আজও আতঙ্কে আঁতকে ওঠেন রাঙ্গামাটির মানুষ
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০১৯, ১২:৩৮ পিএম
রাঙ্গামাটির ভয়াবহ পাহাড় ধসের ২ বছর পূর্ণ হলো আজ। আজকের এই দিনে ২০১৭ সালের ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড় ধসের ৪ সেনা কর্মকর্তাসহ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে ১২০টি তাজা প্রাণ। অন্যদিকে ২০১৮ সালের একই দিন ১২ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় নানিয়ারচর উপজেলার বড়পুলপাড়া, ধর্মচানপাড়া ও হাতিমারায় একই পরিবারের ৫ জনসহ ১১ জন নিহত হন। বিভীষিকাময় এই দিনটির কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে আঁতকে ওঠেন সাধারণ মানুষ। মা-বাবা, ভাই-বোনসহ বহু আত্মীয়স্বজন হারিয়ে মানুষ নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছেন। তারপরও সেই দিনটি সবাইকে তাড়া করে ফিরে প্রতিনিয়ত।
রাঙ্গামাটি জেলায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পাহাড় কাটা বন্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সাধারণ মানুষের মাঝে জনসচেতনতা বাড়ানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। সম্প্রতি রাঙ্গামাটি শহরের মহিলা কলেজ গেট এলাকায় কাপ্তাই হ্রদের মাটি কেটে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে মাটিচাপা পড়ে ৩ শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে।
২০১৭ সালে রাঙ্গামাটি শহরে ৪ সেনা সদস্যসহ ৬৫, কাউখালী উপজেলায় ২৩, কাপ্তাইয়ে ১৮, জুরাছড়িতে ৪ ও বিলাইছড়ি উপজেলায় ২ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে শিশু ৩৩, মহিলা ৩০ ও পুরুষ ৪২ জন। নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ২০ জন। আহত হয়েছেন ৮২ জন। এর মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বেশ কয়েকজন চলে গেলেও ৩৯ জন রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
অপরদিকে ২০১৮ সালের ১২ জুন মধ্য রাতে ভারি বর্ষণের ফলে উপজেলার সাবেক্ষং ইউনিয়নের বড়পুলপাড়ায় ৪, ধর্মচানপাড়ায় ৪ এবং হাতিমারায় ২ জন, ঘিলাছড়িতে ১ জন পাহাড়ের মাটিচাপা পড়ে নিহত হয়েছেন। একই দিনে রাঙ্গামাটি পৌর শহরের ২০ থেকে ২৫টি স্থানে মাটি ধসের ঘটনা ঘটলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
১ জুন ঘূর্ণিঝড় মোরার তাণ্ডব আর লংগদুর অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর ১৩ জুন ঘটে যায় রাঙ্গামাটির ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা। এতে বিছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা। গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় পুরো শহর। দেখা দেয় চরম মানবিক সংকট। পাহাড় ধসের ৪ দিনের মাথায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হয় এবং রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে ৮ দিন সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন থাকার পর সেনাবাহিনীর তত্ত¡¡াবধানে মানিকছড়ি শালবন এলাকায় বিকল্প সড়ক চালু করে যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। ফলে স্বাভাবিক হয়ে আসে রাঙ্গামাটির জীবনযাত্রা।
১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড় ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ও সম্পদের ক্ষতি হয় রাঙ্গামাটিতে। পাহাড় ধসের ঘটনায় সেনা সদস্যসহ মারা যান ১২০ জন। আর আহত হয়েছেন দেড় হাজারেরও বেশি। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আড়াই হাজারের মতো। গত বছর পাহাড় ধসের ফলে রাঙ্গামাটি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭২০। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি সদরে ৯০, কাউখালীতে ১৯০, নানিয়ারচরে ৩০, বরকলে ৭০, চিংমরং, ওয়াগগার ও রাইখালীতে ৩৪০। এরা কিছু ত্রাণসামগ্রী ছাড়া আর কিছুই পায়নি।
অন্যদিকে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ৯ দিনের মাথায় চালু হলেও দীর্ঘ ৬ মাস বন্ধ ছিল রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই সড়ক। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ভারি বর্ষণের ফলে ধসে পড়া রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক দীর্ঘ ১ মাস পর চালু করতে পারলেও চালু হওয়ার ৪ দিনের মাথায় আবারো অতিবর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক আবারো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এ ঘটনায় রাঙ্গামাটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন ছিল অনেক দিন। বাজারে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছিল। মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘ্ন ঘটায় টেলিযোগাযোগ ব্যাহত হয়। পানি ও বিদ্যুৎ সংকটে মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের মাটি ভেঙে পড়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।
বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শালবন এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তার ৩০ ফুট জায়গা পাহাড়ের নিচে তলিয়ে গেছে। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের বিভিন্ন স্থানে ১০০ মিটার রাস্তার ৪০-৫০ ফুট গভীরে তলিয়ে গেছে।
রাঙ্গামাটির জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে খাড়া পাহাড় পুনরায় কেটে বাইপাস সড়ক তৈরি করেন সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগের কর্মীরা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ রুটে রাজার হাট, লিচু বাগান, কারিগরপাড়া রাস্তার ওপর পাহাড় ধসে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিল অনেক দিন।
এত কিছুর পরও রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় তিন মাস আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও প্রশাসনের আশ্বাসের কোনো সুফল পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা। এর ফলে রাঙ্গামাটির সাধারণ মানুষের মাঝে প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ জন্মায়। অতীতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের বাসস্থানের আশ্বাস দিলেও পরবর্তী সময়ে সহযোগিতার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি তাদের জন্য। বর্তমানে কোনো দুর্যোগ এলে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আসতে চায় না মানুষ। বিপদ মাথায় নিয়ে নিজের বসতভিটায় পড়ে থাকতে চায় পাহাড়ের ঢালে বাসবাসকারী লোকজন।