×

সাময়িকী

ভালোবাসা অবিনাশী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুন ২০১৯, ০৫:০৮ পিএম

ভালোবাসা অবিনাশী
সুদীপ্ত কনস্ট্রাকশন ফার্ম থেকে বের হয়ে রাতের ব্যস্ত নগরীর মতিঝিলের চারপাশটা দেখে নিল অন্যমনষ্ক হয়ে। তারপর ধীরেসুস্থে কল করলো উবারকে। সুদীপ্ত এসেছে জার্মানি থেকে একটা মিটিংয়ে এটেন্ড করতে। কয়েক দিন থাকবে অফিসের কাজে। সুদীপ্ত কখনো চায়নি এই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় দেশটা ছেড়ে প্রবাসে উড়াল দিতে। কিন্তু জীবন ও জীবিকার সন্ধানে মানুষকে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। ইচ্ছে বা অনিচ্ছের কাছে। সুদীপ্ত জার্মানিতে থাকে ঠিকই কিন্তু তার মনটা পড়ে থাকে নিভৃতে এই মাটিতে। সুদীপ্ত যখন উবারে উঠে বসলো তখন অডিও সিডিতে একটা গান বাজছিল বাহির বলে দূরে থাকুক ভিতর বলে আসুক না সুদীপ্ত এই রকমের গান শুনতে খারাপ লাগে না। গানের সুর আর কথা মন ছুঁয়ে গেলে সুদীপ্তের সব গানই মোটামুটি ভালোই লাগে। উবার চালক যার নাম মাহি সে খুব নিঃসংকোচে বললো স্যার গান বাজালে অসুবিধে নেই তো? সুদীপ্ত জোর দিয়ে বলে উঠলো আরে না না। আমারও গানটা খুব পছন্দের ভালোই তো লাগছে অনেকদিন পর শুনলাম। মাহি খুব আলাপী ছেলে। কিছু মানুষ থাকে না কাউকে দেখলে খুব আপন মনে হয়। নির্বিবাদে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে। মাহিরও মনে হয় সুদীপ্তের ভালোমানুষি চেহারা আর আন্তরিক দেখে তার অনর্গল কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। মাহির বয়স খুব বেশি হলে ৩৩/৩৪ বছর হবে। ফ্রেঞ্চকার্ট দাড়ি। বাড়ি জামালপুর। মতিঝিল থেকে ধানমন্ডি আসতে দীর্ঘপথ, তার ওপর যানজট। বৃহস্পতিবার অন্যদিনের চেয়ে জ্যামটা ভালোই থাকে। মাহিই প্রথম কথা বলতে শুরু করলো, বললো স্যার আপনাকে আমার ভেতর থেকে কেন জানি ভালো লাগছে। মনে হয় আপনার সাথে আমার জীবনের কিছু ঘটনা শেয়ার করি। হয়তো কখনো আর দেখা হবে না। হয়তো হবে। আর দেখা হলেই বা কি! সত্যি তো সত্যি। সুদীপ্তও মাহির কথায় ইমপ্রেস হচ্ছিল। মাহিই প্রথম বলে বাইরের মেয়েরা খুব ভালো হয় তাই না? সুদীপ্ত বললো তোমার কেন মনে হলো বাইরের মেয়েরা ভালো হয়! ও বললো আমার ফেসবুকে আর্জেন্টিনার একটা মেয়ের সাথে কথা হয়। আমি ভালো ইংরেজি বলতে পারি না তবে লিখতে পারি। মেয়েটা খুব ভালো, বিবাহিত। আমাকে সে রিয়েল বন্ধু ভাবে এবং একটি বাচ্চাও আছে বলেছে সবাইকে নিয়ে বেড়াতে আসবে বাংলাদেশে আমার বাসায়। আমি ভিডিওতে আমার গ্রামের বাড়িটা দেখিয়েছি। ওর খুব ভালো লেগেছে। ওদের ভেতর খুব একটা জটিলতা নেই আর মিথ্যা বলে না। সুদীপ্ত বলে ওরা বয়ফ্রেন্ড আর ফ্রেন্ডকে কখনো গুলিয়ে ফেলে না। সবাইর একটা আলাদা স্পেস আছে। বিবাহিত হলেও তাদের খুব ভালো বন্ধু বা বান্ধবী থাকে। তবে রিয়েল বন্ধু। তার সাথে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় না। তাদের ভেতর কোনো মিথ্যাচার বা ভনিতা নেই। একটা রিলেশন থেকে আরেকটা রিলেশনে কখনোই যাবে না। এই বিশ্বাসটুকু মর্যাদা রাখে। তোমার সাথে এডজাস্ট করতে না পারলে অথবা অন্য কোনো রিলেশনে জড়িয়ে গেলে লুকিয়ে রাখবে না, বলে দিবে এবং মিথ্যে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবে। এটুকু সততা সবার ভেতরেই আছে। মাহি খুব দুঃখ করে বললো, স্যার আমরা তো বিদেশিদের সবকিছু অনুকরণ করি কিন্তু ভালোটুকু তো নিতে পারি না। কি শিখলাম আমরা ওদের কাছ থেকে? শিখেছি অপসংস্কৃতি ভালোটা রেখে আমরা খারাপটা গ্রহণ করি। আমাদের চরিত্র বদলাবে না। সত্যের মুখোমুখি আমরা কখনো হতে পারবো না বলে মাহি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো স্যার তাহলে আমার নিজের জীবনের ঘটনাই বলি। সুদীপ্ত বললো তুমি বলতে চাইলে বলো। মাহি বললো আমি উবার চালিয়ে ৪৫-৫০ হাজারের মতো পাই। জামালপুর আমার বউ, মা আর দুই বাচ্চা থাকে। আমি ১০-১৫ দিন পর পর বাড়ি যাই। খেয়ে-পরে ভালোই চলে যায়। কোনো অভাব-অনটন নেই। কুসুম আমার বউ। জানের অধিক ভালোবাসি। তো হঠাৎ আমার চোখে পড়ল আমি ফোন করলেই কুসুম বেশিক্ষণ কথা বলতে চায় না। এড়িয়ে চলে কাজ আছে বলে ফোন রেখে দেয়। আমি আবার ফোন দিলে দেখি এনগেইজ। ঘটনাগুলো অনেকদিন ধরেই আমাকে ভাবাচ্ছিল। আমার মনটা খুব খারাপ লাগছিল। আমি একদিন না জানিয়েই বাড়ি চলে গেলাম। কুসুম আমাকে দেখে বললো কি ব্যাপার খবর না দিয়েই চলে আসছো যে? আমি বুঝতে পারলাম ও বিরক্ত হয়েছে আমি অসময়ে চলে আসছি দেখে। তো আমি খেয়ে আগে আগে ঘুমিয়ে পড়লাম টায়ার্ড লাগছে বলে। আসলে আমি ঘুমাইনি ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম। কুসুমও পাশে ঘুমিয়ে পড়লো আমি বুঝতে পারছিলাম ও উসখুস করছে। অনেকক্ষণ পর ও নিশ্চিত হলো আমি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছি। এক সময় টের পেলাম ও খাট থেকে নামছে নেমে ব্যালকনিতে গিয়ে ফোনে কথা বলছে সেই মুহূর্তে আমি একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। দম আটকে আসছিল। আবার ভীষণ কান্না আসছিল। তারপরও নিজেকে সংবরণ করলাম। ব্যালকনিতে চাঁদের আলো এসে পড়ছে কুসুমের মুখের ওপর। আমি নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে ওর কথা শুনছিলাম। ও চাঁদের আলোর মতোই ভেসে যাচ্ছিল ও পাশের কণ্ঠস্বরে। আমি খুব আস্তে করে পেছন থেকে ওর গলা জড়িয়ে বললাম এত রাতে কার সাথে কথা বলছো? ঘটনার আকস্মিকতায় কুসুম হতচকিয়ে গেল। হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল। আমি মোবাইলটা তুলে নিলাম। আমি যা বুঝার বুঝে নিলাম। আল্লাহ জানেন কেন জানি আমি চিৎকার বা চেঁচামেচি কিছু করলাম না। আমি অল্পশিক্ষিত এত বেশি লেখাপড়া করিনি ডিগ্রি পাস করেছি। তবে আমি প্রচুর গল্প উপন্যাস পড়তাম এক সময়। সেই বোধ থেকে কুসুমকে বললাম সব সময় একটা মানুষকে ভালো লাগবে এটা নাও হতে পারে। তোমার আমাকে আর ভালো লাগে না বলেই তুমি রাতের অন্ধকারে আমাকে রেখে লুকিয়ে কথা বলছো অন্য একজনের সাথে। আমাকে একটা সত্যি কথা বলতো? কয়দিন ধরে তুমি এই রিলেশনে আছো? কুসুম সত্যি কথাই বললো। আস্তে করে বললো ৩ বছর। নিজেকে খুব বোকা লাগছিল যে ৩ বছরে আমি একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি। কুসুমের প্রতি তীব্র ঘৃণা ঠিকরে বের হচ্ছিল আমার চোখ মুখ দিয়ে। আমি ভোর না হতেই বললাম তুমি তার সাথে চলে যেতে পারো। আমি তোমার সাথে আর ঘর করতে পারব না। তবে আমার সন্তান আমার সাথে থাকবে ওদের অযত্ন ও অবহেলা আমি জীবিত অবস্থায় সইতে পারবো না। তুমি যখন ইচ্ছে তাদের দেখে যেতে পারো এই বলে আমি বাড়ি থেকে চলে এলাম। ৩ দিন পর কুসুমের ফোন এলো আমি চলে গেলাম। বাচ্চারা তোমার মায়ের কাছে থাকলো। আমার বাচ্চার বয়স ১ জনের ৫ বছর আরেক জনের ৩ বছর। ছোট ছোট বাচ্চা রেখে চলে গেল সুখী হতে। মাহি তার জীবন কাহিনী বলে তার চোখের জল আর আটকাতে পারলো না। টপ টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সুদীপ্ত যারপরনাই আহত হয়েছে। গল্পটা শুনে ওর মনে হচ্ছিল কোনো ছায়াছবির গল্প শুনছে। চোখের সামনে দৃশ্যগুলো একের পর এক ভেসে আসছে। মাহি, কুসুম তার গ্রামের বাড়ি তার ছেলেমেয়ে, তার মা সেই ছেলেটি যার জন্য কুসুম ঘর ছাড়া। সুদীপ্তের খুব ইচ্ছে করছিল সেই ছেলেটিকেও দেখতে কোন আকর্ষণে মাহির মতো একজন ভালোমানুষকে ইগনোর করলো। সুদীপ্ত বললো মাহি তুমি আবার বিয়ে কর। মাহি বললো, না স্যার মেয়ে মানুষকে আমি আর বিশ্বাস করি না। আমি অনেক ইনকাম করি। ইচ্ছে করলে আমি ফুর্তি করতে পারি। ঢাকা শহরে মেয়ে মানুষের অভাব নেই। কিন্তু প্রতিটি নারীর ভেতর আমি কুসুমকেই দেখতে পাই। এখন আমি আমার মা ছাড়া প্রতিটি নারীকেই ঘৃণা করি। এরা পারে না এমন কাজ নেই। সুদীপ্ত বললো না এটা তোমার ভুল ধারণা সবাই এক রকম না। খারাপ ভালো সবার ভেতরেই আছে। নারী বলো আর পুরুষ বলো। সবাই একরকম হলে তো মানুষের বিশ্বাস উঠে যেত সংসার থেকে। ভালোবাসা বলেও কিছু থাকতো না। হয়তো এমন কেউ তোমার জীবনে আসবে তোমার অতীতের সব দুঃখ ভুলে যাবে। হয়তো এই তুমি একসময় বলবে যা হয়েছে ভালো হয়েছে। মাহি মাঝপথে সুদীপ্তকে থামিয়ে দিয়ে বললো স্যার কি আর বলবো কুসুম এখন আমার মাকে সব সময় ফোন দেয় তারপরে শুরু করে সে ভালো নেই। ফিরে আসতে চায় সন্তানদের কাছে। আমাকেও ফোন দেয়। আমি বলে দিয়েছি আমি তোমাকে ঘৃণা করি। ফোন দিতে না করেছি। তারপরও ফোন দেয় জনম বেহায়া স্যার লজ্জা নেই। এখন নাকি যার কাছে গেছে সে আর ভালোবাসে না। তার দিকে ফিরেও তাকায় না। আমি তো সারাক্ষণই তাকিয়ে থাকতাম। দিনের মধ্যে ৭-৮ বার ফোন দিয়ে খোঁজ নিতাম। সে যে আমার ফোনে বিরক্ত হতো বুঝতে পারতাম না। এখন আমাকে ফোন করে করে বিরক্ত করে ফেলে। নাম্বারটা যে বøক করব তাও পারি না। সুখে থাকতে মানুষকে ভ‚তে কিলায়। সুদীপ্তর কেন জানি মনে হলো এত কিছুর পরেও মাহির মনে কুসুমের জন্য কোথায় জানি একটু জায়গা আছে। হাহাকার আছে। চোরা স্রোতের ভালোবাসা আছে। সুদীপ্ত প্রায় বাসার কাছাকাছি চলে আসছে সুদীপ্তর মনে হলো মাহি কুসুমকে ফিরিয়ে আনবে। সুদীপ্ত বললো তোমার প্রাইভেট নাম্বারটা আমাকে দেবে? যদি তোমার অসুবিধা না থাকে। আমি জার্মানি চলে যাবো। আমি ৪-৫ মাস পর ফোন দিয়ে জানবো তুমি কেমন আছো। কারণ সুদীপ্তর মাথায় মাহির সেই কথাগুলো আটকে আছে। মাহি বলেছিল যেদিন ওদের ডিভোর্স হয় সেদিন মাহি কুসুমের জন্য মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিল। কুসুম যে মিষ্টিটা পছন্দ করতো। বলেছিল কুসুম আমার সামনে মিষ্টিটা খাও আর হয়তো কখনো তোমাকে খাওয়াতে পারবো না। মানুষ অবচেতন মনে অন্যরকম করে ভাবে। কুসুমকে মাহি রাগে, জেদে ঘৃণা করে কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে ঘৃণা করতে পারে না। যদিও ভালোবাসার অপর পিঠে ঘৃণা লেখা থাকে। তবুও কখনো কখনো সব উলট-পালট করে দিয়ে সত্যিকারের ভালোবাসা জিতে যায়। মাহি এখনো কুসুমকেই ভালোবাসে। প্রতিশোধ নিলে সে নিতে পারতো অনায়াসেই মাহি বিয়ে করে সংসারী হতে পারতো। বিবাগী হয়ে ঘুরে বেড়াত না। মাহিদের মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে এখনো আছে। যারা সত্যিই ভালোবাসে কুসুমদের শত অপরাধ সত্তে¡ও। মানুষকে চেনা দায় তার চেয়ে বড় ভালোবাসা বুঝা দায়। কখন কোনদিকে মোড় নেয় আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। ভালোবাসা অবিনাশী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App