গভীর রাতে মোবাইল ফোন
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ জুন ২০১৯, ০৫:২৭ পিএম
চমকে ওঠে শাহেদ। এত রাতে কেন বারবার বাজে মোবাইল। হয়ত আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে হঠাৎ কেউ মারা গেছে। অথবা অন্য কোনো খারাপ খবর যা ঘুম ভাঙিয়ে না জানালেই নয়। ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে খুব বেশি। হ্যালো....?
হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন.....?
কে বলছেন এত রাতে?
যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, খোদা না করুক যদি কেউ মারা যায় সকালে খবরটা দিলেই পারেন। এখন রাত তিনটা। আপনি কল দিয়ে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। হ্যালো....।
কথা বলুন।
চুপ করে আছেন কেন?
আমি অর্পা।
অর্পা তুমি এত রাতে? ঘুমাওনি?
ঘুম আসছে না।
আচ্ছা অর্পা আমি কতবার বলেছি একটু মানিয়ে নিতে চেষ্টা করো ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অতীতকে ভুলে যাবার চেষ্টা করো। স্বামীকে তুমি খুব ভালোবাসো এ কথাটা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলে তোমার সমস্যা কোথায়?
স্বামী অফিস থেকে এলে তার গলা জড়িয়ে চুমো খাও। ব্যাপারটা তো অবৈধ নয়। ঠাণ্ডা কিছু অথবা তার পছন্দমতো কিছু খেতে দাও। এ সব আমি তোমার ভালোর জন্যই তো বলি। অথচ তুমি আমার সাথে কর তামাশা। হাসতে হাসতে বল রিহার্সেল করে দেখিয়ে দিতে। রিহার্সেল করতে শিখিয়ে দিতে গেলে আমার ঝাঁটার বাড়ি খেতে হয়।
আমি সে সব বলতে চাইনে।
ও বুঝতে পেরেছি ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানবে কালকে। হানলে হানুক এটা প্রকৃতির বিষয় কারো তো কিছু করার নেই। আমরা শুধু একটু সাবধানতা অবলম্বন করবো এই যা। অবশ্য তুমি বহুবার বলেছো
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালে
অথবা প্রচণ্ড বজ্রপাত হলে
প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনে
গাছপালা উপড়ে গেলে
কারেন্ট চলে গিয়ে পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে গেলে তুমি দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মাথা রেখে চুপ করে থাকবে একটুও ভয় পাবে না। আগামীকাল সন্ধ্যা নাগাদ ফণী বাংলাদেশে আঘাত হানবে আর তুমি সেই ভয়ে আজ মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে আছ এটা কি কোনো কথা হলো? ধরে নিলাম ঘূর্ণিঝড় ফণী এসেছে। তাহলে তোমার আমার বুকে মাথা গোঁজার সুযোগ কোথায়?
তুমি আজ বনানীতে অভিজাত এলাকায় আর আমি হাতির পুলের সাবলেটে। তোমার সাজানো সংসার আর আমার নিত্যদিনের সঙ্গী বাজার থেকে কিনে আনা কোলবালিশ। অনেক সময় নিজের অজান্তে কোলবালিশটাকে আঁকড়ে সুখ পাই। আবার কখনো বা প্রাণহীন বলে ঠেলে নিচে ফেলে দিই। কোনো প্রতিবাদ নেই। তেমনি পড়ে থাকে। সকালে আবার নিজ হাতেই তুলে নিই।
আমি সে কথা বলছিলাম না।
সে কথা বলছিলে না? তুমি তাহলে এখন ঘূর্ণিঝড় বজ্রপাতকে ভয় পাও না? তবে এতক্ষণ চুপ করে আছো কেন?
তোমার কথা শুনছিলাম। তোমার কণ্ঠস্বর ঠিক আগের মতোই আছে। কথা বলার ঢং একটুও বদলায়নি। তোমার কথা শুনতে আমার ভালো লাগে। মন চায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা শুনে যেতে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তোমার স্বামী কিছু বলছে না?
ও তো বাসায় নেই।
কোথায়?
সিঙ্গাপুর গেছে ব্যবসার কাজে
তুমি কি একা?
একা নই কাজের বুয়া আছে। গেইটে দারোয়ান চাচা থাকে।
আসলে অভিজাত এলাকায় তোমরা যারা থাকো তাদের চিন্তাধারায় এক জায়গায় বড্ড বেশি মিল। টাকা চাই অনেক টাকা। ক্ষমতা চাই অনেক বেশি ক্ষমতা। ঢাকা শহরের অর্ধেক দিলে বলবে পুরোটা চাই, পুরোটা দিলে বলবে দেশটা চাই, দেশটা দিলে বলবে পৃথিবীটা তার কথা মতো চললে ভালো হয়। টাকায় ভালোবাসা বেচাকেনা হয়।
টাকায় মায়ার বাঁধন ছিন্ন হয়।
টাকায় বাপকে চাকর বানায়।
টাকায় তাদের মাকে
গ্রামের জীর্ণ বাড়িতে ঠেলে দেয়।
বাদ দাও তো সে সব।
তাহলে বল এত রাতে ফোন করলে কেন? শুধু কি আমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য? তাহলে বলতে আমি রবী ঠাকুরের দু’বিঘা জমি আবৃত্তি করে মোবাইলে পাঠিয়ে দিতাম। তুমি রাত জেগে শুতে আর আমি নাক ডেকে ঘুমাতাম।
আসলে আমি জালাল স্যারের কথা বলতে চেয়েছিলাম।
মারা গেছেন গত শনিবার।
হ্যাঁ, তোমাকে কে বলেছে?
যদু নাথ।
যদু নাথ কে?
ঐ যে কালো করে। ভালো ফুটবল খেলতো। নাটকে কৌতুক অভিনয় বেশ ভালো করতো। যে কোনো আড্ডায় বসলেই গায়ের রং কালো বলে বেশ আফসোস করতো। মনে পড়ছে?
হ্যাঁ চিনতে পেরেছি।
জালাল স্যারের মৃত্যুর কথা বলতে সে কেঁদেই দিল।
আহারে!
আসলে জানো অর্পা জালাল স্যারের মৃত্যুতে আমাদের স্কুল একজন সত্যিকার অভিভাবককে হারালো এবং দেশ হারালো একজন আদর্শ শিক্ষককে। ক্ষয়ে যাওয়া জমিদার বংশে তার জন্ম অথচ টাকাপয়সা আয়ের কথা কখনো ভাবেননি। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো দেখে মানুষ করার চেষ্টা করতেন। স্যারের মৃত্যু সংবাদ শুনে মন ভেঙেছে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম।
আমি অন্য কথা ভাবছিলাম।
অন্য কথা?
হ্যাঁ।
খুলে বলতো শুনি।
নির্ধারিত তারিখ আমার মনে নেই। সেদিন ছিল সোমবার। স্কুল ছুটির পর এক ফাঁকে আমার হাতে চিঠি গুঁজে দিতে গিয়ে জালাল স্যারের হাতে ধরা খেলে। স্যার চোখ বড় বড় করে আমাকে নানা প্রশ্ন করলেন। অর্থাৎ আমার কাছে জানতে চাইলেন চিঠিপত্র আদান প্রদানের ব্যাপারে আমি কিছু জানি কিনা। নাকি তুমি একতরফাভাবে আমাকে যন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা করছো। তুমি চোখের ভাষায় আমাকে ব্যাপারটা না করতে শিখিয়ে দিলে। কথামতো আমি মাথা নেড়ে স্যারকে জানিয়ে দিলাম আমি কিছুই জানি না। স্যার এবার দাঁতে দাঁত কেটে বললেন বটে।
আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম।
নত করে দিলাম মাথা।
স্যার গম্ভীর কণ্ঠে বলেন
অর্পা তুমি যাও।
আমি চলে গেলাম। ধীর পদে।
তবে খুব কষ্ট হচ্ছিল মনে।
পরে শুনেছি স্যার তোমাকে নিয়ে অফিস কক্ষে প্রবেশ করলেন। এবং তিনখানা বেত একত্র করে তাঁর শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ভীষণভাবে মারলেন। প্রচণ্ড মারে জ¦র এসেছিল।
তিন দিন আসনি স্কুলে।
আমি ভেবেছিলাম ছেড়ে যাবে স্কুল। কিন্তু যাওনি। পরে বুঝতে পেরেছি স্কুল ছেড়ে অন্য কোথাও গেলে তো আমাকে দেখতে পাবে না। এই ভেবে মারের যন্ত্রণা, অপমান সব সহ্য করে গেলে। আমার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়েছিল। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় তখন যদি মোবাইল ফোন থাকতো তাহলে কোনো ঝামেলাই হতো না। তোমাকে ফোন করতাম।
অথবা তুমি আমাকে করতে।
না হলে এসএমএস করে দিতে।
সে সময় তোমার আমার মতো যারা ভালোবাসায় দিশেহারা ছিল তারা একটা চিঠি পাঠাতে কত কষ্টই না করেছে। সাবধান হতে হয়েছে। মায়ের হাতে মেয়ের চিঠি পড়লে তো মহাবিপদ। কোনো কারণ না দেখিয়ে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে।
অর্পা।
বলো।
স্যারের জন্য দোয়া কর।
অবশ্যই করবো মনটা কাঁদছে।
ভয় পেয়ো না ঘূর্ণিঝড়কে। আলামতে বোঝা যাচ্ছে তা ভারতের উড়িষ্যায় প্রচÐ আঘাত হানবে। এবং অবশেষে দুর্বল হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না।
আমি এখন ঘূর্ণিঝড় এবং বজ্রপাতকে ভয় পাই না।
বল কী অর্পা?
সত্য বলছি।
কেন এমন হলে?
যার জীবনে প্রতিদিনই ঘূর্ণিঝড় হয়। বজ্রপাতে আকাশ ফাটে। তার মনে আর বজ্রপাতের ভয় থাকে না। এ পৃথিবী তার স্বপ্নের ঠিকানা নয়। লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক। ধ্বংস হয়ে যাক- ক্ষতি কি? কেমন আছো তুমি?
ভালো আছি!
এ কথা বহুবার তোমাকে বলেছি। যার ভালো থাকা মন্দ থাকা সমান কথা তার মন্দ থেকে লাভ কী। বরং মন্দকে ভালো বলে চালিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সব কিছু পেয়ে ভালো থেকো তুমি। তুমি ভালো থাকলে আমার সকল কল্পনা সার্থক হবে।
হ্যালো....।
হ্যালো শাহেদ রেখে দিলে কেন?
আমার কথা শেষ হয়নি। রাত এখনো আছে বাকি।