×

বিশেষ সংখ্যা

জাগতিক কল্যাণের স্বচ্ছ বহিঃপ্রকাশ ঈদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০১৯, ০৩:১৭ পিএম

জাগতিক কল্যাণের স্বচ্ছ বহিঃপ্রকাশ ঈদ
উৎসব শুধু আনন্দ বিনোদন নয়, মানুষের জাগতিক জীবনের সাথে আত্মস্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই উৎসবের আয়োজন সৃষ্টি হয় কোনো লৌকিক আচার-আচরণ, উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে। বিজয়ের কোনো জাতীয় বীরের অথবা কোনো বিগ্রহকে ঘিরে জাতিতে জাতিতে বিভিন্ন সময় নির্দিষ্ট দিনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয় নিজ নিজ জাতির উৎসব। বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশে ঈদুল ফিতর হলো বৃহত্তম বাৎসরিক উৎসব। ঈদ শব্দটি আরবি। অর্থ খুশি, আনন্দ, আনন্দোৎসব ইত্যাদি। ধর্ম মতে, ‘ফিতর’ মানে রোজা ভাঙা। ইফতার শব্দটিও ‘ফিতর’ থেকে এসেছে। ঈদুল ফিতরের অর্থ রোজা শেষ হওয়ার আনন্দ। রমজানের দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় কষ্ট ও ক্লান্তির পর স্বাভাবিকভাবেই সুখ ভোগের বিষয়টি এসে যায়। ঈদুল ফিতর রোজাদারদের সেই স্বভাবসমেত সুখ উপহার দেয়। পবিত্র ঈদ মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে এবং স¤প্রীতি বৃদ্ধি করে। ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়ে রাজা-প্রজা এক কাতারে শামিল করিয়ে দেয়। ঈদের উৎসবে স্থানীয় সংস্কৃতির গুরুত্ব আছে। ঈদ বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় উৎসব হলেও এতে স্থানীয় সংস্কৃতিও যোগ হতে পারে। তাই দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদ উদযাপিত হয় বিভিন্ন সংস্কৃতিতে। ঈদের দিন সাধারণত বাঙালি পুরুষ ও ছেলেরা পায়জামা-পাঞ্জাবি এবং নারীরা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ পরেন। অর্থাৎ বাংলাদেশে ঈদ উদযাপিত হয় বাঙালি সংস্কৃতিতে। এমনিভাবে মালয়েশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ, সৌদি আরব ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করেন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে। মদিনায় ঈদ উৎসবের শুরু হয়ে কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের রূপ ধারণ করেছে। তবে কালপরিক্রমায় ভৌগোলিক ব্যবধান ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের কারণে ঈদ উৎসবের ধরন পরিবর্তিত হলেও এর মৌলিক বিধানাবলি ও মূল চেতনা অপরিবর্তিত আছে। মুঘল আমলে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার ধানমন্ডির ঈদগাহ? মাঠটি ঈদ উৎসবের অগ্রযাত্রার একটি নিদর্শন হিসেবে আজো বর্তমান। তবে ১৯ শতকের আগে এ উৎসব ছিল রাজা-নবাব কিংবা সমাজের বিত্তশালী মানুষের উৎসব। পরে তা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বিস্তৃত হতে শুরু করে। প্রাচীন বাংলায় ঈদ উৎসবের আনন্দ আয়োজন কেমন ছিল তা জানার উপায় নেই। সুলতানী আমলে (১৩০০-১৫৩৮ খ্রি.) মোটামুটি দুইশ বছরের বেশি সময়ে নগরকেন্দ্রিক ঈদ উৎসবের কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায়। গৌড় পান্ডুয়া, সোনারগাঁওকেন্দ্রিক রাজধানী শহরগুলোতে তৎকালীন সুলতানদের নির্মিত মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো। ঈদ উপলক্ষে সুলতান, আমির, ওমরাহদের উদ্যোগে ঈদের বর্ণাঢ্য মিছিল হতো, এ মিছিলে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সমাহার থাকতো। ইসলামি পতাকা, রঙ-বেরঙের পতাকা বহন করে চলত পাইকরা, মিছিলের অগ্রভাগে রাজকীয় হাতিতে অবস্থান করতেন সুলতান স্বয়ং। ছাতাবাহী অন্যান্য পাইক বরকন্দাজ দল থাকতো পিছু পিছু। ঈদের জামাতে সুলতানদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ‘বাদশাহী কা তখ্ত।’ নামাজের সময় সুগন্ধি গোলাপজল ছিটিয়ে দেয়া হতো। সুলতানদের উদ্যোগে মসজিদ আঙিনায় নামাজ শেষে ঈদের খাবার বিতরণের প্রচলন ছিল। বর্তমান বাংলায় আমরা প্রতি বছরই দেখি হাজার হাজার মানুষ শত বিড়ম্বনা পেরিয়েও কর্মস্থল শহর ছেড়ে প্রিয় নিজ গ্রামে চলে যাচ্ছেন। মা-বাবা, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে মিলে ঈদ উপভোগ করছেন। ঈদের আগের দিন তো ঢাকা শহরসহ বড় বড় শহর এক ধরনের ফাঁকাই হয়ে উঠে। এটি এখন বড় শহর, নগরের চিরায়ত দৃশ্য বলা যায়। চারদিকে এখন ঈদুল ফিতর উপভোগের পূর্ণ আয়োজন দৃশ্যমান। নগরীর দোকানপাটগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। হাজারো মানুষ কেনাকাটায় ব্যস্ত। দোকানিদেরও কথা বলার ফুরসত নেই। বড় বড় শপিং মল, হকার্স মার্কেট কিংবা মহল্লার দোকান সবখানেই এখন ভিড় আর ভিড়। মনে হয় যেন ঈদের কেনাকাটাতে কারো কোনো ধরনের ক্লান্তি নেই! ভেদাভেদ ভুলে পারস্পরিক উপহার-শুভেচ্ছা বিনিময় ঈদ উৎসবকে প্রীতিময় করে তোলে। আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনকে বিভিন্ন ধরনের উপহার দেয়া হয় ঈদ উপলক্ষে। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সমাজসেবীসহ বিভিন্ন পেশা ও বিভিন্ন বয়সী মানুষের শুভেচ্ছা বিনিময় বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। সাম্প্রতিককালে ঈদ কার্ড ও মোবাইল ফোনের খুদে বার্তা, ই-মেইল, ফেসবুকের মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় সহজ হয়েছে। ঈদের উৎসব শুধু ভোগের নয় ত্যাগেরও। ভোগে শুধুই সুখ আছে আর ত্যাগে সুখ ও আনন্দ উভয়ই আছে। তাই ঈদের উৎসবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ঈদের আনন্দে সম্পৃক্ত করার জন্য কমবেশি সবাই চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দলীয় নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও জনগণকে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে তাদের ঈদের আনন্দে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেন। ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসায়িক পণ্যের দিকে জনগণকে আকৃষ্ট করার জন্য ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। সমাজের সবাইকে ঈদের আনন্দে সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন সমাজসেবীরা। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মীরা সবাইকে ঈদের আনন্দ দেয়ার জন্য রচনা নির্মাণ করেন বিশেষ সাহিত্য ও নতুন নতুন বিনোদন কর্মসূচি। ঈদ মুসলমানদের আনন্দ উৎসব হলেও সাম্প্রদায়িক স¤প্রীতির বাংলাদেশে এ উৎসবে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও অংশ নিয়ে থাকেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের লোকেরা ঈদ উৎসবে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এতে পাস্পরিক সহানুভূতি, জাতীয় ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় হয়। তবে বাঙালি মুসলিম জীবনে ঈদ উৎসব উপভোগেও আমরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বিশ্বায়ন আর মিডিয়ার কারণে ঈদ উৎসব এখন আর সেই সনাতনী ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আর এ কারণে শুধু শহুরে জীবন নয়, গ্রামীণ জীবনের ঈদ উৎসবেও যুক্ত হয়েছে নানা পরিবর্তন আর বর্ণিলতা। তবে সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, গ্রামের ঈদ সব সময়ই বৈচিত্র্য ও বর্ণময়। সেই তুলনায় শহুরে ঈদ কিছুটা হলেও নাগরিক চরিত্রের মধ্যেই ডুবে থাকে। গ্রামের ঈদে দারুণ প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। এক সময় গ্রামে ঈদের দিন নামাজ শেষে নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হতো যেখানে গ্রামের নবীন-প্রবীণ সবাই অংশ নিত। রশি টানা, দৌড় প্রতিযোগিতা, নৌকাবাইচ, নবীন আর প্রবীণের মাঝে ফুটবল খেলা, ভলিবল খেলা, হাডুডু খেলা, লাঠি খেলা এরকম নানাবিধ খেলাধুলার আয়োজন থাকতো। একইসাথে থাকতো নাটক, পালাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বা বিচিত্র অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো আয়োজনের কোনো ঘাটতি নেই। তবে আগের তুলনায় আয়োজনে আরো বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার আয়োজনে আধুনিকতা যুক্ত হওয়ায় অনেক কিছুই মিইয়ে গেছে তথ্যপ্রযুক্তির কারণে। ঈদ আনন্দের এখন অন্যতম অনুষঙ্গ স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। এক যুগ আগেও ঈদের রাতে শুধুমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় সবাই চোখ রাখতেন। সবচেয়ে জনপ্রিয় ঈদ ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য সবাই কমবেশি প্রস্তুতি নিতেন। কিন্তু গত এক যুগে ঘর বিনোদনের জায়গাটি অসম্ভবরকম বিস্তৃত হওয়ার কারণে ঈদ উপভোগে চ্যানেলগুলোর প্রতিযোগিতামূলক আয়োজন এখন আমাদের নগর ও গ্রামীণ জীবনে অন্যরকম প্রভাব ফেলেছে। প্রায় সব চ্যানেলই পাল্লা দিয়ে ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণ করছে। প্রতিটি চ্যানেলই এক নাগাড়ে ছয় থেকে সাতদিন শুধু ঈদের অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানসহ নাটক, টেলিফিল্ম, গান, রম্যবিতর্ক, টকশো, ফান শো, রান্নাবান্না, তারকালাপসহ নানাবিধ বর্ণিল আয়োজনের সমাহার থাকছে। আগে কেবলই শহরে মানুষের ঘরে টিভি থাকলেও যুগের চাহিদায় টেলিভিশন এখন বিত্তহীন, দরিদ্র, গরিব মানুষের ছেঁড়া-ফুটো ঘরেরও অলঙ্কার। ফলে বলতে দ্বিধা নেই স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো বর্তমানে আমাদের ঈদ আনন্দকে আরো রূপময় করে তুলেছে। এসব তো গেল ঈদ আনন্দের আনন্দময় নতুন সব আয়োজনের কথা। কিন্তু ঈদ উৎসবের অন্যতম একটি বিষয় হলোÑ সম্প্রীতি, সৌহার্দ আর ঐক্যের মহামিলন। ধর্ম মতে, ঈদ উৎসব ধনী, গরিব নির্বিশেষে এক কাতারে নিয়ে আসে। তাই প্রতিটি ঈদে আমরাও এমনটি কাম্য করি কোনো বিরোধ বা অপচর্চা নয়, চাই মানুষের মাঝে সম্প্রীতির মিলনমেলা। চাই প্রতিটি মানুষের জীবনে ঘটুক ঈদ আনন্দের প্রতিফলন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অনেক ঘটনায় এর ব্যত্যয় হয়। ঈদ উৎসবেও আমরা বিবিধ ক্ষেত্রে সামগ্রিকতা আনতে ব্যর্থ হই। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ঐক্যের তুমুল টানাপড়েন থাকার কারণে আমরা দেখেছি আমাদের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেককিছুই মুখ থুবড়ে পড়ে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের জাতীয় জীবনে অন্তহীন সমস্যা রয়েছে। একদিনে যেমন রয়েছে শত নাগরিক বিড়ম্বনা, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি। ঈদের সময় আমরা আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছি সড়ক, মহাসড়কে দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া। প্রতি বছরেই অনেক পরিবারের ঈদের আনন্দ মাটি হয়েছে শুধুমাত্র সড়ক দুর্ঘটনা কারণে। মানুষের জাগতিক কল্যাণের জন্য মনের মাধুরী মেশানো স্বচ্ছ পবিত্র আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হলো উৎসব। জাত, পাত, গোত্র প্রকৃতিতে দৃশ্য-অদৃশ্য উৎসব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই বহমান। হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, দরিদ্রতা, ক্লিষ্টতা, মলিনতা, হানাহানি হতাশাগ্রস্ত সমাজে উৎসব আনন্দ একটি ঐক্যবদ্ধ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে। উৎসব হতাশাগ্রস্ত হতোদ্যম একটি জাতিকে চিরবহমান এক উচ্ছ¡ল প্রাণ প্রাচুর্যের ঝর্ণাধারায় নিয়ে যায়। মানুষ উৎসবকে কেন্দ্র করে আত্মা প্রাচুর্যের শক্তি ফিরে পায়। নিরাপত্তা, ঐক্য, সম্প্রীতিতে জাতীয় জীবনে ঈদ হোক আরো আনন্দময়, এই প্রত্যাশা আমাদের তথা সব দেশবাসীর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App