×

জাতীয়

ঝুঁকিতে আড়াই কোটি মানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুন ২০১৯, ১১:০৬ এএম

ঝুঁকিতে আড়াই কোটি মানুষ
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক ঝুঁকিতে পঞ্চম অবস্থানে উঠে আসা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে ষাটের দশকে নির্মিত বেড়িবাঁধ বর্তমানে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বছর বছর প্রবলমাত্রার ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যার কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধের মূল কাঠামো। মেরামত, সংস্কার, পুনর্নির্মাণ খাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও পরিকল্পিত টেকসই বাঁধ ব্যবস্থাপনা আজও গড়ে ওঠেনি। এতে বন্যা, জোয়ার, জলোচ্ছ্বাসে নোনাপানি উপচে প্রতি বছরই প্লাবিত হচ্ছে বহু জনবসতি, ফসলি জমি। গত পাঁচ দশকের বিপর্যয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকিতে উপকূলের আড়াই কোটির বেশি মানুষ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বাড়তে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ভয়াবহ রূপ নেবে। এ পরিস্থিতিতে তারা উপক‚লের প্রাণিসম্পদ রক্ষায় স্থায়ী-টেকসই বাঁধসহ জোয়ার-ভাটার পানি নিয়ন্ত্রণকারী পোল্ডার ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণের তাগিদ দিচ্ছেন। রাজস্ব খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সমন্বিতভাবে ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আলোকে উঁচু-মজবুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের পরামর্শও দিচ্ছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য প্রদানে নিযুক্ত প্রসেসিং বিভাগ বলছে, উপক‚লের ১৩ জেলাজুড়ে বিস্তৃত ৪,৭৬৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অনেকাংশই দীর্ঘদিন ধরে ঘূর্ণিঝড় ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নাজুক হয়ে পড়েছে। সেসব অংশে মেরামত, পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি ফসলিজমিতে নোনাপানি ঠেকাতে ১৩৯টি পোল্ডার সংস্কার করা হচ্ছে। তবে বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, উপক‚লের ১৯ জেলাজুড়ে পুরনো, পরিত্যক্ত, সরকারি ও স্থানীয়ভাবে নির্মিত ১০ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের আট হাজারই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে নোয়াখালী, ভোলা, বরিশাল ও পটুয়াখালীর উপক‚ল, নদ-নদী ও চরাঞ্চলের বাঁধের অবস্থা বেহাল। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে নির্মিত ৪,১০০ কিলোমিটার উপক‚লীয় বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ার মূল কারণ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস। মহাদেশীয় খাদ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের স্বল্প গভীরতা আর ফানেল আকৃতির জন্য ঘূর্ণিঝড়ে ধেয়ে আসা বিপুল জলরাশি তলদেশে বাধা পেয়ে ফুলে উঠে উপক‚লে প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত পাঁচশ বছরে এমনই ৫৩টি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় উপক‚লে আঘাত হানে। ১৫৮৪ সালে পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী ঘূর্ণিঝড়ে উঁচুস্থানে থাকা উপাসনালয় ছাড়া উপক‚লের সবকিছু তলিয়ে যায়। প্রাণ হারায় ২০ লাখ মানুষ। আবার ১৮৭৬ সালে ২২০ কিলোমিটার বেগে ৪৫ ফুট জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় দুই লাখ মানুষ। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ-মহামারি। অনুরূপ গত শতকের পঞ্চাশ দশকে কয়েক দফায় প্রবল ঝড়ে উপক‚লের ভূমি-সম্পদ-জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় জাতিসংঘের একদল পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ১৯৫৭ সালে উপক‚ল পরিদর্শনে আসেন। তাদের পরামর্শেই ১৯৬২ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তায় উপক‚লজুড়ে ৪,১০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ও নেদারল্যান্ডসের আদলে ১,০৩৯টি জলকপাট নির্মিত হয়। তবে এসবের সুবিধা পেতে না পেতেই ১৯৭০ সালে ২২৪ কিলোমিটার বেগে ও ৩৩ ফুট উচ্চতার ঢেউ ফের আঘাত হানে উপক‚লে। জলোচ্ছ্বাসে ডুবে প্রাণ হারায় পাঁচ লাখ মানুষ, লণ্ডভণ্ড হয় বেড়িবাঁধ। সেই ক্ষত না শুকাতেই ১৯৯১ সালে আড়াইশ কিলোমিটার বেগের ম্যারিয়েনের আঘাতে বাস্তুহারা হয় এক কোটি উপক‚লবাসী। এ অবস্থায় তৎকালীন সরকার নতুন বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগও নেয়। আবহাওয়া অফিসের সূত্রমতে, গত এক যুগে সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, রোয়ানু, মোরাসহ ডজনখানেক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে উপক‚লের দীর্ঘ বেড়িবাঁধ। তবে শুধু যে দুর্যোগেই বাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে তা নয়, বরং মানুষের লোভের থাবাতেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বাঁধের বিশাল অংশ। ষাটের দশকে ফসলিজমিতে নোনাপানির প্রবেশ বন্ধ করে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যে বেড়িবাঁধ তৈরি হয়, নব্বইয়ের দশকে এসে সে উদ্দেশ্য উল্টে যায়। বাঁধ কেটে কেটে জমিতে নোনাপানি ঢুকিয়ে শুরু হয় চিংড়ি চাষ। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় ক্ষমতাশালীরা নোনাপানির জন্য বেপরোয়াভাবে বাঁধ ফুটো করতে থাকে। এমনকি ২০০৮ সালে ৫০ কিলোমিটার বাঁধে সাড়ে তিনশ ফুটো করারও দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। কেননা, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে বাঁধ কাটার শাস্তি মাত্র দুটো টাকা হলেও ২০১০ সাল অবধি ‘সাদা সোনা’ চাষে এক টাকার লভ্যাংশ পাঁচ টাকায় ঠেকেছিল। এতে বেড়িবাঁধের ভেঙে পড়া ছাড়া কোনো পথই ছিল না। ২০১২ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনে বাঁধ কাটার জরিমানা বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা আর তিন বছরের জেলের বিধান করা হলে তার কার্যকারিতা নেই। কোস্ট ট্রাস্টের হিসাবে, সিডর ও আইলায় নতুন-পুরনো মিলিয়ে ৮,০০০ কিলোমিটার বাঁধের বহুস্থান ভেঙে ও ভেসে যায়। সর্বশেষ ‘ফনী’র আঘাতে আরো বেহাল হয়েছে। ট্রাস্টের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো অংশ ভেঙে গেলে গোটা বাঁধই অকার্যকর হয়ে পড়ে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অপ্রতুল বরাদ্দ ও পরিকল্পনাহীন সংস্কার কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে খুলনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেড়িবাঁধ ভেঙে জমিতে নোনাপানি ঢুকলে টানা কয়েক বছর ফসল ফলে না। মিঠাপানির মাছ ও প্রকৃতিবান্ধব কীটপতঙ্গের বংশবিস্তারও বাধাগ্রস্ত হয়। তবে বাঁধ সংস্কারে প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ বরাবরই থাকে অপ্রতুল। বিষয়টি স্বীকার করে পাউবোর পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ হাসানুজ্জামান বলেন, জেলার ১৩৫০ কিলোমিটার বাঁধের চার কিলোমিটারে পুরোটা ও ২০ কিলোমিটারে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব বাঁধ মেরামতে চাহিদা মোতাবেক অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। গত কয়েক দশকে বিপন্ন বাঁধ মেরামত ও সংস্কার ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে উপক‚লীয় বেড়িবাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি) হাতে নেয় সরকার। দক্ষিণাঞ্চলের অংশে খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠী ও পটুয়াখালীর ৪,৭৬৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মজবুত ও উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য ৩,২৮০ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে সাত বছর মেয়াদি প্রথম ধাপের কাজ (ফেজ-১) শুরু হয়। ২০১৬ সালে এসে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের বাঁধ রক্ষায় একনেকে ২৮০ কোটি টাকা অনুমোদন হয়। পাশাপাশি জেলা ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমেও স্থানীয়ভাবে বাঁধ মেরামতের কাজ চলে। ২০১৭ সালে সংসদে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি মোকাবেলার উপযোগী করে ১৭টি পোল্ডার সংস্কার ও বাঁধগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধিসহ মজবুত করার প্রকল্প সিইআইপির অগ্রগতি তুলে ধরেন। পাউবোর প্রসেসিং বিভাগের পরিচালক নুরুল আমিন জানান, সিইআইপি’র প্রথম ধাপের কাজের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সাল করা হয়েছে। এরপরই শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপ। পাশাপাশি বৈদেশিক সাহায্য কমিয়ে সাতক্ষীরা ও খুলনায় শিগগিরই নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। তবে কোস্ট ট্রাস্টের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্যোগের আগে নানারকম প্রস্তুতি বা অতিপ্রস্তুতি দেখা গেলেও দুর্যোগের পর সব ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতি চালু আছে। এর ওপর বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে সরকারি অর্থ ‘নয়ছয়’ তো আছেই। বর্ষায় বাঁধ ভাঙলেই নতুন প্রকল্পের নামে বরাদ্দ আসে। বছরের পর বছর ধরে সংস্কারের নামে চলে ‘নয়ছয়’, অপচয়। কোস্ট ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক বরকত উল্লাহ মারুফ বলেন, বেড়িবাঁধের ওপর স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘেঁষতেই দেয়া হয় না। অথচ বাঁধে সামাজিক বনায়ন কিংবা ঘরবাড়ি তুললে অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকে। এ ব্যাপারে পাউবোর কোনো উদ্যোগও নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নইম ওয়ারা বলেন, উপক‚লীয় বেড়িবাঁধের দায়িত্ব স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। তারা নিজেদের প্রয়োজনেই বাঁধকে মজবুত ও টেকসই করে তুলবে। তাতে যদি কোনো সংস্থার স্বার্থহানি হয়, সেটা মেনে নিতেই হবে। এদিকে, ষাটের দশকে বেড়িবাঁধ গোড়ায় ৮৩ ফুট ধরে উচ্চতা ও চওড়া ১৩ ফুট করা হলেও বর্তমানে তা ৮ ফুটে দাঁড়িয়েছে। জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় অকার্যকর এসব ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিতর্কও কম নয়। বেড়িবাঁধ ও সইস গেটের কারণেই নদ-নদী দিয়ে উজান থেকে আসা পলি উপক‚লের ফসলি জমিতে না গিয়ে নদীর বুকে জমে নাব্যতা কেড়ে নিচ্ছে বলে অভিমত অনেকের। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিসহ লাগামছাড়া দুর্নীতির অভিযোগও বিস্তর। উপক‚লীয় বাঁধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও তথ্য নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা উল্লেখ করে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক পানিবিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, এ কারণেই চিড়িং চাষ নিয়ে এলজিইডি ও পাউবো বহু মামলায় জড়িয়েছে। তার মতে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত বাঁধ-ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ডেল্টা পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি উপক‚লে জলবায়ু মোকাবেলা সংক্রান্ত অবকাঠামো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। অরক্ষিত বাঁধ বা সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে পাউবোতে কোনো তথ্য উপাত্ত না থাকার কথা স্বীকার করে সিইআইপির পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামীর ঝুঁকি নিরূপণ ও অত্যাধুনিক টেকসই পানি-ব্যবস্থাপনার ডিজাইন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এজন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এসে উপক‚লে তিরিশ মাসব্যাপী জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদন দেবেন। তার ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেছেন, উপক‚লীয় পোল্ডার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সরকার নতুন করে ভাবছে সরকার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে পোল্ডারগুলোকে টেকসই ব্যবস্থাপনার আওতায় আনলে উপকূলের তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষ ঝুঁকিমুক্ত হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App