×

জাতীয়

চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডে সহিংসতা বাড়ার আশঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০১৯, ১২:৫৬ পিএম

চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডে সহিংসতা বাড়ার আশঙ্কা
কারাগারের ভেতরেই শীর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী হত্যাকাণ্ড ঘিরে অস্থিরতা বিরাজ করছে চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডে। এ ঘটনা আরো সহিংসতার জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এরই মধ্যে বদলা নেয়ার হুমকি দিয়েছেন দেশের বাইরে অবস্থানরত অমিত মুহুরীর ভাই অনিক মুহুরী। প্রতিশোধ নিতে মরিয়া অমিত মুহুরীর অনুসারিরাও। খুন, টেন্ডারবাজিসহ কমপক্ষে ১৫ মামলার কারান্তরীণ আসামি অমিত মুহুরীর হত্যাকাণ্ড চট্টগ্রামের ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত বলেই মনে করছেন স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, অপরাধ সংক্রান্ত মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা। বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক ও অসংখ্য অপরাধ মামলা পরিচালনাকারী এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত গত শনিবার ভোরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে অশনি সংকেত হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই হত্যাকাণ্ড যে আরো সহিংসতার জন্ম দেবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? তার মতে, জেলখানার মতো নিরাপদ জায়গায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ বিষয়ে রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে, যা সত্যিই দুঃখজনক। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, অনেক রাজনীতিবিদকেও নানা মামলায় কারাগারে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে তারাওতো জেলখানার ভেতরে নিরাপদ নন। কারা কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতাসহ সংশ্লিষ্টদের গাফিলতিকে দায়ী করে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাও দাবি করেন এই সিনিয়র আইনজীবী। এদিকে এখন পর্যন্ত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী হত্যার কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ উদঘাটনে গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি ও মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া গোয়েন্দা পুলিশও এখনো কোনো ক‚লকিনারা করতে পারেনি। অমিত হত্যা মামলার একমাত্র অভিযুক্ত রিপন নাথের সঙ্গে অমিতের কোনো পূর্ব শত্রুতা ছিল কিনা, না থাকলে রিপন কেন অমিতকে হত্যা করল, কারাগারে সেলের ভেতর ইট কীভাবে গেল, কেন ঘটনার দিনই সেল পরিবর্তন করে রিপনকে অমিতের সেলে আনা হলো- এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। গত ২৯ মে রাত ১১টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অমিতকে গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। রাত ১টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। এ ঘটনায় পরদিন (৩০ মে) কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নাশির আহমেদ। ওই মামলায় তদন্ত করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। মামলায় আসামি করা হয়েছে রিপন নাথ নামে ২৮ বছর বয়সী এক হাজতিকে। কারাগারের ৩২ নম্বর সেলের ছয় নম্বর কক্ষে ইটের টুকরো দিয়ে মাথার পেছনে আঘাত করে হত্যা করা হয় অমিতকে। রিপনকে ঘটনার দিন বুধবার বিকেলে ওই কক্ষে নেয়া হয়। পোশাক কারখানার শ্রমিক রিপন একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে গত এপ্রিল থেকে কারাগারে আছেন। ঘটনার দিন বিকেলে রিপন নাথকে কারাগারের ওই কক্ষে পাঠানো নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ছুরি নিয়ে ধরা পড়া একজন আসামিকে হত্যা মামলার আসামির ওই সেলে পাঠানোর কথাও নয়। তারপরও কেন তাকে পাঠানো হলো? হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ওই ইট রিপন নাথ কোথায় পেল? এসব প্রশ্ন ঘুরেফিরেই আসছে। মৃত্যু সনদে অমিত মুহুরীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘সিভিয়ার হেড ইনজুরি, এক্সিডেন্টাল ইনজুরির’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘দুই চোখ বন্ধ, মুখ সামান্য খোলা, দুই কানে ও নাকে রক্তের দাগ আছে। মুখের ডানপাশে দাড়ি ও গোঁফ আছে। বাম পাশেরটা কামানো। বুক-পেট-পিঠ স্বাভাবিক। দুই পা লম্বালম্বি স্বাভাবিক ছিল।’ কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত অমিতের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে রেলের দরপত্র নিয়ে জোড়া খুনসহ হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির ১৫টি মামলা রয়েছে। হত্যা, পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে আগেও তিনি একাধিকবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। রাউজান পৌরসভার রেজাউল করীমের ছেলে ইমরানুল করিম ইমন হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর পুলিশ তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে। এরপর থেকে দীর্ঘ দুই বছর অমিত মুহুরী কারাগারে ছিলেন। চট্টগ্রাম নগরীতে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রক বাবর, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে। নেপথ্যের কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা : অমিতের পরিবারের অভিযোগ, নগর যুবলীগের এক নেতার বলয়ের ভেতরকার গ্রুপ-উপগ্রুপের দ্বন্দের জেরেই অমিতকে হত্যা করা হয়। অমিত ও তার হত্যাকারী হিসেবে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত রিপন নাথের মাদকাসক্তিকেও কারণ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। আবার অমিতের বন্ধু মহলের দাবি, যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের শক্তি ক্ষয় করতে তার বিরোধী পক্ষ কারা প্রশাসনকে ব্যবহার করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এদিকে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, অমিত মাদকাসক্ত ছিলেন। তার হত্যাকারী রিপনও মাদকাসক্ত। কারাগারে ইয়াবার টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে রিপন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কারাগারের একটি সূত্র জানায়, স্থানান্তরিত হয়ে অমিতের কক্ষে আসার পর রিপনকে কট‚ ভাষায় গালাগাল করেন অমিত। এই গালাগালকে কেন্দ্র করে ক্ষিপ্ত রিপন ইট দিয়ে আঘাত করে অমিতকে হত্যা করতে পারে। এদিকে অমিতের বাবা অরুন মুহুরীর দাবি, এই হত্যা পরিকল্পনার পেছনে কারাগারের কর্মকর্তারাও আছেন। তার প্রশ্ন, কারাগার একটি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকে, সেখানে মানুষ কীভাবে খুন হবে? তিনি বলেন, শুধু ইট নয়; ছুরি দিয়ে অমিত মুহুরীকে জখম করা হয়েছে। তার শরীরে ছুরিকাঘাতেরও চিহ্ন ছিল। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নাশির আহমেদ বলেন, অমিত মুহুরীকে ইট দিয়েই জখম করে হত্যা করা হয়। একজন দাগি আসামির কক্ষে কেন ছুরি নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া একজনকে পাঠানো হলো, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত দাগি আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সেলে সাধারণ কয়েদিদের রাখা হয় না। রিপন নাথকে ওই সেলে পাঠানোর বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম না। তাকে কেন ওই সেলে পাঠানো হয়েছে, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তারা বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখছে। অমিতের ভাইয়ের ভিডিও বার্তা ভাইরাল : এরই মধ্যে ফেসবুকে অমিতের ছোট ভাই অনিক মুহুরীর একটি ভিডিও বার্তা ভাইরাল হয়েছে- যেখানে তিনি সরাসরি অমিতের এক সময়কার রাজনৈতিক এক বড় ভাইকে দোষারোপ করেছেন। নাম উল্লেখ না করলেও তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যে কেউ ধারণা করতে পারবে অনিক কোন নেতাকে দোষারোপ করছেন। সেই ভিডিও বার্তায় সম্পূর্ণ পরিকল্পিত এবং কারাগারের বাইরের কারো নির্দেশে তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন কলকাতায় বসবাসরত অনিক মুহুরী। গত ৩১ মে অমিতের স্ত্রী নিধি দত্ত মুহুরীর ফেসবুক পেইজে লাইভে এসে তিনি এ কথা বলেন। ১১ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে অনিক মুহুরী প্রশ্ন করেন, অমিত মুহুরীকে মারার ক্ষমতা রিপন নাথের আছে? তিনি আরো বলেন, ‘দেখছি আমার ভাইকে শেভ করা অবস্থায় মেরেছে। আমার ভাই অর্ধেক শেভ জীবনে করেনি’। কারাগারের বাইরে থেকে অমিতকে খুনের পরিকল্পনা হয়েছিল দাবি করে অনিক মুহুরী বলেন, ‘ছয়-সাতজন মিলে পুরো প্ল্যানিং করে আমার দাদাকে মারা হয়েছে। আর যে প্ল্যানিং করেছে, ঘরের মধ্যে বসে বসে, দাঁড়া, ঘরের মধ্যে বসে প্ল্যানিং করে আমার দাদাকে মেরে ফেলবি। নাটক করো? নাটকের দিন শেষ। অমিতের ছোট ভাইয়েরা আছে। অমিতের ছোট ভাইরা অমিতকে ভালোবাসে। যে ঘরের মধ্যে বসে প্ল্যান করে কোটি টাকা খরচ করে আমার দাদাকে মারিয়েছে, তার বিচার চাই।’ তদন্ত করছে একাধিক সংস্থা : এদিকে কারা অভ্যন্তরে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী খুনের ঘটনায় গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। জেলা প্রশাসকের গঠিত এক সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাশহুদুল কবীর গতকাল শনিবার বিকেলে ভোরের কাগজকে বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আসামি রিপন নাথসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। রোববার (গতকাল) তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। কমিটির অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ফলাফল প্রতিবেদন উঠে আসবে। সেই অনুযায়ী কমিটি সুপারিশ করবে। তদন্তে প্রাপ্ত ফলাফল বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এছাড়া কারা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য কারা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি, প্রিজন) ফজলুল হক গত শনিবার বিকেলে ভোরের কাগজকে বলেন, আসামি রিপন নাথের সঙ্গে কথা হয়েছে। সে শুধু বলেছে, অমিতের সঙ্গে তার সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছিল। এসময় ‘মাথা গরম’ হওয়ায় সে ইট দিয়ে তাকে আঘাত করে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেসব অভিযোগ এসেছে- সবগুলো বিষয় মাথায় নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। রিপন ইট কোথায় পেল, কেন সে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, এর পেছনে আর কেউ জড়িত কিনা বা কারাগারের কেউ জড়িত ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক আজিজ আহমেদ বলেন, আমরা কারা অভ্যন্তরের বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। যাচাই-বাছাই করে দেখছি। বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। যার সবগুলোই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ জোন) উপকমিশনার মেহেদী হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, আসামি রিপন নাথকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সে ইট দিয়ে অমিত মুহুরীকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছে। কিন্তু কী কারণে তাকে হত্যা করেছে- এই বিষয়ে সে একেক সময় একেক কথা বলছে। রিমান্ড শেষে এই বিষয়ে চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। এর আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App