×

মুক্তচিন্তা

ঈদ প্রতিবার, এবারো

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০১৯, ০৮:১৩ পিএম

এখন ঈদের আনন্দটা বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। ঈদ উপলক্ষে মানুষের নানা ধরনের প্রস্তুতিও লক্ষ করা যায়। আগের চাইতে আমাদের সমাজ অনেক বেশি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। দারিদ্র্যের হার অনেকটাই কমে এসেছে। ফলে এখন ঈদে আগের মতো একেবারেই হতদরিদ্র মানুষের নিরানন্দ ঈদ খুব একটা দেখতে হয় না। সে ক্ষেত্রে ঈদের আনন্দে গ্রামেগঞ্জে এখন সব মানুষেরই যার যার মতো এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী আনন্দ, উৎসব, খানাপিনা, দাওয়াত, পারিবারিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি ঘটতে দেখা যায়।

বাংলাদেশে এখন ঈদের আনন্দ অনেক বেশি বিস্তৃত, শহর ও গ্রামের সর্বত্র ঈদের ব্যাপক আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। তবে এর বেশিরভাগই হচ্ছে নতুন নতুন কাপড়-চোপড় কেনা, খাবার-দাবার, ঈদগায়ে একসঙ্গে নামাজ আদায় কোলাকুলি করা এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করা। ঈদ উপলক্ষে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যায়। গ্রামগুলো মুহূর্তের মধ্যেই নতুন নতুন অতিথিতে ভরে ওঠে। চারদিকে কোলাহল বেড়ে যায়। এক ধরনের আনন্দ উৎসবের আমেজ গ্রামে পরিলক্ষিত হয়।

বিশেষত যাদের বাবা-মাসহ পরিবারের নিকটাত্মীয়স্বজন গ্রামে থাকেন তাদের কাছে শহর থেকে সপরিবারে কর্মজীবীরা যখন ছুটে যায় তখন সবার মধ্যেই আনন্দের উচ্ছ্বাস এতটাই ব্যাপক থাকে যে, তাতে বাড়ি বাড়ি যেন স্বজনদের উৎসব মেলায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ঈদের এই আনন্দের পরিবেশ প্রদানের সক্ষমতাটি আমাদের সমাজ জীবনে এক ধরনের বাড়তি গুরুত্ব নিয়ে এসেছে। সে কারণে নাড়ির টানে বাড়ি যেতে যানবাহনে যত কষ্টই হোক না কেন তা হাসিমুখে সবাই মেনে নিচ্ছে।

বাস্তবেই এখন শহর থেকে মানুষ ঈদ উপলক্ষে যতবেশি যাওয়ার চেষ্টা করে অন্য সময় তা খুব একটা হয় না। এটিই নাগরিক জীবনে যারা কর্মব্যস্তময় জীবনযাপন করে তাদের জন্য একটি বড় ধরনের স্বস্তিদায়ক বিষয়। ফলে এখন ঈদের আনন্দটা বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। ঈদ উপলক্ষে মানুষের নানা ধরনের প্রস্তুতিও লক্ষ করা যায়। আগের চাইতে আমাদের সমাজ অনেক বেশি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। দারিদ্র্যের হার অনেকটাই কমে এসেছে। ফলে এখন ঈদে আগের মতো একেবারেই হতদরিদ্র মানুষের নিরানন্দ ঈদ খুব একটা দেখতে হয় না। সে ক্ষেত্রে ঈদের আনন্দে গ্রামেগঞ্জে এখন সব মানুষেরই যার যার মতো এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী আনন্দ, উৎসব, খানাপিনা, দাওয়াত, পারিবারিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি ঘটতে দেখা যায়। এক ধরনের সমতাও এসব আয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে- যা তিন-চার দশক আগেও আমাদের এখানে খুব একটা দেখা যেত না।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখনো ঈদ আসত। তবে প্রতিবারই নতুন জামা কিংবা নতুন জুতা পেয়েছি তা কিন্তু মনে পড়ে না। তখন আমাদের বাবা-মায়ের সামর্থ্য ততবেশি ছিল না। সব ভাইবোনকে চাহিদামতো পোশাক বা জুতা দিতে পারেননি। কাউকে জামা দিয়েছেন তো অন্যকে জুতা কিনে দিয়েছেন। এভাবেই বাবা-মার সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে আমাদের অতীত দিনের ঈদগুলো কেটেছে। খুব বেশি খাওয়াদাওয়া করার আয়োজন ঘরে থাকতো না। কিছু মিষ্টিমুখ অথবা খাওয়ার আয়োজন ছাড়া তেমন বিশেষ কোনো উন্নত খাবার ছিল বলে মনে পড়ে না। তবে সবার ঘরেই কমবেশি কিছু কিছু সেমাই, ফিরনি ও ভাত-মাংস হতো যা এ ঘর-ও ঘরের সদস্যরা কমবেশি খাওয়ার আমন্ত্রণ পেত।

মনে হয় সেই সময় ঈদগুলো আমাদের ছিল একান্তই ঈদের নামাজ আদায়ের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আরো আগে বাবা-মায়েদের কাছে শুনেছি ঈদের আনন্দ বলতে ঈদগায়ে যাওয়াটাই রীতিতে ছিল নতুন কিছু কেনাকাটা সবার পক্ষে সম্ভব হতো না। সেই সময়ে আর্থসামাজিক বাস্তবতা খুব একটা ভালো ছিল না। ফলে ঈদের বৈচিত্র্য খুব একটা দাবি করার ছিল না। শহর থেকে গ্রামেও মানুষের যাতায়াতের তেমন সুযোগ ছিল না। এখনকার মতো এতবেশি মানুষ শহরে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিল না। অর্থবিত্ত তাই ততটা পরিবারের ছিল না। সে কারণেই অতীতে স্বল্পসংখ্যক যারা শহরে কাজকর্ম করতেন তাদের কেউ কেউ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে গ্রামে ঈদ করতে আসতেন। তাদের কিছুটা নতুন কাপড়-চোপড় নিয়ে ঈদ করতে দেখতাম। গ্রামে হাটবাজার আগে তেমন ছিল না। নতুন জামাকাপড়েরও বেচাকেনা ততবেশি ছিল না। ঈদ এ এই পর্বের দিকে মানুষের দৃষ্টিও ততটা দেখা যেত না। জীবনটা তখন সীমিত সম্পদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। গ্রামে গ্রামে বেশিরভাগ মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বা কাছাকাছি অবস্থান করছিল। অল্পসংখ্যক ছিলেন যাদের হাতে কিছু অর্থ থাকত তারাই কেবল ঈদে কিছু কেনাকাটার কথা ভাবতেন। তাদের সন্তানরা হয়তো চাহিদামতো পোশাক পেতো। তাদের ঘরে হয়তো খাবার দাবারের আয়োজনটাও ভালো হতো। কিন্তু দুয়েকজনের ঘরে ভালো খাবারদাবারের আয়োজন হলে সবাইকে তো নিমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হতো না। ফলে আমাদের সেই কালের ঈদ ছুটদের কাছে খেলাধুলা করে বেড়ানোর ঈদ ছিল। বড়দের দেখেছি ঈদগা থেকে ফিরে এসে হয়তো কিছু খাওয়াদাওয়া কিংবা গালগল্প করা অথবা বিশ্রামে সময় কাটানো। আবার অনেককে দেখেছি যথারীতি মাঠেঘাটে নিজের কাজ নিজে করতে যাওয়া।

এভাবেই স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের ঈদগুলো আনন্দ নিরানন্দের মধ্য দিয়েই কেটেছিল। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের সমাজে যে পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে তার সঙ্গে আমাদের আনন্দ উৎসব ঈদ পালন ইত্যাদিও গতিময়তা লাভ করতে থাকে। কারণ এ সময় মানুষ গ্রাম থেকে শহরে, আবার গ্রাম থেকে বিদেশে অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন, বাড়িতে যাদের নিকটজনরা থাকেন তাদের জন্য বিদেশ থেকে আগে থেকেই টাকা পাঠিয়ে দেয়ার প্রবণতা লাখ করা গেছে। এখন তো এই অর্থ পেতে বাড়ির লোকজনের অপেক্ষাও করতে হয় না। লাখ লাখ মানুষ বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাঠাচ্ছেন, শহর থেকে গ্রামে অনেকেই ছুটে যাচ্ছেন, গ্রামের পরিবেশ এখন আর আগের সেই গ্রামে নেই। এখন সেখানেও সুপার মার্কেট এই ঈদ উপলক্ষে বেশ জমজমাট হয়ে উঠছে। শহরে যা কিনতে পাওয়া যায় গ্রামেও তাই বেচাকেনা হয়। ফলে ঈদের আনন্দটি এখন সব পরিবারেই ছড়িয়ে পড়েছে। আনন্দ করার মতো অর্থবিত্ত প্রায় সবার হাতেই চলে এসেছে। এ কারণে এখনকার ঈদ সবাইকে নিয়েই যেন ঈদ। খুব কম লোকই আছেন যারা বলতে পারেন যে তাদের সবার মতো আনন্দ ও কেনাকাটা করার অর্থ নেই। গ্রামে এখন যারা পিছিয়ে পড়ে আছে তাদের অর্থবিত্তবান সবাই নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে। সুতরাং অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া মানুষরাও এখন ঈদে নতুন পোশাক ও খাবারদাবার কিনতে পারে।

এদিক থেকে আমরা বলতে পারি যে, আমাদের ঈদটা কাটে সবাইকে নিয়ে। তা ছাড়া ঈদুল ফিতরটি যেহেতু খাবারদাবার কাপড়-চোপড় ইত্যাদি কেন্দ্রিক তাই আমাদের প্রতিবেশী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধু-বান্ধব পরিচিতজনরাও এইদিনে, এই অনুষ্ঠানাদিতে স্বাচ্ছন্দ্যে অংশগ্রহণ করছেন। তাদেরও দেখা যায় পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন পোশাক ও খাবারদাবারের আয়োজন করতে। তারাও পারিবারিকভাবে এই দিনে কিছু না কিছু করেন আবার মুসলিম সম্প্রদায়ের পরিচিত জনদের সঙ্গেও সময় কাটান, খাওয়াদাওয়ায় অংশ নেন। এটি একটি সর্বজনীন উৎসবের রূপ পেয়েছে। এ নিয়ে আমাদের দেশ, সমাজ ও মানুষজন গর্ব করতে পারে।

এবার ঈদের বৈশিষ্ট্য আগের বছর কিংবা বছরগুলোর চাইতে খুব আলাদা করে কিছু বলার নেই। তারপরও বলতে হবে এবারের ঈদযাত্রা অনেক অঞ্চলের মানুষের কাছেই আগের চাইতে ভোগান্তিতে কম ছিল, স্বাচ্ছন্দ্যেই বাড়িতে যেতে পেরেছেন। এবারের রমজানে ভেজালবিরোধী অভিযানে মানুষ আগের চাইতে নিরাপদ খাদ্য কেনার সুযোগ বেশি পেয়েছেন। বিএসটিআইর অনুমোদিত দ্রব্যসামগ্রী কেনার ধারণা নিয়ে বাজার করতে পেরেছেন। কেনাকাটা আগের চাইতে এবার শৃঙ্খলায় আসার একটা প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এটি ইতিবাচক। তবে রমজান উপলক্ষে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ অতি মুনাফার যে আয়োজন করে থাকে এবার তাতে কিছুটা ছেদ হয়তো পড়েছে। তারপরও পুরোপুরি মুক্ত হয়নি।

এবারের ঈদের আরেকটি উল্লেখ করার মতন ঘটনা হচ্ছে দেশে প্রচুর ধান উৎপাদনের ফলে প্রকৃত কৃষকের হাতে নতুন ধান বিক্রির মাধ্যমে বাড়তি অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে তাদের কেনাকাটায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটতে পারে। কিন্তু ধান উৎপাদনে এবার যে অর্জন ঘটেছে তা বাংলাদেশে কৃষি অর্থনীতিকে আরো বেশি প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছে বলে মনে হয়। এবারের ঈদে গরমটি বেজায় বলেই মনে হয়। ফলে যারা গ্রামেগঞ্জে ছুটে গেছেন তাদের কিছুটা হাপিত্যেশ করতে হতে পারে। যতটা জানি দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ১২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং গ্রামেও খুব বেশি বিদ্যুতের অভাব হবে না। গ্রামে তাদের ঈদ নিশ্চয় এবার ভালোই হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App