ বছেরের গোলগাল চেহারার একটি মেয়ের মাথায় এখনো কি একটা লাগানো আছে মুকুটের মতো দেখতে। গলায় তখনো ঝুলছিল মুক্তার মতো দেখতে সাদা পুঁতির মালা। আহা মনে হচ্ছে এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এখনই কাবুলিওয়ালার মিনি চরিত্রে অভিনয় করবে। মুখকে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে, চোখকে এদিক-ওদিক বাঁকিয়ে এখনই কিছু একটা আবদার করবে। নিশ্চয়ই ওর বাবা-মাও ছিলেন সাথে। মনে পড়লো আলিমের, শাখাওয়াৎ ভাই আগেই বলেছিলেন যে লঞ্চে নতুন বর-কনেসহ বরযাত্রী ছিলেন। হয়তো এই মেয়েটিও বরযাত্রীই ছিল। আলিমের এখানে এসে পৌঁছানোর পরও পেরিয়েছে প্রায় চার ঘণ্টা। উদ্ধার কাজ এখনো চলছে। এখন পর্যন্ত লাশ জমেছে পঞ্চান্নটি। যে দিকটাতে লঞ্চটা ডুবেছে, সেই দিকে একটা খাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন আলিম। লোকজন, পুলিশ, সাংবাদিকরাও এদিক-ওদিক ছুটছেন। কোনো কোনো ঘটনায় ঠায় দিয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, খোঁজ নিতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে সাংবাদিকতার পেশা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়। পাশেই একটা চায়ের দোকান। তবে রোজা বলে মনে হয় বন্ধ। একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় আলিম। কিছুটা ক্লান্ত লাগছে। রোজা না হলে এখনই চলে যেতেন ছোট্ট দোকানটিতে। একটা লাল চার সাথে চলতো সিগারেট। ঢাকার বাইরে ছোট ছোট টং-এর মতো দেখতে চায়ের দোকানগুলো তার খুব ভালো লাগে। হাতে সময় থাকলে আড্ডা দেয় স্থানীয় লোকদের সঙ্গে। তাদের থেকে স্থানীয় রাজনীতির খবর পায় অনেক। কিছুদিন আগেইতো এই রকম একটা টং-এর দোকানে বসেই সে গোপনীয় কিছু খবরের উপাদান পেল। কিন্তু আজকের দিনটি অন্যরকম। রোজা না হলেও তার এখন একটা সিগারেট ছাড়া কোনো কিছুতেই রুচি হতো না। কিন্তু রোজা হওয়াতে সিগারেটও খেতে পারছেন না। এর মধ্যে মা কয়েকবার ফোন করেছেন। কখন ঢাকায় ফিরছি জানতে চেয়েছেন। ঢাকায় পত্রিকা অফিসে কিছু সংবাদ পাঠিয়ে দিয়েছেন আলিম থানায় বসেই। তবে তিনটি লাশের এখনো পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। এর মধ্যে জোবায়েরেরই ফোন। -ভাই...(একটু থেমে), কোথায় আপনি? -কেন কী হয়েছে? - আরও লাশ ভেসে উঠতেছে। -তাতো ওঠার কথাই, এত মানুষ নিখোঁজ। - আজকে মনে হয় শেষে হবে না। -নিউজটা লেখা শেষ করলেন? একটু জোর দিয়েই বললো আলিম। -জ্বি, কিছুটা বাকি আছে। -কখন পাঠাবেন? দেরী হলেতো আজকে আর ধরাতে পারবেন না। - আমি লিখছি, আপনি যদি দেখে দিতেন একটু... - আমারতো এখানে দেখে দেয়ার কিছু নাই। আর আমিতো কোনো প্রশিক্ষণে আসি নাই। আমি বিশেষ কাহিনীগুলো করবো, আপনি নিয়মিত যা পাঠানোর সেটি পাঠান। জোবায়ের ঘণ্টাখানেক এদিক-ওদিক করে আবারও থানার দিকে পা বাড়ালো আলিম। ভাবছে জাবায়কে ফোন দেবে না। এখন এই ছেলেটাকে বিরক্তিকর লাগছে। জোবায়েরের ভাবখানা এমন যে তাকে ঢাকা থেকে ডেকে এনেছে তাই তিনি গায়ে হাওয়া দিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। তবে থানার গেটের কাছেই পৌঁছতেই জোবায়রকে দেখলো। ফোনে কার সাথে কথা বলছে। আলিমের দিকে একটু তাকালো, কিন্তু আবারো ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো জোবায়ের। আলিম ওর দিকে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে থানার ভিতর ঢুকে পড়লো। ওসির সাথে দেখা। -বুঝলেন সাংবাদিক ভাই, সব লাশেরইতো ঠিকানা পাইলাম, শুধু একজনেরটাই পাচ্ছি না। -নারী না পুরুষ? -নারী, ২৩/২৪ মনে হয় বয়স হবে। -অন্যদের আত্মীয় স্বজনের দেখাইছেন? -তাতো দেখাইলাম, কিন্তু কেউই চিনতেছে না। -কেন, অনেকটা সময় পেরিয়েছে তো, মনে হয় চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। লাশটা কী অনেক ফুলে গেছে? নাকি নীল হয়ে গেছে? -কিছুটা ফুলা, কিন্তু মুখ বিকৃত হয়নি। -অভিযান কী শেষ? এখনো কতজন নিখোঁজ আছে? -নিখোঁজতো আছেই, থাকবেই। তবে আজ রাতেই ঘোষণা হবে শেষের, রোজার মাস আর কত? -কিন্তু এই কাজটাও ঠিকভাবে করতে হবে, মানুষের মৃত্যু বলে কথা। -দেখতে চান মহিলার লাশ? -না, আমি দেখে আর কী হবে? আমিতো আর ওনার ঠিকানা জানি না। -ছবি তুলে ফেসবুকে দেন, যদি কারও পরিচিত হয়? -সেটাতো আপনারাও করতে পারেন। -ভালো কথা বলছেন। দেখি কী করা যায়। জোবায়ের ঢুকলো ওসির রুমে। তাকে এখন কিছুটা আয়েশী দেখাচ্ছে। আলিমের কথায় কিছু মনে করেছে কীনা কে জানে? তবে জোবায়ের একবারও আলিমের দিকে তাকাচ্ছে না। ওসির দিকে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে কেউ দেখলে মনে করবে দুজনের মাঝে কোনো পরিচয় নেই। আলিমও কিছু বলছে না। হঠাৎ করে জোবায়ের বলে বসলো -আলিম ভাই চলেন মেয়েটার একটা ছবি তুলি। -কোন মেয়ে? -ঐ যে যারে কেউ চিনতে পারতেছে না। ঠিকানা পায় নাই। -আরে উনিতো মেয়ে না, মহিলা (দারোগা) -ঐ এভাবে কী ছবি তোলা ঠিক হবে? আর তোমাদের এখানে ভালো ফটো সাংবাদিক আছে? -না, এই মোবাইলের ক্যামেরায় তুলবো আর কী? -ছবি তুলে আর কী হবে? পারলে ঠিকানা বাহির করেন। থানার মধ্যে আবারও কান্নার রোল পড়ে হঠাৎ। আত্মীয়স্বজনরা আসতেছে। মৃতদেহগুলো উল্টেপাল্টে দেখতেছে। নাক, মুখ চাপা দিচ্ছে কেউ কেউ। অনেকগুলো মৃতদেহ কিছুটা ফুলে উঠেছে। দুই-একজনের চেহারা কিছুটা কালচে নীল হয়ে গেছে। একজন বৃদ্ধাকে ধরে নিয়ে আসলেন তার দুই আত্মীয়। কিছুটা এগিয়ে গেল আলিম। -উনাকে আনছেন কেন এর মধ্যে? -কী করুম ভাই? ঘরে থাকতে চায় না, কয় আমারে আমার ছাওয়ালের কাছে নিয়া চল। -উনি বললেন আর আপনারা নিয়ে আসলেন? -না এনে উপায় কী, উনি বার বার মূর্ছা যাইতেছেন। আলিম সেই বয়স্কার দিকে তাকালো। বয়স তার মায়ের মতোই। চোখে চশমা। তবে শোকের কারণে কি-না তাকে তার মায়ের থেকে আরেকটু বয়স্ক দেখাচ্ছে। আলিম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেই মায়ের দিকে। ভাবছে তার যদি এমন কিছু হয় তার মাও হয়তো এই রকম পাগল হয়ে যাবেন। আলিম মায়ের একমাত্র ছেলে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে এই মহিলার কাছে, তার আর সন্তান আছে কীনা? পরক্ষণেই ভাবলো, থাকলেই বা কী? সব সন্তানেই তো বাবা-মার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারো জায়গা কী কেউ নিতে পারে? হয়তো এই সন্তানকে মা খুঁজবে সারা জীবন। উনাকে কী একটু পানি খেতে দিবেন কীনা আলিম ভাবলো। আবার ভাবলো এই রোজার সময় পানি খাবেন কীনা জিজ্ঞেস করলে কী মনে করেন আবার। মাথাটা টনটন করছে আলিমের। প্রচণ্ড গরম, মৃত্যু, কান্না, সবকিছু মিলেই মনে হয় মাথার এই গুমোট ভাব। অন্য সময় হলে একটা সিগারেট ধরাতেন। মনে পড়লে তাড়াহুড়া করে আজ ঠিকমতো পানি খাওয়া হয়নি সেহরিতে। আসলে এসাইনমেন্টের টেনশন থাকলে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হয় না। মা এ টেনশনে থাকেন। আচ্ছা ঐ মহিলার একটা ছবি তুলে ফেসবুকে দিলে কেমন হয়?। পুলিশ যদিও বলেছে ওরা করবে, তারপরও সেওতো চেষ্টা চালাতে পারে। এখন তো ফেসবুকেই অনেকেই অনেক কিছু বের করে দিতে পারে। হলি আর্টিজান বেকারিতে যখন জঙ্গি হামলা হলো তখন তো এই ফেসবুক থেকেই সবাই সেই সন্ত্রাসীদের কথা জানতে পেরেছিল। তাহলে এক চেষ্টা দিলে কেমন হয়? এই ভাবনা থেকে আবার আলিম মর্গের দিকে যায়। সবাই নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনের মদরদেহ খুঁজে পেয়েছে। শুধু এক কোণে পড়ে আছে মেয়েটা, আলাদা করা। আশপাশে জোবায়েরের আশায় চোখ ঘোরালেন। এখন জোবায়ের পাশে থাকলে ভালো হতো। যদিও মর্গে এখনো অনেক মানুষ। বার বার করে বিভিন্নজন দেখতে চাচ্ছেন স্বজনদের লাশ। একটু দূর থেকেই প্রথম মুখের ছবিটা নিলেন। কিন্তু খুব বেশি আসছে না মুখের ছবি। কেউ চিনতে পারবে না। আরেকটু কাছ এগিয়ে গেলেন আলিম। এবার মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে তার মুখের আদল। প্রথম নিজের ফেসবুক থেকে ছবিটা পোস্ট করলেন, পরে বন্ধবান্ধব চেনা-জানা সকলকে বললেন ছবিটা শেয়ার করতে। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। উদ্ধার কাজ শেষের ঘোষণা ইতোমধ্যেই দেয়া হয়েছে। একবার ভাবলেন এখনই রওয়ানা দিবেন ঢাকায়। ইতোমধ্য দুটো স্টোরিসহ রিপার্ট পাঠানো হয়েছে কয়েক দফায়। কিন্তু জোবায়ের জোরাজুরিতে ইফতারের সময় জোবায়েরে বাসায় যেতে হলো। জোবায়েরর মা খুবই আন্তরিক। ইফতারের সময় মা ফোন দিলেন -কীরে কই তুই? -এইতো মা, ইফতার করছি, জোবায়ের আর খালাম্মার সাথে। -যাক, তবুও রাস্তাঘাটে ইফতার করতে হয়নি। -আমি রওয়ানা দিতে চেয়েছি, কিন্তু জোবায়ের দেয়নি। একটু পরেই রওয়ানা দিবো। -এত লাশ দেখার পর এই রকম মন নিয়ে কিছু কী খেতে পারতেছিস? আমিতো টিভিতে দেখেই খেতে পারছি না। -তুমি চিন্তা কর না। আমি রওয়ানা দেয়ার আগে তোমাকে ফোন দিব। ইফতারের পর একটু চা খেয়ে রওয়ানা দেয় আলিম। জোবায়েরকে বলে রাখে সেই ঠিকানাহীন মহিলাকে নিয়ে একটা স্টোরি বানাতে। আর তার মনে হতে থাকে হয়তো একটু পরেই মিলে যাবে ঠিকানা। ঢাকার জ্যাম ঠেলে বাসায় পৌঁছাতে প্রায় ১০টা। ইফতারের পর শপিংমলগুলোর সামনে ভিড় লেগেই থাকে। পরের দিন জোবায়েরকে ফোন দিয়ে জানতে পারে আলিম এখন পর্যন্ত সেই মেয়েটির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনদিন হয়ে যায়। মর্গেও আর লাশটিকে রাখতে চায় না। জোবায়ের থেকেই আলিম জানতে পারে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম হিন্দু লাশ গ্রহণ করেনা। জোবায়েরই আলিমকে পরামর্শ দেয় কোনোভাবে পত্রিকায় মেয়েটির ছবি ছাপা যায় কীনা দেখতে। কী জানি জোবায়েরে এত মায়া পড়লো কেন এই মেয়েটার ওপর? তার নিজেরও কী পড়েছে খানকটা? তা না হলে সে কোন জোবায়েরকে ফোন করছে দিনে কয়েক বার? বার বার মনে হচ্ছে কেন মেয়েটির খোঁজে কেউ এলো না? মেয়েটি লঞ্চে ছিল এটাতো তার পরিবারের কেউ না কেউ জানতে। তাহলে তারাই বা কেন তাদের মেয়েটি মের গেছে নাকি বেঁচে আছে সে খবর নিতে আসলো না।? যাহোক নিউজ এডিটরের সঙ্গে একটু আলাপ করতে হবে। মেয়েটার কোনো ছবি ছেপে পরিবার পরেজনদের খোঁজ নেয়া যায় কীনা একটু দেখা দরকার। নিউজ এডিটরকে রাজি করানো গেল। আলিমের তোলা ছবিটাই পত্রিকায় ছাপা হলো। তার নম্বর আর থানার ওসির নম্বর দেয়া হলো যোগাযোগ করার জন্য। প্রথম দুদিন কেউ ফোন করলো না। এরই মধ্যে থানার ওসি দায়িত্ব নিয়ে দ্বিতীয় দিনই দাহ করলেন। মর্গে রাখা যাচ্ছিলো না আর লাশটি। সেদিন মঙ্গলবার। অফিসের বাইরে এসে চা খেতে খেতে সহকর্মী জাকিরের সাথে আড্ডা দিচ্ছেলেন আলিম। হঠাৎ অপরিচিত নম্বর থেকে নম্বর ভেসে আসলো ফোনে, রিং বেজে উঠলো : -স্যার সেলাম। আমি লগন সর্দার, লছমীর বাবা কইছি। -জ্বি, কে আপনি? -লছমির বাবা -লছমি কে? আমিতো চিনি না। -স্যার আমার মাইয়ার ছবি যে আপনি পেপাইরে দিলেন... -কোন মেয়ে? -ঐযে, নদীতে ডুইবা মরছে.. -তা আপনি এতদিন কই ছিলেন? আমরা কতভাবে চেষ্টা করছি আপনাদের ঠিকানা পেতে? কেউ আসেনি। দুইদিন পর ওসি সাহেব দাহ করলেন। -(কান্নার স্বর) স্যার..আমারতো কোনো ঠিকানা নাই। আমরা নৌকায় থাকি...ঠিকানা পামু কই। আমাগেতো কোনো ঠিকানা নাই স্যার। -নৌকায় থাকেন মানে? -আমরা বাইদ্যা। আমার মাইয়া লছমী। গত ফাগুনেই বিয়া হইছিল। তার শ্বশুরবাড়িও আরেকটা নৌকায়। মাইয়াটা শ্বশুরবাড়িই ছিল। ঐ নৌকা থেকেই মাইয়াডা গেছে গা... -তা তিনদিনেও আপনার যোগাযোগ করেন নাই কেন? -কেমনে করুম স্যার, আমিতো নৌকা নিয়া গেছি আরেক জায়গায়। আমরাতে জানি না লছমির খবর। (কান্না) একটু আগেই কইলো লছমির ফুডু নাক ওঠলো, আর আপনের নম্বরটা দিল...স্যার আমনের কাছে আমার লছমির আর ফুডু আছে? -নৌকা থেকে ও কীভাবে পড়লো? -হেতো জানি না স্যার...তয় শুনলাম লঞ্চ ডুবার পর কে একজন তার শ্বশুরবাড়ির নৌকায় কিছু কাছে আইস্যা বাঁচার চেষ্টা করছিল, আর লছমি তারে বাঁচানোর জন্য নদীতে ঝাঁপ দিছিল। নদীতে বড় হইয়া মাইয়া আমার নদীতেই মরলো... -ওর শ্বশুরবাড়ির কেউ যায়নি কেন? -স্যার যদ্দুর হুনছি, নৌকায় তখন ও একাই ছিল। কেউ নাকি জানতো না। বিকেলথুন ওর খোঁজাখুঁজি করতে ছিল। ওর শ্বশুর রয়না সর্দার অনেক জায়গায় খুঁজছে। আমরাতো বাবু ঠিকানা নাই, কেমনে জানান দিমু? -এপাশ থেকে আলিম চুপ হয়ে গেল। তাইতো কত রকমের ঠিকানা হয় মানুষের। আরা কয়টাইবা জানি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App