মায়া ও আমার পুত্র
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০১৯, ০৩:২৬ পিএম
আমি যখন বাড়ি ঢুকেছি তখন ফুরিয়ে এসেছিল দিনের আলো। সন্ধ্যা নামছে। বর্ষাকালের সন্ধ্যা। পূর্ণিমা সন্ধ্যা বলে দিনের মতো স্পষ্ট চারদিক। তোমাদের দেখতে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না।
২৫ শে মার্চের রাতও ভোর হয়েছিল।
এই রাতও ভোর হবে।
এই তো আর দুতিন ঘণ্টা পরই ভোর হবে। আমার কাজও ততোক্ষণে শেষ হয়ে আসবে...
কিন্তু মায়া, আমি আর পারছি না।
আমার শরীর আর চলছে না।
একে এ রকম ঘটনা, পুরো পরিবার ধ্বংস, সেই শোকতাপ, মাথা তালগোল পাকিয়ে যাওয়া অবস্থা, আরেকদিকে যোদ্ধার দায়িত্ব, আমি কোনদিকে যাই, মায়া!
বাবার লাশ দেখে আমি কাঁদতে পারি না।
মায়ের লাশ দেখে কাঁদতে পারি না।
বোনের শরীরের ওপর দিয়ে ওরকম ঘটনা ঘটে যাওয়া, তার করুণ কাতর মৃতমুখ...
আমি কাঁদতে পারি না, মায়া। আমি কাঁদতে পারি না। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। শোক করতে ভুলে গেছি।
তারপর তুমি!
তারপর আমার সন্তান।
আমি কাঁদতে পারি না, মায়া।
আমার চোখে পানি নেই।
যোদ্ধার চোখে পানি আসতে নেই।
কিন্তু যোদ্ধাও তো মানুষ! যোদ্ধাই আসলে পরিপূর্ণ মানুষ। এ কথা শিখিয়েছিলেন বাবা।
আমি তারপর যোদ্ধা হয়ে গেলাম। সব হারাবার পরও যোদ্ধার দায়িত্ব নিলাম। গোয়ালঘরের ওদিক থেকে খুঁজে আনলাম কোদাল। উঠানে খুঁড়তে শুরু করলাম কবর।
বাবার কবর।
মায়ের কবর।
বোনের কবর।
এখন স্ত্রীর কবর।
তারপর...
আমি আর পারি না, মায়া। আমার শরীর চলে না। আমার ইচ্ছে করে এই যে তোমার আর আমার পুত্রের লাশ এনে রাখলাম উঠানে, তোমাদের পাশে আমি একটু বসি। আমি একটু জিরিয়ে নেই। আমি একটু তোমার সঙ্গে কথা বলি। আমি একটু তোমার কোলে মাথা রাখি।
কোলে মাথা রাখলে তুমি যেভাবে আমার বুকে হাত বুলাতে, মাথায় হাত বুলাতে, মায়া, তুমি আমাকে একটু সেই ভাবে আদর করো। তোমার আদরে স্পর্শে, ভালোবাসার নরম আঙুলে কাটিয়ে দাও আমার সব ক্লান্তি। আমাকে আবার সবল করো, সতেজ করো। খানিকপর তাহলে আমি আবার শুরু করতে পারি আমার যুদ্ধ।
কবর খোঁড়ার যুদ্ধ।
গোড়খোদকের কাজ।
ওদের বুট আর গুলির শব্দে স্তব্ধ হয়েছিল প্রকৃতি। সব পাখি উড়ে গিয়েছিল অচিন গাঁয়ে, নিরাপদ গাঁয়ে। ডাকতে ভুলে গিয়েছিল পাখিরা। বাড়ি এসে আমি কোনও পাখির ডাক শুনিনি।
আমি কি পোকামাকড় ঝিঁঝিদের ডাক শুনেছিলাম?
শুনিনি।
তারাও স্তব্ধ হয়েছিল।
তারাও থেমে গিয়েছিল ঘাসবন বা ঝোঁপের অন্ধকারে।
নৈঃশব্দ।
চরম নৈঃশব্দ।
চ‚ড়ান্ত নৈঃশব্দ।
বল্টুটা কোথায় গেল? বল্টু বিড়ালটা?
বাড়ি পাহারা দেওয়া এতদিনকার কুকুরটা?
কদম, বারেকের মা, পারুল?
গরুগুলো তো নিশ্চয় এই দেশীয়...গুলো নিয়ে গেছে। বাড়ির আসবাবপত্র নিয়ে গেছে। আমাদের বাড়ি হয়ে গেছে মৃত্যুপুরি। কবরখানা।
মায়া, এই যে দেখো আমি ঠিকই তোমার পাশে বসেছি। আমার পুত্রের পাশে বসেছি। আমার ডানপাশে তিনটি কবর। বা পাশে তোমার কবর এখনও পুরোপুরি খোঁড়া হয়নি। কিছুটা হয়েছে। এসো কাজের ফাঁকে গল্প করি আমরা। একটু ভালোবাসার কথা বলি। একটুখানি প্রেম করি তোমার সঙ্গে।
সকালবেলা ঘটে যাওয়া ঘটনা, মায়া। প্রখর রোদের দিন ছিল। তোমাদের শরীর পচতে শুরু করেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য আমি কোনও গন্ধ পাচ্ছি না। রক্ত মাংসের গন্ধ আমি পাচ্ছি না। আমি পাচ্ছি সুবাস। সুঘ্রাণ। প্রেমিকার দেহের ঘ্রাণ, স্ত্রীর দেহের সুগন্ধ। পুত্রের কোমল মায়াবী শিশুগন্ধ।
আহ, এরচে পবিত্র গন্ধ আর কী হতে পারে!
ভালোবাসার গন্ধই তো পবিত্রতম গন্ধ।
এখন ডাকছে ঝিঁঝিরা। ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে গলা খুলেছে কীটপতঙ্গ। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে খোলা উঠান। বাঁশঝাড় আর গাছপালায় মৃদু একটু হাওয়া আছে। সেই হাওয়ায় নড়াচড়া করছে তলার ছায়া।
অদ্ভুত এক নীরবতা!