×

সাময়িকী

হারুর বোধোদয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুন ২০১৯, ০১:৪২ পিএম

হারুর বোধোদয়
হারুন মিয়া ওরফে হারুর হঠাৎ করেই দেশ-ভাবনায় পেয়ে বসল। রেস্টুরেন্টের খদ্দেরদের দিকে তাকায় এখন-তখন, আর খদ্দেরদের আলাপ-সালাপের ধরনধারণ দেখেশুনে নিজেকে শুনিয়ে যায় হায়! দেশটা কি উচ্ছন্নে গেল শেষটায়? ভালোমানুষগুলো কি উধাও হয়ে গেল এ দেশ থেকে? সালামটা কি তাহলে সত্যি কথাই বলেছিল? হারুর বয়স খুব একটা বেশি নয়। তবে পড়াশোনার আন্দাজে বছর চারেক বড়ো এই যা। গাঁয়ের ইশকুলে কেলাস টেন অব্দি লেখাপড়া করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বাড়ির হাল আর গেরস্থ বাবার হকিকতটা ভালো দিকে না থাকায় এতদিনে কেলাস সিক্স টপকাতে পেরেছে কেবল। গেলবারের বন্যায় নদী-পাড়ের ইশকুলটার সলিল সমাধি হয়ে যেতেই উন্নত-শিক্ষার ব্যাপারটার যাহোক একটা সমাধান হয়ে গেল। বাবা যেন হাঁপ ছেড়ে বলল, যাক বাবা, বাঁচা গেল! ইশকুলটা যখন পানির তলায়, ছাত্ররাও যখন গলাগলি করে ছত্রখান আর মাস্টাররাও যখন সবাই এদিক-সেদিক সটকে পড়েছে তখন আর পড়াশোনার দরকারটা কী? বাবা একদিন হারুকে কাছে ডেকে বলল, শোন বাবা, আগামী হপ্তায় তুই ঢাকায় চলে যা। তোর বড়োকাকা ওখানে বড়ো একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছে ওখানেই কাজকম্ম করবি। তারপর একদিন নিজেই একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসবি বুঝেছিস? শহরে যেতে হারুর একটুও ইচ্ছে নেই। ঢাকা শহরটা নাকি চোর-জোচ্চোর-লুটেরাদের আড্ডাখানা। এ-ওকে পটাস-পটাস গুলি করে মারছে নয়তো কচাং কচাং করে চাকু চালিয়ে শরীর-টরির ফর্দাফাঁই করে সারছে। সালামই এতশত তথ্য জোগান দিয়েছে হারুকে। গাঁয়ের বন্ধু সালাম শহরে থাকে। বন্ধু না ছাই! শহরে থেকে থেকে স্বভাবটা গোল্লায় গেছে। ও নাকি মলম পার্টি নাকি টানা পার্টি করে বেশ দু-পয়সা রোজগার করে বেড়াচ্ছে। এ বয়সেই সিগারেট ফুঁকতে শিখেছে। গেলবার, মানে এই কদিন আগে সালাম যখন গাঁয়ে বেড়াতে এলো, তখন হারুর কাছে ওর কাজের ফিরিস্তি মেলে ধরতেই হারু বিষম খেয়ে বলেছিল ব্-বলিস কী রে! এ তো চুরির কাজ! তুই চুরি করিস? ছিঃ! আচ্ছা, একটু সবুর কর, আমি পুলিশ হয়ে নিই, তখন তোকে ধরে থানায় চালান দেব। শহরের সবকটা চোর-ছ্যাঁচড়কে ধরে ধরে থানায় চালান দেব। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সালাম ফিচেল একটা হাসি ছুড়ে বলেছে, তুই কজনকে চালান দিবি রে? শহরের সবাই চুরি-ডাকাতি করেই বেড়ায়। ওখানে কি ভদ্রলোক থাকে? ছোঃ! একবার তো পুলিশ হয়ে নিই তখন দেখিস। সবকটাকে ফাটকে পুরব। তোকে দিয়েই বউনি হবে আমার, দেখে নিস। সালাম ঠোঁট উল্টে বলল, আর পুলিশ হবি তুই! গাঁয়ে পড়ে থাকলে তোকে ওই গরু-ছাগলই চড়িয়ে বেড়াতে হবে সেটা বুঝিস তো? হারুরও নাক উঁচু। বলল, আমাকে চিরকাল গাঁয়ে পড়ে থাকতে হবে, সেকথা তোকে কে শোনাল? আমি শিগগির-শিগগির ঢাকায় পাড়ি দিচ্ছি, তা জানিস? ঢাকায় যাবি! সালাম সত্যি-সত্যি অবাক হলো এবারে। সিগারেটের টুকরো টোকা মেরে দূরে ঝোপের ধারে পাঠিয়ে বলে, হঠাৎ এমন মতি হলো যে? হুম, যাচ্ছি আমি ঢাকায়। বাবা বলেছে। ঢাকায় বড়োকাকা একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে। আপাতত ওই রেস্টুরেন্টেই চাকরি করব। বাবা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বাবা অবশ্যি বলেছে, বড়ো হয়ে আমি নাকি একটা রেস্টুরেন্টের মালিক হব। হব না ছাই! আমি হব গিয়ে পুলিশ! যা দারুণ পোশাক না ওদের! বেশ লাগে দেখতে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বলতে বলতে হারুর চোখ দুটো আবেশে বুজে আসে। সালাম তখন বলেছে, ঢাকায় গিয়ে টিকতে পারবি তো? ওখানে সবাই হয় চাকুবাজি নয়তো পিস্তলবাজি করে বেড়ায়। খুন-টুন হয়ে যাওয়াটা তো নিত্যদিনের কারবার ওখানে...। রেস্টুরেন্টের চাকরিটা মন্দ নয়। হারুকে কাছে পেয়ে বিনি পয়সার কর্মচারী পেয়ে বড়োকাকার যেমন প্রাণ জুড়াল তেমনি বয়-বেয়ারার দায়িত্বটা পেয়ে নেহাত অখুশি হয়নি হারু। ভারি তো কাজ! খদ্দেরদের টেবিল-টেবিল ঘুরে খাবারের অর্ডার নাও, চলে যাও রান্নাঘর-লাগোয়া কাউন্টারে, ওখানে গিয়ে মুখস্ত বলে যাও খাবারের নামগুলো, তারপর ফিরতি পথে খাবার হাতে করে যার যার টেবিল শনাক্ত করে খাবার সাজিয়ে যাও এই তো! এমন কী আর শক্ত কাজ! তবে খাবার শেষে গোলমাল বাধার সম্ভাবনা ছিল অবশ্যি খাবার-খরচার হিসেব-নিকেশ করতে হতো যে! কিন্তু কেলাস সিক্স অব্দি পড়েছিল বলে রক্ষে। যোগ-বিয়োগটা জানা ছিল বেশ। তাই খদ্দের ক্যাশ-কাউন্টারের কাছাকাছি পৌঁছতেই হারু অক্লেশে হাঁক পাড়তে পেরেছে সামনের জন বত্রিশ! পেছনের জন পঁয়তাল্লিশ! তবে প্রথম-প্রথম গোল যে বাধেনি, তা নয়। খদ্দেরের অর্ডার নিতে গিয়ে তো নিত্য গোলমাল ফুল-প্লেট বেসন মাখানো ফুলকপির অর্ডার নিয়ে অবলীলায় হাফ-প্লেট ফুলুরি-ভাজা পরিবেশন করেছে, আস্ত মুরগির বদলে হাফ-ছাগলকে প্লেটে বয়ে এনেছে, ডিমের কারির পরিবর্তে মাছের তরকারি এমনতর আরও কত কী! তারপর এক টেবিলের অর্ডার অন্য এক টেবিলে হাজির করে সাজিয়ে দিয়েছে, একজনার খাবারের বিল, অন্য একজনের কাঁধে বিলক্ষণ চাপিয়ে দিয়েছে, একহাতে গেলাস-বাসন ধরাধরির কসরত দেখাতে গিয়ে প্রথম সপ্তাহেই তিনটে গেলাস, চারটা বাসন ও পাঁচটা তস্তরি মেঝেতে ঝনঝনিয়ে আসন পাতিয়ে যাচ্ছেতাই কেলেঙ্কারি কাণ্ড বাধিয়েছে। বড়োকাকা একদিকে প্রমাদ গুনে আর অন্যদিকে টুকরো হয়ে যাওয়া বাসন-কোসনের দরদস্তুর করে হারুকে বলেছে শোন, সবকটা টেবিল সামাল দেয়া তোর কম্ম নয়। তুই বরং এক দুই তিন চার এই চারটে টেবিলের তদারকিতে থাকবি, বুঝেছিস? হারু তা-ই করে যায়। দিন সাতেক পর, মাসের পয়লা তারিখে এক নম্বর টেবিলে গ্যাঁট হয়ে যিনি বসলেন, তাঁকে দেখে হারুর প্রাণ জুড়িয়ে কুলফি। নীল পোশাক পরা এক পুলিশ কর্মকর্তা। নির্ঘাত দারোগা। স্বাস্থ্যটা মোটামুটি মোটার দিকে যখন, রোগাটেও নয় তখন দারোগাই হবে! তবে অমন একটা জেল্লাদার পোশাক হারু চড়াবে ওর গায়ে একদিন না একদিন ভেবে রাখে হারু। কোমরে হাত রেখে ‘কী খাবেন?’ প্রশ্নটা করতে না করতেই বড়োকাকা ক্যাশ-কাউন্টার ছেড়ে হা হা করে ছুটে আসে। শোন, এঁর সাথে তমিজ করে কথা বলবি, বুঝেছিস? অমন নওয়াবিপনা দেখাতে যাস নে কোমর থেকে হাত নামা, বেয়াদব কোথাকার! নে এখন, এঁর জন্যে ইস্পেশাল সব খানা নিয়ে আয়। রান্নাঘরে গিয়ে বললেই ওরা বুঝবে। আর, ইনি যখন আসবেন, তখন এই এক নম্বর টেবিলেই ওঁকে তমিজের সাথে বসাবি, বুঝেছিস? হারুর হাতদুটো ততক্ষণে কোমর থেকে সরে গিয়ে বড়োকাকার মতন হাত কচলানোর ভঙ্গি নিয়েছে। তা খেলেন বটে দারোগা সাহেব যাকে বলে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া। মাছ-মুরগি-খাসি-ডাল-ভাত এবং সবশেষে এক বাটি দই সাবাড় করে তিনটে ঢেঁকুর তুলে ক্যাশ-কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াতেই হারু কঠিন একটা যোগ-অঙ্ক কষে হাঁক পেড়েছে ‘তিনশ কুড়ি!’ হারুর হাঁক শুনে দারোগা সাহেব একটা বিরক্তিসূচক চাউনি দিয়ে হারুকে একদম চিকেন টিক্কার মতন ঝলসে দিয়েছেন। আর বড়োকাকা হাত কচলে বলেছে ওর কথায় কান দেবেন না হুজুর। নতুন এসেছে তো!এইনা বলে, বড়োকাকা রুষ্ট দারোগা সাহেবের কাছ থেকে কোনো টাকা তো নিলই না, উল্টো দেরাজ খুলে অনেকটা দরাজ দিলে একটা পুরুষ্টু খাম দারোগার হাতে তুলে দিল। কী তুলে দিল বড়োকাকা? খামের ভেতর কী এমন জিনিস ছিল? দারোগা সাহেবের কাছ থেকে খাবারের খরচাটা নিল না কেন? এটা বড়োকাকার কোন্ ধরনের খামখেয়ালি? অনেকগুলো প্রশ্ন হারু নিজের কাছে নিমেষে করে বসে। উত্তর মিলল না। উত্তর পাবার জন্যে বড়োকাকার মুখোমুখিও হলো না। পরবর্তী কদিনের অভিজ্ঞতা হারুর জন্যে খুব একটা সুখকর হয়নি বরং শহুরে মানুষগুলো সম্পর্কে সালাম যা’ বলেছিল, তার অকাট্য প্রমাণ পেয়ে হারু বেশ কাহিল হয়ে পড়ল। খদ্দেরদের খাদ্য-টাদ্য বিলোতে গিয়ে হাতে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে মেঝেতে পেয়ালা-পিরিচের ঝনঝনানি শোনা যেতে থাকে। হয়েছে কী? না, হয়েছে অনেক কিছুই। এই দুই নম্বর টেবিলের কথাটাই ধরা যাক না! দারোগা সাহেবের বিনি পয়সায় ভোজের পর সাতদিন গ্যাছে কি যায়নি, অমনি এক দুপুরে দু’নম্বর টেবিলে দশাসই একজন এসে হাজির। তোয়ালেটা কাঁধে করে টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই মোট্কু খদ্দের অর্ডার দ্যায়, কৈ মাছ আছে তো আজকে? হারু ঘাড় হেলাতেই, মোটকু বলে চলে তাহলে ওই কৈ মাছই...। তক্ষুনি টেবিলের ওপর রাখা লোকটির মোবাইল ফোনটা টিং টিং টুং টুং করে ওঠে। আপন অর্ডারটাকে অবহেলায় ঠেলে রেখে, লোকটি ফোনটা হাতে করে বলল, হ্যাঁ বল্, কী বলবি?... কী বললি? ঠ্যাং দুটো দু’টুকরো করতে বলেছি নাকি চার টুকরো তা ভুলে বসে আছিস? তা আর ভুলবি না কেন? মন পড়ে থাকে তোর কোনখানে, কে জানে! চার টুকরো করতে বলেছি আমি ছোট্ট ঠ্যাং, তাই!...। অ্যাঁ?! ওটারও আট টুকরো! হায় হায়! ডোবাবি, তুই ডোবাবি আমাকে।... আচ্ছা, খাওয়াটা সেরেই আসছি আমি, তারপর তোর ঠ্যাংটাকে নিয়ে পড়ব আমি; বত্রিশ টুকরো করব আমি তোর ঠ্যাং দুটোর, বুঝেছিস? বত্রিশ টুকরো! লোকটা মেজাজ মারমুখো করল বটে, তবে প্রাণ-মন মাছমুখো করে দুপুরের খাবারটা খেল কিন্তু বেশ তারিয়ে তারিয়ে। আর দূর থেকে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখে গেল হারু। কী আশ্চর্য! কোন্না কোন্ হতভাগার ঠ্যাং কুপিয়ে টুকরো টুকরো করার আদেশ দিয়ে কিনা দ্যাখো লোকটি কেমন দিব্যি রয়ে বসে খাবার চেটেপুটে চলেছে! শহরের মানুষগুলো কি তাহলে সত্যি-সত্যি পশু বনে গেছে? ওই দারোগা সাহেব এখন যদি উপস্থিত থাকতেন রেস্টুরেন্টে, তাহলে উনি ঠিক ঠিক মোটকুকে পাকড়াও করে হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিতেন। বড়োকাকার সাথে এ ব্যাপারে শলাপরামর্শ করে কোনো লাভ নেই। লোকটি যখন খাওয়াদাওয়া সেরে বিল চুকিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, বড়োকাকাকে তো দেখা গেল লোকটির সাথে চুটিয়ে দু-তিন মিনিট হেসে-হেসে কথা কয়ে গেল! বড়োকাকাও কি তাহলে তলে তলে মানুষ কতল করার দলের কেউ? রেস্টুরেন্টের কাজে বহাল থাকবে নাকি গাঁয়ে ফিরে হালচাষে মন দেবে এই নিয়ে ভাবাভাবি করতে করতে কেটে গেল আরও সাতটা দিন। এরই মধ্যে লোকটি আরও একবার রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে গেছে। সেবারে মোবাইল ফোনে কোনো কাটাকুটির আলাপ নয়, বরং মগজগুলোর কী গতি করতে হবে সে ব্যাপারেই কলজে কাঁপানো নির্দেশনা দিয়েছিল রমজান নামক ব্যক্তিটিকে। মোটকুর দ্বিতীয় পদার্পণের রেশ কাটতে না কাটতেই এলো আরেক জন। ঠ্যাংকাটা মোটকুর তুলনায় এই আরেক জন যথেষ্ট পরিমাণে শুঁটকো। তা হারুর কাছে নবাগত এই খদ্দেরটি মোবাইলে কাকে যেন শাপশাপান্ত করতে চার নম্বর টেবিলে বসে পড়ল এবং মোবাইলে খদ্দেরটি অপর প্রান্তের শ্রোতাকে যা’ শুনিয়ে গেল, তা শুনে হারুও বসে পড়ত মেঝেতে অবশ্যি যদি বড়োকাকা সেটা বরদাস্ত করত। লোকটি শোনাচ্ছিল একদিন ঢাকার বাইরে একটু গেছি কি, অমনি সবকটার গলা কেটে ফেললি? অ্যাঁ? বেল্লিক, উজবুকও আহাম্মক কোথাকার!... এখন এত্তগুলো গলা আমি রাখি কোথায়? তারপর দণ্ডায়মান এবং কম্পমান হারুর দিকে চোখ পড়তেই গলাবাজির মাঝপথে ফোনটি হাতচাপা দিয়ে বলল, একটা হাফ প্লেট-খাসি, একটু বুটের ডাল আর দুটো প্লেন নান... এ লাইনে তোর যে কোনো ভবিষ্যৎ নেই, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। এখন এ কথাটা স্যান্ডো দারোগার কানে না গেলেই রক্ষে। উফ্, হালিম তুই আমাকে জেলের ভাত না খাইয়ে ছাড়বি না দেখছি! কাঁপা-কাঁপা হাতে হারু খাবার পরিবেশন করে গেল। লোকটি একটুও দেরি না করে নানের টুকরো আর খাসির টুকরোর মিলন ঘটিয়ে উভয়কে উদরস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে হারু অবাক-বিস্ময়ে ভাবতে লেগেছে তখন আচ্ছা, গলা কাটাকুটির খবর শুনে কোনো সুস্থ মানুষ কি অমন পরম নিশ্চিন্তে খাবারদাবার এরকম দাবড়িয়ে গলাধঃকরণ করতে পারে? খাবার শেষে একমুঠ ধনে-মিছরিদানা মুখে পুরে হেলতে-দুলতে ক্যাশ-কাউন্টারে এগিয়ে যেতেই আসন ছেড়ে বড়োকাকা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। তারপর মিনিট দুয়েক দুজনায় কত যে এবং কী যে বিচ্ছিরি রসালাপ! আর ওদিকে কাঁপা-কাঁপা গলায় হারু দূর থেকে হাঁক পেড়েছে ব্-ব্-বিয়াল্লিহ্শ! হারু সেদিনই স্থির করে ফেলল, চলে যাবে, ফের গাঁয়ে চলে যাবে হারু। তারপর বৈষয়িক ভাবনাটা মাথায় টোকা দিতেই দিনক্ষণটাও ঠিক করে ফেলল। মাস পয়লাটা আসুক-তখন একমাসের বেতনটা হাতে করে... বড়োকাকা যদিও মাইনের ব্যাপারটা নিয়ে হারু কি হারুর বাবার সাথে কোনো আলোচনায় বসেনি একটিবারের জন্যেও। তবুও...। দেখতে দেখতে মাসপয়লাটা চলেও এলো। দুপুরের দিকে এক নম্বর টেবিলটা ফাঁকা রাখতে হলো সেই দারোগা সাহেবের জন্যে। উনি এলেনও বটে কাঁটায়-কাঁটায় ওই দুপুরেই। এসেই হারুর সাথে চোখাচোখি হলো এবং চোখের ইশারা পেয়ে হারু দারোগা সাহেবের জন্যে ইস্পেশাল খাবারদাবারের অর্ডার দিতে রান্নাঘরের দিকে যাবে তখনই নজরে এলো, ওর আওতাধীন আরও দুটো টেবিলে তখন খদ্দের আসন পেতেছে। আর, কী বরাত! দুই নম্বর টেবিলে সেই মোট্কু খদ্দের এদিকে সেদিকে তাকিয়ে হারুকে খুঁজছে যেন; তিন নম্বর টেবিলে আর কে! সেই শুঁটকো খদ্দের। সে-ও হারুর খোঁজে চোখজোড়া ইতিউতি করতে লেগেছে। আজ রেস্টুরেন্ট তথা শহরে হারুর শেষ দিন বলে খদ্দেরদ্বয়ের পুনরাবির্ভাবে হারুর মাথাটা টলে উঠল না, বুক ধড়ফড় করল না, পিলেটা চমকে গেল না আর হাঁটুজোড়াও কমজোর হয়ে পড়ল না। দারোগা সাহেবের খাবারের বহর টেবিলে সাজিয়ে হারু দুই আর তিন নম্বর টেবিলের অর্ডারগুলো নেবার ব্যবস্থা নিতে যাবে, অমনি রেস্টুরেন্টে চারমূর্তির আগমন। গেল তিরিশ-ছত্রিশ দিনে হাজার কয়েক খদ্দের সামলেছে হারু, কারুর চেহারা-সুরত আলাদা করে মনে রাখার কথা নয় সম্ভবও নয় তবুও হারু জোর গলায় বলতে পারে, এই রেস্টুরেন্টে এর আগে ওদের কাউকে ও চাক্ষুষ করেনি। তা না করলে কী হবে, চারমূর্তি ঘরে ঢুকতেই পুরো রেস্টুরেন্টে কেমন একটা সাড়া পড়ে গেল মৃদু থেকে তুমুল গুঞ্জন যাকে বলে। এবং ওরা চারজন হারুর চার নম্বর টেবিলে গিয়ে বসতেই তবিবর-মোতালেব-জুলমত-এরা সবাই একাট্টা হয়ে হারুর কানে কানাকানি করে গেল তোর কী কিসমত রে! কুড়ি টাকা বকশিশ আটকায় কে! দু’নম্বর আর তিন নম্বর টেবিলের অর্ডার সাপ্লাই করে চার নম্বর টেবিলের কাছাকাছি পৌঁছে টেবিলঘেরা চারমূর্তির ভদ্রলোক জাতীয় চেহারা দেখে হারু যতটা না খুশি হলো, তার চাইতে বলতে গেলে ফুল-প্লেট আহত হলো ওদের পিলে-চমকানো কথাবার্তার আদান-প্রদান শুনে। বিশেষ করে দলের মধ্যমণি হিসেবে যাকে সহজেই শনাক্ত করা চলে সেই সুদর্শন ভদ্রলোকের কথা শুনে হারুর প্রাণ তো প্রায় খাঁচাছাড়া হয়ে ইহলোক ছেড়ে পরলোকের প্রান্তে। ভদ্রলোক বলছিলেন,... না ভাই, তোমরা আমাকে আর যা-ই বলো আর না-ই বলো, ওইসব খুনোখুনির মধ্যে আমি আর নেই। বলি, আর কত! আরও কটা খুন করতে হবে আমাকে, বলো?... না ভাই, খুন-টুন করে ভীষণ বদনাম হয়ে যাচ্ছে আমার তার চাইতে কাউকে বলে-কয়ে অন্য কোনো কাজ-টাজ...। তা শুনে, চারমূর্তির তিনজন হা হা করে ভদ্রলোকের (এক্ষণে অবশ্যি ওকে নেহাতই অভদ্র বলে ভাবতে ইচ্ছে করছিল হারুর) ওপর হামলে পড়ে আর কি! একজন তো বলেই বসল বলছো কি গুরু! তোমার মতন খুনে কটা আছে বলো তো এ শহরে? কত নাম হয়েছে তোমার ওইসব খুন অপহরণ করে আর তুমি কিনা বলছ...। ঠিক তক্ষুনি হারুর দিকে নজর পড়তেই একে একে সবাই মুরগি-মাটন-কোক-ফান্টার অর্ডার দিয়ে পুরোনো তর্কে ফিরে যায়। হারুর তো তখন করুণ অবস্থা। কোনো রকমে হাত-বুক-হাঁটুর কাঁপুনি সামলাতে-সামলাতে রান্নাঘরের কাউন্টারের দিকে টলতে টলতে ছোটে। তারপর কাউন্টারের ওপাশে অর্ডারগুলো পাচার তথা প্রচার করতে থাকে। দুই প্লেট মুরগির কারি, দুই প্লেট খাসির রেজালা, চার প্লেট ভাত, দুটো কোক আর দুটো ফান্টা...। নাহ্, আর নয়! -এবারে ভাবল হারু। শহর ছাড়ার আগে একটা হেস্তনেস্ত করেই যাব। করতেই হবে। নইলে সালামের কাছে মুখ দেখাতে পারব না।... আর তাজ্জব বনে যেতে হয় ব্যাটাদের বুকের পাটা দেখে। এক নম্বর টেবিলে দারোগা সাহেব বহাল দেখেও ব্যাটারা কেমন আরামসে খাবার খেয়ে যাচ্ছে আর খুনখারাবির গপ্প বলে যাচ্ছে! হারু এক নম্বর টেবিলে দারোগা সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দারোগা সাহেব তখন একটা মুরগির ঠ্যাং মুখস্ত করবেন বলে, ঠ্যাংটাকে মুখের কাছে নিয়ে এসেছেন। ঠ্যাংটিতে দাঁত বসানোর আগেই মুখর হয়ে ওঠে হারু। বলে, হুজুর-একটা কথা ছিল! খাবারে বাধা পড়ায় কিঞ্চিং বিরক্ত হলেন দারোগা সাহেব। মুরগির ঠ্যাং থেকে চোখ ফিরিয়ে হারুকে নজরবন্দি করেন।কী চাই? হুজুর, ওই দুই-তিন-আর চার নম্বর টেবিলের লোকগুলো খুব সুবিধের নয়। কেউ গলা কাটে। কেউ পা কাটে আর চার নম্বর টেবিলের ওরা তো খুন-টুন করে বেড়ায়! দারোগা সাহেব টেবিল তিনটিতে চোখ বুলিয়ে নির্লিপ্ত একটা ভাব টেনে জিগ্যেস করেন, তা আমায় কী করতে হবে? ওদের গেরেফতার করুন হুজুর! এক্ষুনি গেরেফতার করুন। নইলে এমন মওকা আর পাবেন না!হারু ব্যাকুল হলো। নিজের চরকায় তেল দাও গে ছোকরা নিজের চরকায় তেল দাও!উপদেশ দিলেন দারোগা। তা শুনে ব্যাকুল হারু বিলকুল বেআক্কেল বনে গেল। চোখদুটোও চড়কগাছ হয়ে গেল। চড়কগাছ হয়ে গেল দারোগা সাহেবের চোখ দুটোও। তা কেবল হারুর পাশে দুজন সেপাইসহ এক পুলিশ অফিসারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ওরা যে কখন হারুর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, হারুও টের পায়নি। নবাগত পুলিশ অফিসারটি এখন তাঁর পাশের সেপাইটিকে কী যেন আদেশ দিলেন আর সেটা তামিল করতে সেপাইটি ঝটপট দারোগার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল। রেস্টুরেন্টসুদ্ধু মানুষ প্রথমবারের মতন একজন পুলিশ কর্তৃক অপর একজন পুলিশকে পাকড়াও হতে দেখল। কে যেন বলেও ফেলল পুলিশে পুলিশ ধরছে! জন্মেও দেখিনি বাবা! পুলিশ অফিসারটি সেই ভোজনবিলাসীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, এ যে পুলিশের লোক, সেটা আপনাকে কে খবর দিল? পুলিশের পোশাক গায়ে চড়ালেই পুলিশ হওয়া যায় না, সেটি জানেন তো? এ হচ্ছে শহরের কুখ্যাত চাঁদাবাজ-নাম হচ্ছে, গে চান্দু। পুলিশের পোশাক গায়ে চড়িয়ে চাঁদা আদায় করাটাই এই জাহাঁবাজটার কাজ। বহুদিন ধরে খুঁজছি ওকে কিন্তু আমিও স্যান্ডো দারোগা, আমার চোখকে ধুলো দেবে তেমন দাগি এখনও জন্মায়নি! ততক্ষণে বড়োকাকা স্যান্ডো দারোগার পাশে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে ব্যস্ত। বড়োকাকা বলল, ধন্যবাদ, অনেক অনেক ধন্যবাদ শুকরিয়া আপনাকে। প্রত্যেক মাসপয়লা আমার কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে যেত, জানেন? বলত, আমার ব্যবসাটা নাকি অবৈধ, রেস্টুরেন্টটা নাকি অবৈধ জমির ওপর...। কিন্তু ওর গায়ে পুলিশের পোশাক দেখে...। কাঁচুমাঁচু গলায় বড়োকাকা ওর বাক্যটা শেষ করতে পারার আগেই স্যান্ডো দারোগা ফের গাঁক গাঁক করে ওঠেন।আর অমনি আপনি ভেবে বসলেন, পুলিশই চাঁদাবাজি করছে, তাই না? আরে সাহেব, শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না, পোশাক দিয়েও তেমনি চাঁদাবাজ আড়াল করে রাখা যায় না বুঝেছেন? এইসব বলে-টলে স্যান্ডো দারোগা নকল দারোগাকে হিড়হিড় টানতে টানতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন। এমন দুঃখ হারু জীবনেও পায়নি। এমন বেকুব হারু জীবনে হয়নি কোনোদিন। এমন ধোঁকাবাজির পাল্লায় হারু পড়েনি কস্মিনকালেও। হায়! যাকে নাকি দারোগা ভেবে বসেছিল, যার আদলে সে নিজেকে গড়ে তুলবে বলে ভেবে রেখেছিল তার সবটুকুই যে পট্টিবাজি, তা কে জানত! শহরের বেবাক মানুষ কি তাহলে দু’দলে বিভক্ত? একদলে পুলিশ আর অপর দলে রাজ্যির দুষ্কৃতিকারীরা? আর এই পোড়া শহরে পড়ে থাকবে হারু? না, থাকবে না আর একটা দিনও পড়ে থাকবে না। বড়োকাকা ফের ক্যাশ-কাউন্টার সামলাতে ব্যস্ত। হারু পায়ে পায়ে বড়োকাকার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে কাকা, চাঁদাবাজ ধরা পড়ল বলে আপনি বেজায় খুশি, তা বুঝলাম, কিন্তু যেটা বুঝলাম না সেটা হলো বাকিসব আজেবাজে মানুষদের হাতের নাগালে পেয়েও ওদের আপনি ধরিয়ে দিলেন না কেন? আজেবাজে মানুষ! কোন্ আজেবাজে মানুষের কথা কইছিস তুই? কেন, ওই যে দুই নম্বর টেবিলে মোটা মতন...। উনি তো ইসমাইল হোসেন! কদ্দূর গেলেই তাঁর বড়ো মাংসের দোকান। আমার রেস্টুরেন্টের গরু-খাসি-মুরগির জোগান তো ওরাই দিয়ে থাকে। হারু একটু যেন হোঁচট খেল। বলল, আর তিন নম্বর টেবিলের শুঁটকো মতন...। ওকে তুই চিনবি কেমন করে? উনি হচ্ছেন মোকাদ্দেস আলী। চমৎকার একটা দর্জির দোকান আছে তাঁর। তোদের পোশাক তো আমি তাঁর দোকানেই বানিয়ে থাকি। পুলিশের পোশাক তৈরির বড়ো একটা অর্ডার নাকি পেয়েছেন তাই নিয়ে বড্ড ব্যস্ত। হারু এবারে হোঁচট নয়, খাবি খেল।তাহলে... তাহলে... চার নম্বর টেবিলে...। সেকি রে! টেবিলের তিনজনকে তোর চেনার কথা নয়, কিন্তু জ্যাম্বো খানকে চিনতে পারলি না তুই? আশ্চর্য! তুই কি সিনেমা-টিনেমা কিছু দেখিস না নাকি? তা না হয় না-ই দেখলি কিন্তু একটা সিনেমার পোস্টারও কি দেখিসনি আজতক? জ্যাম্বো খান! বিখ্যাত অভিনেতা। দারুণ ভিলেনের রোল করে একে খুন করে, ওকে খুন করে, তবে শেষমেশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। হারু এখন হোঁচট খাবে, নাকি খাবি খাবে দিশে করে উঠতে পারল না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App