একা এবং অপারাজেয়
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০১৯, ০৩:২১ পিএম
ব্যাসের মহাভারতে আছে, কৌরব সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় বিদুর ছিলেন একক প্রতিবাদী। সভায় উপস্থিত ছিলেন ধর্মপুত্র যুুধিষ্ঠির, অমিত বলশালী ভীম, বীরযোদ্ধা অর্র্জুন, অনুগামী ছোট দুভাই নকুল ও সহদেব। সকলেই ছিলেন নিশ্চুপ।
শ্রাবণের এক মেঘলা সকালে অমলকান্তি বসে আছেন ব্যালকনিতে, টবে কুমকুমের লাগানো নয়নতারা, দোপাটি, মানিপ্ল্যান্টের লতা আর কয়েকটি ক্যাকটাস গাছ অযত্নে এখনও বেঁচে আছে। বাদলা হাওয়ায় পাতাগুলো নোলকের মতো দুলে ওঠে। এদিকে তাকিয়ে সকালের সময়টা পার করেন তিনি। সময় এখন তার কাছে দ্রৌপদীর শাড়ির মতো, কিছুতেই ফুরোতে চায় না।
সকাল বেলা চলে আসে সজল নামের ছেলেটি, ঘরদোর পরিষ্কার করে, এলোমেলো বিছানা পরিপাটি করে বেডকভার দিয়ে ঢেকে রাখে। টবে জল দেয়। এখন ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে। ঘিয়ে ডিমের ওমলেট তৈরি করার মনকাড়া গন্ধ ব্যালকনিতে ভেসে আসছে।
এক্ষুনি টোস্ট-ওমলেট আর লিকার চা নিয়ে আসবে সজল। ছুটির দিনের এই সকালটাকে আজকাল বড় দুর্বহ মনে হয়।
একা বসে কখনোই চা-কপি খেতে পারেন না তিনি, ভাত তো নয়ই। এখন খিদে কিংবা আনন্দের খাওয়া নয়, এখন তার নিয়মের খাওয়া, অভ্যেসের খাওয়া, সকাল-দুপুর-রাতে খেতে হয় তাই টেবিলের সামনে বসেন তিনি।
মা-বাবা কেউ এখন বেঁচে নেই। একা বসে থাকলে স্মৃতির পিচ্ছিল দেয়াল ঘেঁষে চলে আসেন বাবা বিমলকান্তি, মা অলকা, মা বলতেন, কী প্যাঁকাটির মতো চেহারা বানিয়েছিস রে, দুধ খাবি না মাছ খাবি না, শরীরটা সারবে কি করে?
বিমলকান্তি গম্ভীর গলায় বলতেন, খাওয়া নিয়ে এত সাধাসাধি কিসের? ঘরে যদি অভাব থাকতো, সামনে মাছ-মাংস বেড়ে না দিত তবে ঠিকই খিদে পেত ছেলের।
বাবার কথার ওপর মা কথা বলতেন না, এ এক অলিখিত নিয়ম ছিল। বিমল কন্তি পরিবারের সর্বেসর্বা, অথচ সেই কাঁচাভোরে উঠে মধ্যরাত পর্যন্ত মায়ের ঊনকোটি কাজ আর শেষ হতো না।
চার ভাই বোনের লালন-পালন, সময়ে-অসময়ে অতিথি-অভ্যাগতের যাওয়া-আসা, তাদের দেখাশোন সব অলকাই করতেন।
অ্যাডভোকেট বাবা দিন-রাত ব্যস্ত, বাড়িঘর ঠিকঠাক হবে, রাশি রাশি লালমুখো ইট, সিমেন্টের বস্তা আসে, বাড়ির চারপাশ ঘেরা উঁচু দেয়াল হবে সবই বাবার এক্তিয়ারে, মায়ের মতামত কিংবা ভালো-লাগা মন্দ লাগা বিমলকান্তি কোনোদিন জিজ্ঞেস করেছেন বলে মনে পড়ে না অমলের। এ নিয়ে কেমন এক না বলা দুঃখবোধ জন্ম নিয়েছিল অমলের বুকে কিশোর বয়স থেকেই।
তবে কি মায়ের কোনো স্বাধীনতা ছিল না! হ্যাঁ ছিল, সেটা ছিল শুধু সাংসারিক চৌহদ্দির ভেতরে। অলকা সর্বময়ী কর্র্ত্রী ছিলেন কালিঝুলি মাখা রান্নাঘরের বৃত্তে। আলু-পটোলের ডালনা, শুক্তো, মাছের ঝোল কিংবা আমের চাটনি রাঁধবেন এ ব্যাপারে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা।
সংসারের হাজারো ব্যাপারের মতামত থেকে মায়ের অবস্থান ছিল অনেক দূরে। চিরকালের অনুশাসনের এই নিয়মে বাঁধা মেয়েজনমকে দেখে কিশোর থেকে তরুণ, তরুণ থেকে যৌবনে পা রেখেছেন অমল, উপলব্ধি করেছেন শুধু প্রজনন ক্ষমতার মাঝে বেঁচে থাকে নারীজনম।
পাবলো পিকাসোর ছাগল চিত্রকর্মটি যৌবনে তাকে শিহরিত করেছিল। কাঠের গুঁড়িতে সূক্ষ্ম কাজ করে ভাস্কর্যটি তৈরি করেছিলেন শিল্পী। পেটমোটা ও কুৎসিত ছাগলটির সারা শরীরে লাবণ্যের ছিঁটেফোঁটা ছিল না, শুধু জন্মদানের ক্ষমতা রয়েছে বলে ছাগলটি বেঁচে রয়েছে।
এসব অনুভব করে জ¦লন্ত মোমবাতির ঝরে পড়া ফোঁটার মতো বিন্দু বিন্দু ক্ষোভ জমেছিল অমলের বুকের গভীরে। ন্যায়-অন্যায়ের মোটা দাগের ফারাকটা বোঝার কারণে অল্প বয়স থেকেই প্রতিবাদ করতে শিখেছেন, দোহারা শরীর তার, তবে বুয়েটে পড়ার সময় থেকে নিয়মিত জিম করে শরীরটাকে বলশালী করে তুলেছেন, শুধু হুংকার নয় প্রতিবাদ করতে হলে বাহুবলেরও প্রয়োজন।
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করার পর কুমিল্লা থেকে ছোটবোন অবন্তী তাগাদা দিতে থাকে, দাদা, এবার বিয়ে করে সংসার কর, বয়স কি বসে থাকে রে?
দুভাই-বোন দেশের বাইরে, শান্তিনগরের বাসায় অমল একা। একদিন অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলা মোড়ের দোকানে গেছেন তিনি। শেভিং জেল কিনতে হবে। বেশ ভিড় দোকানটিতে। একটি ছিপছিপে মেয়ে বলল, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। রোমাঞ্চিত হন অমল, কথা তো নয় যেন বাঁশি বেজে উঠল। দোকানি রূঢ় গলায় জবাব দিল, শুনুন, সবাই দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বসে নেই।
মেয়েটি রিনরিনে গলায় বলে, আমার তো শুধু এক দিস্তা কাগজ আর চারটে বলপেন।
হাত তুলে অঙুলি নির্দেশ করে দোকানি বলে, দেরি হলে চলে যান, সবাইকে দিয়ে এরপর আপনাকে দেব।
দোকান ভর্তি কাস্টমার। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নীরবে হাসছে, কেউ উপভোগ করছে মেয়েটির এই অযাচিত অসম্মানে।
ধমনীর রক্ত উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে অমলকান্তির। কেউ নেই প্রতিবাদ করার? মানুষ কি নির্জীব হয়ে গেছে! কারোর সাতেও থাকব না পাঁচেও থাকব না এ কি মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র হতে পারে? মেয়েদের নিপীড়ন মানুষ কি চোখ মেলে দেখতে পারে? আবেগ-অনুভূতি কিছুই কি অবশিষ্ট নেই কারো মনে?
মেয়েটি নীরবে অপমান হজম করে বেরিয়ে আসে।
অমল তীব্র স্বরে বলেন, যাচ্ছেন কোথায়? কাগজ-কলমের দরকার নেই! আসুন।
কথায় শুধু আদেশ ছিল না, অধিকারের ছোঁয়া ছিল দাঁড়িয়ে যায় তরুণী।
অমলকান্তি দোকানিকে বলেন, দোকান খুলে বসেছেন, রিফিউজ করছেন কেন? দিন এক দিস্তা কাগজ আর চারটে বলপেন। দোকানি বলে, হুড়াহুড়ি করলে আমি একলা মানুষ কি পারি?
অমল বলেন, উনি তো হুড়োহুড়ি করেননি। আমিও দাঁড়িয়ে আছি, আপনিই তো বাজে কথা বলেছেন।
শীতের হিমেল এক সন্ধ্যায় দোকানে প্রথম দেখা দুজনের। অমলকান্তি আর কুমকুমের। মা আর ভাইয়ের সঙ্গে চামেলিবাগে ওরা থাকে। নিজে হাইস্কুলে ইংরেজি পড়ায়।
নিঃশব্দে প্রেম আসে প্রথম দেখায়।
পরে অমলের দিকে তাকিয়ে কুমকুম বলেছে, কেউ একটি কথাও বলেনি বরং এনজয় করেছে, আপনি কেন প্রতিবাদ করলেন!
অমল বলেছেন, আমার বুদ্ধিশুদ্ধির স্তর কম নয়, বোকা বলে ভাববেন না আমায়। কাউকে না কাউকে তো প্রতিবাদ করতে হবে।
থতমত খেয়ে কুমকুম বলে,
আমি বোকা ভেবেছি আপনাকে! কী যে বলেন। আসলে কি জানেন, এখনকার মানুষ কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না, আপনি দেখছি জটিলতার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আশ্চর্য মানুষ আপনি!
সত্যি আশ্চর্য মানুষ এই অমলকান্তি। ইস্কাটন গার্ডেন রোডের ফ্ল্যাটে চলে আসেন। খুব তাড়াতাড়ি মনস্থির করেন। অবন্তীকে বলতেই সে চলে এল কুমিল্লা থেকে। স্ল্যাপ ডিসিশান নিলেন অমল। কুমকুমের পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে হলো দুজনার। সংসার-জীবন হয়ে ওঠে আনন্দধামের মতো। বিশেষ করে সকাল ও সন্ধ্যার চা পানের সময়টুকু আনন্দ-মধুর হয়ে ওঠে গল্পে-গানে আর ভালোবাসায়।
সকালের পর ইস্কাটন গার্ডেন রোডের ফ্ল্যাটটি নিঝুম হয়ে থাকে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আসে কুমকুম। ঘরদোর গুছিয়ে অমলের পছন্দের খাবার তৈরি করে। অমল ফিরে আসেন সন্ধ্যার মুখে। গাড়ির চেনা হর্ন শুনে টিপটে চায়ের পাতা ভিজিয়ে রাখে কুমকুম।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে সারাদিনের গল্প আর ফুরোতেই চায় না। কখনো বৃষ্টির ছাঁট শরীর ভিজিয়ে দেয়। কখনো চাঁদভাসা রাতের আলো ছুঁয়ে যায়। শিশির ভেজা শীতরাতের বিষণ্ণ হাওয়া শিউরে দিয়ে যায় ওদের। হাজারো স্বপ্নভরা মায়াবী রাত ফুরিয়ে যাবে বলে বিছানা ওদের টানে না।
মেয়ে ঝুমঝুমের জন্মের পর ভালোবাসা আরো পরিপূর্ণতা পেল। মেটারনিটি লিভ-এ তখন কুমকুম বাড়িতে। প্যাটারনিটি লিভ বলে কিছু নেই। এরপরও অমল ক্যাজুয়েল লিভ ও প্রিভিলেজ লিভ নিয়ে মেয়ের পাশে থেকেছেন। স্ত্রীর কাজে সাহায্য করেছেন। ক্লান্ত কুমকুম রাতে ঘুমিয়ে পড়লে উঠতে কষ্ট হতো ওর। অমল রাত জেগে মেয়ের ন্যাপি বদলে দিয়েছেন, ডায়াপার পরিয়ে দিয়েছেন।
সময় বয়ে চলে তার আপন গতিতে। দিন যায়, রাত আসে।
বড় হয় ঝুমু। স্কুলে ভর্তি হয়। বয়স বাড়ে অমলকান্তি ও কুমকুমের।
কিশোরী ঝুমু ক্লাস টেন-এ পড়ছে।
অমলকান্তি অনুভব করেন, বসন্তের পাগলা হাওয়ার মতো উন্মাদ প্রেম কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সাগরের উত্তুঙ্গ ঢেউ-এর মতো রাশি রাশি ভালোবাসা কোথায় ফেরারি হয়ে গেল?
নিয়মিত অভ্যেসের রুটিনের মতো দাঁড়িয়ে গেল সব। মাঝে মাঝে কুমকুমের কথায় তিক্ততার আঁচ অনুভব করেন অমল।
কুমকুম একদিন বলে, তোমাকে প্রথম দেখে একদম পারফেক্ট জেন্টলম্যান-এর মতো মনে হয়েছিল। কী কুল! সোবার টাইপের মানুষ!
-আমি তো তাই কুমকুম।
ভুরু কুঁচকে কুমকুম বলে, তুমি ভায়োলেন্ট নও, তবে শর্ট টেম্পারড। মনে মনে ধাক্কা খেলেন অমল। আহত হলেন অনেকটা।
-কুমকুম, তোমার অ্যাসেসমেন্ট ঠিক নয়। আমি ভায়োলেন্ট নই, শর্ট টেম্পারডও নই। তবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করি।
কুমকুমের সাথে প্রথম দেখাই হয়েছে প্রতিবাদ করার মধ্য দিয়ে। সে সন্ধ্যাতেই ও জেনেছে অমলকান্তি আর দশটা মানুষের মতো নন, একটু ব্যতিক্রম।
মায়াবী সংসারটি কেমন যেন রুখুসুখু হয়ে ওঠে। রাতে খেতে বসে কুমকুম তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছোড়ে।
-তোমার এই স্বভাবটি কবে ছাড়ব বলো তো।
অমল তাজ্জব। ডাল আর চাকতি বেগুন ভাজা দিয়ে মাখা ভাত প্লেটে পড়ে থাকে। মুখে গ্রাস আর তোলেন না।
-কোন স্বভাবটি বলো তো।
ঝুমু বলে, কেন মা তুমি পাপাকে খাবার সময় বিরক্ত করছ! খেয়ে উঠকু, পরে কথা বলো।
কুমকুম তেতে উঠে।
-দ্যাখো ঝুমু, বড়দের কথার মাঝে একদম কথা বলবে না। অংক আর ইংরেজিতে ফিফটি পারসেন্ট মার্কস পেয়েছ মনে নেই?
এবার মুখ ভরে হাসে মেয়ে।
-জিপিএ ফাইভ না পেলে পাপা বলেছে, আমরা দুজনে সেলিব্রেট করব।
তীব্র-তীক্ষ্ণ স্বরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে কুমকুম।
-তোমার জন্যই মেয়ে নষ্ট হচ্ছে। এত আদর কোত্থেকে আসে শুনি?
অমল আর কুমকুম চুপচাপ মুখে ভাত তুলছে। না খেয়ে উঠে গেলে নতুন এক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হবে।
অস্থির গ্রাসে ভাত খেতে বসেছে কুমকুম।
বলে, তোমার এই পরোপকার আর প্রতিবাদী স্বভাব কবে ছাড়বে বলো তো!
অমল শান্ত স্বরে বলেন, যে ফুটবল খেলতে ভালোবাসে তার খেলা কি বন্ধ করা যায়? যে গান গায় তার সুর কিছুতেই বন্ধ করা যায় না কুমকুম।
কোনোদিন স্ত্রীকে এ নিয়ে বোঝাতে হবে অমল কান্তি কখনোই ভাবেননি। প্রতিবাদ করা কি অন্যায়! নির্যাতন, নিপীড়ন দেখলে জ¦লে ওঠা কি বোকামি?
ও কি ভুলে গেছে চামেলিবাগের মোড়ের দোকানটির কথা। এক দিস্তা কাগজ আর চারটে বলপেনের জন্য অনেকটা সময় দাঁড়িয়েছিল কুমকুম। গায়ে লাগার মতো কটুকথা বলেছিল দোকানি। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পাওয়া যেত বলে প্রচুর ভিড় হতো দোকানে। ভিড়ে দাঁড়ানো নানা বয়সের মানুষরা সেদিন উপভোগ করছিল কুমকুমের অসোয়াস্তি।
ও সে কথা ভুলে গেছে? অমল মনে করেন, কোনো মানুষ সে পুরুষ বা মহিলাই হোক, যদি সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ায় সেই অন্যায় চলতেই থাকে।
কাজের ছেলেমেয়েদের ওপর গরম হাতা-খুন্তি লাগিয়ে ছোট্ট শরীর সেঁকাপোড়া করে দেয় কিছু বাড়িতে, প্রতিবেশীরা যখনই রুখে দাঁড়ায় তখনই ধরা পড়ে নিষ্ঠুর মানুষরা।
সবাই যদি গা বাঁচিয়ে চলে তবে এসব নিপীড়ন তো বন্ধ হবে না।
একরাশ মন খারাপের মেঘ ভেসে বেড়ায় অমলের বুকের ভেতরে।
ঘুমোবার আগে খবরের কাগজটি খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যেস তার। পাপার হাতে আনকোরা সকালের কাগজটি ধরিয়ে দেয় ঝুমু। পাপার গালে মিষ্টি করে হামি খায়। অমল চেয়ারে বসে থাকেন ঠিক ম্যানিকিনের মতো।
এক সময় বুক মন্থন করা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বুলিয়ে যেতে থাকেন কাগজে। খবরের হেডলাইন পড়তে পড়তে দেখতে যেন পান ধর্ষণের রক্তে মাটি লালিম হয়ে আছে, নিপীড়নের আঘাতে কাঁদছে স্নিগ্ধ বাতাস, অপমানের বেদনা নিয়ে আকাশে জমছে বিষণ্ণ মেঘ। ধর্ষকরা উন্নতশির হয়ে মাটি দাপিয়ে বেড়ায় বলেই তো গৈরিক মাটি ফুঁসে ওঠে ভ‚মিকম্প হয়ে, সুনামিতে সাগর আর জনপদ কেঁপে ওঠে।
হাসি-আনন্দহীন নিস্তরঙ্গ সংসারটি বয়ে চলে দিন কয়েক। ঝুমু অতশত বোঝে না, সামনের এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে ও ব্যস্ত। বেশ কিছুদিন থেকে রক্তে সুগার ধরা পড়েছে আমলের। দুধ-চিনি ছাড়া পাপার চায়ের পেয়ালা নিয়ে আসে ঝুমঝুম।
মেয়ে বলে, এই এতিম চা কি করে খাও পাপা?
-তুই এক চুমুক খেয়ে মিষ্টি করে দে তো মা।
রোজ পেয়ালায় ছোট্ট করে চুমুক দিয়ে পাপার হাতে দেয় ঝুমু। এ বাবা আর মেয়ের মধুর খেলা।
সব ঠিক আছে, শুধু কুমকুম আর আগের মতো নেই। অনেকটা বদলে গেছে ও। সংসারের চাপ, কাজের জায়গার ঝামেলা, বয়স আর সময়ই বোধ হয় মানুষকে বদলে দেয়।
রাতে শুতে যাবার আগে কুমকুম জিজ্ঞেস করে, তুমি কি গালিব সাহেবের জন্য জিএম সাহেবকে রিকোয়েস্ট করেছ?
এ ঝড়ের পূর্বাভাস। অমলকান্তি অশান্তি একেবারেই সইতে পারেন না। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি করে জানলে?
কুমকুম বলে, ম্যাজিক করে।
অশান্তিকে বিছানায় টেনে নিয়ে যেতে চান না অমল, তাই বলেন, সত্যি করে বলো তো, কি করে জানলে?
আমি তোমাকে বলেছি অমল, ঘরের খেয়ে বনের মোষ অনেক তাড়িয়েছ, আর নয়।
গম্ভীর কণ্ঠে অমল বলেন, স্বভাব কেউ পাল্টাতে পারে না কুমকুম।
বিছানার চাদর টানটান করতে করতে কুমকুম বলে, গালিব সাহেবের স্ত্রী রোজী আমাদের স্কুলের অংকের টিচার। তাইতো জানতে পারলাম। তুমি জানো এ কথা শুনলে আমি রেগে যাব। সত্যি করে বলো তো, গালিব সাহেবের ট্রান্সফার নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?
-মোটেও মাথাব্যথা নয় কুমকুম, ওর বস আমার ক্লাসমেট ছিল এক সময়। ওকে রিকোয়েস্ট করলে গালিবের বদলি যদি ক্যানসেল হয় তবে অসুবিধে কিসের?
-তোমার অতো মাথাব্যথা কেন শুনি?
মন খারাপ করা স্বরে অমল বলেন, গালিবের মা ছাড়া কেউ নেই। একমাত্র ছেলে। মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, মাঝে মাঝে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়। বউ সেবা করতে পারবে কিন্তু ছোট দুটি বাচ্চা রেখে শাশুড়ি মাকে কি দেখাশোনা করা সম্ভব বলো। নারায়ণগঞ্জ থেকে খাগড়াছড়ি বদলি হয়ে গেছে। জয়েনিং টাইমে ও এখানে আছে। আমার রিকোয়েস্টে বদলির অর্ডারটা যদি ক্যানসেল হয়, ওর মায়ের দোয়া তো পাব।
হ্যাঁ, কুমকুম তুমি বলতে পার চাকরি করলে অফিস যেখানে পাঠাবে সেখানেই জয়েন করতে হবে। তবে মানবিক দিকও তো একটা রয়েছে।
সে রাতে কুমকুম কিছু বলে না। বালিশে মাথা রেখে অমল ভাবেন, পৃথিবীটা যে এখন অন্যরকম হয়ে গেছে, সেকথা হয়তো কুমু জানে না। কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য জুডো ক্যারাটের ক্লাসে ভর্তি হচ্ছে। পায়ে পায়ে বিপদ এখন।
মানুষকে সাহায্য করা, প্রতিবাদ করা অন্যায় কিছু নয়। নির্যাতন-নিপীড়ন দেখলে জ¦লে ওঠা তো বোকামি নয়। কুমু ভারডিক্ট শোনায় হয় তোমার প্রতিবাদী চরিত্র ছাড়ো পরোপকারের নেশা বাদ দাও, নয়তো একটা ডিসিশনে যেতে হবে।
কুমকুমের বুকের কাছে সন্তান আছে, প্রিয় সংসার রয়েছে তারপরও ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়। হয়তো এ সংসারে সবই ছিল, শুধু ছিল না ভালোবাসার ছিটেফোঁটা। কী বোকা অমল কি করে এই গূঢ় ব্যাপারটি তার নজর এড়িয়ে গেল।
ঝুমুর মামা এখন সেগুনবাগিচাতে থাকেন।
এক বিকেলে ঝুমুকে নিয়ে মায়ের কাছে গেল কুমকুম। অমল ভেবেছেন, এ সাময়িক বিচ্ছেদ, রাগ পড়লেই আবার ঘরে ফিরবে।
ফিরে আর আসেনি ওরা।
এলেবেলে ভাবনার মাঝে বারবার ফিরে আসে ঝুমু। আত্মজাকে মনে পড়ে যখন তখন। কিছুদিন একসঙ্গে থাকার পর জীবন কি একঘেয়ে ঠেকেছে কুমুর কাছে?
কিছুই বুঝতে পারেন না অমল। শুধু ভুলতে পারেন না সেই দিনগুলো যখন ভোরবেলা দুজনে একসাথে বসে চায়ে চুমুক দিতেন, টুকটাক কথা বলতেন, বৃষ্টিভেজা রাতে উষ্ণ কফির স্বাদ নিতে নিতে নীরবে বসে থাকা। এ সময় ঝুমঝুম পাপা পাপা বলে অমলকান্তির গলা জড়িয়ে ধরত। তিনি ভাবতেন সত্যি, জীবন বড় সুন্দর! কী আশ্চর্য সুন্দর স্নেহ-মমতার এই সম্পর্ক!
দুই.
বিকেল থেকে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে, রমনা পার্কে আজ আর যাওয়া হলো না, সুগার কিছুতেই কমছে না। সন্ধ্যার মুখে বৃষ্টি থেমে গেল। ফুটপাত ধরে কিছুটা সময় হেঁটে এলে বেশ হয়।
ইসকাটনের সরু গলি দিয়ে বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকেন অমলকান্তি। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে শান্তিনগরে চলে আসেন প্রায়ই। এ তার পুরনো চেনা জায়গা। চামেলিবাগের দিকে এলে তীব্র আকুলতা এখনো বুকের ভেতর আছড়ে পড়ে।
বাদলা হাওয়ায় হাঁটতে বেশ লাগছে। গায়ের শালটা কাঁধে ফেলে রাখেন অমল। মৃদু শীতলতা ছুঁয়ে যায় তাকে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু ভাবেন অমল। চামেলিবাগ গলির রাস্তাটা পার হয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে রিকশা নেবেন, এরপর সোজা বাড়ি।
বিকেলে ঝুম বৃষ্টি হয়েছে বলে এখানে-ওখানে জল জমেছে। লোকজনও কম, রাস্তার ফ্যাকাসে আলোতে স্পষ্ট করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
আকাশছোঁয়া বাড়িগুলো একেবারে নতুন, চেনা রাস্তাগুলোকে অচেনা মনে হচ্ছে তার। নতুন বাড়িগুলোর রঙের জেল্লায় আধো আলোতেও চোখ ধাঁধিয়ে যায় তার। সামনের এই রাস্তাটি তার খুব চেনা। পাতাভরা ঝুপসি কামিনী গাছের জন্য এ রাস্তাটি তার খুব প্রিয়। বৃষ্টিভেজা গাছটিতে অগণিত সাদা ফুল ফুটে আছে। মিষ্টি গন্ধে হাওয়া মোহময় হয়ে উঠেছে। নানা রকমের ফুলের ভিড়ে কামিনী গাছ বড় একটা দেখা যায় না।
হঠাৎ অমলের মনে হয় গাছটির নিচে চার-পাঁচ জনের ছায়াশরীর। সচকিত হয়ে ওঠেন তিনি। মেঘলা সন্ধ্যায় কোনো ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে পেয়ালা-চামচের টুংটাং, উচ্চলয়ে ভেসে আসছে হিন্দি ফিল্মের চটুল গান ‘মেরে রসকে কমর, তুনে পেহলি নজর।’
তিন তলার ফ্ল্যাটের জানালা থেকে একজন মহিলার উচ্চকণ্ঠের আওয়াজ শোনেন তিনি।
-এই কি হচ্ছে? হচ্ছেটা কি শুনি? কি করছ তোমরা? সত্যিই তো, চাপা গলার পুরুষ কণ্ঠের মাঝে মিহি ও রিনিরিনি সুরের অসহায় আর্তি ছাড়–ন ছাড়–ন বলছি, প্লিজ, করছেন কি আপনারা? পৌরুষ উপচে পড়ছে গলার স্বরে এ্যাই একদম কথা বলবি না, ওমরাওজান বানিয়ে দেব আজ রাতে, একদম চুপ।
সেই মুহূর্তে অমলকান্তির বুকের ভেতর ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে ওঠে ক্রোধ। কামিনী গাছের ঝুপসি পাতা আর থিরিথিরি কাঁপা ফুলের দিকে ছুটে যান। পলকের মাঝে ঘটে ব্যাপারটি।
শরীরের সব জোর দিয়ে অমল তিনটি ছেলের ঘাড় ধরে দেয়ালে ঠুকে দেন মাথা। আবছা আলোয় পালিয়ে গিয়ে আঁধারে মিশে যায় তিনজন। সেই মুহূর্তে বৃষ্টির ভেজা রাত চিরে বেবিট্যাক্সি থেকে যাত্রী নেমে বলেন, কী হয়েছে?
কথা না বলে পলকের মাঝে মেয়েটিকে নিয়ে বেবিট্যাক্সিতে বসে ইস্কাটন গার্ডেন রোড ছুটে চলেন অমল।
মেয়েটির শরীরে ওড়না নেই। নিজের শাল দিয়ে অনামিকার শরীর ঢেকে দেন। ভাড়া মিটিয়ে লিফটে ওঠেন অমল। ওমরাওজান বানাবে। ওরা কি জানে না ওমরাওজানের মাটি ছাড়া শারদীয়া পূজাও হয় না। বাড়িতে পা রেখে অমলকান্তিকে জড়িয়ে ধরে মেয়েটি।
-পাপা, আমার পাপা
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তিনি ভাবতে থাকেন, কতো মিরাক্যাল ঘটে যায় মানুষের অজান্তে। অন্তরাত্মা দিয়ে তিনি ঝুমুকে চেয়েছিলেন যে।
কিছুটা সময় স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকেন দুজন। মেয়ের কান্না স্তিমিত হয়ে এলে অমল বলেন, ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসো।
এখন ঘরে একা তিনি। দুচোখ বেয়ে তার কান্নার ধারা নামে। বিড়বিড় করে বলেন, কুমু, রক্ষকের ভ‚মিকায় আমি দাঁড়াব না? আমি তো প্রস্তর যুগের মানুষ নই, বুদ্ধির স্তর আমার কম নয়। তাহলে আমি কেন সম্মুখ সমরে যেতে ভয় পাব? আজ গা বাঁচিয়ে পালিয়ে এলে আমার ঝুমুর কি হতো বলো তো? কৌরব সভায় বিদুর প্রতিবাদ করেছিলেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বসন জুগিয়েছিলেন। কাউকে না কাউকে তো অসহায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।
তোয়ালে দিয়ে ভেজা মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসেছে ঝুমু।
অভিনয়ে পারঙ্গম মানুষের মতো উচ্ছ¡সিত সুরে অমল বলেন, আয় মা, আজ রাতে আমরা খিচুড়ি রাঁধি। খিচুড়ি খাবি তো?
শ্রাবণের জুঁইফুলী বৃষ্টি নেমেছে আবার। দুজন অসম বয়সী আনাড়ি মানুষ খিচুড়ি রাঁধছে। আনন্দে মুখর হয়ে ওঠে কিচেন। কাটার বোর্ডে পেঁয়াজ ছুরি দিয়ে কাটতে কাটতে অমল বলেন, তুই তো একবারও আমার খবর নিতে এলি না মা! ভুলে গিয়েছিলি পাপাকে!
এসএসসিতে গোল্ডেন ফাইভ পেয়ে পাপাকে প্রণাম করতে এসেছিল মেয়ে। এইটুকু ব্যস।
অনভিজ্ঞ ঝুমু মা-বাবার জটিলতার মাঝে ঢুকতে চায়নি। বুকভরা অভিমানও ছিল ওর, মা কেন নিজেদের বাড়ি ফেলে ওকে নিয়ে চলে গেল? পাপা কি পারত না মাকে ফিরিয়ে আনতে?
এ ধরনের এলোমেলো ভাবনা সারাক্ষণ ওকে বিষণ্ণ করে রেখেছে।
এই মুহূর্তে পাপার সামনে দাঁড়িয়ে অপরাধবোধে ভুগতে থাকে ঝুমঝুম। এত বিশাল যার হৃদয়, অন্যের জন্য যে এত ভাবে মা তাকে একা ফেলে গেল কি করে?
চাল-ডাল ফুটছে হাঁড়িতে।
অমল বলেন, ইলিশ ভাজা হলে ভালো হতো, কি বলিস ঝুমু! খিচুড়িতে ঘি আর চেরা কাঁচালংকা দিয়ে ঝুমঝুম বলে, আলু আর পটোল ভেজেছি পাপা। খেয়ে দ্যাখো, দারুণ লাগবে।
রাত সোয়া দশটা বাজে।
অমল বলেন, তোমার মা ভাববে তো ঝুমু, ফোন করো।
কিছুটা দোনামোনা করে ও। পরে অনিচ্ছায় ফোন করে। কুমকুমের চড়া গলা শোনা যায়।
-এত রাত্তিরে কোত্থেকে ফোন করছ? আমি ভেবে মরি।
মেয়ে বলে, বড় এক বিপদ থেকে বেঁচেছি মা। বাঁচিয়েছে কে জানো?
-না বললে জানব কি করে?
-আমার পাপা। আমি তার কাছেই আছি মা। তোমার ভাবতে হবে না।
ওপাশের মানুষটির মুখে কোনো কথা নেই।
টেবিলে সব গুছিয়ে রেখেছে ঝুমু।
-পাপা, খেতে এসো।
পরম তৃপ্তিতে চোখ বুজে খাচ্ছেন অমল। মেয়ের বেড়ে দেয়া খাবার অমৃতের মতো লাগছে।
-কেমন হয়েছে পাপা?
-অসম, নুন একটু কম আর কি।
-পাপা। আদুরে গলায় অভিমান মাখা।
ঠা ঠা করে অনেকদিন পর হাসেন অমল।
-অমনি রাগ করলি মা? দারুণ হয়েছে। আজ আমার বাড়িতে উৎসব মা মণি। একটু ঘি দে তো মা।
-ঘি খাবে? তোমার তো অ্যাসিডিটি হয় পাপা।
হাসিমুখে অমল বলেন, আজ রাতে আমরা এতটুকুন পাপ করতে পারি ঝুমু, কি বলিস?
বিছানায় শুতে এসে চোখ ভিজে ওঠে তার। মেয়ে পরিপাটি করে বিছানা পেতে রেখেছে। সত্যি বাবা আর মেয়ের পবিত্র সম্পর্কের মতো পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
ঝুমুর চোখে আজ আনন্দে ঘুম আসছে না। ওয়ার্ডরোব খুলে দেখে থরে থরে সাজানো সালোয়ার-কামিজ-কুর্তি-ওড়না। সব ঠিক আগের মতো। ওর ছোটবেলার বারবিডল, টেডিবিয়ারগুলো সাজিয়ে রেখেছে পাপা।
বৃষ্টিভেজা সারা রাতে এই ফ্ল্যাটে অপার্থিব এক আনন্দ খেলা করতে থাকে।
তিন.
সকালটা খুব মনোরম! টলটলে মধুর মতো ভাদ্রের রোদ, শরৎ এসে গেছে।
কমলা রঙের কুর্তিতে ঝলমল করছে ঝুমু। হাতের পেয়ালা টেবিলে রাখে।
-ভুলে গেছিস মা? মিষ্টি করে দিবিনে?
-ওহ্ ইয়েস।
ভুবন ভোলানো হাসি ঝুমঝুমের, চায়ে ছোট্ট চুমুক দিয়ে পাপার হাতে তুলে দেয়।
মন খারাপ করা সুরে অমল বলেন, আজো সুগার ফ্রি বিস্কিট?
-ওহ পাপা, নাও মিষ্টি বিস্কিট।
এবার হাসিমুখে অমল বলেন, মিষ্টি বিস্কিট খেয়ে আজ অন্তত সেলিব্রেট করি।
কি বলিস ঝুমু?
বেলা বাড়ছে, তেতে উঠেছে রোদ।
অমলকান্তি আজ প্রতীক্ষা করছেন চেনা পদশব্দের। কুমকুম আজ আসবে, ওকে আসতেই হবে।
দেখছ পাপা, বেলী ফুলের টবের পাশে দুটো প্রজাপতি উড়ছে। আজ আর দুর্বহ সময় নয়, প্রতিটি মুহূর্ত ভরে উঠছে আনন্দে। আহমদ ফরাজের শায়ের মনে পড়ে আচমকা।
শোনা হ্যায় লোগ উসে আখ ভরকে দেখতে হ্যায়
শোনা হ্যায় উসে তিতলিয়া ছাতাতি হ্যায়
শায়েরির ছন্দে মগ্ন হয়ে থাকেন অমল। প্রায় বছর খানেক পর লিফট থেকে নেমে স্বাভাবিক ছন্দে হেঁটে আসে কুমকুম, সঙ্গে ভাই কৌশিক।
স্বাভাবিক গলায় কথা বলেন অমল-কৌশিক। রোজ যেমন একজন গৃহিণী ঘরোয়া কাজে ব্যস্ত থাকে, তেমনই সদাব্যস্ত হয়ে গেছে কুমকুম। একটি রাতের ঘটনা পালটে দিয়ে গেল অমলের দিন-রাত। কৌশিক এক সময় বলেন, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো কিছু লোক আছে বলেই তো পৃথিবীটা এখনো এগিয়ে যাচ্ছে।
ছুটির দিন বলে স্কুল-অফিস-কলেজের তাড়া নেই। সজলকে নিয়ে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কুমকুম।
প্রেসার কুকারে মাটন সেদ্ধ হচ্ছে, রাইস কুকারে ভাত, মিক্সিতে মিহি হচ্ছে পেঁয়াজ-রসুন-আদা।
শীতের কমলালেবু বিকেলের মতো দিনটি হুঁশ করে ফুরিয়ে যায়। এল স্নিগ্ধ রাত।
গভীর রাত, মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কুণ্ঠিত হয়ে বিছানায় বসে আছে কুমকুম। ওর দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে কিছু গান, কিছু কথা। বন্ধু আজিমের বাড়িতে ‘গজল সন্ধ্যার’ আয়োজন হয় মাঝেমধ্যে। গজলের কিছু কলি গুনগুনিয়ে ওঠে বুকের গভীরে।
‘দিল দুখানে কো লিয়ে আ যা
তু মুঝছে খাপা হো তো
জমানে কে লিয়ে আযা/রঞ্জিস সহি
বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক কষ্ট অমলকান্তির। এ বেদনা শুধু স্ত্রী-বিরহজাত নয়, প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আনন্দেও গলনালীতে কান্নার বাষ্প জমতে থাকে।
নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ কুমকুমের। অমল নিস্পৃহ যোগী নন। ‘লম্বি জুদায়ি’র পর মিলনে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে হাওয়া।
এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যান অমল।
শেষ রাতে অপূর্ব এক স্বপ্ন দেখেন তিনি। বিষণ্ণ সংসারকে যেন দূরে ঠেলে দিয়ে ধীরে ধীরে এক আনন্দ-পৃথিবীর জন্ম হচ্ছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে উত্থিত হচ্ছে মহামানবের বাণী।
গেরুয়া রঙের শরীর বসন, শিরে গেরুয়া রঙের উষ্ণীষ। স্বামী বিবেকানন্দ গাঢ় গলায় বলছেন ওঠো, জাগো এবং লক্ষ্য লাভ করিবার পূর্বে থামিও না।’
শ্লথ পায়ে এগিয়ে আসছেন সাদা রঙ রেশমের আলখাল্লা পরা রবীন্দ্রনাথ। মিহি কণ্ঠে বলছেন, ‘কেন তোমরা আমার সার্ধশতবর্ষ নিয়ে মেতে আছ? এত ফুল, এত সুরের লহরী মন আমার ভরে গেছে। তোমরা আমার মৃন্ময়ী, ফটিক, হৈমন্তী, নিরুপমা, কুমু, কাদম্বিনী ওদেরকে দ্যাখো।’
অমোঘ মহাকাল থেকে নিঃসৃত হচ্ছে কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুলের যৌবনদীপ্ত কবি নজরুলের বাণী পৃথিবীর মানুষরা, তোমরা প্রমীলাদের দ্যাখো।
শিহরিত আনন্দে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন অমলকান্তি। জানালার শার্সির ফাঁক দিয়ে দেখতে পান বাইরের কাঁচা ভোর। আবছা আলোর কণাগুলো সরিয়ে পুব আকাশে উদিত হচ্ছে জ্যোতির্ময় সূর্য।