×

সাময়িকী

চেনা-অচেনা এই শহরে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০১৯, ০৪:৩৫ পিএম

চেনা-অচেনা এই শহরে
গুলশান ১-এ নতুন একটা শাড়ির দোকানের উদ্বোধন হবে। এ উপলক্ষে জমজমাট ফ্যাশন শো’র আয়োজন করা হয়েছে। আজকাল ঢাকায় প্রায়ই এমন ফ্যাশন শোর আয়োজনের চল। সানজানার পারফরম্যান্স রয়েছে ওখানে। একজন র‌্যাম্প মডেল হিসেবে তার বেশ নামডাক হয়েছে অল্পকিছু দিনেই। তাই তো এখন বেশিরভাগ ফ্যাশন শোতে সানজানার ডাক পড়ে। এর বাইরে টিভিসির জন্যও মডেল হয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ও। টিভিতে প্রায়ই বিভিন্ন অ্যাডে তাকে দেখা যায়। আজকাল আবার মিউজিক ভিডিওতে কাজ করছে, অনেকগুলোর শুটিং হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে মিউজিক ভিডিওগুলো দেখানো শুরু হবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং ইউটিউবে। সানজানার সঙ্গে মুনার জানাশোনা প্রায় এক বছরের। উত্তরায় এক ক্লাবে তার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। অনেক রাতে পার্টি শেষ হলে মুনা কিছুটা বেকায়দায় পড়েছিল সে দিন। যার সাথে সেখানে গিয়েছিল তার জরুরি কাজ থাকায় মাঝপথেই সে পার্টি ছেড়ে যায়। মুনা ভেবেছিল, একটা ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া নিয়ে বাসায় চলে যেতে পারবে। কিন্তু রাত অনেক হয়ে যাওয়ায় আশপাশে রাস্তায় কোনো ট্যাক্সি ক্যাব অথবা সিএনজিও পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন বাইরে ধুমসে বৃষ্টি হচ্ছিল। অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে একটা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল মুনা। বেশ ভয় পাচ্ছিল সে। উত্তরায় গত বেশ কিছু দিন এমন কতক ঘটনা ঘটেছে যা যে কোনো মেয়ের জন্য আতঙ্কের। এখানে নানা ফাঁদ পেতে ভাড়া গাড়ির জন্য অপেক্ষমাণ মেয়েদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের পর খুন করার বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। তাই রাতে গাড়ির জন্য এভাবে একাকী দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ ছিল না মুনার। শহর থেকে দূরে নির্জন জায়গায় পরদিন ধর্ষিতা মেয়েদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া গেছে। পত্রিকার পাতায়, টিভি পর্দায় ঘটনাগুলোর বিবরণ দেখে শিউরে উঠছে সবাই। এখন ঢাকায় তেমন অপরাধী চক্রের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আজকাল মেয়েদের নানা কাজে ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে। চাকরি-বাকরি কিংবা কলেজ, ভার্সিটি, কোচিংয়ের ক্লাস শেষে অনেক মেয়েরই বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে যায়। রাস্তায় গাড়ির জন্য লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করতে করতে আরো সময় গড়িয়ে যায়। এ অবস্থায় লম্পট অপরাধী দলের ফাঁদে কে, কখন, কোথায় পড়ে যায় তেমন একটা ভয় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে রাতে রাস্তায় থাকায় সব মেয়েকেই। বিষয়গুলো মুনার অজানা নয়। মুনা অস্থির হয়ে ভাবছিল, কী করা যায় এখন। তাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পার্টি শেষে গাড়ি নিয়ে বেরোতে থাকা কয়েকজন পুরুষ লিফটের অফার করেছে। অচেনা বা অল্প পরিচিত কারো গাড়িতে এত রাতে চড়াটা মোটেও উচিত হবে না ভেবে ‘নো থ্যাংকস, আমার গাড়ি আসছে, পথে জ্যামে আটকা পড়েছে’, বলে অজুহাত খাড়া কোনোভাবে সরিয়ে রেখেছে নিজেকে। অথচ এদিকে রাত বাড়তে থাকায় মুনার মধ্যে দুশ্চিন্তা আরো জেঁকে বসছিল। এই অবস্থায় হঠাৎ তার পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। চমকে তাকায় সে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে সানজানা। আজকের পার্টিতে যেই মেয়েটির সাথে তার প্রথম পরিচয়। তেমন বেশি কথা হয়নি। অল্প সময়ের আলাপে তাকে বেশ স্মার্ট এবং ড্যামকেয়ার মনে হয়েছে মুনার। সানজানার স্মার্টনেস তাকে আকৃষ্ট করলেও ড্যামকেয়ার ভাবটা ভালো লাগেনি। ‘হাই মুনা বেবি, এখানে একা দাঁড়িয়ে কেন, কেউ কী আসবে তোমাকে নিতে,ওয়েটিং ফর সামবডি? মুনা কী জবাব দেবে সানজানার প্রশ্নে, বুঝে উঠতে পারে না। এর মধ্যে ঝড়-বৃষ্টির মাত্রাটা বেড়েছে আরো। বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে খুব। কাপড়চোপড় ভিজে একাকার। ভাড়া গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকাটাও অসম্ভব হয়ে উঠছে। এভাবে বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। ঠিক বুঝতে পারছে সে। ‘গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি, কিন্তু একটা ট্যাক্সি ক্যাবও দেখছি না। অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল’, বেশ অসহায় ভঙ্গিতে বলে মুনা। ‘বোকা মেয়ে! এত রাতে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এভাবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক নয়। কোনো ভয় নেই তোমার? এসো, আমার গাড়িতে। তোমাকে একটা লিফট দেই, বাসায় তো যাবা?’ অল্প কিছু সময়ের পরিচয়ে সানজানাকে খুব বেশি জানার সুযোগ হয়নি। কিন্তু তার গাড়িতে যাবার আহ্বানে আন্তরিকতার ছোঁয়া মুনাকে মুহূর্তেই স্পর্শ করে। আর ‘না’ বলতে পারে না। দরজা খুলে সানজানার পাশের সিটে বসে মুনা। না, গাড়িতে আর কেউ নেই। সানজানা একাই গাড়ি নিয়ে এসেছিল পার্টিতে। বেশ সাহসী তো মেয়েটা, মুনা ভাবে। ‘এই মেয়ে, কোনোদিকে যেতে হবে বলো?’ সানজানা একটু মজা করে জানতে চায়। ‘আমার বাসা তো মোহাম্মদপুরে, বাবর রোড,’ মুনা বলে কিছুটা আড়ষ্টভাবে। তাকে এত রাতে লিফট দিতে সানজানার মোহাম্মদপুর যেতে হচ্ছে ভেবে নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে থাকে সে। বাসায় কে আছে? আই মিন কার সাথে থাক? উইথ ফ্যামিলি অর উইদাউট ফ্যামিলি? ‘আরেকটা মেয়ের সঙ্গে থাকি, ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট নিয়ে।’ ‘ওহ, বুঝতে পেরেছি ‘কী বুঝতে পেরেছেন?’ সহজ সরল ভঙ্গিতে বলে মুনা। ‘নাহ, ও কিছু না,’ বলে সানজানা ড্রাইভিংয়ে মন দেয়। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। পথঘাট সব ভেসে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় রাস্তায় বেশ পানি জমে গেছে ইতোমধ্যে। এর মধ্যে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বেশ টাফ। তারপরেও খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে সানজানা। ড্রাইভিংয়ে তার হাত ভালোই পাকা। এত রাতে একটা মেয়ে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে, কেমন নিঃসংকোচে ড্রাইভ করছে। তার মধ্যে কোনো ভয়ডর বা শঙ্কা নেই। কিন্তু সানজানার দিকে বেশ কয়েক মুহূর্তে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুগ্ধ হয়ে যায় মুনা। এই ঢাকা শহরে এমন সাহসী মেয়ে কয়টা আছে, কৌত‚হল বোধ করে মুনা। যে গভীর রাতে একাকী ব্যস্ত রাজপথে গাড়ি ড্রাইভ করে কোনো কিছু পরোয়া না করে। হঠাৎ পরিচিত হওয়া একটি মেয়েকে তার বাসায় পৌঁছে দিতে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়েছে। এতসব বিষয় চুপচাপ বসে ভাবছিল মুনা। মাঝে টুকটাক সানজানার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। উত্তরা ছেড়ে গাড়ি বনানী চলে এসেছে ততক্ষণে বাইরে তাকাতেই খেয়াল করে মুনা। তন্ময় হয়ে সানজানাকে দেখছিল সে, আর অনেক কিছু ভাবছিল তাকে নিয়ে। হঠাৎ গাড়িটা থেমে পড়ায় ঘোরটা কেটে যায় তার। চমকে বাইরে তাকায়। সামনে লম্বা জ্যাম। রাস্তায় অনেক পানি জমে থাকায় এগোতে পারছে না কেউই। সহজে এই জ্যাম ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। সানজানাকে বেশ চিন্তিত মনে হয় এবার। দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠতে থাকে তার চেহারায়। ‘বেশ প্রবলেম হলো তো, তোমাকে কীভাবে নিয়ে যাব এত রাতে মোহাম্মদপুরে, রাস্তাঘাট ডুবে গেছে বৃষ্টির পানিতে, এগোতে পারছে না কেউ, কী যে করি এখন?’ ‘আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল,’ হতাশা ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে। মুনা বিব্রত বোধ করতে থাকে ভীষণভাবে। ভাবে হায়, তাকে গাড়িতে তুলেই মেয়েটা আজ বিপদে পড়ল। তা না হলে এতক্ষণে গুলশানের নিকেতনে নিজের বাসায় পৌঁছে যেত সে। তার কারণে এত রাতে রাস্তায় বড় একটা বিপদে পড়ে গেল সানজানা। নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হয় মুনার। ‘আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে তুমি বাসায় চলে যাও, আমার কারণে তুমি বিপদে পড়েছ, এখন সাফার করছ, আই অ্যাম সরি, প্লিজ, ড্রপ মি হিয়ার অ্যান্ড ইয়্যু গো টু ইয়্যুর হোম, আমি একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারব চিন্তা করো না,’ নরম গলায় কথাগুলো বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায় মুনা। ‘অ্যাই মেয়ে, পাকনামো দেখাচ্ছ! আমাকে এখানে এই রাস্তার একাকী রেখে তুমি বাসায় চলে যাও, আমি একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারব। ইস্, কত্তো সেয়ানা হয়েছে মেয়েটা। আর একটা কথা বললে দিব আচ্ছা করে, চুপ করে বস। ডন্ট বি সিলি, ইউ আর নট সো ডেয়ারিং...। নামো তো দেখি গাড়ি থেকে, তুমি কি ভেবেছ আমাকে, আমি এখানে এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে রাস্তায় তোমাকে একা ফেলে রেখে বাড়ি গিয়ে নাক ডেকে ঘুমাব, আর তুমি একা এই রাতে বৃষ্টির মধ্যে পড়ে নাকানিচুবানি খাও...। আমি এটা মেনে নেব, ভাবলি কী করে তুই?’ এবার হঠাৎ ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’য়ে নেমে আসে সানজানা। যেন কত কাছের মানুষ, কতদিনের চেনা এই মুনা মেয়েটি। ‘তুই আমার সাথে চল, আমার বাসায়, কোনো ভয় নেই। কাল সকালে চলে যাস তোর বাসায়, তোর কোনো বিপদ হোক আমি চাই না, আমার বাসায় গেলে তোর কোনো সমস্যা বা বিপদ হবে না, গ্যারান্টি দিচ্ছি।’ একটানা কথাগুলো বলে সরাসরি তাকায় সানজানা মুনার দিকে। ঢাকা শহরে আসার পর অনেক মানুষের সাথে ওঠাবসা হয়েছে মুনার। কতজনের সাথে মিশেছে। কতবার যে প্রতারিত হতে হয়েছে তাকে। কাউকে এখন সে বিশ্বাস করে উঠতে সাহস পায় না। সবাইকে ধান্ধাবাজ, প্রতারক, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী মনে হয় কেবল। অথচ সানজানার কথাগুলো শুনতে শুনতে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে মুনা, তার সঙ্গে অল্পকিছু সময়ের আলাপ পরিচয়ে মেয়েটা এতটা আপন করে নিয়েছে ভাবতেই বুকের ভেতরটাতে কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। কেন জানি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। একসময় ঝরঝর কান্নায় ভেঙে পড়ে মুনা। সানজানা আন্দাজ করতে পারে তার ব্যথা। সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। সে রাতে সানজানা মুনাকে তার গুলশানের নিকেতনের বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। বাইরে থেকে তাকে দেখে ওভার স্মার্ট, ড্যামকেয়ার একটা মেয়ে মনে হলেও সানজানার ভেতরটা অনেক সুন্দর আর ভীষণ সহজ সরল। তার মনটা খুবই নরম। তার চাল-চলন কথাবার্তা ব্যবহার সবকিছুতেই এক ধরনের রাফ অ্যান্ড টাফ ভাব ফুটে উঠলেও সে রাতে মুনা সানজানার ভেতরের আসল রূপটা দেখেছিল। সে চাইলে মুনাকে বৃষ্টিমুখর রাতে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যেতে পারত। ক্লাবে স্বল্প পরিচয়ের সূত্রে মুনার মতো একটা মেয়ের প্রতি এতটা সহানুভ‚তি দেখিয়ে নিজের বাসার নিয়ে যাওয়া এবং ভেজা জামাকাপড় পাল্টে তার নিজের জামাকাপড় পরতে দেওয়া, নিজের বেডরুমে একই বিছানায় পাশে ঘুমোতে বলা। সবকিছুতে সানজানার উদারতার প্রকাশ তাকে দারুণ মুগ্ধ করেছিল। সেই থেকে সানজানার সঙ্গে মুনার বন্ধুত্বের সূচনা। দিনে দিনে এটা আরো গভীর হয়েছে। ওর বাবা নেই। আরো আগেই মারা গেছেন। বড় দু’ভাই আছেন, থাকেন কানাডায়। ওখানকার সিটিজেনশিপ পেয়েছেন। তাদের কাছে মা থাকেন। সানজানাও প্রায়ই কানাডায় মা ও ভাইদের কাছে গিয়ে থাকে। ওখানকার একটা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশনও নিয়েছিল। কিছুদিন ক্লাস করে আবার দেশে ফিরে এসেছে কী এক টানে। ছোটবেলা থেকেই সানজানার স্বপ্ন, দেশের সেরা এবং জনপ্রিয় মডেলদের একজন হবে সে। কানাডা গিয়ে কোনোভাবেই নিজের মন টেকাতে পারেনি তাই; কারণ ওখানে যাবার আগে থেকেই র‌্যাম্প মডেল হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন ফ্যাশন শো’তে তার বিচরণ শুরু হয়ে যায়। কম সময়ের মধ্যে অনেকের নজর কেড়েছিল। মিডিয়াতেও তাকে নিয়ে বেশ আলোচনা সৃষ্টি হয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যে। তেমনি পরিস্থিতিতে কানাডার একটি ইউনিভার্সিটিতে তার এডমিশন হয়ে গিয়েছিল। বড় দু’ভাই সব ব্যবস্থা করেছিলেন। যেতে মন না চাইলেও অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে কানাডা চলে যেতে হয়েছিল তাকে। ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছিল বলে। মা ও ভাইদের মন রক্ষার্থে টরেন্টো ইউনিভার্সিটিতে বেশ কিছুদিন ক্লাস করেছিল। কিন্তু সানজানা কোনোভাবেই সেখানে মন বসাতে পারেনি। মডেলিং অঙ্গনে বিচরণের নেশা তাকে ওখানে স্থির হয়ে থাকতে দেয়নি। শেষতক মা ও ভাই-ভাবির বাধা উপেক্ষা করে অনেকটা জেদ দেখিয়ে কানাডা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিল সে। গুলশান নিকেতনে নিজেদের ফ্লাটে দূরসম্পর্কের এক খালাকে নিয়ে থাকে সানজানা। খালাই তাকে মায়ের মতো দরদ দিয়ে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু একরোখা, জেদি স্বভাবের মেয়েটিকে বশ মানাতে গিয়ে মহিলাকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়। খালার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হয় সানজানার। নানা বিষয়ে সানজানাকে বাধা দিলে কিংবা কোনো ব্যাপারে নিষেধ করলেই সে হইচই বাধায়। যদিও এক সময়ে মাথা ঠান্ডা হলে আবার খালার গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদিত কণ্ঠে বলে ‘সরি খালা, আমার ভুল হয়ে গেছে, আর করব না এমনটা, তুমি কিন্তু মাকে, ভাইয়া-ভাবিদের বলবে না প্লিজ।’ এমনই সানজানা। বেহিসাবী জীবনযাপন করলে মা, বড় দু’ভাই তাকে ঢাকায় একা একা থাকতে দেবেন না, ঠিকই কানাডা চলে যেতে বাধ্য করবেন। মাঝখানে তারা সানজানার জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন, কানাডা যেতে না চাইলে সে ঢাকায় বিয়েশাদি করে ঘরসংসার শুরু করুক। বিয়ের পর চাইলে লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পারবে সানজানা। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ভালো প্রস্তাবও এসেছিল বিয়ের। মডেলিং জগতে বেশ নামধাম হয়েছে সানজানার। এখন অনেকেই তাকে চেনে বেশ ভালোভাবেই। বিভিন্ন অ্যাডে তাকে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। টিভি নাটক, সিনেমায় নায়িকা হওয়ার অফার আসছে হরদম। গ্ল্যামার জগতে তার দারুণ সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ক্রমশই। এ অবস্থায় বিয়েশাদি করে সব সম্ভাবনা জলাঞ্জলি দিতে রাজি নয় মেয়েটি। সে তার স্বপ্নপূরণের পথ ধরে এগোতে চায়। বিয়েশাদি করবে না সে এখন, সাফ জানিয়ে দিয়েছে গার্জেনদের। তার এমন মনোভাবে দেখে বিদেশে বেশ চিন্তায় আছেন মা ভাই-ভাবিরা। শোবিজের দুনিয়ায় মেয়েদের জন্য অনেক ফাঁদ পাতা থাকে। সানজানার আবার তেমন ফাঁদে পড়ে যায় কখন, কে জানে? পরিবারের সবার দুশ্চিন্তা এখন তাকে নিয়ে। সময় পেলেই মুনাকে বাসায় ডেকে নেয় সানজানা। নিজের সব কথা আপন ভেবে তাকে খুলে বলে। র‌্যাম্প মডেলদের অনেকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব থাকলেও মুনার সঙ্গে আলাপ পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হওয়ার পর তাকেই এখন সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ ভাবে সানজানা। মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় পড়াশোনা করতে আসা সাধারণ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের একটি মেয়ের জীবন কীভাবে বদলে গেছে। পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে একাকী এই শহরে টিকে থাকার জন্য নিয়তই লড়াই করছে। মুনাকে কাছে ডেকে নিয়ে নিজের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার সব অনুভ‚তি শেয়ার করা মুনাকে সাহস ও সহানুভ‚তি দেয়া, নানা বিষয়ে বুদ্ধি পরামর্শ দেয়া। সানজানার মতো একজন বান্ধবীকে পাশে পেয়ে মুনা আগের চেয়ে নিজেকে অনেকটা সাহসী ভাবতে পারছে। আগের মতো নিজেকে ততটা অসহায় মনে করে না সে আর। গুলশানের ফ্যাশন শোতে সানজানার পারফরম্যান্স রয়েছে। দেশের সেরা কয়েকজন র‌্যাম্প মডেলের একজন হিসেবে বেশ কয়েকটি কিউতে অংশ নেবে সে। তারই অনুরোধে মুনা যাচ্ছে সেখানে। ভাড়া করা গাড়িতে রওনা দিয়েছে সেই কখন। ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে এক সময়ে হাতির ঝিলে এসে পৌঁছে গাড়ি। আর একটুখানি পথ বাকি। শো শুরু হবে রাত ৮টায়। এখন বাজে সাড়ে সাতটা। পথে আসতে সানজানার সঙ্গে নিজের জড়িয়ে পড়ার কথা ভাবছিল মুনা। সানজানার সঙ্গে তার নিজের জীবনের তেমন মিল না থাকলেও তাকে ভীষণ আপনজন মনে হয় এই শহরে। সবাই তাকে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেও সবকিছু জানার পর সানজানা মুনাকে আপন করে কাছে টেনে নিয়েছে। ফ্যাশন শো শুরুর আগেই মুনা পৌঁছে যায়। সানজানা তার অপেক্ষায় ছিল। ড্রেসিং রুমে সব মডেল যে যার মতো ড্রেস পরে সেজেগুজে বসে আছে। কয়েকজন দেশি-বিদেশি বিখ্যাত ডিজাইনারের নতুন কিছু পোশাক, শাড়ি এবং জুয়েলারি এই ফ্যাশন শোতে তুলে ধরবে মডেলরা। নির্ধারিত সময়ের কিছু সময় পর শুরু হয়ে যায় ফ্যাশন শো। সারিবেঁধে রানওয়ে ধরে বিচিত্র ভঙ্গিতে বিভিন্ন পোশাক পরা মডেলরা এগিয়ে আসে। তাদের আকর্ষণীয় ক্যাটওয়াক উপস্থিত দর্শকরা মুহূর্তেই মন্ত্রমুগ্ধ। চমৎকার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ছন্দে আন্দোলিত সুনিপুণ দেহভঙ্গিমায় রানওয়ে ধরে এগিয়ে আসা মডেলদের ক্যাটওয়াক পুরো পরিবেশকে মোহনীয় করে তোলে। বর্ণিল আলোকচ্ছটায় জমকালো পরিবেশে সানজানার ক্যাটওয়াক উপস্থিত সবাইকে আন্দোলিত করে তোলে। উচ্ছ¡সিত দর্শকদের সপ্রশংস করতালির মধ্যে একের পর এক কিউতে অংশ নেয় সে। ক্যাটওয়াকের সময় তার মুখের উজ্জ্বল হাসি, ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল ঝিলিক উপভোগ করতে করতে মুনা ভুলে যায় তার অতীত বর্তমানের সব দুঃখ বেদনা হতাশা বঞ্চনা লাঞ্ছনার কথা। পৃথিবীটাকে দারুণ সুন্দর মনে হতে থাকে এই স্বপ্নীল পরিবেশে। অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যায় তার দেহমনে। হারিয়ে যায় সে চমৎকার এক মনোমুগ্ধকর অনুভবে। ফ্যাশন শো শেষ হতে হতে রাত দশটা পেরিয়ে যায়। ড্রেসিং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল মুনা। কিছুক্ষণের মধ্যে জিন্স প্যান্ট আর হালকা গোলাপি রংয়ের শার্ট পরা সানজানাকে বেরিয়ে আসতে দেখে এগিয়ে যায় সে। কাছে এসেই মুনার কাছে সানজানা জানতে চায়, ‘কেমন হয়েছেরে?’ মুনা চাপা গলায় বলে, ‘একদম ফাটাফাটি! জাস্ট ওসাম বেবি! ইউ আর গ্রেট সানজানা; আই অ্যাম সো ইমপ্রেসড।’ মুনার উচ্ছ্বাস আর প্রশংসা শুনে সানজানা হেসে চোখ টিপে। ‘র‌্যাম্পে হাঁটতে হাঁটতে আর ড্রেস বদলাতে বদলাতে টায়ার্ড হয়ে গেছি, ক্ষুধায় পেটের ভেতর ইঁদুর ছোটাছুটি করছে। লেটস গো ফর ডিনার,’ সানজানা তাগাদা দেয়। লিফটে নিচে নেমে পার্কিং লটে রাখা নিজের গাড়িতে চড়ে বসে সানজানা। আজ পাশে নয়, পেছনের সিটে বসে মুনা। পাশের সিটে বসে তার ড্রাইভিং দেখলে নাকি কেমন অস্বস্তিবোধ করে সানজানা। তার গাড়িতে চালাতে সমস্যা হয়। মুনা পেছনের সিটে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে সানজানাকে দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ আগে যে মেয়েটা ফ্যাশন শোর রানওয়েতে নিপুণ ভঙ্গিতে ক্যাটওয়াকে ব্যস্ত ছিল এখন সে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসে। গভীর মনোযোগ তার সামনের রাস্তার দিকে। সানজানাকে দেখে নতুন করে মুগ্ধ হয় মুনা। দুই. সানজানার একটা মিউজিক ভিডিওর শুটিং হবে উত্তরার দিয়াবাড়িতে। বেশ বড় বাজেটে তৈরি হচ্ছে মিউজিক ভিডিওটি। দেশের বাইরে শুটিংয়ের আয়োজন ছিল প্রথমে। কিন্তু সানজানার তুমুল ব্যস্ততার কারণে বিদেশে মিউজিক ভিডিওর শুটিংয়ের জন্য সময় দেয়া সম্ভব নয়। এটা তাদের জানিয়ে ছিল সে। অন্য কোনো মডেল নিয়ে কাজটা করার পরামর্শ দিয়েছিল সানজানা নিজেও। কিন্তু মিউজিক ভিডিওর মেকার কর্পোরেট হাউসের পছন্দ সানজানাকে। তাকে নিয়েই কাজটা করতে চায় তারা। আগামীতে তারা কলকাতার সঙ্গে একটা জয়েন্ট ভেঞ্চার সিনেমা তৈরি করবে, যাতে নায়িকা হিসেবে সানজানাকে প্রথমবারের মতো রুপালি পর্দায় আনার পরিকল্পনা তাদের। তারই প্রস্তুতি হিসেবে সানজানাকে মডেল করে মিউজিক ভিডিওটি তৈরি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে সানজানার সম্ভাবনা কতটা তা যাচাই করে দেখতে চায় তারা। সিনেমায় নায়িকা হওয়ার তেমন কোনো ইচ্ছে বা স্বপ্ন কোনো সময়েই ছিল না সানজানার মনে। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে সিনেমার রুপালি পর্দায় নিজেকে নায়িকা হিসেবে তুলে ধরার এক ধরনের জেদ চেপে বসেছে তার মনে। এর পেছনেও কারণ রয়েছে। কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়ার লংকাউইয়ে এবং ইন্দোনেশিয়ার বালিতে কয়েকটি টিভিসির শুটিংয়ে গিয়েছিল সানজানা। অ্যাড ফিল্মগুলোতে তার সঙ্গে মডেল ছিল সিনেমার সুপারস্টার জনপ্রিয় নায়ক আকাশ চৌধুরী। শুটিংয়ের সময় তার কিছু আচরণ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। সেই জনপ্রিয় নায়ক তার পুরনো অভ্যাসবশত সানজানাকে অশালীন প্রস্তাব দিয়েছিল বেশ কয়েকবার। একরাতে মদ্যপ অবস্থায় বেসামাল হয়ে রিসোর্টে সানজানার রুমের দরজায় নক করেছিল। দরজা খুলতেই ঘরের মধ্যে ঢুকে সানজানাকে জড়িয়ে ধরে জোর করে বিছানার দিকে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছিল। আকাশের বেপরোয়া আচরণে চমকে উঠলেও তেমন অবাক হয়নি সানজানা; কারণ শোবিজ বা মিডিয়া জগতের হালচাল এর মধ্যে সে বুঝে গেছে। এখানে বেশ কিছু মানুষ আছে যাদের স্বভাব চরিত্র পশুর মতো। যারা ভদ্রতার মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু তাদের ভেতরে লুকিয়ে আছে জঘন্য পশুবৃত্তি। সুযোগ পেলেই নিজের প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে নিজের পাশবিক ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে চায়। বিশেষ করে শোবিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সুন্দরী মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়। আকাশ চৌধুরী সিনেমায় এখন নায়ক হিসেবে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। অনেক দাপট তার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে। তার সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হলে এই লাইনে টেকা মুশকিল। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সিনেমায় নায়িকাদের কাস্ট কিংবা বাদ দেন পরিচালক প্রযোজক। যে কারণে প্রায় সব নায়িকাই তাকে খুশি রাখতে চায়, কোনোভাবে চটাতে চায় না। সানজানাকে তেমন মেয়েদের একজন ভেবে আকাশ তার অভ্যাসবশত অশালীন আচরণ শুরু করেছিল। আগে থেকে নায়ক আকাশের স্বভাব সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করেছিল সানজানা। শোবিজের চেনাজানা কয়েকজন আগেভাগেই সতর্ক করেছিল তাকে। বিদেশে শুটিং করতে আসার আগেই এসব শুনে সাবধান হয়ে গিয়েছিল সানজানা। গভীর রাতে রিসোর্টে তার রুমে ঢুকে মাতাল অবস্থায় আকাশের অশালীন আচরণ ঠেকাতে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছিল সানজানা সেদিন। দু’হাতে জড়িয়ে ধরা আকাশের কবল থেকে এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে তার গালে কষে কয়েকটা চড় মেরেছিল সানজানা। তার চড় খেয়ে আকাশের মাতলামি ছুটে গিয়েছিল। ভীষণ অবাক হয়েছিল সে সানজানার প্রতিক‚ল আচরণে। অন্য মেয়েরা যেখানে গভীর রাতে তাকে সাদরে গ্রহণ করে, নিজেকে সঁপে দেয় তার ইচ্ছের কাছে, কিছুতেই বাধা দেয় না তার আহ্বান, সেখানে নতুন একজন মডেল গার্ল হয়ে সানজানা তাকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করল, তাকে চড় মারল, হেনস্থা করল। যা আকাশ চৌধুরীর মতো সুপারস্টারের অহং লাগে প্রচণ্ড। ব্যাপারটা অন্য কেউ দেখেনি বলে সানজানা কাউকে বলেনি, একরকম চেপে গেছে। নালিশও করেনি কারো কাছে আকাশের ঔদ্ধত্য আচরণের বিষয়ে। এ বিষয়টা জানাজানি হলে হইচই বেধে যাবে নির্ঘাত। মিডিয়াও ব্যাপারটা লুফে নিবে। তা ফলাও করে প্রচার হবে, মজার কিস্সা রটানো হবে পত্রপত্রিকায়। যাতে আলটিমেটলি সানজানাও ফেঁসে যাবে। এতে আর কিছু না হোক নিজের মান-ইজ্জত ডুববে। এই হচ্ছে শোবিজ জগতের ধারা। আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের কাছে নিজের ইমেজের বারোটা বাজবে। এমনিতেই তার মডেলিং ক্যারিয়ার নিয়ে পরিবারের সবাই এক ধরনের অস্বস্তিতে রয়েছে। তার ওপর এ ধরনের ঘটনা শুনতে তো আর কথা নেই। মা ও ভাই-ভাবিরা বারবার চাপ দিয়ে যাচ্ছে মডেলিং ছেড়ে দিতে। সে রাতের ঘটনার পর থেকে সিনেমার সুপারস্টার নায়ক আকাশ শুটিংয়ের সময় সানজানাকে নানাভাবে অপদস্ত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। সামান্য ভুল-ত্রু টির জন্য সবার সামনে অপমানজনক মন্তব্য করতে দ্বিধা করছে না সে। ‘এসব মেয়েদের সঙ্গে শুটিং করা মানে নিজের পজিশন নষ্ট করা। কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না, অল বোগাস, থার্ড ক্লাস, জীবনে কোনো দিন সিনেমায় নায়িকা হতে পারবে না’ এতসব মন্তব্য শুনে খুব খারাপ লাগলেও চুপ থেকেছে সানজানা, টুঁ শব্দটি করেনি। অথচ ঢাকায় এর আগে যাদের সঙ্গে কাজ করেছে সে সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে বারবার। সবাই তাকে দেশের সেরা মডেলদের একজন হিসেবে অভিহিত করতে কার্পণ্য করেনি। তার মধ্যে সম্ভাবনার প্রকাশ দেখেই বড় বড় নির্মাতারা এখন সানজানাকে নিয়ে টিভিসি, মিউজিক ভিডিও, টিভি সিরিয়াল, নাটক নির্মাণ করতে এগিয়ে আসছেন। সিনেমায় নায়িকা করার বেশ কিছু প্রস্তাবও এসেছে তার কাছে। আকাশের আচরণে অপমানিত এবং ক্ষুব্ধ হলেও সানজানা তা প্রকাশ করেনি। বরং মনে মনে জেদ চেপেছে সিনেমার নায়িকা হয়ে প্রমাণ করবে সে কেমন অভিনেত্রী। সিনেমায় নায়িকা হয়ে দর্শকদের মন জয় করার যোগ্যতা রয়েছে তার এটা সে দেখিয়ে দিতে চায়। দিয়াবাড়িতে নিজের শুটিংয়ের কথা মুনাকে জানিয়েছিল সানজানা। গত বেশ কিছুদিন ধরে মুনাকে কেমন অস্থির মনে হচ্ছে। সানজানাকে নিজের সব কথা খুলে বলেছে সে। শাহেদের সঙ্গে মুনার সম্পর্কের সবকিছুই জানে সানজানা। শুটিংয়ের ফাঁকে মুনাকে ফোন করে। ও প্রান্তে মুনার কণ্ঠে অস্থিরতা টের পায় সে। ‘মুনা, কী হয়েছে, এনিথিং রং?’ ‘নাহ, তেমন কিছু না।’ ‘তাহলে এভাবে হাওয়া হয়ে গেলে যে, তোমাকে দেখি না কতদিন।’ সানজানার কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলে মুনা। ‘আরে হাওয়া হলাম কোথায়। এই ঢাকা শহরেই তো আছি, হারিয়ে আর কোন চুলোয় যাব।’ ‘তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।’ ‘বলো তাহলে।’ ‘আরে এখন তো শুটিং করছি, বিজি টাইম পাস করছি। এখন জরুরি কথা বলার চেয়ে জরুরি কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি, পরে বলব সব তোমাকে।’ শুটিং শুরু হয়ে যায় ততক্ষণে। ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সানজানা। তিন. মুনার আজকের জীবনটা অনেক দুঃখ যাতনা অপরাধবোধ আর চরম গ্লানিতে ভরা। নিজের কিছু ভুলের মাসুল দিতে গিয়ে গ্লানিময় এই জীবনে জড়াতে হবে ভাবতে পারেনি সে। ব্যস্ততায় ভরা এই জনবহুল শহরে বিপজ্জনক ঘৃণ্য এক জীবনে নিজের ভাগ্যকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে সে। ওর কাছে মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সতীত্ব, সারল্য এসবের কোনো দাম নেই। মুনা গত দু’বছরে ঢাকা শহরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বদলে গেছে অনেক। এখন কত পুরুষের সঙ্গে ওর ওঠাবসা। সবার সঙ্গে মেলামেশা করতে হয় ফ্রিভাবে। একটা অ্যাড ফার্মের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করে মুনা। আসলে ওর কাজ হলো বড় বড় ক্লায়েন্টদের সন্তুষ্ট রাখার পাশাপাশি নতুন ক্লায়েন্ট ধরা। অ্যাড ফার্মের বিজনেস বাড়াতে বড় বড় পার্টির কাছে যেতে হয়, ছলেবলে কৌশলে বিজনেস বাগাতে হয় বসের নির্দেশে। এজন্যে প্রয়োজনে কোনো পুরুষের ইচ্ছেমতো বিছানায় যেতে হলে হাসিমুখে রাজি হতে হয়। ব্যাপারটা এখন মুনার গা সওয়া হয়ে গেছে। সে এখন বিভিন্ন পুরুষের ইচ্ছেমাফিক তাদের শরীরের চাহিদা মেটাতে তাদের সাথে রাত কাটাতে দ্বিধাবোধ করে না। এসব নিয়ে তার মনে কোনো পাপবোধ জাগে না, অনুতাপ, অনুশোচনা হয় না। প্রয়োজনে আরো সাহসী আরো বেপরোয়া হতে পারে মুনা। তার কাছে আজকাল প্রেম, ভালোবাসা, অনুরাগ এসবের কোনো মূল্য নেই। এসব মূল্যহীন মনে হয় মুনার কাছে। অ্যাড ফার্মের কাজের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে গুলশান বনানী আর বড় বড় হোটেলের পার্টিতে, গেস্ট হাউজে যায় সে। এক সময় মুনার মধ্যে সারল্য ছিল, নিষ্পাপ পবিত্রতার ছোঁয়া ছিল দেহমনে। হৃদয়জুড়ে প্রেম ভালোবাসার তীব্র আকাক্সক্ষা ছিল। কিন্তু এসব কিছুর বিনিময়ে চরমভাবে প্রতারিত হতে হয়েছে তাকে। স্বপ্নের শহর ঢাকায় স্বপ্নপূরণ করতে এসে দুঃস্বপ্নের এক পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে গেছে মুনা। এই শহরটাকে মাঝে মাঝে খুব অচেনা মনে হয় তার। অথচ এই শহরে আছে সে বেশ কয়েক বছর ধরে। এখনও বুঝে উঠতে পারেনি এই শহরটাকে, শহরের মানুষগুলোকে। দিনাজপুর শহরের মেয়ে মুনা। ওখানকার কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছিল একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে মুনা পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। ঢাকায় এসে প্রথমে উঠেছিল চাচার বাসায়। থাকত জিগাতলা এলাকায়। ওর বাবা একটা সরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন। মাসে মাসে মেয়ের পড়াশোনা আর থাকা খাওয়ার জন্য টাকা পাঠাতেন। শুরুতে তেমন সমস্যা হচ্ছিল না। হঠাৎ করে চাচা পুরো ফ্যামিলি নিয়ে সাউথ আফ্রিকা চলে গেলে মুনাকে হোস্টেলে উঠতে হয়েছিল। তখন খরচাটা বেড়ে গিয়েছিল। বাবার পাঠানো টাকায় নিজের সব খরচ মেটানো ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছিল। পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় ভার্সিটিতে প্রথম কয়েক সেমিস্টারের রেজাল্টও ছিল চমৎকার! মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে ওর বাবাও ভীষণ আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। ভার্সিটি থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাস করে বেরোনোর পর খুব ভালো একটা চাকরি হয়ে যাবে, তেমন প্রত্যাশা ও স্বপ্ন ছিল মুনার মনেও। কিন্তু এক সময়ে ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়ে ওর জীবনের গতিপথটাই পাল্টে যায়। এখন মুনা এই শহরে ভিন্ন এক জগতের বাসিন্দা। বিপথগামী মেয়ের নানা কুকীর্তি কাহিনী জানার পর ওর বাবা দুঃখে অপমানে হার্টফেল করে মারা যায়। তারপর পরিবারের কারো সঙ্গে মুনার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। সবাই তার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কারো কাছে যাবার কোনো পথ নেই মুনার। ঢাকা শহরের বিশাল জনারণ্যে মুনা এখন নিজেকে ভীষণ একা নিঃসঙ্গ মনে করে। তার সঙ্গে অনেক মানুষের ওঠাবসা থাকলেও তাদের কাউকে আপন ভাবতে পারে না। সবাইকে মনে হয় আস্ত জানোয়ার স্বার্থপর, লোভী, বিকৃত রুচির আর মানসিকতার। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য অন্ধকার এক জগতে পথ চলছে, তার গন্তব্য কোথায় জানে না মুনা। হঠাৎ মাঝে মাঝে মনে হয় এভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো হতো। চরম হতাশা, প্রচণ্ড অপরাধবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খায় সারাক্ষণ। অন্ধকার জগতে ডুবে যাওয়ার আগের সময়গুলোর কথা মনে হলে মুনা কেমন যেন অস্থির এলোমেলো হয়ে যায়। সবকিছু ভুলে যেতে কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ইয়াবার মাঝে সব হতাশা দুঃখ গ্লানি মুক্তি খোঁজে। যতক্ষণ নেশার ঘোরে থাকে ততক্ষণই সব ভুলে থাকে। নেশা কেটে গেলে ঘোর থেকে বেরিয়ে এলে হতাশা দুঃখবোধ তাকে আরো ভয়াবহভাবে গ্রাস করে। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয়। তার পাশে সহানুভ‚তি জানানোর মতো কেউ নেই। সবাই নানা মতলবে তার কাছে ঘেঁষতে চায়। সবার উদ্দেশ্য মুনার তাই জানা আছে। একজন মানুষও যদি পরম মমতায় একান্ত আপনজনের মতো তার পাশে সহানুভ‚তির হাত তুলে দাঁড়াত, নির্ভরতার ছায়া দিত, মতলবাজ মানুষগুলোর কবল থেকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয় দিত তাহলে এতদিনে মুনার জীবনটা আবার বদলে যাওয়া পথ পেত। আগের সেই জীবনে ফিরে যাওয়া সুযোগ ঘটত। ঢাকার বাতাসে নাকি বিষ ছড়িয়ে আছে। মুনার কাছে এই শহরের পরিবেশটাকে ভয়ঙ্কর বিষাক্ত মনে হয়। মাঝেমাঝে ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। ইচ্ছে করে দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? চার. আজ অনেক বছর পর সৌরভকে দেখল মুনা। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে গাড়িতে বসে আছে মুনা, আর রাস্তার একপাশের ফুটপাত ধরে হাঁটছে সৌরভ। আজও সেই একই রকম হাঁটার ভঙ্গি, চুলের স্টাইলেও কোনো পরিবর্তন নেই। বয়স কিছুটা বাড়লেও আগের মতোই রয়েছে সবকিছু, বিশেষ কিছু বদলায়নি। দিনাজপুরে মুনাদের বাসার ঠিক বিপরীত দিকের বাসাটা ছিল ওদের। রোজ বিকেলে সৌরভকে দেখতে ছাদে চলে যেত মুনা। ক্লাস নাইনের ছাত্রী তখন সে। সৌরভকে দেখলে সারা শরীর আর মনের গভীরে কেমন একটা অন্যরকম অনুভ‚তি ছড়িয়ে পড়ত। সৌরভ তখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। তার প্রতি দুর্বলতার কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারেনি মুনা কোনোদিন। খুব কাছের বান্ধবীদের কয়েকজন জানত অবশ্য ব্যাপারটা। তারা অনেকবার বলেছে, সৌরভের মুখোমুখি হয়ে মনের একান্ত গভীরে জেগে ওঠা অনুভ‚তির কথাগুলো বলতে। লজ্জা, সংকোচ আর ভয় সবসময় মুনাকে জড়িয়ে ধরত। কারণ ওই বয়সটাই ছিল এই স্বভাবের। তাই সৌরভকে বলি বলি করে তার বলা হয়নি তাকে ভালো লাগার কথা। সৌরভের কবুতর পোষার শখ ছিল। বিকেলে সে তখন পোষা কবুতরগুলোকে খাওয়ানোয় ব্যস্ত থাকত। মুনা ছাদের এককোনায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত তাকে। রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যেত তাদের। কিন্তু তাদের ঐ মুহূর্তগুলো কীভাবে যেন কেটে যেত। লজ্জায় মুনা কেন জানি মুখ তুলে তাকাতেই পারত না তার দিকে। কথা বলা তো দূরের কথা। ছাদে উঠে দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখার জন্য ছাদে যাওয়াটা নেশার মতো হয়েছিল তার। এজন্য কতবার যে বৃষ্টিতে ভিজেছে সে, তার হিসেব নেই। এমনও হয়েছে দিনের পর দিন মুনা ছাদে অপেক্ষা করেছে, কিন্তু সৌরভের দেখা পায়নি। মাঝে মাঝে বেশ রাত হয়ে যেত শুধু তাদের বাসার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। হয়তো একটিবারের জন্য দেখা গেলেও এরপর সারাদিনে আর দেখাই যেত না। সৌরভের বাবা সরকারি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। বদলির চাকরি। অন্য জেলা শহর থেকে মাত্র কয়েক বছরের জন্য মুনাদের শহরে এসেছিল তারা। সৌরভের মা একবার দু’বার মুনাদের বাসায় এসেছিলেন প্রতিবেশী হিসেবে। কিছু সময় গল্পগুজব করে আবার চলে গেছেন। মুনার মা বেশ কয়েকবার তাদের বাসায় গেলেও তার কিন্তু যাওয়া হয়নি। যেতে খুব ইচ্ছে করত। কিন্তু তার বয়সী সৌরভের কোনো বোন ছিল না ঐ বাসায়। এ অবস্থায় গিয়ে কার সাথে কথা বলবে, ভেবে আর যাওয়া হয়নি। মা কয়েকবার তার সাথে যেতে বলেছিলেনও। মুনার নিজেরও ভীষণ ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু ও বাসায় গেলে তো সৌরভের মুখোমুখি হতে হবে। তার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেয়েও যেতে পারেনি তখন সে। মুখোমুখি হলে কী কথা বলবে মুনা। সৌরভকে দূর থেকে দেখেই তার মনে যেরকম তোলপাড় বয়ে যায়, সামনাসামনি হলে কী যে হবে অবস্থা, ভাবতেই শরমে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেত তার। একদিন মুনাদের স্কুলে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে নামি-দামি কয়েকজন শিল্পী গিয়েছিলেন বিচারক হিসেবে। অনুষ্ঠানে তারা গানও গেয়েছিলেন। ফলে সেখানে উপস্থিত দর্শক শ্রোতার ভিড় ছিল খুব। বান্ধবীদের সঙ্গে দলবেঁধে গিয়েছিল মুনা। প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকার পর অন্য বান্ধবীদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। নিজেদের স্কুলে অনুষ্ঠান হলেও আয়োজক ছিল বাইরের লোকজন। মুনা অনেক চেষ্টা করেও বসার জন্য ভালো একটা জায়গা খুঁজে পাচ্ছিল না। কাউকে বলে যে সে ব্যবস্থা করবে তারও সুযোগ ছিল না। বেশ অসহায় ও বিব্রতবোধ করছিল মুনা। তখনই তার সামনে এসে কোত্থকে উদয় হয়েছিল সৌরভ আচমকা। তাকে দেখে তো থতমত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। আরো বেশি আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিল মুনা তখন। সৌরভের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল সে। তাকে কী বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না মুনা। কী বলতে গিয়ে আবার কী বলে ফেলে, ভাবছিল। অনুষ্ঠানে এসে বসার মতো ভালো জায়গা পাচ্ছে না সে, এটা সৌরভ ঠিক বুঝে নিয়েছিল। একই পাড়ায় থাকে ওরা। পথেঘাটে প্রায়ই দেখা হয়। কিন্তু কথা হয়নি কোনোদিনও। মেয়েটির নাম মুনা। ওর মা বেশ কয়েকবার এসেছেন তাদের বাসায়। মুনার বাবা ব্যাংকে চাকরি করেন। স্কুলে ভালো ছাত্রী হিসেবে আলাদা সুনাম আছে তার। সবই জানে সৌরভ। কিন্তু তার সাথে কথা হয়নি কোনো সময়ে। ‘মুনা, এসো তো আমার সঙ্গে,’ বলে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল সৌরভ। তার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরবে কি ধরবে না, দ্রুত ভাবছিল মুনা। অনেক দ্বিধা, সংকোচ, ভয়, লজ্জা কাজ করছিল মনের মধ্যে। ইতস্তত করছিল সে। ‘কী অনুষ্ঠান দেখবে না, চলো, তোমাকে ভালো একটা জায়গায় বসিয়ে দিই।’ খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে বলেছিল সৌরভ। তার কণ্ঠে কী এমন মোহনীয়ভাব জড়িয়েছিল। মুনা এক মুহূর্তেই সব দ্বিধা সংকোচ ভয় লজ্জা ঝেড়ে ফেলে সৌরভের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরেছিল। অদ্ভুত এক আবেশে মুনার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল তখন। অনেক ভিড়-ভাট্টা ঠেলে বেশ ভালো একটি জায়গায় বসার সুযোগ করে দিয়েছিল সৌরভ। কিছুক্ষণ আগেও যে কথা একটু ভাবতে পারছিল না মুনা। অনুষ্ঠান আয়োজকদের সঙ্গে সৌরভের ভালো সম্পর্ক থাকায় মুনার জন্য ভালো একটি জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিল সেদিন। এটা মুনা ঠিকই বুঝে নিয়েছিল। তাকে বসার সুযোগ করে দিলেও সৌরভ দূরে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখছিল। মুনার পাশে বসার জায়গা থাকলেও সেখানে বসেনি সে। এতে খানিকটা বিব্রতবোধ করছিল মুনা। সেদিন বেশ ভালোভাবে অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পেলেও বারবার ঘাড় ফিরিয়ে সৌরভকে লক্ষ করছিল মুনা। কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছিল তার সঙ্গে। অনুষ্ঠান শেষ হলে বান্ধবীদের পেয়ে গিয়েছিল সে। আসার আগে সৌরভকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেও আশপাশে কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছিল না। তার জন্য অপেক্ষা করারও সুযোগ ছিল না তখন। বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল সবার, রাত বেড়ে যাওয়ায়। সৌরভকে ধন্যবাদ জানাতে না পারায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কিছুই করার ছিল না তখন মুনার। এক ধরনের অপরাধবোধ তার মনে চেপে বসেছিল। বাড়ি ফেরার পর বারবার সৌরভের হাত ধরে থাকার কয়েক মুহূর্তের কথা মনে হতেই সারা শরীরে এক ধরনের পুলকভাব ছড়িয়ে পড়ছিল মুনার। সৌরভের স্পর্শ এখনও জড়িয়ে আছে হাতে। ধুয়ে ফেললে তা হারিয়ে যাবে, যে কারণে হাত না ধুয়ে ছিল সে রাতে। বিছানায় শুয়ে কেবলই ভাবছিল সৌরভের কথা। অনুষ্ঠানে বসার জন্য ভালো জায়গা না পেয়ে যখন অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল তখন হঠাৎ করে সেখানে সৌরভের উপস্থিত হওয়া, তার আন্তরিক আহ্বানে বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়া, অনুষ্ঠান দেখার ফাঁকে চোখাচোখি হওয়ার দৃশ্যগুলো সিনেমার মত একে একে ভেসে উঠছিল। সে রাতের স্মৃতি অনেক দিন মুনার মনে গেঁথে ছিল। অল্প কিছুদিন পর সৌরভের বাবা বদলি হয়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে যোগ দেন। তার সাথে গোটা পরিবারও পাবনা চলে যায়। এরপর মাস গড়িয়ে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। সৌরভদের পরিবারের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি। সৌরভের সাথেও দেখা সাক্ষাৎ কিংবা যোগাযোগ হয়নি মুনার। আজ হঠাৎ এভাবে রাস্তায় তাকে দেখবে, ভাবতে পারেনি সে। মুনার ইচ্ছে করছিল, গাড়ি থেকে নেমে সৌরভের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তাকে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ তুমি, কী করছ এখন, তুমি কি জানতে, তুমি কি বুঝতে আমার মনের কথা। সৌরভ, তুমি কি জানো, দিনের পর দিন একটি মেয়ে শুধু তোমাকে একনজর দেখার আশায় কতটা সময় ধরে অপেক্ষা করেছে, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুঁজতে চেয়েছে। তোমার কাছে তার নিজের মনে গভীরে জেগে ওঠা একান্ত অনুভ‚তিগুলো প্রকাশ করতে চেয়েছে। মুনা গাড়িতে বসে সৌরভের হেঁটে যাওয়া দেখতে দেখতে হারিয়ে যায় কোন অতলে। কিছুক্ষণের মধ্যে যানজট খুলে যায়। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকা সৌরভ মুনার দৃষ্টিসীমার আড়াল চলে যায় ততক্ষণে। ঘাড় ঘুরিয়ে অস্থিরভাবে কিছুক্ষণ খুঁজে ফিরে মুনার চোখ। নাহ, কোথাও দেখা যায় না সৌরভকে। এই বিশাল ঢাকা শহরে কোথায় থাকে সে, নাকি অন্য কোথাও থাকে? কোনো কাজে ঢাকায় এসেছে সে, এখন সে কী করছে, ঘরসংসার শুরু করেছে নাকি ব্যাচেলর রয়ে গেছে কিছুই জানা হলো না তার। পরক্ষণেই মুনা নিজের কথা ভাবতেই অনেকটা গুটিয়ে যায়। সৌরভকে দিনাজপুরে থাকার সময় দেখা সেই মুনা কি এখন আগের মতো একই রকম আছে? কত কী বদলে গেছে চারপাশে। পৃথিবীতে কত ওলটপালট ঘটেছে। তার নিজের জীবনটাও কি আছে আগের মতো? কত চড়াই-উৎরাই পথ পাড়ি দিয়ে এই শহরে টিকে আছে সে। কত ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে তার জীবনে। সব অতিক্রম করে এখন সে দাঁড়িয়ে আছে কোথায়? আগের সেই একইরকম অনুভূতি কি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে সে নিজে? এতসব ভাবতে গিয়ে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখে মুনা। ঢাকা শহরে পড়াশোনা করতে এসে অন্ধকার এক জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে মুনা। ক্রমেই সে তলিয়ে যাচ্ছে আরও গভীরে। বাঁচার চেষ্টা করছে নানাভাবে। কিন্তু পারছে না। এখন হঠাৎ সৌরভকে রাস্তায় দেখে তার মনে নতুন করে ঝড় ওঠে। সেই কিশোরী বেলায় সৌরভ তার জীবনে এসেছিল প্রথম প্রেমের শিহরণ হয়ে। যদিও মুনার ভালোবাসা ছিল একতরফা, সেই ভালোবেসেছিল মনে মনে। মুখ ফুটে বলতে পারেনি কোনোদিন তার হৃদয়ের কথা। সৌরভ হয়তো জানত না মুনার হৃদয়ে জেগে ওঠা ভালোবাসার কথা। কিংবা সে জানত, বুঝতে পারত পাশের বাড়ির কিশোরী মেয়েটির হৃদয়ের একান্ত অনুভ‚তির কথা। জেনেও সে কাছে এগিয়ে আসেনি, দূরেই রয়ে গেছে। এত বছর পর মুনার তার প্রথম প্রেমের সৌরভ ঠিকই অনুভব করে। আজও তা রয়ে গেছে। হৃদয়ে অন্যরকম আবেশ ছড়াচ্ছে। পাঁচ. সানজানার সঙ্গে যোগাযোগ নেই বেশ কিছুদিন। আজকাল আর ফোন করে কথা বলা হয় না আগের মতো। অথচ এর আগে মুনার সঙ্গে সপ্তাহে একবার না একবার দেখা হতো। শুটিং বা অন্য কাজের ব্যস্ততা না থাকলে নিজেই গাড়ি নিয়ে হাজির হতো। মুনাকে সাথে নিয়ে শহর থেকে দূরে কোথাও কিংবা ব্যস্ত শহরেই ঘুরে বেড়াত। গত এক মাসে সানজানার জীবনে বেশ কয়েকটি নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। মডেলিং থেকে সিনেমায় নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে সে। কয়েকদিন আগে হোটেল সোনারগাঁওয়ে সানজানার প্রথম সিনেমা ‘হৃদয়ে অনন্ত ভালোবাসা’র মহরত হয়েছে বেশ ঘটা করেই। দেশের সব পত্রপত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে খবরটি বেশ ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। দেশ সেরা জনপ্রিয় মডেল, সানজানা আফরিন এবার রুপালি পর্দায় নায়িকা হিসেবে আসছেন। এ নিয়ে শোবিজে রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। অনেক সিনেমা প্রযোজক পরিচালক লাইন দিয়েছে তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইতোমধ্যে। সবাই সানজানাকে কাস্ট করে সিনেমা বানাতে আগ্রহী। বাংলাদেশের সিনেমার চরম দুর্দিন যাচ্ছে এখন। দর্শক সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। ফলে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষিত ভদ্র শ্রেণির মানুষ বাংলাদেশের সিনেমার কথা শুনলে ভ্রæ কুঁচকায়। দর্শক টানতে আজকাল কলকাতার নায়িকা এনে ছবি তৈরি করতে চাইছে কেউ কেউ। এ নিয়ে আবার শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। ফলে সানজানার মতো জনপ্রিয় মুখকে সিনেমার পর্দায় আনতে উৎসাহী সবাই। তার কারণে অনেক দর্শক সিনেমা দেখতে আগ্রহী হবে, তেমন ভরসা করছেন সিনেমা ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। অনেক সিনেমায় নায়িকা হওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব থাকলেও সানজানা তার প্রথম সিনেমার নির্মাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে একটি বিশেষ শর্তে তা হলো, প্রথম ছবিটি মুক্তি পাবার আগে অন্য কোনো প্রযোজকের সিনেমায় সে অভিনয় করতে পারবে না। চুক্তিবদ্ধ হওয়া প্রথম সিনেমার শুটিং শুরুর আগে সানজানাকে অভিনয় ও নাচের প্রশিক্ষণ নিতে হচ্ছে নিয়মিত। ইদানীং তাই খুব ধকল যাচ্ছে তার ওপর। দিনরাত প্রশিক্ষণে ডুবে থাকতে হচ্ছে তাকে। এর মধ্যে হেয়ারস্টাইল এবং লুক ঠিক করতে মুম্বাই যেতে হয়েছে। ওখানকার বিউটি এক্সপার্টরা তার হেয়ারস্টাইল এবং নতুন লুক ঠিক করে দিয়েছেন। দর্শক যাতে সানজানাকে প্রথম অভিনীত সিনেমায় নতুনভাবে আবিষ্কার করে তার সব ব্যবস্থা থাকছে। সানজানা নিজেও বেশ মনোযোগ দিয়েছে অভিনয় ও নাচ শেখার ব্যাপারে। অভিনয় বিশেষজ্ঞদের তত্ত¡াবধানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নেয়ার পাশাপাশি দেশ-বিদেশের অসংখ্য সিনেমা দেখতে হচ্ছে তাকে। আবার তাকে ছুটতে হচ্ছে নাচের প্রশিক্ষকের কাছে। এর ফাঁকে আবার যেতে হচ্ছে জিমে। নানা শারীরিক কসরত করে ফিগারটাকে আরো শার্প আর সুন্দর করে তুলতে হচ্ছে। ডায়েটিংও করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে গত ক’দিনে ভিন্ন এক গ্রহের বাসিন্দায় পরিণত হয়েছে যেন সে। খুব কষ্ট হচ্ছে সানজানার। তারপরেও সে সিনেমায় দুর্দান্ত এক চমক নিয়ে উপস্থিত হতে চায়। কারণ সিনেমার সুপারস্টার নায়ক আকাশের লাঞ্ছনা ও অপমানজনক আচরণ কোনোভাবেই ভুলতে পারেনি সে। তার জেদ সিনেমায় নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেবেই দেবে এবার। আকাশ চৌধুরীর মতো নায়ককে সে উপযুক্ত একটা শিক্ষা দিতে চায়। অবহেলা কিংবা অগ্রাহ্য করার মতো অযোগ্য মেয়ে নয় সে। সবাইকে চমকে দেওয়ার মতো যোগ্যতা রয়েছে তার। ছয়. মুনার কাছে নিজের ব্যস্ততার ফিরিস্তি দিয়েছে সানজানা। পাশাপাশি জানিয়েছে তার মায়ের অসুস্থতার খবর। কানাডা থেকে বড় ভাইয়া ফোনে জানিয়েছে মায়ের অসুখের কথা। তাকে ওখানকার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বেশ কিছু জটিল রোগ ধরা পড়েছে মায়ের। ডাক্তাররা বলেছেন, খুব বেশিদিন হয়তো বাঁচবেন না তিনি। মাকে শেষবারের মতো দেখতে যেতে বলছেন বড় ভাইয়া। এদিকে প্রথম অভিনীত ছবির শুটিং শুরুর তারিখও ঠিক হয়েছে। এ অবস্থায় কী করবে, সানজানা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মুনার কাছে একটা পরামর্শ চেয়েছে সানজানা। মুনার তখন নিজের বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। বাবা মারা গেছেন হঠাৎ করেই। হার্ট অ্যাটাকে করে অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন বাবা। ঢাকায় পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে ছিলেন মেয়েকে। অনেক বড় আশা করেছিলেন মুনার ব্যাংকার বাবা। মেয়ে বিবিএ, এমবিএ করে বড় চাকরি করবে, তার চেয়েও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হবে। চারদিকে মুনার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। তার প্রশংসা শোনা যাবে সবার মুখে। কিন্তু বাবার স্বপ্ন, আশা সবই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। মুনার অধঃপতিত জীবনের সব বিবরণ শুনে সহ্য করতে পারেননি তিনি। মেয়ের বিপর্যস্ত অন্ধকার জীবনের কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ার পর লজ্জা আর অপমানে বাড়ি থেকে বের হওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন বাবা। ঘরের মধ্যে একাকী চুপচাপ বসে থাকতেন। যন্ত্রণায় তিনি হয়েছিলেন বাকরুদ্ধ। সেই আঘাতে একদিন হঠাৎ করে হারিয়ে গেলেন। বাবা আর তার মুখ দেখতে চান না, বলে গিয়েছিলেন। যে কারণে বাবার মৃত্যুর পর বাড়ি যেতে পারেনি মুনা, তাকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ পায়নি। এ আপসোস তার রয়েই গেল জীবনে। মা বেঁচে আছেন। তার মনেও অনেক ক্ষোভ, দুঃখ মুনাকে নিয়ে। মেয়ে পরিবারের মান-সম্মান সবই লুটিয়ে দিয়েছে। কারো কাছে মুখ দেখানোর উপায় নেই। সেই মেয়ের কারণে স্বামীকে হারিয়েছেন অসময়ে। মেয়ের নাম মুখে আনতে চান না মা আর, তার মুখ দেখা তো দূরের কথা। মুনা তার বাবার কথা, মায়ের কথা, ভাইবোনদের কথা মন থেকে সরাতে পারেনি। সব সময় তাদের কথা মনে পড়ে, নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে ভেবে বুকের মধ্যে কষ্টের পাথর চেপে বসে আরো, ক্রমেই তা আরো ভারী হয়ে ওঠে। মুনা সানজানাকে বলেছে, যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন সে যেন তার অসুস্থ মাকে দেখার জন্য অবশ্য অবশ্যই কানাডা যায়। কারণ, দেরি করলে তাকে দেখার সুযোগ হারাতে পারে চিরকালের মতো। পরে এ নিয়ে আক্ষেপ করতে হবে তাকে, অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হবে আজীবন। সানজানা মুনাকে অনেক পছন্দ করে। মেয়েটির সঙ্গে অল্পদিনেই কেমন একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাকে বান্ধবী, বোন ইত্যাদির চেয়ে আরো অনেক আপনজন মনে হয় তার। সানজানা জানে, এই শহরে মুনাও তাকে অনেক কাছের একজন মনে করে। নানা বিষয়ে তার ওর ভরসা করে। যে কোনো বিপদ কিংবা সমস্যায় সাহায্য চায়, পরামর্শ চায়। মুনার কথামতো সানজানা স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সিনেমাতে অভিনয় শুরু করার আগেই মাকে দেখতে কানাডা যাবে। যাবার সব প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সে। টিকিটের তারিখ কনফার্ম করা বাকি শুধু। কানাডায় অসুস্থ মাকে দেখতে যাবার আগে সানজানা বলেছিল দশ পনের দিন থেকেই চলে আসবে। প্রথম অভিনীত সিনেমার শুটিংয়ের তারিখও ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু নায়িকার মায়ের অসুস্থতার কারণে তাকে কানাডা যেতে হওয়ায় শুটিংয়ের নির্ধারিত তারিখ পেছানো হয়েছে। এর মধ্যে পঁচিশ দিন পেরিয়েছে। সানজানার কোনো খবর নেই। কানাডা পৌঁছার পর টরেন্টো এয়ারপোর্টে নেমেই ফোন করে জানিয়েছিল, তাকে নিতে মা ও বড় ভাই এসেছেন গাড়ি নিয়ে। যাকে দেখার জন্য সানজানার কানাডা যাওয়া, সেই গুরুতর অসুস্থ মা সুস্থ হয়ে গেছেন, মেয়েকে নিতে এয়ারপোর্টে এসেছেন জেনে মুনারও ভীষণ ভালো লেগেছে। সানজানার মায়ের অসুখের খবর শুনে মুনার মনটাও অস্থির হয়ে উঠেছিল। তার সুস্থতার জন্য দোয়া করেছে সে অনেকবার। গত পঁচিশ দিনে একবারও ফোন করেনি সানজানা। এদিকে দেশের কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে খবর বেরিয়েছে। সানজানা আপাতত দেশে ফিরছে না, কানাডায় বিয়ে করে ওখানেই সেটেলড হওয়ার চিন্তাভাবনা করছে জনপ্রিয় এই মডেল তারকা সম্প্রতি। এরকম কত গসিপ নিউজ ছড়ায় পত্রপত্রিকায় অনলাইনে। জনপ্রিয় তারকাদের নিয়ে সবার বিশেষ আগ্রহ, কৌত‚হল থাকে যে কারণে গুজব গুঞ্জনেরও অন্ত থাকে না। সানজানাকে নিয়েও তেমন খবর ছড়িয়েছে হয়তোবা। মুনা প্রথমদিকে তেমন ভাবলেও পঁচিশ দিনেও তার কোনো খোঁজখবর জানতে না পেরে মনের মধ্যে এক ধরনের উশখুশ ভাব সৃষ্টি হয়েছে। সানজানার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই। ওখানকার কোনো টেলিফোন নম্বরও দেয়নি সে। মাঝখানে একদিন গুলশানের নিকেতনে সানজানার বাসায় গিয়েছিল মুনা। বাসায় ওর খালাকে পেলেও তিনিও কানাডার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন। আগের টেলিফোন নম্বরগুলোতে কেউ কল রিসিভ করছে না। ছাব্বিশ দিনের মাথায় কাল রাতে সানজানা কানাডা থেকে ফোন করেছিল। খুব বেশি কথা হয়নি মুনার সাথে। সে পাঁচ মিনিটে যা বলেছে তার সারমর্ম হলো : পত্রপত্রিকার নিউজ পোর্টালে তাকে নিয়ে যেসব খবর রটাচ্ছে তা বানোয়াট গুজব নয়। সে সত্য সত্য বিয়ে করেছে, পাত্র কানাডায় একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। মা ও ভাই-ভাবির পছন্দে বিয়েটা হয়েছে। তার নিজেরও পছন্দ হয়েছে পাত্র। আপাতত দেশে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। কানাডায় নতুন জীবন শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। মেয়ের চিন্তায় মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মেয়েকে কাছে পেয়ে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সানজানাকে গত বেশ কিছুদিনে যতটা চিনেছে তাকে যতটা দেখেছে তাতে ভীষণ জেদি, বেপরোয়া, একরোখা একটা মেয়ে বলে মনে হয়েছে। সেই সানজানা হঠাৎ এভাবে রাতারাতি পাল্টে গেল। মডেলিং জগতের জনপ্রিয়তা, নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের হাতছানি, শোবিজের মোহ সব কিছু উপেক্ষা করে আটপৌর সংসার জীবনে মিশে যেতে চাইছে অন্য আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই। ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক মনে হয় মুনার কাছে। হিসেব মিলছে না মুনার কাছে। হঠাৎ করে সানজানা এভাবে বদলে গেল কেন? প্রশ্ন করে নিজেকে। পরক্ষণেই ভাবে, মানুষের জীবনটা এমনই। কারো কারো বদলে যেতে তেমন সময় লাগে না। নাটকীয়ভাবে নিজেকে পাল্টে ফেলে কতজন। এক জীবন ছেড়ে অন্য আরেক জীবনের সাথে অ্যাডজাস্ট করে নেয়। নতুন জীবনকে মানিয়ে নিতে পারে অনায়াসে। সানজানা কি তাহলে তেমনই এক মেয়ে, ভাবতে চেষ্টা করে মুনা। ঢাকায় সানজানাকে নিয়ে যেভাবে মাতামাতি শুরু হয়েছিল, শোবিজ অঙ্গনে তার ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনা নিয়ে যেসব আলোচনা জমে উঠছিল, তা অনেক প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় নায়িকাদের মনে দুশ্চিন্তা ছাপ ফেলেছিল। সানজানা তাদের কাছে হয়ে উঠছিল এক বড় প্রতিদ্ব›দ্বী। সিনেমায় সানজানার আগমনে তাদের কারো কারো পজিশন টলে উঠে পারে এমন আশঙ্কা করছিল চলচ্চিত্রবোদ্ধারাও। সেই সানজানা শেষ পর্যন্ত কিনা তাহলে রণেভঙ্গ দিল, কিন্তু কেন প্রশ্ন উঠেছিল মিডিয়া জগতে। তবে সেই যাই হোক, সানজানা সুন্দর এক নতুন জীবন শুরু করেছে জেনে খুশি হলেও মুনার মনটা অন্যদিকে বেশ ভারী হয়ে উঠেছে। এই শহরে তার একজন শুভাকাক্সক্ষী আর অনেক কাছের মানুষ ছিল সানজানা। বিপদে-আপদে দুঃখ-বেদনায় সংকটে তার কাছে ছুটে যেত। এত কাছের একজন বন্ধুকে হারিয়ে মুনার মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়। দারুণ মিস করতে থাকে তাকে। কিছুই ভালো লাগে না তার। গত কয়েকদিন ধরে শরীরটাও ভালো লাগেছ না। কেমন একটা অস্বস্তিভাব চেপে বসেছে। খাওয়াদাওয়া করতে ইচ্ছে করে না। সারাদিন শুধু শুয়ে থাকতে মন চায়। এক ধরনের ক্লান্তি, অবসন্নতা যেন গ্রাস করেছে তাকে। কোনো কঠিন অসুখ বাঁধিয়ে বসল নাকি, ভাবনা হয় নিজেরই। তার যে লাইফস্টাইল তাতে এটা অস্বাভাবিক নয় মোটেও। আচ্ছা, যদি তেমন কোনো কঠিন মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয় তাহলে কী হবে ভাবতে গিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মুনা। এরকম নানা দুর্ভাবনার ঘোরে দিন কাটে তার। পুরনো দিনগুলো হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে বারবার। এই শহরে পা রাখার পর গত ক’ বছরে কত মানুষের দেখা পেয়েছে সে। কতজনের সাথে মিশেছে। ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। কাছাকাছি এসে আবার অনেক দূরে হারিয়ে গেছে। তাদের দেখা পায়নি আর কখনও। এতদিন থেকেও এই শহরটাকে এখন পর্যন্ত ভালোভাবে চিনতে পারল না, আজও অচেনা রয়ে গেছে অনেক মানুষ। অনেক কিছুই চেনা সম্ভব হয় না এত কাছাকাছি থেকেও। এটাই হয়তো পৃথিবীর অমোঘ একটা নিয়ম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App