ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে...
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০১৯, ০৫:৩৬ পিএম
চট্টগ্রামের লোক ও আঞ্চলিক গানের একটি সমৃদ্ধ ধারা হলো সাম্পানের ঐতিহ্য সম্পর্কিত গান। শতবর্ষ ধরে সাম্পান, সাম্পান-মাঝি এবং নদী ও নারী নিয়ে অসংখ্য চিরসবুজ গান লেখা হয়েছে। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদী, শঙ্খ নদ, মাতামুহুরী, বাঁকখালী নদী এবং সাম্পান নিয়ে অনেক কালজয়ী গান রচিত হয়েছে। সেসব গান চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতির বড় এক সম্পদ।
চোড চোড ঢেউ তুলি পানিত
লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে
যার গই কর্ণফুলী।।
(কথা, সুর ও শিল্পী : মলয় ঘোষ দস্তিদার)
বাঁশখালী মইশখালী
পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান
গুরগুরাই টানে
আয় তোরা কন্ কন্ যাবি
আঁর সাম্পানে।
(কথা, সুর ও শিল্পী : সনজিত আচার্য)
‘পালে কী রং লাগাইলরে মাঝি
সাম্পানে কী রং লাগাইল
শঙ্খ খালর সাম্পানওয়ালা আঁরে
পাগল বানাইল।’
(কথা ও সুর-কবিয়াল ইয়াকুব আলী, শিল্পী-শেফালী ঘোষ)
এখনো কি গুরগুরাই টানে কর্ণফুলীর সাম্পান? পালে রং লাগিয়ে নারীর মনেও রং ছড়ান রঙিলা মাঝি?
না, কর্ণফুলী বা শঙ্খে এখন আর শোনা যায় না সাম্পান চলার সেই চেনা সুর ‘ক্যাঁ কোরত, ক্যাঁ কোরত’, নিশি রাইতে আর ‘প্রেমের ঘাটে’ সাম্পান ভেড়ায় না রঙিলা মাঝি। এখন নদী দাপিয়ে বেড়ায় ইঞ্জিনের নৌকা। এখন সেই সাম্পান নেই, নেই সাম্পানওয়ালাও। কিন্তু আছে সাম্পানওয়ালার গান, সে গান এখনো পাগল করে চাটগাঁর মানুষকে, শুধু কি চাটগাঁ, সে গানে উন্মাতাল হয় গোটা দেশ!
১৯৩২ সালে কলকাতার হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচএমভি) থেকে জগন্ময় মিত্রের তত্ত¡াবধানে মোহাম্মদ নাসিরের কণ্ঠে প্রথম চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয়েছিল। সেই রেকর্ডের এক পিঠে ছিল এই গানটিÑ ‘চাঁনমুখে মধুর হাসি/দেবাইল্যা বানাইলরে মোরে/সাম্পানর মাঝি।’ মোহাম্মদ নাসিরের কণ্ঠে আঞ্চলিক গান সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রথম বাণিজ্যিক ধারায় প্রবেশ করে। মোহাম্মদ নাসিরের সেই গানটি এখনো চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়। আসলে সাম্পান ও তার মাঝি নিয়ে গত ৮০ বছর ধরে যত গান রচিত হয়েছে মোহাম্মদ নাসিরের এই গানটিই ছিল তার অন্যতম উৎস। ১৯৪১ সালের দিকে মলয় ঘোষ দস্তিদারের কণ্ঠে, তারই কথা ও সুরে গ্রামোফোন রেকর্ডে বের হয় সেই কালজয়ী গানটি, ‘চোড চোড ঢেউ তুলি...।’ সাম্পান ও সাম্পান মাঝি নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় গান সম্ভবত শেফালী ঘোষের গাওয়া সেই গান ‘ওরে সাম্পানওয়ালা/তুই আমারে করলি দেওয়ানা...।’ এই অমর গানটির রচয়িতা হলেন মোহন লাল দাশ।
তবে কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটা গান খুবই জনপ্রিয়, সেটা হলো, ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয় ভাঙা আমার তরী...।’ ধারণা করা যায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জলযান সাম্পান নিয়েই এই গান তিনি লিখেছেন। কারণ যৌবনে তিনি একাধিকবার চট্টগ্রামে এসেছেন, কর্ণফুলী নদী ও পতেঙ্গা সৈকতে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। সে হিসাবে সাম্পান নিয়ে নজরুলের গানটি মোহাম্মদ নাসিরের ‘চাঁন মুখে মধুর হাসি’রও আগে লেখা এবং গাওয়া।
চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতির এক বড় ঐতিহ্য নদী, খাল এবং সাম্পানমাঝি নিয়ে রচিত গান। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদী, শঙ্খ খাল ও সাম্পানমাঝি নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য আঞ্চলিক গান। এ অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিরহ-মিলনের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী ও শঙ্খ এবং কক্সবাজারের মাতামুহুরী ও বাঁকখালীকে ঘিরে। এসব নদীর মাঝিরা সাম্পানে পাল তুলে দিয়ে গাইতেন আঞ্চলিক গান। গলা ছেড়ে দিয়ে গাইতেন বলে এ গানের আরেক নাম ‘হালদাফাডা গান’। এ গানের বড় অংশই রচিত হয়েছে নর-নারীর প্রেম-বিরহ নিয়ে।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত কল্যাণী ঘোষ রচিত ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান’ গ্রন্থে ‘সাম্পানের ঐতিহ্য সম্পর্কিত গান বা সাম্পান মাঝির গান’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের সাথে ‘সাম্পান’ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। উল্লেখ্য, চীন সাগরের উপক‚ল থেকে বঙ্গোপসাগরের উপক‚ল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের এই বিশেষ ধরনের নৌকার বড় বৈশিষ্ট্য হলো ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেও ডোবে না। সাম্পানের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে সাম্পানের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রামের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামও তৈরি হয়েছে।”
সাম্পান নামক জলগাড়িটি এই জনপদের মানুষের জীবন-জীবিকার যেমন উৎস, তেমনি তাদের সংস্কৃতিরও অনুপম অনুষঙ্গ। তাই সাম্পান ও তার কাÐারি নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, নাটক, গাথা। যা চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। চট্টগ্রামের লোককথার ভিত্তিতে রচিত সনজিত আচার্যের ‘সাম্পানওয়ালা’ আঞ্চলিক নাটকটি নিয়ে সত্তরের দশকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং সেই ছবি সারাদেশে আলোড়ন তুলেছে।
সাম্পানমাঝি নিয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর বেশিরভাগ লিখেছেন রমেশ শীল, আসকর আলী পÐিত, সেকান্দর পÐিত, মোহাম্মদ নাসির, অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, মোহন লাল দাশ, এম এন আখতার, আবদুল গফুর হালী, কবিয়াল ইয়াকুব আলী, লক্ষীপদ আচার্য, সনজিত আচার্য, সৈয়দ মহিউদ্দিন, আহমদ কবির আজাদ, দীপক আচার্য, নুরুল আলম, সিরাজুল ইসলাম আজাদ, খোরশেদুল আনোয়ার, ইকবাল হায়দারের মতো সঙ্গীতজ্ঞ। শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, এম এন আখতার, কল্যাণী ঘোষ, সনজিত আচার্য, কান্তা নন্দী, বুলবুল আক্তার, গীতা আচার্যসহ নাম না জানা অনেক শিল্পীর কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়েছে এসব গান। আব্দুল গফুর হালীর ‘কুশল্যা পাহাড়’, ‘গুলবাহার’ সনজিত আচার্যের ‘সাম্পানওয়ালা’সহ অনেক আঞ্চলিক নাটকে উঠে এসেছে সাম্পান-মাঝির জীবনের কথকতা।
এই চট্টগ্রামের নদী ও নারীর প্রাণের দোসর হলেন সাম্পানওয়ালা বা সাম্পানের মাঝি। সঙ্গীতজ্ঞ মোহন লাল দাশ সেই মাঝির রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে...
‘সাম্পানওয়ালার বাবরি চুল
হরি নিল জাতের ক‚ল
সে বিনা মোর পরান বাঁচে না
ওরে সাম্পানওয়ালা
তুই আমারে করলি দেওয়ানা।’
এই বাবরি চুলের সাম্পানমাঝি কত নারীর মন চুরি করেছে, আর কত নারীর কান্নার জলে বেড়েছে কর্ণফুলীর জল, সে কথা মোহন লাল দাশ বলেছেন সুরে সুরে, ‘কুতুবদিয়া বন্ধুর বাড়ি/বিচ্ছেদ জ্বালা সইতে নারি/বন্ধু বিনা ঘুম তো আসে না...।’
আমাদের চট্টগ্রামে সাম্পানওয়ালার গানে প্রেম-বিরহ যেমন এসেছে তেমনি গীত হয়েছে সাম্পানের কাণ্ডারির শৌর্যবীর্যের কথাও। মোহন লাল দাশের চিরসবুজ সেই গানে আছে সে কথাও...
‘বাহার মারি যারগই সাম্পান
ক্ষেণে ভাটি ক্ষেণে উজান
ঝড় তুফানে পরওয়া করে না।’
এখানে একটি ঘটনা বলা যায়, ১৯৬৮ সালে শেফালী ঘোষের কণ্ঠে ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’ গানটি গ্রামোফোন রেকর্ডে বের হলে আঞ্চলিক গানে নতুন জোয়ার আসে। সত্তরের দশকে আঞ্চলিক গানে স্বর্ণযুগেরও শুরু এই গান দিয়ে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পান শেফালী ঘোষ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতির পিতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মঞ্চে উঠার সময় শেফালীকে কাছে ডেকে নেন বঙ্গবন্ধু, আদুরে গলায় বলেন, ‘শেফালী ওই গানটি গাইতে হবে কিন্তু!’ কোন গানটি? সেই গানটি হলো ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দেওয়ানা...।’ চট্টগ্রামের সেই আঞ্চলিক গানটি তখন এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, এটি মনজয় করেছিল বঙ্গবন্ধুরও।
আঞ্চলিক গানের পথিকৃৎ রচয়িতা কবিয়াল রমেশ শীলের গানে সাম্পান এসেছে নানা অনুষঙ্গে। সাম্পান নিয়ে তার একটি গভীর অনুভববের গান...
আমার সাম্পান যাবে উজানে
কে যাবি রে আয় রে তোরা
আমার হাউসের সাম্পানে
বাদাম দিলে উড়ি চলে রে দাদা
মদত করে পবনে।।
মোহাম্মদ নাসিরের সেই গানটি ‘চাঁনমুখে মধুর হাসি’ আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হলেও এই গানটি একটি আধ্যাত্ম চেতনার গান আর তাতে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সাম্পান ও তার মাঝি। নদী পার হতে গিয়ে ঘাটের পয়সার জন্য আটকে গেছেন ক‚লনারী। আসলে তিনি ধরা পড়েছেন মাঝি তথা পরম প্রিয়তমের প্রেমের ফাঁদে। গানের অন্তরা বলে তেমনটাই...
‘ওরে ও সাম্পানওয়ালা ভাই
আমি তো গিরস্থের মাইয়া
সঙ্গের কড়ি নাই
পার করাই দাও ও মাঝি ভাই
কিনারে লাগাও তরী।।
আমি তো অবলা নারী
প্রেম জ্বালা সইতে নারি
তোমার কারণে বন্ধু
পরান আমার যায় ছাড়ি।।
অচিন্ত্য কুমারের লেখা, ‘সূর্য ওডের লে ভাই লাল মারি/ রইস্যা বন্ধু ছাড়ি গেল গই আঁর বুগত ছেল মারি’ গানটি গেয়েই তো আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ। যে গানে বিরহী নারীর আকুতি...
‘শঙ্খ খালর কুলর উয়র (ও ভাই)
রইস্যা বন্ধুর ঘর
লাগত পাইলে কইও তারে
(মোর) পরানর খবর
নিদয়া বন্ধের জ্বালায়রে
পরান আমার যায় ছাড়ি।’
আহ! এই গানে কী অপরূপ প্রেম আর কী অনুপম বিচ্ছদ যাতনা! শঙ্খ খালের ক‚লে যে ‘রইস্যা বন্ধুর’ ঘর সে তো সাম্পানমাঝিই হবে। আর সাম্পানমাঝি মানেই তো সেই বাঁশরীয়া যে চোখের ইশারাতে প্রেম শেখায়। এই গানের একটি অন্তরায় রইস্যা বন্ধুকে শঙ্খের ‘কালা পানি’র সাথে তুলনা করেছেন কবি।
শঙ্খ খালর পানিরে কালা
কালা দুশমন
তার্তুন অধিক কালা (অভাই)
পাষাণ বন্ধের মন
ফিরিয়া না চাইল বন্ধুরে
অবলারে গেল ছাড়ি।।
সাম্পানমাঝি নিয়ে অসাধারণ গানগুলো কীভাবে লেখা হলো? এমন প্রশ্নের উত্তরে আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল গফুর হালী একটি গল্প বললেন, শোনা যাক সে গল্প-‘আজ থেকে ৪০/৫০ বছর আগেও আমার গ্রাম পটিয়ার রশিদাবাদ থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার একমাত্র মাধ্যম ছিল সাম্পান। সন্ধ্যায় শঙ্খ খালের ঘাটে গিয়ে সাম্পানে উঠতাম, চানখালী খাল দিয়ে মধ্যরাতে সাম্পান পৌঁছাত পটিয়ার ঈন্দ্রপুলে। সেখানে যাত্রাবিরতি। বাড়ি থেকে আনা ‘ভাতের মোচা’ খুলতাম আমরা। খাওয়ার পর আবার রওনা দিতাম। সকালে চাটগাঁ শহরের সদরঘাটে পৌঁছাত সাম্পান। তখন তো গাড়ি ছিল না। সাম্পান ছিল মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাভাবিকভাবে সাম্পান ও সাম্পানমাঝি নিয়ে গান ও নাটক লেখা হয়েছে অসংখ্য। গফুর হালীর লেখা জনপ্রিয় একটি গান হলো...
‘তুই মুখ কেয়া কইয্য কালা
যদি আঁরে লাগে ভালা
(অ ভাই) শঙ্খ খালর মাঝি
আঁই তোঁয়ার লগে রাজি।’
আসলে তিন-চার দশক আগেও এই জনপদে সাম্পান ছাড়া মানুষের জীবন ছিল অচল। সাম্পান শুধু মানুষ পার করতো তা নয়, সাম্পান দিয়ে হতো মালামাল আনা-নেওয়া, চট্টগ্রামসহ সন্নিহিত এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য। হেমন্তে গেরস্থ বাড়িতে ধান উঠলেই কুমাররা সাম্পান নিয়ে ছড়িয়ে পড়তেন গোটা চট্টগ্রামে, ধানের বিনিময়ে বিক্রি করতেন মাটির জিনিস। পাশের নদীতে সাম্পান ভিড়িয়ে কেউ বিক্রি করতো খেজুর রস, কেউ জিলাপি, কেউ বা শাড়ি-চুড়ি। তাই সাম্পান চট্টগ্রামের মানুষের জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্রোতধারায় মিশে আছে।
আঞ্চলিক গানের আরেক প্রবীণ গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী এম এন আখতারের কথাতেও একই সুর, তিনি ছোটবেলায় রাউজানের গ্রামের বাড়ি মোহাম্মদপুর থেকে শহরে আসতেন সাম্পানে চড়ে, কর্ণফুলী নদী দিয়ে। ১৯৭১ সালে সাম্পান নিয়ে প্রথম গান লেখেন...
ক্যাঁ কোরত ক্যাঁ কোরত
চাম্মান অলা ক্যাঁ কোরত
ক্যানে যাইয়ম বব্বুরত
বব্বুরজ্জামাই তিয়াই রইয়ে
ঘাঁড়ার দুয়ারত।।
জামাইর হতা দোচরা
দুরুচ কুরা মোচরা
আঁরে দেখি বব্বুরজ্জামাই
যার গৈ বাজারত।।
১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামের শিল্পী সনজিত আচার্য রচিত আঞ্চলিক নাটক ‘সাম্পানওয়ালা’ নিয়ে তৈরি হয় সিনেমা। ‘সাম্পানওয়ালা’ নাটকটি চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছিলেন সত্য সাহা। এতে অভিনয় করেছিলেন চট্টগ্রামের মেয়ে চিত্রনায়িকা শাবানা। নায়ক ছিলেন আলমগীর। ওই বছরই ছবিটি মুক্তি পেলে গোটা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ছবির প্রায় সব গানের কথা ও সুর ছিল সনজিত আচার্যের। কণ্ঠ দিয়েছিলেন শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, সনজিত আচার্য ও কান্তা নন্দী। ‘সাম্পানওয়ালা’ ছবিতে সনজিত আচার্যের কথা ও সুরে কান্তা নন্দীর কণ্ঠে দারুণ জনপ্রিয় একটি গান হলো ‘ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে।’ কান্তা নন্দীর কণ্ঠে ওই ছবির আরেকটি জনপ্রিয় গান হলো...
‘কি গান মাঝি হুনাইল হায় রে
কি বাঁশি মাঝি বাজাইল
কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালা
আঁর মন হরি নিল।।’
গত চার দশক ধরে গানগুলো শ্রোতাদের মাত করছে। ২০০৬ সালে মৌসুমী ও ফেরদৌসকে দিয়ে ‘সাম্পানওয়ালা’ ছবিটি রিমেক করা হয়। সেখানে ক্লোজআপ ওয়ান তারকাদের দিয়ে ছবির গানগুলো নতুন সঙ্গীতায়োজনে গাওয়ানো হয়। নতুন স্বাদের গানগুলো তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
লক্ষীপদ আচার্যের কথা ও সুরে শেফালী ঘোষের গাওয়া নিচের গানটি চিরসবুজ গান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত...
রঙিলা মাঝিরে
এই ঘাড়দ্দি সাম্পান ভিড়াইও
আইস্যরে তুই নিশি রাইতে
আস্তে গরি মাতাইও।।
লক্ষীপদ আঞ্চলিক গানের আরেকজন দিকপাল শিল্পী। সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী এই শিল্পী শুধু ‘রঙিলা মাঝিরে’ গানটির জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে জীবনমুখী ধারার সংযোজক হলেন সৈয়দ মহিউদ্দিন। সাম্পানকেন্দ্রিক জীবনকথা এসেছে তার গানে, তবে একটু ভিন্নভাবে। মহির এসব গানেও জীবনমুখী ভাবধারা প্রস্ফুটিত। শেফালী ঘোষের গাওয়া সৈয়দ মহিউদ্দিনের লেখা গানটিতে তারই ইঙ্গিত...
মন কাচারা মাঝি তোর
সাম্পানত উইটতাম নঅ
আঁরে দেখি গলা হাকদি
কিল্লাই কঅলি
পইসা লইতাম নঅ।।
সৈয়দ মহিউদ্দিনের এই গানে লোকশিক্ষারও সবক দেখা যায়
মঅনা মক্ত ঘাট পার অইবুর
ময় মুরব্বির মানা
হাশরদ্দিন কাঁধর বোঝা
আজাব জরিমানা রে
আত্তে আছে জানা...।।
সৈয়দ মহিউদ্দিন আঞ্চলিক গানে যেমন জীবনমুখী ধারা সৃষ্টি করেছেন তেমনি তিনি চট্টগ্রামের বিশুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষায় গান লিখেছেন। উপরিউক্ত গানটি তারই উদাহারণ।
কক্সবাজার এলাকার মাতামুহুরী, বাঁকখালী নদী এবং সাম্পান-মাঝিদের নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক গান। এম এ রশিদ কাওয়াল, আহমেদ কবির আজাদ ও সিরাজুল ইসলাম আজাদের গানগুলো দারুণ জনপ্রিয় এ অঞ্চলে। আহমদ কবিরের একটি গান, ‘কক্সবাজার দইজ্যার চর/তার উয়রদি পার/দইজ্জ্যার চরত ঢেউ খেলি যার/হত গম গম লার।’ বছর আটেক আগে শিল্পী রবি চৌধুরীর কণ্ঠে গানটি দারুণ জনপ্রিয় হয়।
কক্সবাজারের লোকশিল্পী বুলবুল আক্তারের কণ্ঠে দারুণ একটি জনপ্রিয় গান হলো...
‘বাঁকখালীর মাঝি অভাই
সোনাদিয়া বাসা
মুখ্খান হালা গইজ্য কিল্লাই
হনে দিল আশারে
ওরে বাঁকখালীর মাঝিরে।’
তবে বিকৃতি আর চৌর্যবৃত্তির কবলে পড়ে এবং আকাশ-সংস্কৃতির আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে সাম্পানমাঝির গান। এই গান বাঁচিয়ে রাখতে এখনই উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানালেন শিল্পী সনজিত আচার্য। তাঁর কথা, ‘আমাদের অহংকার আঞ্চলিক ভাষার এসব গান বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এখন গানগুলো বিকৃত করে গাইছেন তারকা শিল্পীরা। এটা আঞ্চলিক গানের জন্য অশনি সংকেত।’
প্রসঙ্গত, গত এক দশক ধরে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানগুলো নতুন সঙ্গীতায়োজনে গেয়ে জাতীয় পর্যায়ে অনেক শিল্পী তারকা বনে গেছেন। আবার অনেক তারকা শিল্পীও নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে কিংবা নতুনদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আঞ্চলিক গান গাইছেন। তবে তাতে বিকৃতির অভিযোগ আছে, আছে গানের ¯্রষ্টা ও মূল শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী না দেওয়ার অভিযোগও।
২০০৪ সালে চট্টগ্রামেরই সন্তান শিল্পী সন্দীপন আবদুল গফুর হালী রচিত ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে’ গানটা দিয়ে বাজার মাত করেন। এরপর ২০০৬ সালে হাবীব-শিরিন আবদুল গফুর হালীর ‘পাঞ্জাবিওয়ালা, মনের বাগানে’ এবং অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তীর ‘ওরে আমার ময়না পাখি’ গানগুলো দিয়ে দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে ঝড় তোলেন। এরপর ক্লোজআপ ওয়ান তারকা সালমা এমএন আখতারের ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে’ এবং সোনিয়া ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’, নোলক বাবু ‘বাঁশখালী মইশখালী’ গানগুলো গেয়ে চট্টগ্রামের গানকে জাতীয় পর্যায়ে যেমন তুলে ধরেন তেমনি তারা নিজেরাও জনপ্রিয়তা পান। এছাড়া বেবী নাজনীন, হৃদয় খানসহ অনেক তারকা শিল্পী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান গেয়ে দারুণ জনপ্রিয়তা পান। কিন্তু সন্দীপন আর বেবী নাজনীন ছাড়া প্রায় সবার বিরুদ্ধে গানের সুর ও কথা বিকৃতির অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে সোনিয়ার কণ্ঠে ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’ গানটি সুপারডুপার হিট হলেও গানটার প্রাণ হরণ করা হয় বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রামের অনেক শিল্পী। এসবের অবসান হওয়া উচিত।
আগেই বলেছি কর্ণফুলী বা শঙ্খে এখন আর গুরগুরাই চলে না সাম্পান? শোনা যায় না সাম্পান চলার সেই চেনা সুর ‘ক্যাঁ কোরত, ক্যাঁ কোরত’।
সৈয়দ মহিউদ্দিনের গানে উঠে এসেছে সাম্পানের সাম্প্রতিক দুর্দিনের কথা...
সাম্পানমাঝি সাম্পান বায়
আগের মতো পেসিঞ্জার ন পায়।
নৌকার মাথিত ইঞ্জিল দেখি
মানুষ গেইয়ে হেইখ্যা ঝুখি
সরে সরে আইবু যাইবু
দেরি গইত্যু কনে চায়।।
আসলে এখন ছুটে চলার সময়, এখন আর ধীরে বহে না নদী। তাই কর্ণফুলী-শঙ্খ বা মাতামুহুরী-বাঁকখালীতে দাপিয়ে বেড়ায় ইঞ্জিনের নৌকা, যন্ত্রের শব্দে হারিয়ে গেছে মাঝির গান। কিন্তু চাটগাঁর মানুষ এখনো ভুলেনি সাম্পান চলার সেই সুমধুর সুর, ‘ক্যাঁ কোরত ক্যাঁ কোরত’, তাই এখনো বিরহী নারী আকুল হয়ে গায় সেই গান...
ওরে সাম্পানওয়ালা
তুই আমারে করলি দেওয়ানা।।
কুতুবদিয়া বন্ধুর বাড়ি
বিচ্ছেদ জ্বালা সইতে নারি
বন্ধু বিনা ঘুম তো আসে না।।