×

বিশেষ সংখ্যা

পঞ্চাশ বছর পরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০১৯, ০১:২০ পিএম

পঞ্চাশ বছর পরে
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছে তবারকের মন। সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে ভাইকে খুঁজে পাবে। তোফাজ্জলকে পাওয়ার আশা অবশ্য সে কখনো করেনি। তবু একবার চেষ্টা করতে দোষ কি! না পেলে না পাবে; তারপরও যদি একটু সান্ত্বনা দিতে পারে অশান্ত মনটাকে। ফিরে পাওয়ার পরের আনন্দানুভূতি কল্পনা করে নয়, বরং অজানা এক আতঙ্কই যেন তাকে বেশি ঘিরে ধরেছে। এটাকে ঠিক আতঙ্ক বলা যায় না, বরং বলা যেতে পারে অনিশ্চয়তাবোধের যন্ত্রণা। এই বোধটা মনে জেগেছে কলকাতায়ই। বিমানে চড়ার পরপর। ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পর তবারকের উত্তেজনার মাত্রা যেন বেড়ে যায় আরো কয়েকগুণ। কেন?—আবেগ। এক অবরুদ্ধ আবেগ তার ভেতর থেকে যেন ঠেলে বের হতে চাচ্ছে। সঙ্গে যদিও অসমবয়সি বন্ধু কৌশিক রায় আছে, তবু সে সম্পূর্ণ নির্ভরতা অনুভব করতে পারছে না। মনে হচ্ছে বেসুরে গান বাজছে; বারবার কাটছে তাল; আর লয়ও যেন অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কৌশিক এই সময়ে তার সঙ্গী হতে রাজি ছিল না; ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণে। অনেক অনুনয় করে কৌশিককে সঙ্গে আসতে সে রাজি করিয়েছে; তার যে আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। ধরতে গেলে তবারক ঢাকায় এসেছে কৌশিকের ভরসাতেই। বাংলাদেশের এই রাজধানী শহরে সে আগে কখনো আসেনি। অবশ্য এই ব্যাপারে প্রথম আলাপ সে কৌশিকের সঙ্গেই করেছে। কৌশিকের উৎসাহ দেখে তার আগ্রহ বাড়ে। তার মেজদা সুনীল রায় সরকারি চাকরি করে এখানে। বন্ধুর কাছে সে জেনেছে সুনীল বাবু একজন মুক্তিযোদ্ধাও। এমনকি যুদ্ধের সময় গুলির আঘাতে একটি চোখও হারান তিনি। যুদ্ধে কৌশিক বাবাকেও হারিয়েছিল। তার বাবাকে হত্যা করেছিল স্থানীয় রাজাকাররা। অবোধ শিশুর মতো কৌশিকের কাছে বারবার জানতে চায় তবারক, পাবো তো খুঁজে? চিনতে কি পারবো তোফাজ্জলকে? কৌশিক সান্ত¡না দেয় বন্ধুকে— পাবে। অবশ্যই পাবে। যদি সে বেঁচে থাকে এবং ঢাকায় থাকে তবে না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আবার তবারক নিজেই মনে মনে ভাবে, নাকি ভাই বেঁচে নেই! এ কথা ভাবতে গেলে কেন যেন বুক কেঁপে উঠছে। অনেক আশা নিয়ে ভাইকে খুঁজতে এসেছে সে। শেষ দেখার পঞ্চাশ বছর পর। মা-বাবা তো এতদিন পর বেঁচে থাকার কথা নয়। ছোটবোন নূরজাহান কি তার কাছাকাছি কোথাও আছে? থাকলে আছে কোথায়? মনে মনে এভাবে হিসাব-নিকাশ করে চলে তবারক। এসব কথা ভাবতেই মনের কোণে ভেসে ওঠে সেইসব দিনগুলো। তিন ভাইবোন মিলে খেলছে। মারামারি ঝগড়াঝাটি খুনসুটি করছে। আরো কত কী! একটি সুন্দর পরিবার ছিল তাদের। ছিল ছিমছাম গাছপালা ঘেরা বাড়ি। বাড়ির পেছনে ছিল ছোট একটি পুকুর। জমিজমাও কম ছিল না। তার বাবা মজিবের বাজারে একটি মুদি দোকানও ছিল। ভালোই বেচাকেনা হতো। দুই ভাই বাবাকে সাহায্য করত। তোফাজ্জলের চেয়ে বিক্রয়িকের কাজে তার দক্ষতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বাবাও তার ওপরই বেশি ভরসা রাখতো। এমনকি সবাই প্রশংসা করত তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে তার এক শিক্ষক তো একবার বলেই ফেলেছিল, তুমি বাঁচলে অনেক বড় হবে। সুশ্রী চেহারার জন্য দুই ভাইকেই সবাই আদর করতো। এজন্য তার মা-বাবারও একরকম পুত্রগর্ব ছিল। কোনো কিছুরই অভাব ছিল না তখন। কত সুন্দর ছিল সেইসব দিন! যে রাতে তাদের গ্রামে হামলা হয় তখন তার বয়স বড়জোর পনেরো হবে। সদ্য হালকা গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। আর একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করেছিল প্রতিবেশী করিম চাচার মেয়ে সকিনাকে। সকিনাও আড়ালে আবডালে লুকিয়ে দেখছিল তার গতিবিধি। তাদের এ লুকোচুরি-খেলা নজর এড়ায়নি তোফাজ্জলের। তোফাজ্জলটা একটু বোকাই ছিল। জানিয়ে দেয় তার বাবাকে গোপন-ব্যাপারটা। বাবা সেদিন রাতে বেদম প্রহার করেছিল বালক তবারককে। করিম চাচাকেও শাসিয়েছিল— মেয়েকে বেঁধে রাখো, নইলে পরে পস্তাতে হবে। তারপর তাদের প্রেম যেন পেয়েছিল নিষিদ্ধ স্বীকৃতি। দুজন রাতের আঁধারে লুকিয়ে দেখা করত বাড়ির আশপাশে কোথাও। তার সাংকেতিক আওয়াজে সকিনা বের হয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হতো। কৈশোর প্রেমের বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল তবারকের দেহ-মন; স্বপ্নে-কল্পনায় কত মধুরই না ছিল সেসব দিন-রাত। আহা! কোথায় এখন সেই সকিনা! বেঁচে কি আছে! তবারক আর তোফাজ্জল যমজ। হঠাৎ কেউ নয় শুধু, অনেক পরিচিতজনও তাদের আলাদা করে চিনতে পারত না ; দুজনের চেহারায় এমনই সাযুজ্য ছিল। তবারকের নাকের নিচে ছোট তিলটি না থাকলে তাদের মাও বোধহয় দুজনকে আলাদা করতে ব্যর্থ হতো। প্রতিবেশী থেকে শুরু করে ক্লাসের সহপাঠীরাও এই ভুল করত। তখন দুজনই হাসত মনে মনে। তারাও মজা করত অনেক সময়। একজন ভুল করলে কখনো শাস্তি পেতে হতো অন্যজনকে। কখনো একজন মাথা পেতে নিত অন্যজনের প্রাপ্য শাস্তি। বিশেষ করে তবারক সরল ভাইটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করত সবসময়। ধানবাদ রেল স্টেশনটি ছিল তাদের বাড়ির খুব কাছে। একলা দুপুরে বা নির্জন সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে তবারক এখানে সময় কাটাতো। সেদিন একটু দেরি হয়েছিল। হঠাৎ মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি, পালাও পালাও রব, আকাশে আগুনের শিখা দেখে তারা বুঝে গিয়েছিল গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে যাওয়া মানে নিশ্চিত মরণ। তার কয়েকদিন আগে থেকে সবাই বুঝতে পারছিল যে, পরিস্থিতিটা ভীষণ থমথমে যেন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে শিগগিরই। ঝড় শুরুর আগের পূর্বাভাসের মতো। প্রাণ বাঁচাতে তখন স্টেশনে থেমে থাকা দিল্লিগামী ট্রেনে উঠে পড়ে সে। সঙ্গী হয় কয়েকজন বন্ধু ও তার চাচাতো ভাই ইউনুস। ইউনুস বয়সে তার থেকে ছয় বছরের বড় হলেও দুজনের মধ্যে ছিল দারুণ সখ্য। ট্রেন চলতে শুরু করলে নামা আর হয়ে ওঠে না। পথে অনেক স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালেও ইউনুসের ভরসায় সে চলে যায় দিল্লিতে। তারপর জয়পুর, আহমেদাবাদ, বোম্বাইসহ বিভিন্ন শহর ঘুরে একপর্যায়ে কলকাতায় এসে তবারক থিতু হয়। ইউনুস তাকে এত মুহূর্তের জন্যও তখন চোখের আড়াল হতে দিত না। ওইসময় দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল অদ্ভুত এক সম্পর্ক। সে ঠিক বুঝতে পারত না ইউনুসের ভালোবাসা। তবে উপলব্ধি করত যে, এই প্রাণের টান নিখাদ ও নিঃস্বার্থ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে গ্রামে এসে তবারক জানতে পারে, তার মা-বাবা ভাইবোন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেছে; দখল হয়ে গেছে তাদের বাড়িঘর জমিজিরাত—সব। সীমাহীন বেদনা বুকে নিয়ে অশ্রুসজল চোখে সে আবার কলকাতায়ই প্রত্যাবর্তন করে। আশ্রয় নেয় ইউনুসের কাছে। তারপর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-যন্ত্রণাবোধ, অপমান— সেসব ঘটনা শুনলে পাষাণের চোখেও জল আসবে। এত প্রতিক‚ল পরিস্থিতির মধ্যেও হাল ছাড়েনি জেদি তবারক; সমস্যা মোকাবেলা করেছে কঠিন মনের জোরে। এভাবে সে হয়ে ওঠে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। শত আঘাতেও সুন্দর মনটিকে ধরে রেখেছিল, গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করলেও সুবাস যেমন জড়িয়ে থাকে তাতে। তার সততা, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠায় মুগ্ধ হয় বাঙালি-মালিক আইয়ুব নবী— আদরের একমাত্র মেয়ে আয়েশাকে তুলে দেন তার হাতেই। আয়েশার মধ্যে সে ফিরে পায় হারানো প্রেম সকিনাকে। এক বাঙালি ও এক বিহারি মেয়ের গায়ের গন্ধ কীভাবে হুবহু একরকম হয় তা তাকে ভাবিয়েছিল দীর্ঘদিন। আয়েশার প্রাণ-উজাড় করা ভালোবাসা, শাশুড়ির আদর-যত্ন আর শ্বশুরের অকৃত্রিম স্নেহে অচিরেই তার দুঃখের জীবনটা সুখে ভরে যায়। আর এভাবে ভুলতে থাকে ফেলে আসা জীবনের কথা। শ^শুরের সহযোগিতা ও স্ত্রীর প্রেরণায় জীবনকে সাজায় রুচিশীল তবারক। এখন কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকার একজন বড় ব্যবসায়ী সেদিনের অসহায় বালকটি। বেশ নামযশও হয়েছে। গরিব-দুঃখীর মাঝে অকাতরে টাকা বিলায় সে। মানুষের বিপদে এগিয়ে যায়। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে জানে তবারক। তার ছেলেরা ব্যবসা আরো বাড়িয়েছে। হজও করেছে সে এই বছর। ৬৫ বছর বয়সেও তার শরীর অটুট। তবে চুল দাড়ি সব সাদা; সামান্য মেদ জমেনি কোথাও। ছেলেপুলে নাতি-নাতনি নিয়ে তবারকের এখন ভরা সংসার। তাকে কেন্দ্র করে ঘিরে থাকা সবাই বেশ ভালো আছে; এত সুখের মধ্যেও দিন দিন এক অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। মা-বাবা ভাইবোনের খোঁজ যদি একবার পাওয়া যেতো! বিশেষত মক্কা শরিফে হজ করার সময় সে বাবা-মাকে স্বপ্ন দেখে; ওরা তাকে ডাকছে— তুই আমাদের কোনো খোঁজ নিলি না বাপ! দেশে ফিরেই তার জেদ চেপে বসে। ভাইকে খুঁজে বের করবেই করবে। মা-বাবা বেঁচে না থাকলেও ভাই অবশ্যই বেঁচে আছে— তার ধারণা। ক্রেতা থেকে বন্ধু হয়ে-যাওয়া কৌশিকের কাছে তার মনের এই ইচ্ছে প্রকাশ করতেই কৌশিক তাকে আশ^স্ত করে। তবারক জানতে পেরেছে ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় অনেক বিহারি-মুসলমান থাকে। এদের বলা হয় মোহাজের বা দেশত্যাগী। এরা বেশিরভাগই মিশে যেতে পারেনি এখানকার সমাজের মূলধারার সঙ্গে। কারণ তারা একটি পাপকে ধারণ করছে। সেই পাপ জড়ানো এ দেশের জন্মের সঙ্গে। তখন মোহাজেররা লড়েছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা বাঁচানোর জন্যে। এমনকি তারা হত্যা করেছিল বহু নিরস্ত্র বাঙালিকে। সাহায্য করেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে। দোসর হিসেবে। বিভিন্নভাবে। তাই পূর্ববাংলা স্বাধীন হওয়ার পর এদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। নাগরিকত্বহীন এসব মোহাজের বাস করছে যুদ্ধাপরাধের কালিমা গায়ে মেখে। মানবেতর উপায়ে। বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে। অবশ্য কেউ কেউ পাকিস্তানের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে; পেয়েছে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। স্বজাতি-ভাইদের এই দুর্গতির কথা শুনে তবারকের বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠেছিল সেদিন। তোফাজ্জল আবার এমন কিছু করে নাই তো! তখন থেকে সে প্রায় ভাবে, তার মতো এরাও যদি সেদিন ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে না পালাতো, তবে তো আজ তারা এই অবস্থায় পড়তো না ; জড়াতে হতো না এমন অপকর্মের সঙ্গে। যদি এমন হতো বাংলার মতো বিহারের এক অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত, তবু এদের একটি গতি হয়তো হতো। গাড়িতে চলতে চলতে বন্ধুকে তবারক আলী আকস্মিক প্রশ্ন করে, তোমরা দেশ ছাড়লে কেন? তোমার ভাই এদেশের জন্য যুদ্ধ করেছে; বাপ প্রাণ দিয়েছে। কৌশিক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।—সে অনেক কথা; বললে শেষ হবে না। তবারক বলে, জানতে খুব ইচ্ছে করে। আমি বুঝি, তোমার বুকেও আমার চেয়ে ব্যথা কম নয়। তবে শোনো। আমাদেরও একটি সুন্দর বাড়ি ছিল। চট্টগ্রাম জেলায়। সীতাকুণ্ডের জাফরাবাদে। যেদিন উগ্রপন্থী হিন্দুরা অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙে, তার কয়েকদিন পর রাতের আঁধারে আমাদের পাড়ায় আক্রমণ হয়; ভাঙা হয় মন্দির। সব ফেলে আমরা লুকাই প্রতিবেশী এক মুসলমান-বাড়িতে। স্থানীয় ধর্মোন্মাদ তরুণরাই এ-কাজ করে। জেহাদি জোশে। প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে। শ্লোগান দেয়— একটা একটা হিন্দু ধরো, সকাল বিকাল নাস্তা করো। হিন্দুবিদ্বেষী এবং সুযোগসন্ধানীরা ইস্যুটিকে কাজে লাগায় তখন। অন্যান্য হিন্দু বাড়ির মতো দখল হয়ে যায় আমাদের বাড়িও। নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা ঢাকায় চলে আসি। এদিকে দাদার মনটাও ভালো ছিল না। অফিসে বিভিন্ন রকম সমস্যা চলছিল। সহকর্মীরা তার সঙ্গে এমন আচরণ করছিল যে, যেন তিনি নিজে গিয়ে বাবরি মসজিদ ভেঙে এসেছেন। ওই সময় এক মৌলবাদী সহকর্মী দাদাকে মালাউন ও ভারতের দালাল গালি দিয়ে বলে, এটা তোর দেশ নয়, তোদের দেশ ভারত। অন্যদের চোখেও যেন লোকটির প্রতি সমর্থন। কারণ কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ায় না। ন্যূনতম প্রতিবাদটুকু পর্যন্ত করে না। সহকর্মীদের এমন আচরণ দাদাকে বিমূঢ় করে। এসব কী বলে! তোমার ভাই না দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে! দুঃখটা তো এখানেই। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেও যখন এমন কথা শুনতে হয় দাদা তা মেনে নিতে পারেনি। তার পরপরই তিনি পরিবারকে কলকাতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। আমার নির্দিষ্ট কোনো চাকরি না থাকায় আমার পরিবারকেও তাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় দাদা। বাড়ির ঘটনার জন্য আমার স্ত্রীর মনও বিক্ষিপ্ত ছিল; এ ব্যাপারে তার সমর্থন পেয়ে আমিও রাজি হয়ে যাই। তারপরও এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে কি ঠিক করল তোমার দাদা? বাড়ি হারানো, অস্থিতিশীল সামাজিক পরিন্থিতি, অফিসের গোলমাল— সব মিলিয়ে একটি ক্ষোভ তাঁর মনের মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে। বিমর্ষ দাদার মুখের দিকে আমরা তাকাতে পারছিলাম না তখন। সে মুখে ভাসছে কেবল কিছু প্রশ্ন— কেন যুদ্ধ করলাম? কোথায় গেল ধর্মনিরপেক্ষতা? কেন রাষ্ট্রধর্ম? যে স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, কোথায় উড়ে চলে সে স্বপ্ন! দেশ যে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, এই দেশ তাঁকে কখনো কাছে টেনে নিবে না; বরং শুনতে হবে দেশদ্রোহিতার অপবাদ। পরবর্তী প্রজন্মকে একটি নিরুপদ্রব জীবন দেয়ার জন্যই তিনি নিয়েছিলেন এমন কঠিন সিদ্ধান্ত। আবার এটাও যে ঠিক করেছেন তা দাদা কখনো কখনো মনে করতেন না। তাঁর মধ্যে হতাশা দেখেছি অনেকবার। বন্ধুর কথা শুনে তবারক বিচলিত হয়।— হায় রে ধর্মনিরপেক্ষতা! এ দেশটি কি তাহলে একটি মিনি-পাকিস্তান হয়ে উঠছে? তাহলে তার জাতি-ভাইয়েরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়ে কী অন্যায় করেছে! তারা তো পাকিস্তানেই এসেছিল, বাংলাদেশে নয়। অথচ পাকিস্তানের হয়ে লড়ার পরও সরকার তাদের পাকিস্তানে নিয়ে যাবার কথা ভাবছে না। আটকে-পড়া পাকিস্তানি হিসেবে দিন কাটাতে হচ্ছে আলো-বাতাসহীন বদ্ধ রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে। আবার কৌশিকদের মতো মুক্তিযোদ্ধার ভাই ও সন্তানদেরই বা কেন দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে হচ্ছে! কেবলই ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে। তবুও তো ভালো যে, বাংলার একটি অংশ ভারতে থাকাতে তারা সেখানে যেতে পারছে। আর অস্তিত্ব টেকাতে এখানে পালিয়ে আসা বিহারিদের তো সেই জায়গাটুকুও নেই। এসব ভাবতে ভাবতে ও আলাপচারিতায় গাড়ি আজিমপুরে পৌঁছে যায়। কৌশিকের ভাইয়ের সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারে তারা ওঠে। তবারকের কথা শুনে সুনীল রায় বেশ অবাক হন। তার ভাইকে বাঁচাতে সে নিয়ে যেতে চায়। নিজ দেশে। আর তিনি পরিবারকে রক্ষা করতে পাঠিয়ে দেন। অন্য দেশে। সুনীলের কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ে হতাশা। মুহূর্তে চোখের কোণে ছলকে ওঠে অশ্রুবিন্দু। তবারকের সঙ্গে কথা বলার সময় সুনীল বাবু দুজনের ব্যথার সাদৃশ্য খুঁজে পান। অথচ দুজনের মাতৃভাষা ভিন্ন এমনকি ধর্মও ভিন্ন। দুজনই তো এখন বাস্তুচ্যুত। এর মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে? ভ‚মিপুত্র হয়েও আজ চৌদ্দপুরুষের ভিটেয় থাকার ও যাওয়ার অধিকার নেই কারো। সেখানে বাস করছে স্বভাষী ভিন্ন ধর্মের মানুষ। তবে কি মাতৃভাষা নির্মাণ করে না আত্মীয়তার সম্বন্ধ? ধর্মই কি সব? না। তাহলে তো বিহারি মুসলমানদের বুকে রাখতো বাঙালি মুসলমানরা। এভাবে দূরে ঠেলত না। সুনীল বাবু তাকে বলেন, এখানে বেশ কয়েকটি বিহারি ক্যাম্প আছে। আপনার ভাইকে খুঁজে পেতে কষ্ট হবে। তবে ভালোভাবে খোঁজ করলে হয়ত তোফাজ্জলের কোনো খবর পাওয়া যেতে পারে। সুনীল রায়ের কথায় তবারক একটু আশার আলো দেখতে পায়। বিকেলে তারা মিরপুরের উদ্দেশে রওনা হয়। কালশি মুড়াপাড়া ক্যাম্পে চারজন তোফাজ্জলের দেখা মেলে। দুজনের বয়স চল্লিশের নিচে; দুজন তার সমবয়সী। তবে তাদের কারো বাপের নাম মজিব নয়। ক্যাম্পের সর্দার নাটু জব্বার তাকে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন ক্যাম্পের কথা বলে। জানায়, সেখানে বেশ কয়েকজন তোফাজ্জল আছে। অতঃপর তারা মোহাম্মদপুরের ক্যাম্পগুলোতে খোঁজ করতে আসে। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে যে, এখানকার পাঁচটি ক্যাম্পে সাতজন তোফাজ্জল আছে। একজনের বাপের নামও মজিব, কিন্তু মায়ের নাম হালিমা নয়। বিভিন্ন বয়সী তোফাজ্জলদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে টাউন হল ক্যাম্পে ছয় নম্বর তোফাজ্জলের সঙ্গে সব মিলে যায়। এমনকি বিহারের তাদের গ্রামের নামও। কিন্তু তোফাজ্জলের দেখা মেলে না। দেখা হয় তোফাজ্জলের ছেলে রওশনের সঙ্গে। রওশনকে দেখেই সে বুঝতে পারে যে, এ তার রক্তের উত্তরাধিকার। তাদের চেহারার অদ্ভুত সাদৃশ্য কৌশিকের চোখেও অনায়াসে ধরা পড়ে। রওশনের কাছে সে সব শুনতে পায়; তার মা-বাবার কথা, বোনের কথা। মা-বাবা পালানোর সময় সীমান্তের কাছে ওই রাতেই খুন হয়। ধর্ষণ করে হত্যা করা হয় নূরজাহানকে। তোফাজ্জল তখন একটি দলের সঙ্গে মিশে কোনোরকমে প্রাণে বাঁচতে সক্ষম হয়। এসব শুনতে শুনতে অশ্রু সংবরণ করতে পারে না তবারক। মাঝের পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান যেন ঘুচে যায় মুহূর্তে। রওশন এখন ৩৫ বছরের যুবক। দারিদ্র্যের কশাঘাতও তার চেহারার আভিজাত্য ঢাকতে পারেনি। রওশন কাজ করে মোহাম্মদপুরের এক সেলুন দোকানে। তার দুই ছেলে। নাজির ও নাসির। ছেলেরাও কাজ করে তার সঙ্গে। ক্যাম্পের অন্যান্য বিহারি শিশুদের মতো এরাও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। রওশন তবারককে পেয়ে যেন খড়কুটোর দেখা পায়। বাঁচার জন্য। চাচাও বাড়িয়ে দেয় তার উদার হাত— তোদের আমি কলকাতায় নিয়ে যাবো। আমাদের দেশে। রওশনের স্ত্রী রেহানাও বেশ খুশি হয় এই প্রস্তাব শুনে; মনে মনে বলে, আল্লাহ এতদিনে আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। তবারক ভাই সম্পর্কে রওশনের কাছে যা শুনে তার জন্য কৌশিকের সামনে বিব্রতবোধ করতে থাকে। তোফাজ্জল একজন স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী। মিরপুরের কসাই কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল সে। কিন্তু কেন এমন অপরাধে জড়ালো সে? ভারতে থাকলে কি এমন জঘন্য কাজ করার দরকার হতো? সেখানে আর কিছু না থাকুক, নাগরিকত্বটুকু তো থাকতো। অখণ্ড পাকিস্তান বজায় রাখার জন্য সে জড়ায় যুদ্ধাপরাধে; অন্যান্য বিহারি যুবকসহ যুক্ত হয় রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে। যুদ্ধের পর বাঙালিরা তাকে একরকম মেরেই ফেলেছিল। নেহাত এক মুক্তিযোদ্ধার সুনজর থাকায় কপালের জোরে প্রাণে বেঁচেছিল সেদিন; তবে বিকলাঙ্গ অবস্থায়। মস্তিষ্কে বিকৃতি শুরু হয় বছর তিন আগ থেকে। বিড়বিড় করে খালি বলত, আমার পাকিস্তান, আমার পাকিস্তান। এই পাকিস্তানের জন্য নিজ হাতে মানুষ জবাই করেছি। আমি পাকিস্তানে যাব। আমার দেশে যাবো। আমার প্রাণের পাকিস্তানে যাব। তোফাজ্জলের পাগলামি সীমা ছাড়িয়ে গেলে রওশন কয়েক বন্ধুর সহযোগিতায় পাকিস্তানের কথা বলে পাবনায় নিয়ে যায়। মানসিক হাসপাতালে। সব শুনে তবারক নির্বাক। এসব কী বলছে রওশন! স্তম্ভিত হয়ে যায় কৌশিকও। কৌশিকের ধারণা ছিল ভাষা ভিন্ন হলেও সমধর্মীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। অথচ সে এসব কী শুনল! সে ভাবে কলকাতার কথা। কলকাতায় ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন ভাষার মানুষ দূরত্ব বজায় রেখে হলেও সহাবস্থান করে; কারো সঙ্গে নেই কারো কোনো সংঘাত। কিছুক্ষণ পর তবারক বলে, আমাকে আমার ভাইয়ের কাছে একবার নিয়ে চল। আমি তাকে শুধু একবার নিজ চোখে দেখতে চাই। তাকে না দেখে মরলেও আমি শান্তি পাব না। ওইদিন রাতেই তারা পাবনার উদ্দেশে রওনা হয়। হাসপাতালের সুপার তাদের জানায়, আপনাদের রোগীর অবস্থা ভালো নয়। আপনারা এসে ভালোই করেছেন; নইলে আমরাই আপনাদের খবর দিতাম। যান, তিনি ১০৩ নম্বর বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তবারক কাকে দেখছে? একি সে নয়? একই চেহারা, একই রকম সাদা চুল দাড়ি। তোফাজ্জলের চোখ দুটি ঠিকরে বের হতে চাইছে। তবারক মৃত আত্মজের খোলা চোখ দুটো বন্ধ করে দেয়। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ে। রওশনকে জড়িয়ে ধরে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App