×

সাময়িকী

আলসে দুপুরের ডায়রি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুন ২০১৯, ০৬:৩০ পিএম

আলসে দুপুরের ডায়রি
আলসে দুপুরের ডায়রি
এক. উপন্যাসের প্লট খুব সহজ। অন্তত গবেষণার বিবেচনাতে তো বটেই, আকারে আকৃতিতেও এমন একটি প্লট পাঠকের কাছে কাম্য নয়। বাক্যটি বোধহয় সাংঘর্ষিক হয়ে গেল। বিচক্ষণ পাঠক মাত্রেই ভ্রু কুঁচকাবেন, হয়তো নাক সিঁটকে বলবেন পাঠকের ভালোলাগা আর গবেষণা তো এক নয়, বরং বিপরীত। কথাটির সঙ্গে আমি সহমত, আবার সহমত নইও। সহমত এই জন্য যে, মানুষ আসলে বিবেচনার ভিত্তিতে জীবনের সব হিসেব-নিকেশ করে না যদিও সে জানে ওটা করাই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জীবনকে যারা গণিতের খাতা মনে করেন তাদের প্রতি যেমন রয়েছে আমার অরুচি, তেমনি স্বভাবসুলভ উদাসীনতার শেষ রাস্তায় যদি সৃষ্টিশীলতার ল্যাম্পপোস্টটা জ্বলতে না দেখি, তাহলে সে-ই উদাসীনতাও আমার অভিধানে অর্থহীন। অভিধানটি আমার ব্যক্তিগত বলেই রক্ষা; তা না হলে হয়তো অর্থের অনর্থক অনাচারে অনাসৃষ্টি সৃষ্টির অভিযোগে বহু ভাষাবিদই আমার বিরুদ্ধে কলম ধরতেন। অবশ্য সময়ের জোরে এ ভয়টা আপাতত নেই। কারণ এখন প্রযুক্তির যুগ, একটু বাড়িয়ে বললে অস্থিরতারও যুগ তাই কলমের চেয়ে ভাষাবিদগণ হয়তো মামলা ঠুকে দেয়াটাকেই সুবিধাজনক মনে করবেন। তাতেও সমস্যা নেই কারণ মামলাও কাগজে-কলমে করা হয়, অতএব এখনো কলম ধরার বিষয়টি উঠে যায়নি। ভবিষ্যতে সবকিছু যখন অনলাইনভিত্তিক হয়ে পড়বে মানুষ যখন অনলাইনে মামলা করতে পারবেন এবং এসএমএসের মাধ্যমে তাকে শুনানির তারিখ জানিয়ে দেয়া হবে তখন ‘কলম ধরব’ বলে আর শৈল্পিক হুমকি দেয়া যাবে না। তখন ‘কি-বোর্ড চাপলাম’ বলে প্রযুক্তিগত হুমকি দিতে হবে। এত কথা বলেও যে রক্ষা পাব তারও উপায় দেখছি না। কারণ রবীন্দ্রনাথের সময়ের নিন্দুকেরা এখন আর নেই, তাই চাইলেও নিন্দুককে ভালোবাসাটা ঠিক হবে না। অবশ্য কবিগুরুর যুগেও যে সবাই নিন্দুককে ভালোবাসতো তা নয়। রবীন্দ্রনাথ পারতেন, কারণ তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। নিন্দুক চিরকালই নিন্দুক। ভালোবাসলেও সে বলবে, ওই ভালোবাসার ‘ভ’ টা ছোট। আবার দেখেশুনে সবগুলো অক্ষর বড় বড় করে লিখে ‘ভালোবাসি’ বললেও নিন্দুক বলবে আমার ক্ষেত্রেই কেবল এই রুচিহীনতার প্রকাশ, অত বড় করে বেঢপাকৃতির মতো কেউ ‘ভালোবাসি’ লেখে? আমাদের সময়ের নিন্দুকেরা ভাষাবিদদের কলম ধরার বিষয়টিকে খুব একটা সহজ করে দেখবেন না। কেউ কেউ হয়তো ঠোঁট উল্টিয়ে বলবেন কোথাকার কোন আনাড়ি লেখক, তার বিরুদ্ধে লেখারই বা দরকার কি? বরং লিখেই তো এর কাটতিটা বাড়িয়ে দিল! যত্তোসব! কথা সত্য। এমন ঘটনাও আজকাল প্রায়শই শোনা যায়। এক সময় বিতর্কিত লেখক হওয়াটা ছিল গর্হিত, এখন বিতর্কিত লেখকরাই হন গর্বিত। এক সময় নিন্দুকেরা বলতেন অমুক লেখকের বই নিষিদ্ধ করা উচিত। আর এখন? পারলে লেখকই বলেন আমার বইটি নিষিদ্ধ করা হোক। এক সময় লেখক ছিলেন জীবনঘনিষ্ঠ, আর এখন লেখক আত্মাঘনিষ্ঠ। জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যে আত্মা হয় উপমা; কিন্তু আত্মাঘনিষ্ঠ সাহিত্যে জীবন হয় মার্জিন কেবল ফাঁকা পড়ে থাকে, শূন্য। এর প্রভাব পাঠকের মনস্তত্ত্বেও পড়েছে। পড়াটাই স্বাভাবিক। পাঠকের মনন গড়ে উঠে মূলত লেখকের সংবেদনশীলতার ওপর। লেখক কতটা ছুঁয়ে গেলেন? কতটা গভীরে গেলেন? আর একটু যাওয়া যেত কি? আর একটু? যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবার একটা প্রবণতা, কিন্তু ছুঁয়ে যাওয়া হলো না শেষ পর্যন্ত। সব মিলিয়ে গেল। কাহিনী, চরিত্র, আখ্যান, উপমা বা অন্য আরও কিছু এমনকি দর্শন কিংবা জীবনাদর্শের মতো বিষয়গুলোও। কেবল ভালোলাগার একটা আবেশ পড়ে রইল এক চিলতে রোদের মতো জীবনের শীর্ণ বারান্দাটাকে আঁকড়ে ধরে। এই ভালোলাগার আবেশটুকুই লেখক, এখানেই তিনি বাস করেন প্রতিনিয়ত কথা বলেন পাঠকের সঙ্গে। তাই চারুদত্ত আধারকারের বেদনা যখন মনের আয়না ছবি আঁকে তখন আপনাতেই প্রশ্ন করি যাযাবরকে। মনে মনে জানতে চাই, এ কার উপর ‘দৃষ্টিপাত’? মলাটবদ্ধ এমন একটি বেলে লেটারে কেবল চারুদত্ত আধারকারই উঠে এলেন? এতে কী একবারও ধরা পড়েনি বিনয় মুখোপাধ্যায়? উত্তর মেলে না তবুও প্রশ্নগুলো জেগে থাকে। এই প্রশ্নই তৈরি করেছে পাঠকদের যুগে-যুগে, কালে-কালে। আবার এই পাঠকের মনোবীক্ষণ করতে গিয়েই জন্ম নেন আরো সাহিত্যিক। প্রেমের উঠোন পেরিয়ে সৃষ্টি এসে দাঁড়ায় জীবনের রাজপথে। সে রাজপথের ব্যাকরণ অন্যরকম। তাই মালার নিটোল প্রেম, স্বপ্নের সংসারের ঘাট পেরিয়ে কুবের নৌকা ভাসায় কপিলার গহীন গাঙে। মালার ভালোবাসা তখন কপিলার অঙ্গুলি হেলন, বিলোল কটাক্ষের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এতেও পাঠক বিচলিত হয় না বরং তারিফ করে মানিকের শিল্পী সত্তাকে। কারণ এ পাঠক তো রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’র পাঠক। সময় এভাবেই ইতিহাসে রূপ নেয়। এটা সময়ের ধর্ম, নাকি ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য সে কথা অন্যদিন হবে। তবে এ কথা ঠিক, ইতিহাস আর সময় কখনো হাত ধরাধরি করে চলেনি। আজ যেটা ঘটনা, হয়তো বহুদিন পর নানা বিবেচনায় তা ইতিহাসের মূল্য পাবে। আবার না-ও পেতে পারে। এটা কার ট্র্যাজিডি? সময়ের? নাকি ইতিহাসের? ট্র্যাজিডি যার-ই হোক দায়টা আপাতত রিজভীর। রিজভী মর্তুজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। স্নাতক শেষ করলেন মাসখানেক হলো। এবার স্নাতকোত্তরের পালা। স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তরের বিচারে রিজভী কতটা যোগ্য সে বিষয়ে আমি খুব একটা জানি না, তবে এটা জানাতে পারি যে সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে রিজভীর কোনো তুলনা নেই। রিজভীর বিভাগে রিজভীই অন্যরকম। পুরো ক্লাসে তার চেয়ে ভালো সাহিত্য কেউ পড়ে না এবং পুরো ক্লাসে তার চেয়ে খারাপ রেজাল্টও কেউ করে না। তাই বই পড়ার বিষয়ে তার যতটা আগ্রহ বইয়ের সমালোচনাতে তার আগ্রহ ততটা নয়। কিন্তু এতে তার কোনো আক্ষেপ নেই। সে আনন্দিত। কারণ একটাই। এই কারণটাই আজ কলাভবনের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ জোর দিয়ে বলছিল রিজভী। ‘শোন। আমি আর কিছু না পারি নিজেকে মরার হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছি। আমি রেজাল্ট ভালো করিনি সত্য কিন্তু নিজস্ব স্বাধীনতায় কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দিইনি’ কথাগুলো বলেই সিগারেটটা ধরালো রিজভী। এই সিগারেটের প্রতিও তার অন্যরকম একটি অনুভূতি আছে কিন্তু সেটা ঠিক কী রকম তা জানা যায়নি, আসলে কারো কখনো জানার আগ্রহ হয়নি। স্নাতকোত্তর পর্যায়। ক্লাস শুরু হবে কয়েকদিন পর। বন্ধুরা সবাই মিলে নানা আলোচনায় মত্ত। কে কোন বিষয়ে থিসিস করবে, কার তত্ত্বাবধানে করবে এ নিয়েই সকলের সময় কাটে। তবে রিজভীর কোনো ভাবাবেগ নেই। ওর অবশ্য কোনোকালেই কোনো ভাবাবেগ ছিল না। সারাদিন ক্যাম্পাসে কাটিয়ে রিজভী যখন হলে ফিরে এল রাত তখন এগারোটা। সলিমুল্লাহ হলের ১১৩ নম্বর কক্ষে আজ প্রায় সাড়ে চার বছর যাবৎ থাকছে রিজভী। কী মায়া পড়ে গেছে হলটির ওপর। চেয়ার টেনে বসেই একটি সিগারেট ধরালো। অপ্রয়োজনে। মাঝে মাঝে এমন অপ্রয়োজনেই সিগারেট ধরায় সে। আজ ছিল চৈত্র সংক্রান্তি। কাল পহেলা বৈশাখ। সারা ক্যাম্পাস জুড়ে সাজ সাজ রব। হলে কেউ-ই তেমন থাকে না চৈত্র সংক্রান্তির রাতে। অথচ এই সময়গুলোতেই তার হলে নিজের ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে রিজভীর। আধখোলা জানালাটির দিকে তাকিয়ে একমনে সিগারেটে শেষ টান দিচ্ছে সে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে বের করলো নীলক্ষেত থেকে কিনে আনা একটি পুরোনো লিটল ম্যাগাজিন। জামা-কাপড় না বদলেই শুয়ে পড়ল বিছানায়। শুয়ে শুয়ে উল্টোতে থাকে প্রায় ছেঁড়া ম্যাগাজিনের পাতাগুলো। কতক্ষণ পড়ে তার খবর নেই। কিন্তু হঠাৎ টেবিলের কাছে ফিরে আসে। একটা কলম নিয়ে খাতার উপরে লেখে ‘কনফ্লুয়েন্স’। লেখকের নাম রেবেকা মাহমুদ। যে নিবন্ধটি থেকে বইটির নাম পাওয়া গেল তা মূলত একটি চলচ্চিত্রের উপর লেখা। লেখক উল্লেখ করেছেন বইটি প্রায় দুষ্প্রাপ্য এবং এর কোনো হদিস এখন আর পাওয়া যায় না। আরেকটি বিষয় হলো প্রকাশকালীন বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও পরবর্তীতে প্রকাশনা সংস্থা লেখকের অনুমতি না থাকার কারণে বইটি পুনর্মুদ্রণ করতে পারেনি। তাছাড়া বইয়ের মূল পাণ্ডুলিপিটি কোথায় আছে তা-ও জানা যায় না। রিজভী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের মানুষ। দেরি করে সিদ্ধান্ত নিয়ে সিদ্ধান্তের জন্য সময় অপচয় করাকে সে খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। তাই রিজভী সিদ্ধান্ত নিল বইটির উপর সে তার মাস্টার্সের থিসিস করবে। ব্যাস ওইটুকুই। বিভাগের সঙ্গে তার ওই এতটুকুই সামঞ্জস্য। এরপর আর বিভাগের কাছে যাওয়া হলো না। কারণ থিসিসের অনুমতি মেলেনি। বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে রিজভী যা বুঝল তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক কাজের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় আবার ওই উৎসাহ যাতে কাজে না লাগে তার জন্যও যথাযথ ব্যবস্থা রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত রিজভী সিদ্ধান্ত বদল করলো। না গবেষণা ওই বইটি নিয়েই হবে, তবে মাস্টার্সটা আপাতত করবে না রিজভী। বন্ধুরা হায় হায় করলো বটে কিন্তু যার জন্য করলো তার কোনো হায় হায় সুলভ মনোভাব লক্ষ করা গেল না। বইটি নিয়ে কাজ করার জন্য রিজভী প্রথমেই লিটল ম্যাগাজিনে পড়া লেখাটির লেখকের কাছে গেল। সামান্য যা কিছু পাওয়া গেল তা নিয়েই শুরু হলো তার গবেষণাযাত্রা। তবে গবেষণা বলতে আসলে যা বোঝায় তা কি সত্যিই হয়? হয়তো হয়। রিজভী ভাবে। এখন তার অনেকটা সময় ভাবনাতে কাটে। ভাবনা অনেক। এখনও বইটির বিষয়ে তেমন কিছুই জোগাড় করতে পারেনি সে। কত বছর আগে লেখা একটি বই। তার আর কোনো সংস্করণ হয়নি। মাত্র একবারই প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর তার আর কোনো হদিস মেলেনি। যে প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল বইটি তা-ও এখন আর নেই। কোনো ক‚লকিনারা পায় না সে। ক‚লকিনারা কীসের? বইয়ের না লেখকের? মাঝে মাঝে ভাবে রিজভী। বইটির প্রতি তার আগ্রহ আছে কিন্তু তার চেয়েও বেশি আগ্রহ লেখকের প্রতি। রেবেকা মাহমুদ। কেন তিনি দ্বিতীয়বার বইটি মুদ্রণের অনুমতি দিলেন না? তার কীসের সঙ্কোচ ছিল? তাছাড়া তার মৃত্যুর পরও তো কাজগুলো করা যেত? এসব প্রশ্ন নানাভাবে ঘুরপাক খায় রিজভীর মাথায়। কিন্তু উত্তর মেলে না। অবশেষে একটা রাস্তা পাওয়া গেল। রাস্তার হিসেবটা মিলল বাংলা একাডেমির একটি পুরোনো জার্নাল থেকে। সেখানেই উল্লেখ আছে বইটির মোড়ক উন্মোচনের সালটি। রিজভী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি আর্কাইভ ইত্যাদি তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে পাওয়া গেল বইয়ের খবর। সেদিন ছিল ২৯ মাঘ। তৎকালীন সময়ের শীর্ষ খবরের কাগজ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছেপেছিল বই প্রকাশের সংবাদটি। সেই সংবাদের গতি ধরে এগুলে আরও তথ্য পাওয়া যায়। যেমন একটি সাহিত্য পত্রিকায় বইটি সম্বন্ধে লেখা হয়েছে এটি মূলত একজন নারীর মনোদ্বৈরথের অবলোকন মাত্র। এতে ভাবের উন্মেষ ঘটেছে, কিন্তু চোখের উন্মোচন ঘটেনি। এভাবে কতদিন কেটে গেছে রিজভী জানে না। যতই বইটির ভেতরে যায় ততই তার মনে হতে থাকে গবেষণার ধরন বদলাতে হবে। আদল বদলাতে হবে। মাঝে মাঝে মনে হয় এখানে গবেষণার কিছু নেই, পুরোটাই উপলব্ধির। একদিন সকালে। বাসা থেকে বের হয়ে রিজভী হাঁটতে থাকে ফুটপাত ধরে। ওর যা অভ্যেস। ফুটপাতে পড়ে থাকা বইগুলো থেকে পছন্দের বইটি খুঁজে নেয়া। রিজভীর এ বিষয়ে একটি দারুণ দর্শন আছে। দর্শনটি এমন যে যদি অনুসন্ধিৎসু একটি মনের অধিকারী হতে হ তাহলে অবশ্যই একজন মানুষকে পল্টন, বাংলাবাজার কিংবা নীলক্ষেত থেকে পুরোনো বই খুঁজে বের করতে হবে। এটা তার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। এই খুঁজে বের করার মধ্য দিয়ে মানুষের ভেতরের মনের জানালাটা আলো পায়। তাতে উজ্জ্বল রশ্মি ফুটে ওঠে। সেখানেই হঠাৎ চোখে পড়ল বইটি। ‘কনফ্লুয়েন্স?’ না ভুল দেখছে না রিজভী। ঠিক মূল লেখাটিই। তার হাত কাঁপছে। লেখকের নাম রেবেকা মাহমুদ। ‘কত?’ বলেই মানিব্যাগে হাত দিল রিজভী। ততক্ষণে দোকানদারেরও বোঝা হয়ে গেছে রিজভীর অবস্থা। তাই বুঝে শুনে দাম চাইলেন ছয়শত আশি টাকা। রিজভী একবার তাকাল কপাল কুঁচকে। কিন্তু কিছু বলার আগেই দোকানদার বললেন অ্যানশিয়েন্ট পিস কই পাইবেন? এইডার নিউজ ছাপানি পত্রিকাগুলিও অহন উইঠ্যা গ্যাছে। কথা সত্য। তাই বলে ছয়শত আশি টাকা! কিন্তু রিজভী কথা বাড়াল না। টাকা দিয়ে বইটি কিনে বাড়ি ফিরল রিজভী। এই প্রথম তার রাস্তা দিয়ে চলতে ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে কে যেন এসে ছিনিয়ে নিবে বইটি। দুই. উপন্যাসের প্লটটি নিতান্তই পলকা। অন্তত রেবেকা মাহমুদ তাই মনে করেন। তাই তো খবরটি শোনার পর তিনি প্রথমটায় বিশ্বাসই করতে চাননি। এরপর বিশ্বাস করেছেন। বিশ্বাস করলেও ধারণা তো আর বদলায় না! ধারণা থেকেই যায় তার আপন কড়চায়। রেবেকা মাহমুদেরও তাই হলো। খবরটি শোনার পর থেকে তার ব্যস্ততার অন্ত নেই। একের পর এক চিঠি, টেলিফোন... আর কত লোক যে আসছেন দেখা করতে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এখন যে সময় এসেছে তাতে নতুন লেখককে একটি উপন্যাস লেখা নিয়ে যতটা ভাবতে হয়, তার চেয়েও বেশি ভাবতে হয় সেটি প্রকাশের জন্য। এ কারণেই বোধহয় নান্দনিক প্রচ্ছদ আর সুন্দর কাগজের মধ্যে প্রকাশকগণ প্রতিনিয়তই অপাঠ্য সরবরাহ করছেন পাঠকের রুচির চৌপায়ায়। ফলে দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ দেখে মুগ্ধ হয়ে বই কিনে বাড়ি নিয়ে আয়েশ করে যখনই পড়তে বসা হয় তখনই দেখা যায় ‘পাঠকের মৃত্যু’। তবে এদিক থেকে রেবেকা মাহমুদের ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে। দেশের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা ‘বৈতরণী’র স্বত্বাধিকারী গালিব চৌধুরী তার বন্ধু। বন্ধু মানে কেবল বন্ধুই নয় একেবারেই ছেলেবেলার বন্ধু। বস্তুত গালিবের অনুরোধেই রেবেকা বইটি লেখার কাজে হাত দেয়। এতে অবশ্য রেবেকারও একটা শর্ত ছিল সেটা হলো বইটি সে ইংরেজিতে লিখবে। লিখলোও তাই। ‘কনফ্লুয়েন্স?’ শিরোনামে বইটি বাজারে আনল বৈতরণী প্রকাশনা। এই তো সেদিনের কথা! অথচ এরই মধ্যে এতো বড় একটি ঘটনা। ভাবতেই গা শিউরে উঠে রেবেকার। মোট ২৪০ পৃষ্ঠার বই। আটত্রিশটি অনুচ্ছেদ। কথাগুলো যত সহজে বলা গেল তত সহজ অবশ্য সবকিছু ছিল না। এই বইটা বের করতে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে তা কেবল একজনই জানে। পাঠক কি ভাবছেন? এই ‘একজন’টা রেবেকা? মোটেই না। মানুষটা গালিব। প্রায় ছয় বছর যাবৎ বইটি লেখার জন্য তাগিদ দিয়েছে সে। এবং অনুপ্রেরণা। তাগিদ আর অনুপ্রেরণা এ দুইয়ের ভেদটা কি? আছে। অনেক ভেদ আছে। তাগিদ দিয়ে কাজ করাতে চাই অনেক কিছু আর অনুপ্রেরণায় কেবল হৃদয় হলেই চলে। তাই রেবেকার জন্য গালিবের তাগিদ যতটা কাজ করেছিল, তার চেয়ে বেশি কাজ করেছিল তার অনুপ্রেরণা। আহত কর্নেল যেমন শেষবারের জন্য হাত বাড়ায় তার প্রিয় পাইপটির দিকে, তেমনি রেবেকা প্রতিদিন উঠে এসেছে তার লেখার টেবিলে জীবনের শেষ তৃষ্ণাটুকু নিয়ে। তৃষ্ণা মিটেছে, কিন্তু শেষ হয়নি। সৃষ্টির পাত্রে আবার এসেছে গালিবের অনুপ্রেরণা। রেবেকাও লেখার টেবিলে এসেছে পরেরদিন। তার পরের দিন। তারও পরের দিন। এবং উপন্যাসটি শেষ করার দিন। এভাবে পেরিয়ে গেছে ছয় বছর। অবাক হয়ে ভাবে রেবেকা পুরো ছয়টি বছর! কেবল একটি উপন্যাসের জন্য। তার অবাক হয়ে যাওয়া চাহনি দেখে গালিব বলে, ভালো হয়েছে। ছয় বছর তো কী? ‘ঠিকই বলেছ। জীবনের জন্য তো আমি কোনো কিছুই খরচ করিনি সময় তো আমার রয়েই গেছে হিসেবের খাতায় তাই না?’ বলেই আশ্চর্য একটা হাসি হাসে রেবেকা। এই আশ্চর্য হাসিটির জন্য গালিবের মায়া হয়। জীবনকে মনে হয় একগুচ্ছ শুকনো রজনীগন্ধা। দেখে বোঝা যায় এক সময় সব ছিল, অথচ আজ কিছুই নেই। কথাটি অবশ্য সত্য নয়। কারণ আজ সব আছে। গালিবের চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে। রেবেকা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিছু বলছে না। নীরব একজোড়া চোখ, অথচ কত দিনের চেন কত কথায়, শব্দে ভাস্বর এ চোখের জ্যোতি কেউ তা জানে না। তিন. মেয়েটি চেনা নাকি অচেনা? চেনা-অচেনার ভুল শুধরে নিতে আবার তাকায় কেউ কেউ। আপাদমস্তক দেখে। কেউ কেউ মন্তব্যও করে। কিন্তু মেয়েটির তাতে কিছুই যায় না, আসেও না। সে নির্বিকার। মেয়েটি সাহসী কিনা এ বিষয়টা জানা যাচ্ছে না। কারণ সাহস দেখাবার বয়স তার এখনো হয়নি। অথচ বয়সের তুলনায় কয়েক পা বেশি এগিয়ে এসেছে। ধানমন্ডির রোডটা পেরিয়ে মেয়েটি যখন গাড়িতে উঠল তখন দুপুর। পরনে জিন্স প্যান্ট আর ফতুয়া। গায়ে ওড়না আছে, তবে তার কাছে সেটাকে অতিরিক্ত মনে হয়েছে সব সময়ই। গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বলল তুমি ছয় নম্বরে যাও। ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। তারপর বেশ মৃদু গলায় বলল ম্যাডাম তো বাসায় যেতে বলছেন। গাড়ি নিয়ে বের হবেন। মুহূর্তেই গর্জে উঠল মেয়েটি ‘স্টুপিড। আমি যেটা বলছি সেটা র্ক। এটা ম্যাডামের গাড়ি না’ বলেই মোবাইলটা খুলে একটা এসএমএস লিখতে শুরু করলো। ড্রাইভার আর কথা বাড়াল না। গাড়ি চলতে লাগল ধানমন্ডি ছয় নম্বরের দিকে। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। এভাবে ঢাকা শহরে চলা যায় না। তবুও প্রতিদিন এভাবেই ঢাকা শহরে চলতে হয় সবাইকে। এটা যেন এক নিয়তি। নিষ্ঠুর নিয়তি। পনেরো মিনিটের পথ পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল। অবশেষে ধানমন্ডি ছয় নম্বরে এসে থামল গাড়ি। একটি কসমেটিকসের দোকানে ঢুকে মিনিট বিশেক সময় কাটাল মেয়েটি। নিজের পছন্দ মতো সে যে ধরনের প্রসাধনী কিনল তার অধিকাংশই তার প্রয়োজন নেই। আর বাকি যা আছে তা ব্যবহারের বয়স এখনো হয়নি তার। তবুও তার ইচ্ছের মূল্যকে প্রাধান্য দিতে হয়। কেন হয়? এই ‘কেন’র উত্তর এত সহজে দেয়া যায় না। এখানেই বিপত্তি। আমাদের চারপাশের একটি সমস্যা আমরা জানি এর প্রতিকার প্রয়োজন, অথচ আমরা কিছুই করতে পারি না। কারণ আমরা কয়েকটি ‘কেন’র খাঁচায় বন্দি। এ বন্দিত্ব হয়ত একদিন ঘুচবে, হয়ত একদিন আমরা সজাগ হব কিন্তু ততদিন কি আমাদের সত্তাগুলো মানুষের মতো থাকবে? এ বিষয়গুলো মেয়েটির কাছে অবান্তর। তার বয়স কত? ষোলো? সতেরো? আঠারো? এ পর্যন্ত শরীরের দিকে না তাকিয়েই বলে দেয়া যায়। কিন্তু যখন তাকে আপাদমস্তক দেখি তখন বয়স এসে দাঁড়ায় উনিশ-কুড়ির কোঠায়। আর যদি এক ঘণ্টা সময় কাটানো যায়? তাহলে একুশ-বাইশও ছাড়িয়ে যায়। সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় পেরিয়ে গাড়ি যখন নিউমার্কেটের দিকে ছুটল তখনই বেজে উঠল ফোনটা। মিসেস রহমান ফোন করেছেন। মিসেস রহমান। পুরো নাম ফাহিমা রহমান। আমরা যে মেয়েটিকে নিয়ে কথা বলছি ফাহিমা রহমান তার মা। বয়স চল্লিশ পেরোয়নি কিন্তু চেহারাতে পঁয়ত্রিশেরও কম মনে হয়। ফোন করেই তিনি দুটো প্রশ্ন করলেন এক, তুমি কোথায়? উত্তরের যথার্থতা যাচাই না করেই দ্বিতীয় প্রশ্ন কখন আসবে? আমার গাড়িটা লাগবে। প্রশ্নের চেয়ে চাহিদাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই মেয়ের উত্তরেও উত্তরের চেয়ে বিরক্তিটাই গুরুত্বপূর্ণ। বাসায় পৌঁছে মেয়েটি যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। মিসেস রহমান তখন নামছেন। পাশাপাশি দুজনই দুজনকে অতিক্রম করলেন কিন্তু কেউ কারো জন্য ফিরে তাকালেন না। মিসেস রহমান পেছন থেকে কিছু একটা বললেন কিন্তু তা মেয়েটির কান পর্যন্ত পৌঁছলো না। এমন এক ভয়ানক নির্লিপ্ততার মধ্য দিয়ে চলে মা-মেয়ের সম্পর্ক। কিন্তু এর কারণটা কি? তা জানানোর আগে পাঠককে বলে নিচ্ছি এটা সম্পূর্ণই রেবেকা মাহমুদের উপন্যাসের এক ধরনের ভাবানুবাদ। উপন্যাসে উনি মেয়েটির কোনো নাম ব্যবহার করেননি। কেন করেননি সেটা জানার দায়িত্ব আমার নয়, রিজভীর। কারণ বিষয়টা নিয়ে রিজভী গবেষণা করছে। কিন্তু নামহীন একজন সম্বন্ধে এভাবে বর্ণনা দিয়ে যাওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মেয়েটির একটি নাম প্রয়োজন। যেহেতু ঔপন্যাসিক রেবেকা মাহমুদ তার কোনো নাম দেননি, তাই আমরা তাকে ‘অ-নামিকা’ বলে ডাকতে পারি। অনামিকা নাচতে ভালোবাসে। নাচে তার ধ্যান-জ্ঞান সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ কথাটি ব্যবহার করলাম কারণ শিল্পের দ্বার থাকে অবারিত, তাই আলো আসে বাতাস খেলে। কিন্তু অনামিকার ক্ষেত্রে সে রকম হয় না। অন্যরকম হয়। এই অন্যরকমটা কখনো ধরা যায়নি। অনামিকার বাবা সরকারি চাকুরে। বদলির চাকুরি তাই দেশের বিভিন্ন জেলাতে তিনি থাকেন। সপ্তাহে দুইদিন থাকেন ঢাকায়। তার নাম মিজানুর রহমান। মিজান সাহেব ঢাকায় কম আসলেও তিনি তার সন্তানদের জন্য অনেক কিছু করে রেখে যাচ্ছেন। দুই মেয়ে তার। দুজনেই পড়ে দেশের নামকরা মেয়েদের স্কুলে। সন্তানদের তিনি ভালোবাসেন। তবে তার ভালোবাসার গাড়িটা কেবল টাকা রোজগারের রাস্তাতেই পার্ক করা থাকে। তাই অন্য রাস্তাগুলো তিনি চেনেন না। অনামিকা একাই বড় হয়েছে। এই একা বড় হবার একটা সুবিধা আছে এতে নিজের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। কিন্তু অসুবিধাও আছে, আর তা হলো একা বড় হওয়া একজন মানুষের প্রতিদিনই মনে হয় ‘আমার প্রতি কেউ দায়িত্ব পালন করছে না’। অনামিকারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাই তার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই সত্য, কিন্তু অপূর্ণতা আছে। অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা সাময়িক তা ভুলে থাকা যায়। কিন্তু অপূর্ণতার যন্ত্রণা ভয়ঙ্কর তা খামচে ধরে তাকে। এই অপূর্ণতা অনামিকাকে অসহ্য করে তুলেছে। তবে আধুনিক জীবনের সকল নাগরিক সুবিধাই তার আছে। নিজস্ব ঘর। ঘরভর্তি নানা প্রসাধনী। নিজস্ব কম্পিউটার। টেলিফোন আরো যা যা চাই। কেবল সঙ্গ নেই, কেবল সুখ নেই। অনামিকা মাঝে মাঝে ভাবে শহুরে নাগরিক হবার স্রোতে আমার সুখ কী ভেসে গেল? স্ট্যাটাসের সৌধে কী চাপা পড়ে গেল আমার সমস্ত অনুভ‚তি? ভাবনাগুলো কখনো প্রশ্ন, কখনো ভাবনা হয় কিন্তু ফুরোয় না। এই না ফুরোনোর অতি প্রাচীন এক দর্শনকে নিয়ে আমরা ক্রমাগত নাগরিক হয়ে উঠি। নাগরিক হবার যাতনায়, কামনায় আমরা মনুষ্যত্ব হারাচ্ছি। আমাদের বিবর্তন ঘটছে। বিবর্তিত হচ্ছি আমরা। বিবর্ধিত হচ্ছে আমাদের ভেতরের নিঃসঙ্গতা। আমরা সকলেই মানুষ থেকে নাগরিক হতে চাইছি। নাগরিক। মানুষ। তবুও কেবল নাগরিক হতে চাওয়া। সত্যিই সেলুকাস! চার. অনামিকার জীবনের শুরুটা অবশ্য এ রকম ছিল না। শুরুটা ছিল অন্যরকম। এ যেন একটি গল্প যার সূচনাতেই ধরা পড়ল এক বেখাপ্পা এলিজি। সবাই ভাবল এ জীবনেরই অংশ, কিন্তু কেউ মেনে নিতে পারল না। অনামিকা নিজেও মেনে নিতে পারেনি। কোনোদিন পারবেও না। পারবে না তার কারণ সে এখনো এ সত্যটির মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে না। কেবলই মনে হয় এ ক্ষণ তো আমার নয়; এ ক্ষণ তো অসুরের, দানবের। তাই ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো তার কাছে আনন্দ বয়ে আনে না শুধু দুঃখ বয়ে আনে নিষ্প্রভ জীবনের জন্য দুঃখের আরতি। কতই বা বয়স ছিল? সাড়ে চার কি পাঁচ? পুরো পরিবারের মাঝখানটাতে যেন আনন্দ হয়ে হেঁটে বেড়াত এই অনামিকা। হাসত, গাইত সবচেয়ে বড় কথা নাচ করত। পারিবারিক দৃশ্যপট তখনো তার সামনে পুরোপুরি উন্মোচিত নয়। কেবল জানে মা খুব আদর করেন তাকে। বাবা আসেন সপ্তাহে একবার। কখনো সময়ের অভাবে বাবা আসতে পারেননি এমন হয়নি অনামিকার জীবনে। ‘কাকে বেশি ভালোবাসো তুমি?’ এমন প্রশ্নের জবাবে অনামিকা সব সময়ই বলত ‘মা’। ঠিক। মাকেই তো সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সে কারণ মা-ও যে তার জন্যই ভালোবাসা তুলে রেখেছে বুকের তরঙ্গে। বাবা তো সপ্তাহে আসেন একবার। তা-ও এসেই কত কাজ! অনামিকা নিয়ে একটু সময় কাটাবার সময়ও তার হয় না। মাঝে মাঝে অনামিকা মনে করে বাবাকে জোর করে নিয়ে যাব। তারপর বাবা-ও যান। কিন্তু কেমন যেন সবকিছু। ফিকে আলো নেই, কেবলই অন্ধকার। পরিবার অনামিকাকে বড় করে তুলেছে। আরও পরিষ্কার করে খুলে বললে যতটুকু বড় হবার কথা, অনামিকা তার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে। কী আশ্চর্য এই পারিবারিক বন্ধন! কখনো কোনো কোনো পরিবার মানুষকে একেবারেই চোখের আড়াল করে না ফলে যেটুকু বয়সে তার যে রাস্তায় যাবার কথা তার কোনোটাই হয় না। সময়ের তুলনায় সে হয়ে থাকে ছোট, পরিবারের ওপর নির্ভরশীল। আবার অনামিকার পরিবারের দিকেই যদি তাকাই কেমন যেন অদ্ভুত আঁধার এক। পুরো পরিবারই যেন মহাশ্মশান। লোকজন আছে বড় বোন, মা, খালা, তাছাড়া তিনটে গৃহপরিচারিকা। কিন্তু তবুও শূন্যতা। কারণ এই সবাই সবার মতো। কেউ কারো জন্য নয়। সবাই নিজস্ব কারো মধ্যে নেই অন্যের প্রতি এতটুকু দায়িত্ব পালনের সময়। এ শূন্যতা থেকেও অনামিকার বড় বোন পূর্ণতা খুঁজে নিয়েছে। অনামিকাও পারত কিন্তু পারেনি। এ কি অনামিকার ব্যর্থতা? অনামিকা আর তার বড় বোনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য বেশি নয়। তবুও ওর বড় বোন যা পেরেছে সে তা পারছে না। সে যেন কোথায় গিয়ে আটকে আছে যেন বদ্ধ জলাশয়, স্রোত নেই কেবলই কচুরিপানার ছড়াছড়ি। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে রিজভীর খটকা লাগে। সাধারণ একটি বিষয় মনস্তাত্তি¡ক বিচারে এখানে যেটুকু নির্যাস আছে তা করুণ বটে কিন্তু এ সময়ের বিচারে তা কিছুই নয়। আজ থেকে এত বছর আগে একজন বালিকা তার সংসারে থেকে একা আর এখন? এখন তো সংসারেই সে থাকে না। অনামিকার বয়সী আজকের মেয়েরা অনেক সামনে এগিয়েছে। এই বয়সেই তাদের মধ্যে নারীসুলভ অপ্রাপ্তি দেখা দেয় শিশুসুলভ নয়। চট করে ম্যাগাজিনটা বন্ধ করল রিজভী। মনের মধ্যে আসা কথাগুলো গুছিয়ে লিখতে লাগল তার নোটবুকে। কিন্তু লেখাগুলো ঠিক গবেষণার মতো হলো না যা হলো, তার কিছুটা স্বাধীন মতামত, আর বাকিটা নিবেদিত পঙ্ক্তিমালার মতো। শখ করে রিজভী তার নোটবুকটার নাম রেখেছিল ‘গবেষকের ডায়রি’। এখন মনে হচ্ছে জগতে শখ বিষয়টাই অ্যাবস্ট্রাক্ট। ‘জগত’ কথাটি মনে হতেই আবার উপন্যাসে মন দিল রিজভী। উপন্যাসটি রেবেকা মাহমুদের লেখা। ভ‚মিকায় তিনি লিখেছিলেন উপন্যাসের প্লটটি বেশ হালকা। পাঁচ. সত্তা? নাকি জীবন? ঔপন্যাসিক কাকে নিয়ে কাজ করেন? কে বেশি প্রাধান্য পায় ঔপন্যাসিকের কাছে? যদি জীবন নিয়েই তিনি কাজ করতেন তাহলে অনেক ভেতরের খবর আমরা পেতাম না। কারণ ওগুলো জীবন নয় জীবনের ছায়াচিত্র মাত্র। কিন্তু সত্তা নিয়ে যখন লেখা হয় তখন লেখার ভাষায় সে সত্তা জীবন্ত হয়ে ওঠে। সত্তার মূল ব্যক্তিতে আর জীবনের মূল সত্তায়। কেবল এইটুকু ধারণাতেও যদি চোখ রাখি তবুও অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তাই সাহিত্যে জীবন যেভাবে উঠে আসে সেভাবেই উঠে আসে জীবনের দর্শন। তাই এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা যতটা আবশ্যক বর্ণনার শতভাগ শুদ্ধতা ততটা আবশ্যক নয়। কারণ দর্শনের ছায়ায় যে ভাষাচিত্র প্রকাশ পায় এর ঠিক বেঠিকের সঠিক হিসেব বের করা সম্ভব নয়। এ বিষয়গুলো রেবেকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। মনস্তাত্তি¡ক গুরুত্বকে ধারণ করে গবেষণা করা গেলেও সাহিত্য রচনা সৃষ্টি সম্ভব নয় রেবেকা এমনই মনে করেন। আর এ কারণেই যখন তিনি লিখতে বসেন তখন উলোটপালট হয়ে যায় সবকিছু। কেবল এক অসম ঘোর তাকে টেনে নিয়ে যায় জীবনের ভেতর থেকে ভেতরতর জগতে। লেখার বিষয় ছাপিয়ে উঠে আসে এক টুকুরো বাসনা। কিন্তু কীসের বাসনা? প্রশ্নটি মনে হতেই হাত কেঁপে ওঠে রেবেকার। ‘বাসনা’ শব্দটি যেন বাসুকির মতো তার গলা জড়িয়ে আছে। তার আহত মনের মধ্যে ছোবল মেরে এই বাসনা যেন খুঁজে নিতে চায় তার শেষ আশ্রয়স্থলটুকু। কিন্তু কোথায় তাকে আশ্রয় দেবে রেবেকা? তাকে তো দুহাতে তুলে নিয়ে বসাবার জায়গা নেই। রেবেকার যে সমস্তটুকুতে জুড়ে আছে এক সম্মোহিত হৃদয়। আলো-অন্ধকার যে হৃদয়ের কাছে বিলীন প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। তাই যেভাবে উপন্যাসটি এগিয়ে যাবার কথা ছিল সেভাবে আগায়নি। খাপ ছেড়েছে অনেকখানেই আবার কোথাও কোথাও খাপের বাহুল্য লক্ষ করা যায়। রেবেকা যে বিষয়গুলো জানত না তাতেই বরং ভালো হয়েছে। কারণ জানলে নিঃসন্দেহে এমন একটি উপন্যাস তার পক্ষে রচনা করা সম্ভব হতো না। আবার যিনি জানতেন তিনি কেবল বলতে পারতেন, লিখতে পারতেন না। তিনি গালিব। যখন ঘোরের মধ্যে থেকে রেবেকা তার লেখাগুলো লিখে রাখত বজ্রাহতের মতো শব্দকে প্রয়োগ করত যেখানে-সেখানে তখন গালিব তা সাজিয়ে দিত। হয়ত এমন হয়েছে কখনো মাত্র দু পৃষ্ঠা লেখাতে কয়েকটি শব্দ বদলে সেখানে দেয়া হয়েছে উপমা। মাঝে মাঝে রেবেকা মজা করে বলত গালিব, তোমার প্রকাশনা থেকে এ বইটি বের হবে তাই এত যত্ন? গালিব হেসে জবাব দিত আমার প্রকাশনা থেকে তো আরও বই বের হয়, কত স্বনামধন্য লেখকের বইও বের হয় কই অত যত্ন নেই না তো। যত্ন আসলে সৃষ্টিতে না স্রষ্টাতে। কথাগুলো শুনে রেবেকা কেমন যেন হয়ে যেত। না থাকত হাসি, না বেদনা। বিষয়গুলো বুঝতো গালিব। তাই রেবেকার মনোভাব পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকেও বদলে নিত। কখনো নিয়ে যেত কোন দূর এক অন্ধকার বিদর্ভ সময়ে। অন্ধকার সময়। সে-ই সময়। সময়টা কি ভুলে যায় রেবেকা? লেখার টেবিলে বসে আজ নতুন আরেকটি অধ্যায় লিখছে। উপন্যাসের জন্য এভাবে অধ্যায়ে অধ্যায়ে সাজাচ্ছে রেবেকা তার লেখা। ইংরেজি ভাষায় তার দক্ষতা অসামান্য তবে মাঝে মাঝে তার লেখা তার দক্ষতাকেও ছাড়িয়ে যায়। জগতে কত কিছু কত মুহূর্তকে ছাপিয়ে ওঠে। কত আনন্দ বেদনাকে মানুষ জয় করে। কেবল রেবেকা পারে না তার সেই সময়টাকে জয় করতে। মধ্যরাত পেরোতে আর কত বাকি? মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। এখন কেবল একটি ভোরের অপেক্ষা। ভোর। রেবেকা কতকাল ভোর দেখে না। ছয়. ভোরবেলাতেই ফোনটা এসেছিল। খুব চেনা রিংটোন। অনামিকাই সেট করে দিয়েছিল তার মায়ের মোবাইলে। কিন্তু এত ভোরে কে ফোন করল? অনামিকার ঘরটি সবার কোণায়। সেখান থেকে সবকিছু সব সময় শোনা যায় বিষয়টা সে রকম নয়। তবে এখন ভোর প্রায়। তা-ও শীতের ভোর। এমন ভোরে হঠাৎ কে ফোন করল? এ বিষয়গুলোতে অনামিকার আগ্রহ তেমন নেই। কখনোই ছিল না। আজও তার ইচ্ছে করছে না উঠে গিয়ে দেখে কে ফোন করেছে। তাছাড়া ফোনটা তো এখন আর বাজছে না। বন্ধ হয়ে গেছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অনামিকা উঠে বসে বিছানাতে। কম্বলটা সরিয়ে নামতে গিয়েও নামতে পারল না। এত ঠাণ্ড! খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল অনামিকা। স্যান্ডেলটা পরে হেঁটে আসছে সে। দরজাটা সামান্য সরিয়ে নিল। মা-কে দেখা যাচ্ছে। ওই তো। হেঁটে যাচ্ছেন নিজের ঘরের দিকে। পরনে একটা নীল ম্যাক্সি। মা ম্যাক্সিটাই বেশি পরেন। মাকে আর দেখা যাচ্ছে না এখন। মা শুয়ে পড়েছে তার বিছানায়। তার কণ্ঠস্বর এখন আর শোনা যায় না। অনামিকা বিছানায় ফিরে এল। কম্বলটা আবার টেনে নিল শরীরে। চোখের পাতার ঘুম নেমে এল পরীদের মতো করে। দুপুর বারোটা। সাড়ে বারোটা। একটা। ঘড়ির কাঁটায় দেড়টা পেরিয়ে গেলে মিসেস ফাহিমা রহমান ঘুম থেকে ওঠেন। ঘুমের ঘোরেই মোবাইলটা খুলে দেখেন চারটে এসএমএস। একে একে পড়লেন এসএমএসগুলো। তারপর একটা ছোট্ট হাসি হাসলেন। আবার কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়তে চাইলেন কিন্তু ঘুমুলেন না। উঠে, নাস্তা করে যখন তিনি অনামিকার ঘরে গেলেন অনামিকা তখন ম্যাগাজিনে ডুব দিয়েছে। কম্পিউটার আর ম্যাগাজিন এ দুইয়ে অনামিকার সারাটা সময় কাটে। আর কাটে নাচের ক্লাসে। হঠাৎ মাকে দেখে অনামিকা বলল মাম্মি। কাল কার সঙ্গে কথা বলছিলে? মিসেস ফাহিমা রহমান ফিরে যাচ্ছিলেন। একবার পেছনে ফিরে চাইলেন। সামান্য সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। না যা ভেবেছিলেন, তা নয়। অনামিকা নিছকই কৌত‚হলবশত জানতে চেয়েছে। খানিক ভেবে বললেন তোর এক মামা। বিদেশে থাকে তো তাই রাতে ফোন করে। অতকিছু অনামিকা শুনতে চায়নি। শোনার প্রয়োজনও নাই। তাই প্রয়োজন ফুরানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল আমার আজ নাচের ক্লাস আছে। ড্রাইভারকে ফ্রি থাকতে বল। ‘কখন? আমি তো আজ শপিংয়ে যাব ভাবলাম বলে খানিক চুপ করে কী যেন ভাবলেন মিসেস রহমান। তারপর বললেন ওকে। তুমি গাড়ি নিয়ে যাও। আমি কাল বের হব।’ কিন্তু কথাটা অনামিকার পছন্দ হয়নি। মুখের সামনে থেকে ম্যাগাজিনটা সরিয়ে বলল বাবাকে কতদিন বলতে হবে আরেকটা গাড়ি কিনতে। একটা গাড়ি নিয়ে ফকিন্নির মতো টানাটানি করতে হয়। কথাটা তোমার বাবাকে বল। কাজ হবে। অনামিকা যে ম্যাগাজিনটা পড়ছে তার প্রচ্ছদটা রুচিশীল নয়। বিষয়টি মিসেস রহমান খেয়াল করলেন কিন্তু কিছু বললেন না। গাড়ি নিয়ে অনামিকা বের হয়ে গেল নাচের ক্লাসে। সেখানে যে সময়টুকু থাকে তাতে নাচের চর্চা কতটা হয় জানি না তবে জানা-শোনা হয়। একের সঙ্গে অন্যের বেশ বোঝাপড়া হয়। অনামিকার সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু তার কাছে লেখাপড়া ভালো লাগে না এটাই মুখ্য। মাঝে মাঝে অনেক গৌণ বিষয় মুখ্য বিষয়ের চেয়েও মুখ্য হয়ে ওঠে। এটা সম্ভবত জীবনেরই নিয়ম। জীবনের প্রসঙ্গ আসতেই রিজভীর মনে হলো নাহ, মাস্টার্সটা করা উচিত ছিল। এভাবে শূন্যে ভাসিয়ে দেয়া যায় না জীবন। জীবন কী শূন্যে ভাসে? পদার্থবিজ্ঞানে এর কী কোনো ব্যাখ্যা আছে? সাত. অনামিকার মনে হাজারটা প্রশ্ন। এমন কি আসলেই ঘটছে? নাকি পুরোটাই তার ধারণা? সংশয় কখনো স্থায়ী হয় না, তবে অস্থায়ীও নয় বিষয়টি। সংশয় যেন স্থায়ী হয়েও অস্থায়ী আবার অস্থায়িত্বের নিয়ম মেনে স্থায়ী। এ যেন এক আপদ। সেদিনের টেলিফোনটির কথা অনামিকার মনে আসেনি। কিন্তু এখন বেশ মনে হচ্ছে। বারবারই মনের দরজায় একটা খটকা যেন কড়া নাড়ছে। খটকার চেয়ে কৌত‚হল বলা ভালো। তাহলে কে এই লোকটা? এমন আশ্চর্য কেন তার ব্যবহার? তবুও সব কিছু শান্তই ছিল, তবে শান্তিতে ছিল না কোনো কিছুই। শান্ত আর শান্তি এক বিষয় নয়। অনামিকা অনেকভাবে ভাবে কিন্তুর ভাবনার জট খোলে না। গাড়িটা জ্যামের মধ্যে অনেকক্ষণ আটকে আছে। জীবনের সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয় হলো জ্যামের মধ্যে বসে থাকা। অনামিকার অবশ্য তা মনে হয় না। বরং মনে হয় জ্যামের মধ্যে বসে থেকে যদি ক্লাসের সময়টা পার করা যায় তাহলে মন্দ কি? তবে এখন এ ভাবনাটি নয় কারণ ক্লাস শেষ হলো। বাসায় ফোন করা হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। বিরক্তিতে তার সারা গা জ্বলে যাচ্ছে। অনামিকা যখন বাড়ি পৌঁছল সময় তখন রাত আটটা। বাড়ি এসেও কয়েকবার ডোরবেল বাজাতে হলো। অনামিকাদের ডোরবেলটা অন্যরকম। সুইচ টিপলেই অদ্ভুত ধরনের গান বাজতে থাকে। অনামিকা নিজেই পছন্দ করে ডোরবেলটা আনিয়েছে। স্রষ্টা মনোযোগের সঙ্গে লিখলেও, তার সৃষ্টি মনোযোগী নয়। বিষয়টা রিজভীর খুব ভালো লাগে। ফটিকের মতো একটি অমনোযোগী চরিত্র সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ কী একটু বেশি মনোযোগী ছিলেন না? ছিলেন হয়তো! তাই বলে গেছেন সহজ কথা যায় না বলা সহজে। সহজ কোনো কিছুই সহজ নয়, বরং অনেক কঠিন। কিন্তু কতটা কঠিন? জীবন কী কখনো একমুখী? কিংবা মাত্র কয়েক ধাপেই জীবনের সব রসায়নের শেষ? এই কী জীবন? এত সাদামাটা, এত নিরাভরণ? এর কী আর কোনো অর্থই নেই কেবল বেঁচে থাকা ছাড়া? শুধু বেঁচে থাকাই যদি জীবন হয় তাহলে সংসারেরই বা কী দরকার? ভাবতে গেলেই ভাবনা এসে ভর করে মিসেস ফাহিমা রহমানের মনে। এত ভাবতে তিনি চান না। তার দিক থেকেও তো অনেক প্রশ্ন আছে; কই কেউ তো উত্তর দেয় না। কারও তো মাথাব্যথা নেই তা নিয়ে। জীবন তো কেবল বিলাসদ্রব্যের দাস নয় যে সবকিছুকে ওই বিলাসের কাছে বিকিয়ে দিতে হবে। নিজের বলেও তো কিছু আছে, কেবল সবার সবকিছু হয়ে থাকার মধ্যে হয়ত সান্ত্বনা আছে, কিন্তু সুখ নেই। ‘সুখ’ শব্দটি উচ্চারণ করেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিসেস রহমান। দীর্ঘশ্বাসে তার শরীরটা সামান্য দুলে গেল। বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন মিসেস রহমান। সামনেই ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়না। আয়নাতে নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন খুব ভালো করে দেখলেন আবার। খুব ভালো করে। দু’হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিলেন শরীরের দু’পাশে। তারপর উঠে বসলেন বিছানায়। মিসেস রহমানকে যেন ঠিক চেনা যাচ্ছে না আয়নাতে। বয়সের ছাপ যে পড়েনি তা নয় শরীরে মেদেরও সামান্য উপস্থিতি তবুও যেন কোথায় এক অসামান্য, অশান্ত অবাধ্যতা। মুহূর্তে চমকে উঠলেন মিসেস রহমান। উঠে দাঁড়ালেন। আয়নার সামনে। কী আশ্চর্য একটি শরীর। সাদা ম্যাক্সিতে যেন আরও আকর্ষণীয়, আরও আবেদনময়ী হয়ে উঠেছেন। নিজেকে নিজেরই হিংসা হচ্ছে। তারপর আয়নার সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেন নিজেকে। নাহ। ভাবলেই ভাবনা আসে। জীবন কোনো নিয়মের প্রতিযোগিতা নয় যে সবকিছু মানতে হবে। মোবাইলটা ড্রেসিং টেবিলের ওপরেই ছিল। হাতে নিয়েই একটা ফোন করলেন। ওপাশ থেকে ‘হ্যালো’ ভেসে এল। এ পাশ থেকে মিসেস রহমানের কণ্ঠ। ওপাশ থেকে বলছে কথা আর এপাশ থেকে মিসেস রহমানের নিঃশ্বাস। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা কবে কোথায় কার বারণ শুনেছে? সময়। সময়। সময়। যেন মিসেস রহমানের নিজস্ব আবিষ্কার এ এক অন্য রকম সময়। বাতি নিভিয়ে দিলেন মিসেস রহমান। অন্ধকার। ঘড়ির কাঁটার শব্দই কেবল শোনা যায়। কতদূর পথ এগুলো ঘড়ির কাঁটা? সময়ের হিসেব নেই তবুও সময় এগিয়ে যায়। ‘সময় এগিয়ে যায়? নাকি আমরা পিছিয়ে যাই? যত্তোসব’ নিজেই ঘোরের মধ্যে বলে বসল রিজভী। সে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী। সাহিত্যে ভাষার ব্যবহার তার বেশ জানা আছে। কেবল সাহিত্য যদি বিচার করি তবুও ইংরেজির চেয়ে বাঙলা সাহিত্য অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী ভাষার ভেতরগত আবেদন সে কথাই জানান দেয়। বিষয়টি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রিজভীর তর্ক হতো প্রায়ই। বিশ্ব সাহিত্য যে ধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত সেগুলো হয়তো অনেক বেশি ব্রিটিশমুখী, কিন্তু বাঙলা ভাষা সেই ধারাকে একেবারেই আপন করে রেখেছে, করে তুলেছে একেবারেই নিজস্ব। কিন্তু এই সহজ কথাটা সহজে সবাই বোঝে না। সবাই এখন ইংরেজি মাধ্যমকেই মনে করে ‘আপনার মাধ্যম’। কিন্তু কানার হাটবাজারে সহজ কথা সহজে বোঝানো যায় না। এমনকি রেবেকা মাহমুদও বুঝতে পারেননি। তিনিও ইংরেজিতেই লিখেছেন তার উপন্যাসখানা। রিজভীর মনে হলো কত জায়গায় যেন কত আবেগ মারা পড়ে গেল কেবল সঠিক ভাষার প্রয়োগে। আচ্ছা, লেখকের কী দরকার ছিল ইংরেজিতে উপন্যাসখানা লেখার? আট. এখন বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেছে অনামিকার কাছে। সে ভাবতেও পারেনি এমন এক ধরনের ঘটনার মুখোমুখি তাকে হতে হবে। সে যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেল। হঠাৎ যেন আবিষ্কার করল তার আশেপাশে আর কেউ নেই। পুরো পৃথিবীতে অনামিকা একেবারেই একা তার কোনো বন্ধু নেই, কোনো অবলম্বন নেই। মানুষের প্রতি সামান্য বিশ্বাস রাখার মতো শক্তিটুকুও নেই অনামিকার। জীবন যেন তার সাথে এক বিষণ্ণ রূপকথার খেলায় মেতে উঠেছে। তাকে ক্লান্ত করছে, তাকে ভেঙে দিচ্ছে, তাকে জোর করে টেনে আনছে বাস্তবতার রঙ্গমঞ্চে। এখানে সবটুকুই ভয়ঙ্কর। কেবল আলোহীন এক বিরাট মঞ্চ যেখানে অনুভূতি-বিশ্বাস কোনো কিছুর কোনো মূল্য নেই। ম্যাগাজিনটা ছুড়ে ফেলে দিল বিছানায়। একা। একলা অনামিকা। তার কেউ নেই। পুরো ঘর শূন্য কেবল সে একা বিরাজমান, চারপাশ অন্ধকার। জীবন এত বিষাদময়? এত ভয়ানক? কই? আগে তো কখনো সেটা বোঝেনি অনামিকা। এত স্বপ্ন, এত মধুরতা, এত ভালোবাসা সব কেবলই ওই এতটুকুর জন্যই। ভাবতে পারছে না সে। কথাগুলো বারবার কানের কাছে ভাসছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই দৃশ্য। নাহ। এটা কোনো জীবন নয় জীবনের কঙ্কালমাত্র। উঠে দাঁড়ায় অনামিকা। জানালা দিয়ে তখন রাস্তা দেখা যায়। রাতের রাস্তা। সোডিয়ামের বাতিগুলো জ্বলছে। রাত এখন কয়টা বাজে? নিজের মনেই নিজে প্রশ্ন করে অনামিকা। না, সময় জানার কোনো প্রয়োজন নেই তার। সে এখন সময়ের অনেক ঊর্ধ্বে। সময় তার কাছে এখন কেবল কয়েকখণ্ড মাংসপিণ্ড। রাস্তা দিয়ে চলছে কয়েকটি গাড়ি। একটা কুকুর ডেকে চলছে অবিরত। কতক্ষণ ডাকবে? কুকুর কী জানে এ বিশ্বচরাচরে সে-ও সুখী অনামিকার চেয়ে। অন্ধকার কালো আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইল অনামিকা। জানালা দিয়ে যতদূর আকাশ দেখা যায় ততটুকু। আকাশ। তুমিও কালো। তোমার মধ্যেও আছে অন্ধকার। কিন্তু কী আশ্চর্য তোমার দিনের বেলার অভিনয়। নিঝঝুম রাত। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা জানা নেই কিন্তু সবকিছু চুপচাপ। কেবল অনামিকা জেগে আছে। অনামিকা। ঔপন্যাসিক রেবেকা তার ‘কনফ্লুয়েন্স?’ উপন্যাসটিতে মেয়েটির কোনো নাম দেননি। অনামিকাদের কোনো নাম হয় না! অনামিকা ভাঙতে থাকে। ভেঙে যেতে থাকে একে একে তার সবকিছু। অনামিকা আবার রাস্তার দিকে তাকায়। কালো অন্ধকার। কুকুর ডাকছে। মাঝে মাঝে একটা দুইটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলছে। জানালা থেকে সরে এল অনামিকা। ঘৃণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে। ঘৃণা! কীসের ঘৃণা! কার বিরুদ্ধে ঘৃণা! প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যায়। আজ কোনো উত্তরের অপেক্ষা করে নেই তার হৃদয়। আজ সে কেবল দ্রুতগামী রথের মতো এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এখানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই তার অস্তিত্ব নিয়ে এখানে কেউ চিন্তিত নয়। অনামিকা যখন বিছানায় গেল তখন ভোর খুব কাছাকাছি। এখন অনেকটাই স্বাভাবিক অনামিকা। মধ্যরাতের মতো অস্থিরতাটা আর নেই। নেই বিষণ্ণতার ছাপ। অনামিকা কেবল একটু শান্তি চায়। একটু শান্তি। এখন ঘুমানোর খুব দরকার তার। খুব দরকার। দুটো চোখের পাতা এক করতেই ঘুম নেমে এল। ঘুম। নির্বিঘ্ন এক সাধনার নাম। ঘুমের জগত আলোহীন এক সময়। দীর্ঘ সময়। দীর্ঘতর। কখনো দীর্ঘতম। এরপর? এরপর আর কোনো ইতি রেখা নেই। রেবেকা চমকে উঠল? হঠাৎ যখন সম্বিৎ ফিরে পেল তখন হাত কাঁপছে। কী করতে কী করবে, তার কোনো হদিসই পেল না সে। কেবল উপলব্ধি করল চোখের কোণে জল জমেছে। অশ্রু। রেবেকার প্রিয় বন্ধু। চোখ মুছে রেবেকা হেলান দিল চেয়ারে। উপন্যাসের নাম না দেয়া মেয়েটি তখন ঘুমুচ্ছে। ক্লান্তিতে শ্রান্তিতে এক বেঘোরের ঘুম। মেয়েটির নাম দেয়া হয়নি। তাই তার নাম- অনামিকা। অনামিকা বড় হয়ে গেছে। আজ থেকে জীবনের অর্থ সে নিজেই খুঁজে বের করবে। নিজেই মুখোমুখি দাঁড়াবে বারবার। সময়ের অথবা বাস্তবতার। আজ থেকে নিজেই খুঁজে বের করবে জীবনের প্রতীকী মানে। নয়. প্রতীকী মানে? চমকে উঠে রেবেকা। এ কী লিখছে সে? জীবনকে সে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে? অন্ধকার আর আলোর মাঝে এতটুকু অভিনয় ঠাঁই পাবার নয়। অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝে কী কোনো অমোঘ সূত্রকে নিয়মের বেদিতলে উৎসর্গ করা যায়? রেবেকা লিখে চলে। এ কীসের কাব্য আজ অনির্বাণ লিখে চলছে রেবেকা? কীসের কাব্য? এখানে জীবনের মানে, মৃত্যুর মানে আলাদা করে দাঁড়াচ্ছে কি? রেবেকার মাথায় ঢুকে না। কেবল একখণ্ড জীবন যেন বয়ে চলে ধীরে বহে মেঘনার মতো। চাইলেও; আবার না চাইলেও। রেবেকা এর অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না। মাঝে মাঝে মনে হয় তার সৃষ্টি যেন তার বাঁধানো পুকুর ঘাটে আর স্নান করতে আসে না। কেবল ফাঁকি দিয়ে চলে যায় অনত্র। অন্য কোনোখানে। এ যেন নিজের সঙ্গেই নিজের সৃষ্টির যুদ্ধ। এ কেমন যুদ্ধ? কোনো হার জিৎ নেই কেবল আঘাত করেই তৃপ্ত। এ যুদ্ধ তো কঠিন এবং অমানবিক। নিজের তৈরি চরিত্রটি নিজের কাছেই বড় অচেনা ঠেকে। মনে হয় আজ যেন চরিত্রই রেবেকাকে টেনে আনছে নিয়তির দিকে। এখন যে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। পরাধীন। না আর কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে না রেবেকা। ইজি চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে বসে কিছুক্ষণ ভাবে। আজ অনেক দিন পর তার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে। ভেতরের সত্তাটা যেন টেনেহিঁচড়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে একটি সিগারেটের কাছে। যেন একবার, মাত্র একটা টানেই উড়ে যেত সমস্ত পরাধীনতার গ্লানি। কিন্তু পারছে না। হঠাৎ রেবেকার ভেতরটা হু হু করে উঠল। এতটুকু ভালোবাসার জন্য কেমন কাতর হয়ে উঠল তার অন্তরাত্মা। মনে পড়ল গালিবকে। গালিব কি ভালোবাসে রেবেকাকে? গালিব চিরকাল প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেছে। যতবারই এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে, ততবারই সে পাল্টা প্রশ্ন করেছে তোর কী মনে হয়? রেবেকার কিছুই মনে হয়নি। কারণ গালিবের কাছ থেকে খুব সচেতনভাবে পাওয়া একেকটি উত্তর, একেকটি ধারণা থেকে আজ পর্যন্ত রেবেকা বুঝে উঠতে পারেনি গালিব তাকে ভালোবাসে কিনা। কিন্তু রেবেকা জানে জীবন একবার সীমানা পেরিয়ে গেলে আর তাকে ধরে রাখা যায় না। ক্রমশই জীবন তখন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো চলতে থাকে। কেবল চলতে থাকে। চলতেই থাকে। অনামিকারও এভাবেই চলছে। এখন আর শব্দ নিয়ে ভাবে না অনামিকা। ভেবে কী হবে? কিংবা কী হয়েছে? শব্দ থাক অভিধানের আলমারিতে। ওসবে আর কাজ নেই তার। তাই দেখা যায় আগে বেশ খোলামেলা সম্পর্ক থাকলেও, সবার সামনে সব কথা বলত না। কিন্তু এখন বলে। এখন সব শব্দই তার কাছে এক মনে হয়। সব শব্দেই আছে যৌনতার খেলা, শরীর নিয়ে খেলার ইঙ্গিত। অনামিকার বন্ধু মহলটি বিচিত্র। এখানে সবাই আসে হয় মৌমাছি হতে, নয় মধু হতে। এখানে বন্ধু নেই, কেবল বন্ধুত্ব নামটুকু আছে। তাই দেখা যায় সবাই সবাইকে বন্ধু বললেও এখানে অনেক কিছুই ঘটে যা ঘটার নয়। এই কিছুদিন আগেই, এক বেসরকারি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষকের সাথে টেলিফোনে পরিচিত হয়ে তাকে বহুদূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল সান্টা। ওর নামটা কেউ শান্তা ভেবে ভুল করবেন না কারণ নামটা সান্টা-ই এবং বাবা-মা সচেতনভাবে শখ করেই নামটা রেখেছেন। সান্টা এই গ্রপেই বসে আড্ডা দেয়। বয়সে অনামিকার চেয়ে বড় এবং অনামিকার চেয়ে আরও বেশি আবেদনময়ী। ওই বেসরকারি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে সে কী কী করেছে, কতবার বিছানায় গিয়েছে তার সব গল্পই অনামিকা ও তার বন্ধুরা জানে। অনেকে ঈর্ষাও করে, অনেকে কটূক্তি করে। অনামিকাও বদলে গেছে। বস্তুত এ জীবনে সে খুব মজা পাচ্ছে। হই-হুল্লোড় করে ঘুরে বেড়ান। আজ এখানে তো কাল ওখানে এভাবে দিন চলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর মধ্যে অনামিকাও ডুব দিয়েছে কয়েকবার, তবে তা গভীর জলে নয়; শান্ত জলে, ঘাটের কাছে, কিনারা ছুঁয়ে। পরে অবশ্য ভালো লাগেনি। আসলে ভালোলাগার মতো কিছু ছিল না। একবার একটু দেখতে ইচ্ছে করছিল এই যা। কিন্তু আবীর একটু বাড়াবাড়িই করেছিল। তাছাড়া আবীরের অ্যাপিয়ারেন্সটা ভালো লাগেনি অনামিকার। অনামিকা একবার দেখতে চেয়েছিল, ব্যাস ওটুকুই। কিন্তু আবীর অনেকদূর যেতে চায়। এটা নিয়েই একবার কথা হয়েছিল সান্টার সঙ্গে। সান্টাও একই কথা বললো। আবীর স্টেজ বোঝে না। সান্টার সঙ্গেও আবীরের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ওটুকুই। নির্জনে, বাড়ির সিঁড়ির গোড়ায় কিংবা সন্ধ্যার পরে ধানমন্ডি লেকের অন্ধকারে ওই ওটুকুই। এর বেশি কিছু তো প্রশ্নই ওঠে না। ‘অন্তত আবীরের সঙ্গে না রাবিশ’- সেদিন এই কথাগুলো বলে খুব হাসাহাসি হয়েছিল অনামিকা আর সান্টার মধ্যে। সেই সঙ্গে ছিল কেএফসি থেকে কেনা চিকেন। সান্টা অবশ্য অন্য কি যেন একটা খায়। অনামিকার সেটার দিকে তেমন কোনো আকর্ষণ নেই। সান্টার কথা শুনেই ওইদিন আবীরকে এতদূর এনেছিল অনামিকা। জাস্ট ফর ফিল নাথিং মোর। কিন্তু আবীর আহাম্মক। অবশ্য এর জন্য তাকে অনেক খেসারতও দিতে হয়েছে। আবীর বারবার ফোন করে নানা রকম করেছে। সান্টাকেও করেছিল। তাছাড়া সান্টাও বলেছিল সাবধানে থাকতে। অনামিকা সাবধানেই ছিল। দশ. তবুও নানা ঘটনার সঙ্গে অনামিকা নিজেকে জড়িয়ে সুখ পায়। আজকাল কেমন যেন মনে হচ্ছে নিজেকে খানিক খেয়ালি করে দেখলে মন্দ হয় না। বিজন স্যারকে নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। তিনি অহেতুক কথা বলেন, তার চোখের দোষ কারণ তার চাহনিতে আছে হাজার রকমের ইঙ্গিত, তার বলায় দোষ কেননা তার কথাগুলো সরাসরি অশ্লীল না হলেও ঠিক শ্লীলতার মধ্যেও পড়ে না। তবুও বিজন স্যারের অনেক ভক্ত। তিনি নাচেন এবং নাচান। কথাগুলো শুনতে খুব ভালোলাগে অনামিকার। অনামিকাও বলেছে অনেকবার। আমি নাচতেও জানি, নাচাতেও জানি। এই কথা বলে অনামিকা সুখ পেত। মনে হতো বিজন স্যার না থাকলে অহঙ্কার করার মতো জীবনের এত বড় বাক্যটা শেখাই হতো না। এমন একটা বাক্য বলার সাথে সাথে অনুভূতি যে কোথায় চলে যায় অনামিকা ভাবতেও পারে না। সেদিন একাডেমির সামনের গেটে দাঁড়িয়ে অনামিকা কথা বলছিল স্যারের সঙ্গে। কত রকমের কথা। নাচের প্রশিক্ষণটা আরও বাড়াতে হবে। যে রকম হচ্ছে তাতে তুষ্ট থাকলেই চলবে না। কিন্তু সব কথার মাঝে একটা কথা অনামিকার মনের ভেতরে একেবারে গেঁথে গিয়েছিল। জীবনের পুরো ছন্দটা যেন ওই একটি কথার ভেতরে লুকিয়ে আছে। এ যেন এক অসামান্য বাক্যবান। তাছাড়া বলার ধরনটাও দেখতে হবে। বিজন স্যার কথা বলতে বলতে তার বাঁ হাতটা রাখলেন অনামিকার কাঁধের উপরে। না এ এমন কোনো বিষয় নয়। এরকম অনামিকার জীবনে প্রতিদিনই ঘটে। অনামিকার ঘাড়ে হাত দেয়াটা তাই বিশেষ কিছু নয়। তবুও অনামিকার সমস্ত শরীরে হঠাৎ যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। এমন হলো কেন? কেন হলো? কোনো উত্তর পেল না। কেবল ভালোলাগাটুকু ছড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরে। স্যার কিন্তু হেঁটেই চলছেন। সামনে। পুরোনো অডিটোরিয়াম ভবনটার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলেন স্যার তোমার নাচের মুভমেন্ট ভালো। কিন্তু সেটা তো আর ক্লাসের বাইরে পাওয়া যায় না। একটু চমকে উঠল অনামিকা। ‘শোনো, তুমি যেভাবে হাঁট তাতে ফ্যাশনটা হয়ত বজায় থাকে কিন্তু আর্টটা ফানুস হয়ে যায়’ বলেই একবার তাকালেন অনামিকার দিকে। অনামিকাও তাকাল স্যারের দিকে। স্যার কী বললেন? সে তো বুঝতে পারেনি। স্যারের এতো বড় শক্ত কথা কী করে বুঝবে অনামিকা। কিন্তু বিজন স্যার তখনও তাকিয়েছিলেন অনামিকার দিকে। হালকা গোলাপি রঙের একটা ফতুয়ার সঙ্গে আকাশি রঙের জিন্স। অনামিকাকে খুব সুন্দর লাগল বিজন স্যারের কাছে। স্যারের একটানা চেয়ে থাকা দেখে প্রথমটায় খানিক অবাক হলো অনামিকা। তারপর আর কোনো ইতস্তত হয়নি। এরপর বিজন স্যার যখনই ক্লাসে আসেন তখনই অনামিকাকে তিনি আলাদা গুরুত্ব দেন। বিষয়টি অনামিকারও ভালো লাগে। একজন মানুষ, তিনি খুব প্রভাবশালী শিক্ষক। তিনি দেখতে সুন্দর, সবচেয়ে বড় কথা তিনি আলোচিত তার ক্লাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পেরে অনামিকা সুখী। যদিও ক্লাসের অন্যান্যরা সুখী নয়। তাদের কাছে বিষয়টি বাড়াবাড়ি রকমের মনে হলো। ছেলেদের অনেকেই এড়িয়ে চলতে লাগল অনামিকাকে। আর অনামিকা তার চেয়েও বেশি এড়িয়ে চলতে লাগল তার ক্লাসের মেয়েদের। স্বাভাবিক। সে তো সবার চেয়ে আলাদা, অন্যরকম। তাকে তো কোনো বিচারেই আর সাধারণের সঙ্গে ফেলা যায় না। তার নাচের প্রশংসায় স্বয়ং বিজন স্যারও পঞ্চমুখ। অনামিকা হঠাৎ যেন আবিষ্কার করে নিজেকে। এভাবে নিজেকে খুব কম মানুষই আবিষ্কার করতে পারে। অনামিকা হঠাৎ যেন কী একটা টের পেল। নিজের ভেতরে, খুব ভেতরে যেখানে প্রায়শই তার আসা-যাওয়া হয় না। সে যেন আলাদা এক জগৎ। অন্যরকম। এই জগতেও সুখ আছে, কিন্তু অন্য জগতের মতো সুখটা অধরা নয়। খুব সহজেই যেন পাওয়া যায় এ সুখের মাধুরী। এখন আর বিজন স্যারের কাছে টেলিফোন করে সময় চেয়ে নিতে হয় না। সময় মাঝে মাঝে কত সহজলভ্য হয় তার কী কোনো নিশানা আছে? একটা সময় এই বিজন স্যারকে অনামিকার মনে হতো ‘কত দূরের মানুষ’। অথচ আজ? প্রশ্নটা করেই যেন থমকে গেল। আজ কি? আজ কি বিজন স্যার তার খুব কাছের? কেমন কাছের? কোন দিক দিয়ে কাছের? স্যার মাঝেমধ্যে এমন করে তাকিয়ে থাকে কেন? এর অর্থ কী? দ্রুত ছুটে যাওয়া রেলগাড়িতে বসে যেমন দৃশ্যপটকে ঠাহর করা যায় না তেমনি প্রশ্নগুলোকেও কোনো সদুত্তরের ফ্রেমে বন্দি করতে পারেনি অনামিকা। তাছাড়া তার মনটাও তো ভাবুক মন নয়। একবার হয়ত কোনো কারণে কিছু প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটে, আবার মিলিয়ে যায় নিজের মতো করে। কার এত সময় এগুলো নিয়ে ভাববার? তবে ভাবনাটা জরুরি। কারণ ভাবতে না পারলে বিজন স্যারের সঙ্গে ঠিক তাল মেলানো যাচ্ছে না। এই তো সেদিন ধানমন্ডির একটা রেস্তোরাঁয় বসে অনামিকা আর বিজন স্যার কথা বলছিল। স্যারের কথাগুলো অনামিকা শুনেছে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারেনি সব কথা। তবুও শুনেছে। তার শুনতে ভালো লাগে। আচ্ছা! নাচের এই ইতিহাস, এই সংগ্রাম এই ঐতিহ্য এগুলো নিয়ে তো কতজনে কত কথা বলেছে অনামিকাকে। সব তো তার ভালো লাগেনি। কিন্তু একই কথা বিজন স্যারের মুখে এতো ভালো লাগছে কেন? অনামিকা একটু চমকে উঠে। কিন্তু ওইটুকুই। এরপর সব স্বাভাবিক। আগের মতোই। তারপরও। যে বিষয়টি নিয়ে সব সময় অনামিকা স্যারের সঙ্গে মজা করে, সে বিষয়টি দিয়েই শুরু করল। স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর থেকে এ বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই মজা করে থাকে অনামিকা। অবশ্য এটা কেবল যে অনামিকা একাই করে তা কিন্তু নয়, পুরো একাডেমির সবাই এ কাজটি করে থাকে। বিজন স্যারের স্বাভাবিক কথার মাঝেও এক ধরনের নৃত্য কাজ করে। যারা নাচেন, নাচকে ভালোবাসেন তারা একে বলেন ‘কথা বলার আর্ট’। কিন্তু যারা এ দলে নয়, যারা নাচের ক্লাসে আসে কেবল এই জন্য যে এখানে ছেলেমেয়ে একসাথে নাচ হয়, তারা কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি করে। অনামিকা পুরোপুরি সে দলের না হলেও সেও এই উপহাসকারীদের বাইরে নয়, বরং ইন্ধনদাতাদের একজন। অবশ্য এটা এখন নয়, এক সময়। এখন সে আর বিজন স্যারের সম্বন্ধে কিছু বলে না। উল্টো কেউ কিছু বললে ক্ষেপে যায়। এ রকম কেন হয়? অনামিকা তো এ রকম ছিল না। নিজের পরিবর্তনে নিজেই অবাক হয়ে যায় অনামিকা। কিন্তু পরিবর্তন কিংবা ভাবনা কোনটারই রেশ শেষ পর্যন্ত থাকে না। সেই হাসি-তামাশার বিষয় দিয়ে আজও কথা শুরু করেছিল অনামিকা। ‘ছেলেরা নাচলে জানি ক্যামন দ্যাখায়’ বলেই বেশ একটা ঠাট্টার হাসি ছুড়ে দিয়েছিল বিজন স্যারের দিকে। স্যারও একটু হাসলেন। তারপর টেবিলে রাখা কাঁটা চামচটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলেন আর বলতে শুরু করলেন কনফুসিয়াসকে চেন? উনি এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন। আজ থেকে কত বছর আগে কথাটা বলেছিলেন তিনি, কিন্তু দেখ, আজও আমি মনে রেখেছি কথাটা। আমার মতো অনেকেই হয়তো মনে রেখেছে তাঁর কথা। তিনি বলেছিলেন ‘যে পুরুষ নাচতে জানে না, তাকে তরবারি দিও না’। এর অর্থ কী? বোঝো? নাচ অনেক বড় এক শিল্প। এর মধ্য দিয়ে নিজের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন হয়। পরিবর্তনটি ইতিবাচক। এটা মনে রাখতে হবে। তাছাড়া অন্য সব শিল্পের চেয়ে নাচের বিষয়টা একটু আলাদা। ‘আলাদা কেন?’ বলেই একটু নড়েচড়ে বসল অনামিকা। আলাদা হবে না। প্রাচীনকালে যেমন সব ধরনের শিল্পেরই একটি নিদর্শন পাওয়া যায়, ঠিক তেমনটা পাওয়া যায় না নৃত্যকলার ক্ষেত্রে। তবে প্রাচীন মানবসমাজের বিভিন্ন আচার উৎসবে নৃত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। আরকিওলজিস্টরা যে নিদর্শনগুলোকে প্রাগৈতিহাসিককালের নৃত্যকলার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ সালে মিশরীয় দেয়াল চিত্রে এবং ভারতের গুহা চিত্রে নৃত্যকলারভঙ্গি পাওয়া যায়। ইনফ্যাক্ট মুভমেন্ট। কী বোঝা গেল? না তেমন কিছুই বোঝেনি অনামিকা। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। কেবল চেয়ে রইল বিজন স্যারের দিকে। মাত্র এক কী দেড় মাস অথচ এরই মধ্যে স্যারের কত কাছে চলে এসেছে অনামিকা। শুধু কী সে একা? স্যারও তো এখন অনামিকার জন্য আগে থেকেই এসে বসে থাকেন রেস্টুরেন্টে। অনামিকার জন্য অপেক্ষা করেন। রাতে অনামিকা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে স্যারের সঙ্গে। বিষয়টি ভাবতেই তার ভালোলাগে। তাছাড়া একাডেমির মাসিক প্রযোজনাগুলোতে স্যারের নির্দেশনায় যে কয়টি প্রযোজনা হয় সব কটাতেই অংশ নেয় অনামিকা। সব কয়টাতেই অনামিকা সেরা পারফর্মার। তার যেন একটু সন্দেহ হয় সত্যি কী সে এতো ভালো পারফর্মার? সবার চেয়ে সেরা! অনামিকার ঘোর কাটে বিজন স্যারের তুড়ির শব্দে। চোখ ফেরাতেই স্যার ইঙ্গিত করল স্মোকিং জোনের দিকে। অনামিকা সিগারেট খায় এটা স্যার জানে। এখন তো নিজেই অনামিকাকে সিগারেট কিনে দেয়, অবশ্য সবার অলক্ষে। স্মোকিং জোনে এসে দুজনেই সিগারেট ধরাল। বিজন একটা হাত রাখল অনামিকার ডান কাঁধে। অনামিকা মাথাটা হেলিয়ে দিল। স্পর্শ পেল বিজনের হাতের। অনামিকা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। বিজনও। অনামিকা তাকিয়ে আছে বিজনের দিকে। ঠোঁটে পুড়ছে সিগারেট। হঠাৎ কেন যেন মনে হলো এ তো বিজন স্যার নয়, কেবল বিজন। তারপর সিগারেটের ধোঁয়াটা বিজনের মুখের দিকে ছাড়ল। একটা মৃদু হাসি দিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। স্মোকিং জোনের আবছা আলো। অনামিকা আবার তাকাল বিজনের দিকে। বিজন হায়দার। একাডেমির সবাই তাকে বিজন স্যার নামেই চেনে। নাচের কৌশল ও নানা গবেষণামূলক প্রযোজনার জন্য তার নাম আছে দেশে-বিদেশে। আবার বদনামও আছে। বিজন বাঁ হাতটা অনামিকার গালের কাছে এনে রাখল। অনামিকা একটা হাসি দিয়ে বিজনের খুব কাছে চলে এল। খুব কাছে! কতটা কাছে আসলে খুব কাছে আসা হয়? অনামিকা কি তাহলে কাছে আসার রসায়ন জানে? খুব কৌশলে অনামিকার গাল টিপে দিল বিজন। তারপর একটি হাসি। চোখের ভাষায় কী যেন বোঝাতে চাইল। অনামিকা কী বুঝবে বিজনের চোখের ভাষা? অনামিকা আর বিজন খুব কাছাকাছি। বিজন হায়দার, অনামিকাদের একাডেমিতে নাচের শিক্ষক। অনামিকার বয়স এখন আঠারো আর বিজনের তেতাল্লিশ পেরোতে তিন দিন বাকি। এগারো. আর মাত্র তিন দিন! ওয়াও! আজকে একুশ মানে বাইশ, তেইশ, চব্বিশ। গ্রেট, টুয়েনটি ফোর্থ জুলাই। ইউর বার্থ ডে ডিয়ার বলেই যেন খুশিতে ফেটে পড়ল অনামিকা। ‘কিন্তু কোনোদিন বলেন নাই তো?’ যেন হঠাৎ করে আসা অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসটাকে একটু সামলে নিল। তারপর বেশ শান্তভাবে তাকিয়ে রইল বিজনের দিকে। বিজনও বেশ একটা খেয়ালি ভাবে বলল সবাইকে বুঝি বলা যায় সবকিছু। ‘তাই নাকি? সবাইকে সবকিছু বলা যায় না?’ বেশ একটা প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্নটি করল অনামিকা। তারপর আবার তাকিয়ে রইল বিজনের দিকে। যেন কত কালের কত-শত প্রশ্নের উত্তর পাঠ করা যায় ওই মুখের দিকে তাকালে। আচ্ছা, অনামিকা কি প্রেমে পড়ে গেল? অনামিকার নিজের মধ্যেই প্রশ্নটি জন্ম নেয়। কিন্তু উত্তরটি সে জানে না। একে কি প্রেম বলে প্রেম কি এতোই দুনির্বার যে একে কোনোভাবেই অতিক্রম করা যাচ্ছে না। অনামিকা তো নিজেই নিজেকে কতবার বলেছে বিজন স্যারের সঙ্গে এভাবে চলাফেরাটা ঠিক না। ভালোলাগার কি আছে লোকটার মাঝে? সে ভালো নাচে, খ্যাতি আছে কিন্তু তা তো অনামিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। কখনোই ছিল না। তাহলে আজ কেন এই মানুষটার আসন্ন জন্মদিন নিয়ে সে এত বিচলিত। আজ কেন সে এই বিজন হায়দারের সঙ্গ লাভ করে সকল বন্ধুদের সঙ্গ থেকে ছিন্ন। অনামিকা এ সম্পর্কটির বিষয়ে তেমন কিছু ভাবেনি প্রথমে। এখন দিন যত যাচ্ছে তার ভাবনা আরও বেশি প্রবল হয়ে উঠছে। এই প্রবল ভাবনার গতিপ্রবাহকে সে কোনোভাবেই রোধ করতে পারছে না অথচ জানে এ অন্যায়। এটা হয় না। মানুষ কী তার সমস্ত ‘হয় না’গুলোকে ধরে রাখতে পারে? রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। এখনও দুজনেই বসে আছে ধানমন্ডির একটি ফাস্টফুডের দোকানে। একটা চিলি পিৎজা’র অর্ডার দেয়া হয়েছে। একটা মজার জিনিস লক্ষ করো অনামিকা। নাচের সঙ্গে মানুষের ভাবের সম্পর্কটা কিন্তু সবার আগে, অথচ মানুষ নাচকে ঠিক প্রায়োরিটি দেয় না। এটা মানুষের একটা কমন হ্যাবিট। মানুষ যখন কোনো একমাত্র অবলম্বনকে ঘিরে থাকে তখন তারই পূজা করে, বিকল্প একটি অবলম্বন পেলেই সে তার আগের দেবতাকে ভুলে যায়। এই যে নাচ এর বয়স কিন্তু লিখিত বর্ণমালার চেয়েও বেশি। লিখিত বর্ণমালা প্রচলনের আগে নৃত্যকলার এই পদ্ধতির মাধ্যমেই নানা রকমের গল্প বংশপরম্পরায় চলে আসতো। তাই তো নৃত্যরত অবস্থায় অনেক কাহিনীর বর্ণনা পাওয়া যায়। কী বোঝা যায়? না, বোঝা যায় না। অনামিকা কিছুই বোঝে না স্যারের কথা। কেবল এইটুকু বোঝে কোনো কারণ ছাড়াই তার ভালো লাগতে শুরু করেছে স্যারকে। পিৎজা এল। বিজন হায়দার একটা টুকরো হাতে তুলে নিয়ে অনামিকার মুখের কাছে ধরল। অনামিকাও খেল। এই অতি সাধারণ ঘটনাতেও দুজনের মনই হঠাৎ একবার দোল খেল। কিছুই বোঝা গেল না। কেবল বিজন হায়দার বুঝল অনামিকার ঠোঁট স্পর্শ করতে চাইবার ইচ্ছাকৃত ইচ্ছাটা আপাতত পূরণ হয়েছে, আর অনামিকার মনে হলো এই স্পর্শটা অন্য স্পর্শের চেয়ে আলাদা। ফাস্টফুডের দোকান থেকে যখন দুজনেই বের হলো, তখন রাত প্রায় এগারোটা। এরই মধ্যে অনামিকার বাসা থেকে মাত্র একবার ফোন এসেছে। এই কাজটা মিসেস রহমানই করে থাকেন। আজও করেছিলেন। কিন্তু অনামিকা ফোনটা ধরেনি। এখন রাস্তায় বেরিয়ে একবার মোবাইলটা বের করল। বাসার নম্বরে ফোন করতেই মা ফোন ধরলেন। বোঝা গেল, টেলিফোনের কাছেই ছিলেন মিসেস রহমান। ‘হ্যালো’ বলেই প্রত্যাশিত উত্তরের অপেক্ষায় রইলেন মিসেস রহমান। যেন নিঃশ্বাসের শব্দেই বোঝা গেল ফোনটা অনামিকা করেছে। কিন্তু অনামিকার অত কিছু বোঝার দরকার নেই। সে নির্বিকার, বরং এই টেলিফোন করে নিজের খবর দেয়াটাই তার কাছে বেশি বিরক্তিকর লাগে। এখন আর নিজের কোনো কিছুর প্রতিই তার আকর্ষণ নেই। তার এখন আকর্ষণ বাইরে। একেবারেই বাইরে। যতটা বাইরে গেলে বাইরের আলোর বাইরের দিকটা দেখা যায়। ‘আমি আসব না’ খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে গেল কথাটি। নিজের কথায় নিজেই ভয় পেয়ে গেল সে। মনে হলো আর যেন ফিরে যাবার পথ নাই। সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু রেশটা মুহূর্তেই কেটে গেল। টেলিফোনের ও-প্রান্ত থেকে মিসেস রহমান খুব শান্তভাবে বললেন ও তাই নাকি, ঠিক আছে থাক তোমার যেখানে ইচ্ছা। ঠিক অনামিকা তার নিজের ইচ্ছাতেই চলবে। কারো ইচ্ছের কাছে সে বন্দি নয়। টেলিফোনটা রেখেই একবার তাকাল বিজনের দিকে। এখন বিজনকে আর স্যার বলতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় যেন কত আপন। বিজন সবই বুঝল, কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। একটা রিকশা ডাকল বিজন। ধানমন্ডি সাত নম্বর। দুজনেই চড়ে বসল রিকশায়। প্রথমটায় অনামিকা ভাবল বাসায় ফিরে না যাবার বিষয়টা জানান দরকার। কিন্তু তার ভাবনা পরিণতি পেল না; তার আগেই বিজন প্রশ্ন করল জিয়ান জর্জিস নভেরাকে চেন? ‘না’ বেশ সংক্ষেপে উত্তর দিল অনামিকা। অনামিকা যখন ঘোরের মধ্যে থাকে তখন খুব সংক্ষেপে উত্তর দেয়। একেকটি উত্তর যেন এক দুই শব্দের বেশি না হয় এমন হিসেব করে গুনে গুনে দেয়। বিজন একটা সিগারেট ধরাল। রাতের অন্ধকারে চলন্ত রিকশায় বসে কী অনায়াসে সে সিগারেটটি ধরাল। দেখে অনামিকার ভালো লাগল। ইচ্ছে হলো বিজনের ঠোঁট থেকে সিগারেটটি নিজের ঠোঁটে নিয়ে নিতে। রিকশা চলছে। রাতের ফাঁকা রাস্তা। মাঝে মাঝে দুএকটি গাড়ি পাশ কেটে যাচ্ছে। বাতাসটা যেন স্বপ্নময় সমস্ত কষ্ট-দুঃখকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। বিজন একবার তাকাল অনামিকার দিকে। তারপর আবার বলল তা, জিয়ান জর্জিস নভেরাকে চেন না। কী আশ্চর্য, নাচ করতে আস অথচ তাঁকে চেন না। অনামিকা হাসল। তারপর হাতটা বিজনের হাতে রেখে বিজনের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিল। বিজন অনামিকার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল জর্জিস নভেরা ফ্রান্সের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী। তিনি ২৯ এপ্রিল জন্মেছিলেন। এই দিনকে ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। নাচের মেয়েদের এই নামটা না জানলে হয়? অনামিকা কিছু জানতে চায় না। সে কেবল জানতে চায় সুখের এই দিনগুলো এত পরে এল কেন? এতদিন তার বাবা-মা-বোনের সঙ্গে থেকে সে পাগল হয়ে গেছে। এখন এই সময়টাতে সে অনেক বেশি সুখী। অনেক আনন্দিত। বারো. বিজনের কথায় একটা আলোছায়া কাজ করে। আলোছায়া। যার মধ্যে থাকে মাদকতা, থাকে রহস্য, থাকে উৎকীর্ণ জীবনের উপাখ্যান। বিজন হঠাৎ করেই অনামিকাকে অনেক গভীর থেকে অনেক উপরে তুলে এনেছে। অনামিকার জীবনের অর্থ, সামনে যাবার গতি, পেছনে ফিরে তাকাবার মতো নস্টালজিয়া এমনকি বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণাটি পর্যন্ত এসেছে এই বিজনের কথা থেকে, বিজনের সঙ্গে মেলামেশাতে। বিজন তার চেয়ে বয়সে বড়। হলোই বা তাতে কী এসে যায়? মানুষের চোখে ভালোলাগাটাই ভালোবাসার গতি নির্ধারণ করে দেয়। এরপর আর কোনো কিছুর দিকেই ফিরে তাকাতে হয় না তাকে। অনামিকার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অনামিকা তো ছিল একেবারেই অচেনা জগতের মেয়ে। তার কাছে না ছিল কোনো চেনা জগতের ঠিকানা, না ছিল অচেনা জগত থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা। বিজন তাকে এই প্রেরণা আর ঠিকানা খুঁজে দিয়েছে। অনামিকা নিজেও জানে তার পরিবারের মাঝে এখন আর সে আগের মতো নেই। তার মা-বাবা- বোন এমনকি খালা পর্যন্ত মনে করে অনামিকার সঙ্গে কথা বলা মানেই একটি নতুন সমস্যায় পড়া। কিন্তু অনামিকা এদের সঙ্গ চেয়েছিল। নিঃসঙ্গতা তাকে বাইরে এনেছে। একাকীত্ব তাকে চারপাশের নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সে কী করবে? তাকে তো যারা সময় দেয় তারা এ রকমই। এসব ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল মাস ছয়েক আগের কথা। যখন বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল সাভারে। সেখানে তাদেরই এক বন্ধুর শিল্পপতি বাবার বিরাট রেস্ট হাউস। সেখানেই থেকেছিল তারা। সারারাত বিয়ার আর মদের নেশায় তারা সবাই যখন ঘোরের মধ্যে তখন মুুমিন নামের একটা ছেলে এসে অনামিকাকে শুইয়ে দিয়েছিল বিছানায়। অনামিকার সারা শরীরে এখনো মুমিনের স্পর্শ লেগে আছে। কিন্তু পরদিন সকালেই ভুলে গেছে এ কথা। দুজনেই। তাদের দেখলে মনেই হবে না এই মুমিন আর অনামিকা গতকাল রাতে অনেক গভীর পর্যন্ত পরস্পরকে ছুঁয়ে দেখেছে। এই মুমিনের মাঝে অনামিকা কোন সৌন্দর্য খুঁজে পায়নি। তার কিশোরী জীবনের অভিধানে সুন্দরের যে বর্ণনা তাতে ধরা পড়ে না মুমিনের কোনো সৌন্দর্য। অনামিকা আগ্রহ পায় না। মুমিনও না। এভাবেই অনামিকার দিন কাটে। কিন্তু দিনের নিয়মে কাটে না দিন। দিনের নিয়মে দিন কাটলে জীবনের তো আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এভাবেই অনামিকা জীবনের স্বাদ নিয়ে জীবনকে বিলিয়েছে কখনো মনে হয়নি এতে জীর্ণতা আছে, মনে হয়নি এভাবে জীবনের স্বাদ নেয়াটা কেবলই সঙ্কীর্ণ হৃদয়ের একটা ব্যথিত মূর্তিকে তুলে ধরা। কিন্তু বিজন স্যারের কাছে অনামিকা এর চেয়ে বেশি কিছু পেয়েছে। অনামিকা অধিকাংশ ছেলেদের সঙ্গেই দুসপ্তাহের বেশি সম্পর্ক রাখে না। কারণ সম্পর্ক দুই সপ্তাহের বেশি আর সম্পর্কের জায়গাতে থাকে না। এটা অন্যখানে চলে যায়। অন্য রকমের স্বাদ নিয়ে। সেই অন্য রকমের শুরুটা ভালোলাগে অনামিকার, শেষটা নয়। তাই প্রতি সপ্তাহেই তার বন্ধুরা আস নতুনদের সঙ্গে তার বোঝাপড়া নতুনের মতোই থেকে যায়। মাঝখান থেকে যাকে ভালোলাগে তার সাথে একটা গভীরতার খেলা হয়। ব্যাস এইটুকুই। সম্পর্ক বলতে এইটুকুই বোঝে অনামিকা। এর বেশি কিছু কখনো সে ভাবেনি সম্পর্ক নিয়ে। তার কাছে বিয়ে বা অন্য কোনো সম্পর্ককে কেবলই ফাঁকি মনে হয়েছে। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। যদি সংসার বলতে কোনো কিছু বোঝাতে হয় আর তার জন্য বিয়েটা অনিবার্য হয় তাহলে অনামিকার সংসারটা কেমন? তার মা মিসেস রহমান, যিনি বাবাকে ছাড়া পুরো সপ্তাহ কাটিয়ে দেন। টাকার দরকার ছাড়া আর কোনো কারণে সাধারণত টেলিফোনে কথা হয় না তাদের। আর বাবা তার সম্বন্ধে এমন কি কথা নেই যেটা শোনেনি অনামিকা? বাবার চরিত্রকে সে ঘৃণা করে। মাকেও। তার কোনো ভালোবাসা নেই এই সংসারের জন্য। এ সংসার কেবলই একটা নরকের কঙ্কাল মনে হয় অনামিকার কাছে। তবুও এই সংসারে ফিরে যেতে হয় তাকে। তার সব আছে কিন্তু এই সংসারের যে আনন্দ, যে অনন্য অনুভূতি তার কিছুই নেই এখানে। কেবল যন্ত্রণা আর প্রতিমুহূর্তে ক্ষয়ে যাওয়া ছাড়া। এমন সংসার থাকা না থাকায় কী এসে যায়? এতে না আছে আনন্দ না আছে দুঃখ। দুঃখ না থাকাটাও এক ধরনের দুঃখ। ভয়ঙ্কর বেদনার আদি নাম দুঃখহীনতা। দুঃখহীনতার শেষ আছে কিনা জানা নেই তবে তার অন্তহীন উপস্থিতির অভাবটাও একটা কষ্টের ছবি আঁকে। তাই পরিবারের উপর তার একটা ভয়ানক ক্ষোভ জন্ম নেয়। অনামিকা বলে বেড়াত ফ্যামিলি লাইফটাই একটা ডিসগাস্টিং। কারণ তার মতে ফ্যামিলি লাইফে এমন কিছুই নেই যা তাকে আনন্দ দিতে পারে, যা তাকে সুন্দর বোধে আলোকিত করতে পারে। পুরো প্রথাটাকেই তাই তার কাছে একটা রাবিশ মনে হয়েছে। তেরো. সময়ের সাথে অনেক কিছুরই বদল ঘটে। অনামিকারও ঘটেছে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ জীবনের প্রতি তার একটা মায়া তৈরি হয়েছে। অনামিকা এই মায়াটুকুকে ছড়িয়ে দিতে চায় না। কেবল ধরে রাখতে চায়। তার বয়স বেশি নয়, কিন্তু তার বোঝার ক্ষমতা সবকিছু ছাড়িয়ে যায়। তাই এখন আর বারোদুয়ারী মন্দিরের দেবী হতে চায় না। সে হতে চায় একেশ্বরবাদী। তার কাছে সে চায় ভালোবাসা আর ভালোবাসার বিনিময় কী ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে? অনামিকা এখন নাচের ক্লাসে কম যায়। এটাই স্বাভাবিক। যার জন্য ক্লাসে যাওয়া সে নিজেই যদি কাছে আসে তো নাচের ক্লাসে যাবার কী দরকার? বিজন এখন আর আগের মতো নেই। বিজন এখন তাকে অনেক দায়িত্বের জায়গা থেকে আগলে রাখে। এটা অনামিকার ভালোলাগে। অনামিকা তো এমনই চেয়েছিল। এই বিজন অনামিকাকে অনেকগুলো বিষয় অনেকভাবে পরিষ্কার করে দেয়। আগে অনামিকা যা বলত তাই ছিল ঠিক। অন্য কেউ তা নিয়ে কোনো বিতর্ক তুলত না। কিন্তু বিজন বিতর্ক তোলে। এই তো সেদিন। রবীন্দ্রনাথের কথা উঠতেই অনামিকা বলল তুমি রবীন্দ্রনাথ কেন পড়? উনি তো নাচতেন না। ‘রবীন্দ্রনাথ নাচতেন না’ কথাটা শুনতে খুব ভালো লাগল বিজনের। ঠিক। রবীন্দ্রনাথ নাচতেন না। তবে নাচের সমঝদার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রসঙ্গ আসলেই বিজনের মাঝে এক ধরনের আলোড়ন তৈরি হয়। সেই আলোড়ন অবশ্য অনামিকা কিংবা তার মতো মেয়েদের সঙ্গে বলা যায় না। বিজন। বিজন হায়দার। তিনি ভাবছেন তার সামনে বসা মেয়েটিকে নিয়ে। মেয়েটি তার ছাত্রী, তার কাছে নাচ শেখে। হঠাৎ বিজনের মনে হলো অনামিকা কী রবীন্দ্রনাথের কোনো চরিত্রের মতো? কার মতো? প্রশ্ন জাগে বিজনের মনে। অনামিকা কি ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী? না বিনোদিনী নয়, বিনোদিনীর ছিল তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ। কিন্তু অনামিকার তা নেই। অবশ্য একদিক দিয়ে এ দুয়ের মিল আছে আর তা হলো মনে রাখার মতো কোনো চিহ্ন বিনোদিনীও পায়নি, অনামিকাও পাবে না। ‘অসম্পূর্ণ ব্যাকুল চুম্বন’ বিনোদিনীরও সম্পূর্ণ হয়নি, অনামিকারও হবে না। আবার দামিনীর মতোও নয় সে। দামিনী জানত সমাজ কেবলই একটা নিষ্প্রাণ বস্তুমাত্র। হৃদয় ধর্মই তার কাছে প্রধান। কিন্তু অনামিকার তো কোনো স্থিতধী নেই। সে তো কেবল এক এলোমেলো লাফিয়ে চলা। শচীশকে দামিনী ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল আবার বৈধব্যের সাজ ফেলে শ্রীবিলাসকে বিয়ে করতেও দ্বিধা করেনি। অথচ এই বোধগুলো জাগ্রত করে দেবার যোগ্যতাটুকুও নেই অনামিকার। তাই অনামিকা কেবল এক অখণ্ড মাংসস্তূপ অন্তত বিজনের কাছে। আর কোনো পরিচয় নাই তার। বিজনের চুপচাপ বসে থাকা দেখে অনামিকা অস্থির হয়ে উঠছিল। বারবার ইতস্তত করার পর বলল কী সমস্যা। চুপ কেন? বিজন কিছু বলল না। কেবল একবার হাসল। জীবনের কত কত মুহূর্তে মানুষ নির্বিচারে অভিনয় করে যায়। কেউই তা বোঝে না। কেবল বোঝার ভান করে মাত্র। বিজনও সেই রকম অভিনয় করে যায় অনামিকার সাথে আর অনামিকা বোঝে না। অথচ বোঝার ভান করে মাত্র। বিজন একবার একটু ভাবে। কেন এই অভিনয়? এই নারীর মধ্যে কী আছে? কিছুই নেই। কেবল একটি অপরিপক্ক শরীর ছাড়া। বিজনের কথার মাঝে কেমন যেন একটা সন্দেহ দেখা দেয়। আবার তাকায় অনামিকার দিকে। তার শরীর যেন অনেকভাবে অনেক কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু অনামিকা অস্থির হয়ে উঠেছে। কতক্ষণ এইভাবে চুপ করে বসে থাকবে? ঠিক এইভাবে চুপ করে বসে থাকার কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না। তবুও বসে থাকে। হঠাৎ কী হলো বিজন অনামিকার হাত ধরে বলল আজ কী কাজ? অনামিকা হাসল। হাসিতে কত রকমের ভাব তার সব বোঝে না বিজন। বোঝার দরকারও নেই। অনামিকা বলল কোনো কাজ নেই। তোমার সঙ্গে থাকব। বিজন মুহূর্তেই বলে বসল। আচ্ছা। একসঙ্গে থাকব। এই ‘একসঙ্গে থাকব’ কথাটা অনামিকার অসম্ভব ভালো লাগল। অনামিকা বুঝে পায় না এত সুন্দর করে কীভাবে বলল কথাটি। অনামিকার মনে হলো এই যেন এক সংসার। এই যেন এক আনন্দ। এতে যেন লুকিয়ে আছে জীবনের সবটুকু অর্থ। এই অর্থের কাছে জীবনের বাকি সব ম্লান। মায়ের কাছে বাবার সম্বন্ধে শোনা নানা কথা, কিংবা নিজের চোখে মায়ের অন্য পায়ে হেঁটে যাওয়া এসব যেন ম্লান তার কাছে। অনামিকার টাকার অভাব নেই কিন্তু সুখের অভাব আছে। সেই সুখ বিজন তাকে দেয়। বিজনকে অনামিকা ভালোবাসে। ভালোবাসে। অনামিকা ভালোবাসতে জানে। সে এটাও জানে বিজনের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য, বিজনের সঙ্গে তার বোঝার পার্থক্য অনেক। কিন্তু সে ভালোবাসে বিজনকে। কেবল ভালোবাসে বলেই তার কাছে আর সব কথা ম্লান হয়ে গেছে। সেই কথাগুলো আর খুঁজে কিংবা তলিয়ে দেখতে চায় না অনামিকা। কিছু বিষয় তলিয়ে না দেখলে কী এমন হয়? তাতে জীবনের কতই বা ক্ষতি? জীবন তো আর একমুখী নয়। এ হলো বহুমুখী এক গল্পভাণ্ডারের প্রচ্ছদ। এতে কিছু বিষয় যদি উঠে না আসে, এতে কিছু বিষয় যদি হারিয়ে যায় যাক না। তবুও তো ভালোবাসা পাওয়া যাবে। অনামিকা ভালোবাসার মর্ম উপলব্ধি করে এসেছে। বিজন তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। এই ভালোবাসার সবটুকু জুড়ে আছে দুজনের সবটুকু অনুভূতি। এত কিছু কি একসঙ্গে পাওয়া যায়? অনামিকা ভাবতে ভাবতে সময় পেরিয়ে যায়। দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে রিকশার খোঁজে। রিকশা খুঁজতে থাকে দুজন। তারা আজ একসঙ্গে থাকবে। অনামিকা এই ‘একসঙ্গে থাকার’ মাঝে খুঁজে নিয়েছে একটা স্বপ্নকে, একটা সুখকে। এই যেন তার সংসার। এই সংসারটা অন্য রকম। একেবারেই অন্যরকম। কিন্তু বিজন কিছু বলছে না কেন? সে কী বুঝিয়েছে এই ‘একসঙ্গে থাকব’ বলে? বিজন একটা সিগারেট ধরাল। রিকশায় উঠে বসল দুজনেই। রিকশা চলছে। রিকশার গন্তব্য বিজনের বাসা। অনামিকা সংসার করতে যাচ্ছে। বিজনের সঙ্গে। বিজন কী ভাবছে? সংসার? স্বপ্ন নাকি অন্য কিছু। রিকশা এগিয়ে চলছে। এগিয়ে চলছে অনামিকার সংসার করার স্বপ্ন। চৌদ্দ. বিজনের বাসায় কেউ থাকে না। তাই বাতি বন্ধ ঘরগুলোর বাতি জ্বালিয়ে দিতেই যেন একটা অন্যরকম রূপ ধারণ করল ঘরটা। এতক্ষণ যেন ঘরে একটা অন্যরকম সাজ ছিল। বাতি জ্বালাতেই সাজ বদলে গেল। দৃশ্যপট পরিবর্তন হলো। আলো হয়ে উঠল চারপাশ। মনে হলো এই ঘরের সবার সঙ্গে আলোটা যেন একটা মিতালী করেছে। ঘরের কোণ থেকে শুরু করে উন্মুক্ত মেঝে, সিলিং, জানালার পর্দা সবখানে এই আলো যেন তার শাশ্বত অস্তিত্ব প্রমাণ করে চলেছে। আলোও যেন একটা নিজস্ব বর্ণে দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটায়। ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখল অনামিকা। এলোমেলো। একমাত্র শোবার ঘরটা গোছানো। সত্যি বলতে একটু বেশি গোছানো। এত গোছানো থাকে নাকি কারো শোবার ঘর? এক কাপ কফি হাতে নিয়ে অনামিকার সামনে এসে দাঁড়াল বিজন। পরনে নীল ট্রাউজার আর টি-শার্ট। যদিও গরম, তবুও এয়ার কন্ডিশন চলছে বলেই রক্ষে। কফিটা অনামিকার হাতে দিয়েই খুব করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। অনামিকা হাসল। একবার। দুবার। তিনবার। চতুর্থবারও হাসতে চেয়েছিল, কিন্তু থেমে গেল। বিজনের চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে অনামিকা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। বিজনের চোখ সেখানে নাচের জন্য স্বপ্ন, অনুভূতি প্রকাশের নিরন্তর আবেগ আর কী যেন একটা নাম না জানা কথা। কী কথা? অনামিকা বুঝে উঠতে পারে না। তার সামনে বসে আছে বিজন। বিজনকে একটু একটু করে ভালোবাসতে শুরু করেছে অনামিকা। অনামিকা ভালোবাসতে শুরু করেছে। বিষয়টি ভাবতেই তার সমস্ত শরীর যেন শিউরে উঠলো যেন মৃদু কম্পনে ঘোষণা করতে চাইল রাজ্যময় ‘অনামিকা বিজনের সঙ্গে হৃদয় বাঁধনে বন্দি’। কেমন যেন বোধ হতে লাগল ভেতরে বাইরে সবখানে। অনামিকা টের পেল জীবন সরে যাচ্ছে তার আপন অক্ষাংশ থেকে। ভালোবাসার মৃত্যুঞ্জয় মহিমাটাকে আর ভেতরে চেপে রাখা গেল না। কিন্তু তা প্রকাশিত করাও যাচ্ছে না। কারণ প্রেমের দুর্বার আকাক্সক্ষার প্রথম দুর্বলতাই হলো ‘প্রকাশ’। অনামিকা এখন সেই দুর্বলতার চক্রে আবদ্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে বিজনেরও কী এ রকম হয়? বিজনও কী ভালোবাসে অনামিকাকে? অনামিকা বসে আছে বিজনের মুখোমুখি। দুজনেই তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। দুজনই ভুলে গেছে দুজনের বয়স দুজনেই কেবল মনে রেখেছে ভালোবাসার অনুভূতিতে ঘেরা সাতরঙা স্বরলিপিটুকু। রাত এখন কৈশোরে। কয়টা বাজে? একবার ঘড়ির দিকে তাকাল বিজন। আড়াইটা। এই একঘণ্টা সময় তারা তেমন কোনো কথা বলেনি। মাত্র দু-একটি বাক্যালাপ হয়েছে মাত্র। বিজন এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। অনামিকার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল লেটস গো টু স্লিপ ডার্লিং। অনামিকা হাসল। বিজনের বাড়ানো হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াতে গিয়ে বিজনের খুব কাছে চলে এল। একেবারে বুকের কাছে। অনামিকা এই প্রথম খুব কাছ থেকে বিজনকে অনুভব করল। এমন অনুভব অবশ্য অনামিকার জীবনে এবারই প্রথম নয়। তবে অবশ্যই ব্যতিক্রম। এর আগে কেবল ওই অনুভবের আকাক্সক্ষাটুকুই থাকত। শেষ বিচারে আবারও নিঃস্ব হয়ে যেত। কিন্তু এখানে অন্যরকম। এখানে আকাক্সক্ষা স্বপ্ন হয়ে উড়ে বেড়ায় নীল ছোঁয়া গাঙচিলের মতো। রাত অনেক হলো। ঘরের ভেতরের মৃদু আলোতে অনামিকা দেখছে বিজনের মুখ। রাত গভীর হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে শব্দহীনতাই যেন একটা বড় শব্দদূষণ। সেই শব্দহীনতার মাঝে চোখ রেখে অনামিকা দেখতে থাকে বিজনকে। বিজন একবার তাকাল অনামিকার দিকে। অনামিকাকে যেন সম্পূর্ণ দেখে নিল বিজন। বিজনের এই দেখাটি লক্ষ করল অনামিকা। লজ্জা পেল। তারপর অনামিকা টেনে আনল বুকের কাছে রাত তখন অনেক, নৈঃশব্দের শব্দগুলো কানের কাছে এসে কী যেন বলে যাচ্ছে। অনামিকা একবার চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করল যেন আর একবার চিনে নিতে চাইল বিজনকে। কিন্তু তখন অনেক রাত। ঘরের মধ্যে মৃদু আলো। আলোটা ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসছে। ঝাপসা। ক্রমশই ঝাপসা। সেই মৃদু আলোর ঝাপসা দৃশ্যপটে অনামিকার হঠাৎ ভয় হলো। মনে হলো সে অনেক বড় হয়ে গেছে। মনে হলো সে এখানে একা। আজ অনেকদিন পর হঠাৎ মনে হলো মা পাশে নেই। পনেরো. রাতেরও একটা হৃদয় আছে। একটা রূপ-গন্ধ-দৃশ্যকল্প আছে। রাত যত গভীর হয় সেই দৃশ্যকল্পগুলো ততই প্রগাঢ় হয়ে উঠে। যত নিস্তব্ধ হয় ততই রূপের সান্নিধ্যে তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। জীবনের কোনো কোনো সময় একেবারেই রাতের মতো। নিস্তব্ধতায় তার অভ্যন্তরীণ চেতনাগুলো একে একে ডানা মেলে দিতে থাকে। চেতনার পাখা ঝাপটানোর শব্দে ঘুম ভাঙে বোধের জানালাটা খুলে দিয়ে অপেক্ষায় থাকে, কখন আসবে প্রভাতের প্রথম সূর্যকিরণ। রাত এখন গভীর। কয়টা বাজে? এসবের কী কোনো দরকার আছে? নেই। হয়ত নেই, হয়ত আছে। তবুও জীবনের শাশ্বত নিয়মকে কেউ কি খণ্ডাতে পারে, নাকি জীবনের অনিবার্য নিয়তি তৈরি করে শাশ্বত নিয়ম। কোনটা সত্য? কেবল প্রশ্ন পড়ে রয় উত্তর মেলে না। এয়ার কন্ডিশনটা বন্ধ করতে ইচ্ছে করছে অনামিকার। কিন্তু বলার উপায় নেই। এখন যে স্রোতে সে ভাসছে তাতে কোনো প্রতিস্রোত নেই। কেবলই ভেসে যাওয়া। সে-ও ভেসে যাচ্ছে। অনামিকা। একজন কিশোরী। নাচের ক্লাসে যার পরিচয় হয়েছিল বিজন হায়দারের সঙ্গে। বিজন হায়দার। নাচের শিক্ষক। এই দুজন কি ভালোবাসে দুজনকে? ভাবতে গিয়েও ভাবতে পারল না। কোথায় যেন একটা ব্যথা অনুভব করল। মুখ দিয়ে একটা গোঙানি। এর বেশি কিছু না। এর বেশি কিছু চেয়ে কোনো লাভ নেই পাওয়া যাবে না। বিছানার চাদরটা ক্রমেই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অনামিকার মনে পড়ছে তার ছোট্ট ঘরের কথা। কী সুন্দর এতদিন বোঝেনি সে। খুব কষ্ট করে একবার ঘাড়টা ঘুরাল নিচে পড়ে আছে পোশাক যেন আপন পর হবার একটা অনন্য উদাহরণ। একটু আগেই কত মমতায় এই পোশাক জড়িয়ে ছিল অনামিকার শরীরে আর এখন? পোশাকগুলোর উপর একটা ঘৃণা জন্ম নিল ইচ্ছে হলো থু থু ছিটিয়ে দেয়। বাইরে কোথায় যেন একটা শব্দ হচ্ছে। খুব ধীরে, শান্ত শব্দ কিন্তু বিরামহীন। শব্দই যেন শব্দের জন্ম দিয়ে আসছে। শব্দটাতে কান পাতলো অনামিকা। অনামিকার ক্লান্ত শ্রবণ শক্তি। ক্লান্ত। শব্দটা যেন এই একাকী রাতে অনামিকাকে বলতে এসেছে তুমি একা নও, আমরা দুজনে। ‘সত্যি?’ অনামিকা ভাবে। এতদূর এতটা পথ একা ভাবিনি কিন্তু এখন কী ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা। হঠাৎ আবার গোঙানির মতো করে ডেকে উঠল অনামিকা। বিজন তখন দিশেহারা। কী একটা বলার জন্য অনামিকা একবার শরীরটা ছাড়িয়ে নিতে চাইল অমনি মুখ চেপে ধরল বিজন। ঠোঁটের কোণে নোনতা লাগে কী? রক্ত! একটু যেন হাসি পেল অনামিকার। নিজেকে নিজেই উপহাস করবে কিনা ভাবতে লাগল। নিজের সম্বন্ধেও মানুষকে কত ভাবতে হয় অনামিকা ভেবে পায় না। রাত শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। অনামিকার সমস্ত শরীরটা ব্যথায় কুঁকড়ে গেছে। বমিও এসেছে দুবার। আবার হবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু অনামিকা আর বমি করতে চায় না। অনামিকার কাছে সব যেন আবার ভেসে উঠছে। বিগত এক মাসের একাডেমি, নাচের ক্লাস, আজকের বিকেল কিন্তু সব শেষ হলে সব নিরর্থক। এত নিরর্থক মানুষের জীবন? এত নিরর্থক অতিক্রান্ত সময়? অনামিকা একবার ওঠার চেষ্টা করল। সমস্ত শরীর তার ব্যথায় ভরে গেছে। উঠতে পারল না, আবার শুয়ে পড়ল বিছানায়। একটা শব্দে ডানদিকে ফিরে তাকাল। বিজন আসছে। বিজনের আসার ভঙ্গিটার দিকে তাকিয়ে আছে অনামিকা। এই সেই বিজন যে প্রতি ক্লাসে তাদের নাচ শেখায়। এই বিজনের হাঁটার ভঙ্গিটা অনামিকার খুব জঘন্য লাগল। তার হঠাৎ বিজনকে খুন করতে ইচ্ছে করল। ঘরের ভেতরে মৃদু আলো জ্বলছিল। বিজন এসে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে গেল। একবার তাকাল অনামিকার দিকে। অনাবৃত শরীর কিন্তু তার প্রতি আর কোনো আকর্ষণ নেই তার। যাবার আগে একবার বলে গেল সকালে বেরিয়ে গেলে দরজা লক করে দিয়ে যেও। তারপর বিজন হেঁটে গেল পাশের রুমে। সেখানেই তার বিছানা। সেখানেই সে থাকবে। অনামিকা একা পড়ে রইল। সমস্ত শরীরে কী দুঃসহ যন্ত্রণা। সূর্যের আলো এসে যখন পড়ে অনামিকা চোখ খুলে। কিন্তু সম্পূর্ণ খুলতে পারে না। খোলার চেষ্টা করে এই যা। শরীরের ব্যথা অনেকটাই কমেছে। ওঠার চেষ্টা একবার করতেই উঠতে পেরেছে সে। উঠে দাঁড়াল মেঝেতে। বাইরে আলো ফুটেছে। আলো। আলো। আলো। এ আলোর অর্থ কী? এ আলো কী কেবলই একটা প্রহসন নয়? হাঁটতে গিয়ে বুঝল শরীরের সমস্ত শক্তি রাতে লুট হয়ে গেছে। কোনো রকমে হেঁটে গেল বেসিনের কাছে। ট্যাব ছেড়ে তাকিয়ে রইল পানির গড়িয়ে যাবার দিকে। একবার মুখ তুলে চাইল। সামনের আয়নাটায় নিজের অবয়ব দেখে চমকে উঠল অনামিকা। তাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? গালের পাশে ব্যথাটা আগেই বুঝতে পেরেছিল। দেখল চামড়া উঠে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ট্যাব গড়িয়ে জল পড়ছে। জলের কোনো নাম নেই। সেই নামহীন জলের মাঝে স্পর্শ করে আপনাতেই চোখ বন্ধ করে অনামিকা। কী শান্তি! কিন্তু শান্তির সংজ্ঞা কি? এর কোনো সংজ্ঞা আছে নাকি কেবলই একটা বিমূর্ত ধারণাকে প্রতিনিয়ত আমরা মূর্ত করে তুলতে চাই। যেমন অনামিকা রাতে ভালোলাগায় মূর্ত হতে চেয়েছিল। চেয়েছিল সংসার করতে। তার সংসার করার স্বপ্ন তো রাতের প্রথম প্রহরেই পায়ে দলে গেল বিজন। হঠাৎ বমি বমি ভাব হলো। খুব বমি করতে ইচ্ছে করছে। অনামিকা আর পারছে না। নামটি উচ্চারণের সাথে সাথেই বমির ভাবটা প্রবল হয়ে উঠল। রাত শেষ হয়েছে। অনামিকারও সব শেষ হয়েছে। মুখ ধুয়ে খুব কষ্ট করে হেঁটে আসল ঘর পর্যন্ত। বিছানাটার দিকে চোখ গেল। এলোমেলো হয়ে আছে পুরো বিছানা। এতটুকু সংসারের চিহ্ন নেই সেখানে। বালিশের কোণে রক্তের দাগ। আরও ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে চাদরের নানা দিকে। অনামিকা মেঝেতে পড়ে থাকা পোশাকগুলো তুলে নিল। পোশাকগুলো হাতে নিয়েই অনামিকা আবিষ্কার করল এতটা সময় তার শরীরটা ছিল অন্য কোথাও কোনো হিংস্র জন্তুর কাছে, জন্তুর দাঁত-নখরের চিহ্ন লেগে আছে পুরো শরীর জুড়ে। পোশাকটা গায়ে জড়িয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। বাইরে একটু একটু করে রোদ বাড়ছে। অনামিকার মনে হলো এমন রোদ যেন বহুদিন দেখে না সে। কত হাজার বছরের বন্দিদশা থেকে সে যেন এই রোদটুকুর প্রার্থনা করে এসেছিল। কিন্তু প্রার্থনা মঞ্জুর হয়নি। কেবল জানালা দিয়ে যেটুকু আলো আসে রোদের যেটুকু তাপ শরীর ছুঁয়ে যায় কেবল সেটুকুতেই তার অধিকার। ফিরে এসে বিছানায় বসল। পুরো শরীর জুড়ে কেবল ব্যথা যেন মুক্ত হবার উপায় নেই। কোনোভাবেই যেন নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়া যায় না এই অন্তহীন ব্যথার বৃত্ত থেকে। অনামিকা আবার বাইরে তাকায়। বাইরে তখন রোদ। জানালা দিয়ে সে রোদের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়েছে ঘরের ভেতরে বিছানায়। অনামিকা খুব ধীরে হাত বাড়াল যেন ছুঁয়ে দেখতে চায় রোদকে। রোদের কাছাকাছি এসে রোদের শরীরে হাত ছোঁয়াল অনামিকা। কী নরম শান্ত শরীর। যেন মিশে যেতে ইচ্ছে করে। অনামিকা রোদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠল। রোদের হাতে হাত রেখে অনামিকা ফিরে এল জীবনের কাছে। জীবন সুন্দর কিন্তু এই সুন্দর জীবনের কাছে এসে কোনোদিন নৈবেদ্য খোঁজেনি অনামিকা। আজ রোদের আকাশে সে ডানা মেলেছে শূন্য তবুও যেন নিরন্তর পূর্ণতা। আরও ভালোবাসার জন্য, আরও কাছে আসার জন্য এই রোদের শরীরে অনামিকা যেন এঁকে দিল চুম্বন। এবার দুহাত বাড়িয়ে দিল। দুহাতে এসে পড়ল সকালের রোদ। সেই রোদে যেন পুরো শরীরের সমস্ত ক্ষতগুলো শুকিয়ে গেল। সেখানে ফুটল রোদের শাশ্বত গোলাপ ষোলো. আজ বিকেলটাতে রিজভী কিছু আয়োজন করেছে। আয়োজন বড় নয়, তবে ভাবনাটা বড়। রিজভী যখনই একটা নতুন বই পড়ে তখন সে খুব সাদামাটাভাবে বইটা পড়া শুরু করে। কিন্তু ক্রমেই যখন বইটা শেষ হতে থাকে রিজভীর মন আরো ভারাক্রান্ত হতে থাকে। কেন? এ প্রশ্নটা আসতেই পারে। বিষয়টি নিয়ে রিজভীর একটা নিজস্ব মতামত আছে। মতামতটা এ রকম যে আমাদের চারপাশের এত গতিশীলতায় আমরা কোনো কিছুকেই আপন করে ভাবতে পারি না। ভাবনাটা আপেক্ষিক কিন্তু ভাবনার রেশটা চিরন্তন। একে কোনোদিন কোনো চেতনার বেড়াজালে বন্দি করা যায়নি। এই এত তীব্র গতিময়তার মধ্যেও বই একমাত্র ভালোবাসার সঙ্গী। সঙ্গীটা এমন যে তার সঙ্গে অভিমানও ভালোবাসা, কাছে থাকাও ভালোবাসা আবার দূরের কোনো গানে সুর মেলানোও ভালোবাসা। অর্থাৎ এখানে পুরোটাই ইমন রাগের ধরন। তাই বইকে রিজভী অনেক ভালোবাসে। একটা বই যতদিন পড়তে থাকে তার মধ্যে সেই বইটার প্রতি একটি ভালোবাসা, একটা সৌন্দর্যবোধের জন্ম হয়। যখন এই বইয়ের একটি একটি পাতা অতিক্রান্ত হতে থাকে, বইটা আস্তে আস্তে শেষের দিকে যায় অন্তিমের গান শোনায়, তখন তার বেদনাটাও বাড়তে থাকে। মনে হয় যেন কত দিনের কত গভীর সম্পর্ক আজ শেষ হতে যাচ্ছে। কত স্মৃতি, কত গান যেন এই বইটাকে নিয়ে রচনা করেছে। এরই মধ্যে সে জীবনের সার্বিক অর্থ খুঁজে। আজ সেই বেলা শেষের দিন। উপন্যাসটা আজই শেষ হবে। এতদিন এই উপন্যাসটির উপর একটা মায়া পড়ে গেছে। আজ বিকেলেই শেষ হবে উপন্যাসটি। এ যেন এক বেদনা। এ যেন এক কষ্ট। একটি বইয়ের সঙ্গে তার চরিত্রগুলোর সঙ্গে গল্প, সংলাপ এ সবকিছুর সঙ্গে যে সম্পর্ক তার কি কোনো নাম আছে? কোনো সংজ্ঞায় কী বন্দি করা যায় এই ভালোলাগাটুকুকে। এই ভালোলাগা থেকে বিদায়, এই সম্পর্ক থেকে ছুটি সেটা কি মেনে নেয়া যায়? তবুও বিকেলে উপন্যাসটা শেষ হবে। এতদিন এর সঙ্গে তার কত রকমেরই না স্মৃতি জমে আছে। কত কথার মাঝে এই উপন্যাসটি এসেছে কখনো ভালোবাসায়, কখনো অভিমানে। আজকের বিকেলের পর থেকে সেগুলো মনের ফ্রেমে বন্দি হয়ে থাকা আখ্যানমাত্র। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র নিয়ে কি রিজভী ভেবেছে? নিজের কাছেই নিজে প্রশ্নটি করল। তারপর একটু যেন থামল মনে হলো কোনো ভাবনার একটা চকিত রেখা খেলে গেল তার মাথায়। ভেবেছে। চরিত্রগুলোর বিকাশ নিয়ে না হোক অন্তত সৃষ্টি নিয়ে ভেবেছে রিজভী। প্রতিটি চরিত্রকেই ‘একের প্রভাবে অন্য’ এই নিয়মে তৈরি করেছেন ঔপন্যাসিক। কিন্তু কোনো চরিত্রই আবার প্রভাবিত নয়। এ যেন ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর কেমন একটা দ্বন্দ্ব কোনো সমাধান নেই। স্বাধীন না নির্ভরশীল এ দুয়ের বাধায় ধরা উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র। তবুও চরিত্রগুলো মৌলিক হয়ে উঠেছে কোথাও কোথাও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরিত্র তার সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে গেছে বহুদূর। যেমন রাতে বিজনের বাড়িতে একা অনামিকার একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্তে সে যতটা অনড় তেমনি সে শক্ত পরদিন ভোরের আলোকে ছুঁয়ে দেখার সময়। এ যেন অনামিকা চরিত্রের একটা সার্থক রূপায়ণ দাঁড় করানোর ব্যর্থ প্রয়াস। কিন্তু তারপরেও অনামিকা তার মায়ের মতো নয় যদিও তার মায়ের জন্য সে জীবনকে বাজি খেলায় রূপান্তরিত করে। এভাবে আরও হাজার হাজার বিশ্লেষণ করেছে রিজভী, কিন্তু কোনো বিশ্লেষণেই সে স্থির হতে পারেনি। পারার কথাও নয়। কারণ জীবন যদি কেবল ঘটনা প্রবাহের সাথে বদলে যায় তবে তাকে নিয়ে কি কোনো স্থির বিচার চলে? রিজভী আবার তুলে নিল বইটা। একেবারের শেষের অংশগুলো। উপন্যাসটি শেষ হয়ে আসছে। রিজভী পড়ছে বিদায়ী কোনো ভালোলাগার দৃশ্যের চলনে মানুষ হঠাৎ যেমন মায়াবী চোখ রাখে সে রকম চোখ রেখে। সতেরো. অনামিকার পুরো জীবনটাই বদলে গেছে। এতটা বদল আশা করেনি। সে জেনেছিল জীবনটা আগের মতো থাকবে না। কারণ জীবনের ইতিহাস কেবল নির্লজ্জ ভোগের ইতিহাস। এখানে ঠাঁই দেয়া বা ঠাঁই নেয়া কেবলই অভিনয়। এ অভিনয়ের না আছে আদি, না আছে অন্ত। তাছাড়া জীবনের কোনো পথই কোনোদিন অনামিকার জন্য একেবারে মুক্ত ছিল না। সে আজ এত বড় হয়েছে অথচ কোনোদিন দেখেনি মা আর বাবাকে একসঙ্গে হেসে কথা বলতে। সে কেবল দেখেছে তার মা অন্য সুরে অন্য গান গায় আর বাবা প্রতিনিয়ত গড়িয়ে চলে জীবনের আরেকটি রাস্তায়। কিন্তু সে রাস্তার খবর অনামিকাও জানে। সে দেখেছে জীবন কাউকে ক্ষমা করেনি। নিয়তির দুর্নিবার গতিপ্রবাহ প্রতিটি মানুষকে টেনে এনেছে তার আপন বৃত্তে। বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তারপর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে নিজের সিদ্ধান্তের ওপর। অনামিকার এই বদলে যাওয়াটা অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। অনামিকা নিজেও না। সে জানে তার জীবনের গান এখন আর আগের মতো বাজে না। এখন আর রাত করে বাড়ি ফেরে না সে। নাচের ক্লাসে কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার বিষয়েও তার আগ্রহ কমে গেছে। তার এই হঠাৎ বদলে যাওয়াটা আজ সবার চোখে পড়েছে সবাই এখন অনামিকাকে দেখলেই জিজ্ঞেস করে কী রে ভালো আছিস তো? অনামিকা ভালো আছে। তার ভালো থাকার কথা ছিল। তার কোনো অন্যায় নেই যে তাকে খারাপ থাকতে হবে। বরং ভালো নেই তারাই যারা তাকে প্রতিদিন প্রশ্ন করে সে কেমন আছে। মানুষের ভালো থাকা মন্দ থাকার উপর কি জীবনের অনেক কিছু নির্ভর করে? জীবন তো আর রূপকথার গল্প নয় যে তার সবকিছু একরকম থাকতে হবে। এখানে আলো আছে, তেমনি আঁধারও আছে। এখানে স্বপ্ন আছে আবার স্বপ্নভঙ্গের বেদনাও আছে। তাই এখানে কোনো কিছুই ধ্রুব নয়। এখানে সবকিছুই চলে চালকের চাকায় ভর করে। তাই প্রতিক্ষণে পরিবর্তন। তাই প্রতিমুহূর্তে প্রশ্নের মুখোমুখি। অনামিকা নিজেরও মুখোমুখি হয়েছে বহুবার। গত এক বছরে তার যে পরিবর্তন সে পরিবর্তনের ছবিটা একবার সে দেখতে চায়। মন দিয়ে ছবিটা একবার দেখতে চায় অনামিকা। সে কি বড় হয়ে গেছে? তার কি অনেক বোঝার ক্ষমতা হয়েছে? নাকি সে এখন একা এক নিঃসঙ্গ যাত্রী যার যাত্রাপথ আছে কিন্তু চলার শক্তি নেই, আবার শক্তি আছে কিন্তু যাত্রাপথের সীমানা নেই। তবুও অনামিকা ভাবে। যদি সে জন্মগ্রহণ না করত এই পরিবারে। যদি সে একা একটা পথের স্রষ্টা হতো নিজেকে নিয়ে বেড়িয়ে আসত শাশ্বত কোনো বন্দর থেকে যেখানে নোঙর ফেলেছে জীবনের নৌকা। এ পরিবার অনামিকার জন্ম দিয়েছে কিন্তু এখানেই এর দায়িত্ব সীমাবদ্ধ? নিশ্চয়ই নয়। তাই আবার শুরু হলো সেই পুরোনো দ্বন্দ্ব। কী দিয়েছে পরিবার আমাকে? কী দিয়েছে জীবন আমাকে? জীবনের সঙ্গে হিসেবটা মিলাতে বসে অনামিকা আঁতকে উঠল। এত বড় তার দেনা-পাওনার হিসেব কী করে এই হিসেবের খাতাটা সে সম্পূর্ণ করবে? কিন্তু পরিবারের সঙ্গে তার হিসেবটা পরিষ্কার। এ পরিবারে জন্ম নিয়েছে সে। বেড়ে উঠেছে এখানে। তারপরেও এখানে তার সর্বস্ব নিহিত নেই। এখানে যারা আছে তার চারপাশে তাকে নিয়ে যাদের হাজারটা অভিযোগ, প্রতিদিন সে ভালো আছে কিনা এটা নিয়ে যাদের ভাবনার অন্ত নেই তাদের জন্যও ভাবতে হয় অনামিকাকে। আগে হতো না। কিন্তু এখন হয়। এখন মনে পড়ে মায়ের কথা। অনামিকা জানে মা আগের মতো নেই; তবুও মায়ের চলার পথে সে ফেলে রাখে দৃষ্টি। বাবার বিষয়ে অনামিকার কোনো প্রশ্ন নেই কারণ বাবাকে আর মানুষ মনে করে না সে। সে জানে পুরুষ এখন আর মানুষ নয়, পুরুষ কেবলই পুরুষ। তাই অনামিকার নিজের জন্যই করুণা হয়। নিজেকে সে প্রশ্ন করে কী পেলে তুমি? এই যে তোমার জীবন এখানে অখণ্ড অবসরহীন পড়ে আছে এর মাঝে কী আছে? এখানে না আছে প্রাণ না আছে মৃতদেহ এখানে কেবলই স্বপ্ন তার কঙ্কালগুলোকে থরে থরে সাজিয়ে রাখে। প্রতিবাদহীন এক অনড় পাথরের মতো। একে আঘাতের পর আঘাত দেয়া হলো কিন্তু এতটুকু সরানো গেল না। আঘাতের কোনো প্রতিবাদও করল না সে। অনামিকা হঠাৎ ভাবে পাথরের কি কান্না পায়? পাথর কি কাঁদে? তার কান্নার শব্দ কি মানুষ শোনে? ‘মানুষ’ কেমন বিষণ্ন হয়ে শব্দটি উচ্চারণ করল অনামিকা। একটি জীবনে কত ভাঙা গড়া কত বোঝার দায়। একটা সময় তার কিছুই বুঝতে হতো না। কেবল বাবামা আর বড় বোনকে ছাড়া। সে বোঝাটাও হয়ে যেত এক রকম। একটা সময় দেখল এখানে সবাই আলাদা। একের অস্তিত্ব বটে কিন্তু একক সত্তা নয়। তাই এখানে আর কোনো বোঝার দায় রইল না। এবার শুরু হলো নিজের জন্য নিজেকে মেলে ধরা। মানুষ সারাজীবনই অন্যের কাছে নিজেকে, নিজের সৌন্দর্যকে মেলে ধরে। অথচ কী আশ্চর্য! তার এই নিটোল সৌন্দর্য কখনো উদঘাটিত হয় না নিজের সামনে। নিজের কাছেই সে থেকে যায় সবচেয়ে বেশি অচেনা, অজানা। নিজেই নিজের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে। অথবা নিজের কাছে নিজের সবকিছু মেলে ধরতে না পারার কারণে এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীকে পুষতে থাকে নিজের ভেতরে। এই প্রতিদ্বন্দ্বী যখন ধাক্কা দিতে শুরু করে তখনই যুদ্ধ বাঁধে নিজের ভেতরে। এ যুদ্ধ জন্ম থেকেই প্রতিটি মানুষ ধারণ করে। যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় বুঝে, না বুঝে। সারাটা জীবন এই যুদ্ধ করে মানুষ নিজের অস্তিত্বের দাবি মেটাতে চায়। জীবনের সব প্রভাতের আলোর, সব সন্ধ্যার বিষণ্নতা, সব রাত্রির নির্জনতা এই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একেকটি পূর্ণ ছবি হয়ে ওঠে। অনামিকা জানে এ ছবিটাই সত্য বাকি সব মিথ্যে, কেবল ভেলকির খেলা। তাই এখন আর মায়ের কাছে এসে একবারও ভাবে না মায়ের পরিণতির কথা। বাবার প্রতি যদিও তার প্রচণ্ড ঘৃণা তারপরেও সে ভেতরে ভেতরে বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে। আসলে বাবা কিংবা মায়ের সঙ্গে যুদ্ধ নয়। যুদ্ধটা নিজের সঙ্গে। নিজের ক্ষয় হয়ে যাওয়া প্রত্যাশাটার সঙ্গে, ক্রমশ বিলীন হয়ে যাওয়া জীবনের করিডোরটার সঙ্গে, ফিকে হয়ে আসা রঙিন ছবিটার সঙ্গে। এই জীবনের উদাহরণ বয়ে নিয়ে বেড়ায় অনামিকা। কিন্তু ভেবে পায় না এ বয়ে বেড়ানো আর কতকাল? তবুও ভালোবাসা এসেছিল। অনামিকা জানে এ জায়গাটিতে সে সৎ ছিল না। থাকার কথাও নয়। অনামকিার মা সৎ ছিলেন না কোনো সম্পর্কের বিষয়ে, বাবা ক্রমাগত মিথ্যে বলে প্রতারণা করেছে মায়ের সঙ্গে। বড় বোনের অন্ধকার জীবনটা কখনো ঘেঁটে দেখেনি কিন্তু তার বিষয়েও অনামিকা নিশ্চিত। তাই জানে সৎ থেকে লাভ নেই। বরং অসৎ হয়ে যদি সুখটাকে ধরা যায় তো মন্দ কী? কিন্তু সুখ ধরা গেল না। কথাটা কি মিথ্যে হয়ে গেল না? সুখ তো এসেছিল। ঠিক। সুখ এসেছিল। ভালোবাসা এসেছিল অনামিকার জীবনে। ‘ভালোবাসা’ চমকে উঠল অনামিকা। অনেকদিন পর কথাটা আবার মনে এল। সেই সাথে মনে এল একটি মুখচ্ছবি। সেই সাথে মনে হলো বিজনের কথা। বিজন এখন কোথায়? কোনো খবরই জানে না অনামিকা। অবশ্য জানার উপায়ও নেই। এখন সে একেবারে ঘর থেকে বের হয় না। কেবল ঘরেই বসে থাকে। আর সারাদিন ভাবে নানা কিছু। নাচের ক্লাসে যাবার কথা বললেই মেজাজটা বিগড়ে যায়। কতদিন হলো নাচের ক্লাসে যায় না সে। তার বন্ধুরা এখন কোন ইয়ারে? নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজে দেয়া যায়। কিন্তু অনামিকা এখন দিতে পারল না। হঠাৎ বিজনের কথাটা মনে পড়ে গেল তার। বিজনকে সে ভালোবেসেছিল। কেবল এই একটি সম্পর্কে অনামিকা সত্যিই সৎ ছিল। এতটুকু অভিনয় সেখানে ছিল না। এতটুকু খাদ ছিল না সে ভালোবাসায়। কিন্তু নির্ভরতার পুরস্কার তো সে পেয়েছে। পেয়েছে ভালোবাসার যথার্থ মূল্যায়ন। এখন আর কী করার আছে? ‘মূল্যায়ন’ আর ‘পুরস্কার’ শব্দ দুইটি উচ্চারণ করেই একবার হেসে উঠল। অনেকদিন হাসি পায় না। ভালোবাসার কি কোনো পুরস্কার আছে? কোনো মূল্যায়ন আছে? কে কবে কোনো ভালোবাসাকে মূল্যায়ন করতে পেরেছে? অনামিকার মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা। কী বিষণ্ন রাত ছিল সেটা। আজও মনে পড়ে অনামিকার। এখন অবশ্য স্মৃতিটা থেকে সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু তবুও যেন মুক্তি মিলছে না। মুক্তি কেন মিলছে না? কোন বন্ধনে ধরা পড়েছে অনামিকা? এ বাঁধনের নিয়ম কী? এখানে কি কেবলই ধরা পড়া যায় মুক্তি বুঝি মেলে না? অনামিকা একবার বের হবে। আজকে অনেকদিন পর অনামিকা বের হবে। তার মুক্তি চাই। জীবন কোনো থেমে থাকার কাব্য নয়। এখানে কেবল থেমে থাকলেই প্রায়শ্চিত্ত হয় না। অনামিকা জানে সে ভুল করেনি। তাকে তার পরিবেশ যা শিখিয়েছে, সে তা-ই শিখেছে এবং সেভাবেই সে কাজ করেছে। তার প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি পদক্ষেপ যদি ভুল হয় তাহলে তার জন্য এই পরিবেশও দায়ী। অনামিকা তৈরি হচ্ছে। আজ জীবনের সঙ্গে জীবনের যুদ্ধটা শেষ করতে হবে। এভাবে জীবনের শ্মশানে প্রতিদিন একটা করে শবদেহ সে বয়ে বেড়াতে পারবে না। তার মুক্তি চাই। চাইই। মুহূর্তের মাঝে সম্পূর্ণ অনাবৃত হয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। আয়নাতে পুরো শরীরটাকে একবার দেখল সে। এই সেই শরীর যেখানে রয়েছে জন্তুর নখরের তীব্র চিহ্ন। এই সেই শরীর যেখানে সুখের ছবি এঁকেছে অসভ্য সমাজ। এই সেই শরীর যেখানে ভালোবাসার মলাটে নষ্টামি ছুঁয়ে গেছে বারবার। এই শরীরটাকে অনামিকা ভালোবাসে। এখানে যা হয়েছে এখানে যতবার আঘাত এসেছে ততবার এ ভালোবাসাটা আরও বেড়ে গেছে। এখন নিজের জন্য নিজের ভালোবাসা। অনামিকা আজ একা হয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ একা। এখানে যেন আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আর কোনো কিছুর অবস্থান নেই। এখন কেবল একা। এই একাকীত্ব অনামিকাকে আজ অনামিকার সামনেই দাঁড় করিয়েছে। ভালোবাসার সুখপদ্যগুলো একে একে বলে গেছে। কিন্তু তার কোনো শেষ নেই কারণ তার কোনো শুরু ছিল না। বাসা থেকে বেরিয়েই একটা রিকশা নিল। অনেকদিন রিকশাতে চড়ে না অনামিকা। রিকশায় উঠেই মনে হলো এই রিকশাটা যেন তার পরিচিত। এখন সবকিছুকেই তার পরিচিত, তার আপন মনে হচ্ছে। কারণ সে ক্রমে ক্রমে বন্ধন থেকে মুক্ত হচ্ছে। মুক্ত হচ্ছে। মুক্তির নিরন্তর স্বাদ যেন তাকে পেয়ে বসেছে। অনামিকা জানে মুক্ত হলেই পৃথিবীটা তার একান্ত তারই। রিকশা এসে থামল সেইখানে। তার প্রিয় নাচের স্কুলের গেটে। এই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কেটেছে তার কতটা সময়। এখানেই একবার বিজন কাঁধে হাত রেখেছিল অনামিকার। সেই জায়গাটাও আজ সে চিহ্নিত করে রাখল। ভালোবাসার শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন ছিল নাকি ওটা? অনামিকার হাসি পেল। সে এগিয়ে যাচ্ছে মূল ভবনের দিকে। এক পা, দুই পা, তিন পা। আরও কত পদবিক্ষেপে সে পৌঁছবে মুক্তির কাছাকাছি। ওই তো দেখা যায়। আজ এখানে যুদ্ধের শেষ, এখানে যুদ্ধের চিরন্তন বিরতি। অনামিকা ভবনের খুব কাছে চলে এসেছে। ভবনটাকে তার কাছে মনে হচ্ছে মুক্তি। জীবনের সব কিছুর বিনিময়ে পাওয়া এক টুকরো মুক্তি। এক চিলতে স্বাধীনতা। এইটুকুর জন্যই জীবনের এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সে এসেছে এইখানে। এই সময়ের কাছে। এই সময় কী তাকে ফিরিয়ে দিবে বা সে কি এত কাছে এসে ফিরে যাবে? ভবনের মূল ফটকের বামদিক দিয়েই সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল সোজা দোতালায়। এখানে দোতালায় মুক্তি। এখানে এসে একদিনের সে বন্দি হয়েছিল। আজ এখানে এসেই সে তার মুক্তির পথপরিক্রমা খুঁজে নিতে চায়। সোজা বামদিক পেরিয়ে যেতেই মুখোমুখি। সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিজন। বিজন হায়দার। এই দেখা হয়ে যাওয়াতে অনামিকা মোটেও অপ্রস্তুত নয়। কিন্তু বিজন সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেবল একটা কাঁপুনি তার সমস্ত শরীর জুড়ে বেয়ে যাচ্ছে। তড়িতাহতের মতো সে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে অনামিকা। অনামিকা খুব স্বাভাবিক। আজ প্রায় তিন মাস পর দেখা হলো বিজনের সাথে। সেই রাতের পর তিন মাস। অনামিকার এখন কী বলা উচিত? সে কি জিজ্ঞেস করবে বিজন কেমন আছে? নাকি এরপর আর কাকে কাকে বিজন তার বাসায় নিয়ে গিয়েছে। এখন আর কার সাথে রাত এগারোটা পর্যন্ত বিজন গল্প করে। কিন্তু অনামিকার রুচি হলো না। কেন জানি বিজনের দিকে তাকাতেও রুচি হলো না অনামিকার। তবুও তাকিয়ে রইল। অপ্রস্তুত বিজন নিজেই বার কয়েক কেঁপে উঠল। তারপর বলল কেমন আছ? অনামিকার হাসি পেল। মনে হলো যদি হাসতে পারত তাহলে না জানি কত শব্দ করে হাসত সে। কিন্তু হাসতে ইচ্ছে করল না। অনামিকা দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু বিজন দাঁড়াতে পারল না। যেতেও পারল না। কিছুক্ষণ পায়চারি করে এসে অনামিকার সামনে দাঁড়াল। তারপর বেশ শান্ত গলায় বলল দেখ। আমি তোমাকে ভালোবাসি। সেদিনের রাতের জন্য আমি খুব দুঃখিত। সেটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। অনামিকা কিছুই বলল না। একবার তাকাল বিজনের চোখের দিকে। হাসি পেলÑ তবুও হাসল না। ‘অনামিকা’ এবার আর একটু কাছে এসে বলল বিজন। ‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে বিয়ে করব। দেখ আমাদের মাঝে যা হয়েছে, তার জন্য আমরা দুজনেই দায়ী’ বলে একটু থামল বিজন। মনে হলো একটা নিঃশ্বাস নিল। অনামিকা কিছুই বলল না। ঠোঁট জোড়া ঈষৎ প্রসারিত করে হাসল। ঠোঁট প্রসারিত হলো বটে কিন্তু হাসিটা ফুটে উঠল না। বিজন এবার অনামিকার হাত ধরে বসল। তারপর বললো প্লিজ, কমপ্লেইন করলে আমাদের দুজনেরই ক্ষতি হবে। একটু বোঝো। অনামিকা কিছুই বলল না। গলার ভেতরটা হঠাৎ কেমন করে উঠল। কান্না পেল কি? অনামিকা জানে না। খুব সন্তর্পণে হাতটা সরিয়ে নিল বিজনের হাত থেকে। তারপর এসে দাঁড়াল বারান্দার কার্নিশ ছুঁয়ে নেমে আসা রোদের মাঝখানে। অনামিকা এক কিশোরী। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিজন। রোদের কাছে এসে অনামিকা বার কয়েক ঘুরে দেখল তার পুরোনো নাচের স্কুলটার চারপাশ। নাহ কোনো পরিবর্তন হয়নি, আর হবেই বা কী? মাত্র তো তিন মাস। অনামিকার খটকা লাগল। তিনমাস কি মাত্র? এই তিনমাসে তো অনামিকার অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেল। বিজনের দিকে ফিরে তাকাল। তার সমস্ত চোখে মুখে অভিযোগের ভয়। কৌতুকবোধ হলো অনামিকার। তারপর মাথাটা উঁচু করে তাকাল বিজনের দিকে। শান্ত অথচ প্রগাঢ় একটা কণ্ঠে অনামিকা বললো কথাগুলো। খুব নীরবে, বলার সময় একবারও চোখের পলক পড়েনি। একটি নিঃশ্বাসের বেশি খরচ হয়নি। চারপাশটাকে এক বিন্দুতে এনে অনামিকা বিজনকে বলল আমি আপনাকে ক্ষমা করেছি বিজন, কারণ ভুল করে হলেও আমি আপনাকে ভালোবেসেছিলাম। ভালোবাসার এই এক মাহাত্ম্য, এখানে ক্ষমা করা যায়। এরপর অনামিকার গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু তাকে মুক্তি দিয়ে গেল সবকিছু থেকে। আঠারো. রিজভী খুব ধীরে বন্ধ করলো বইটি। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের চশমাটা খুলল। তারপর খুব মন দিয়ে ভাবতে লাগল অনামিকার কথা। অনামিকা। নামটি আমাদের দেয়া। পুরো উপন্যাসে রেবেকা মাহমুদ কোনো নাম দেননি মেয়েটির। রিজভী আবার ভাবতে লাগল। পুরো উপন্যাসটা নিয়ে একটা ভাবনা। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র নিয়ে ভাবনা। অনামিকাকে শেষ বিচারে কেমন বড় করে তুলল লেখক। এ যেন বয়সে নয়, মনন আর মানসিকতায় বড় হয়ে যাওয়া কিশোরী। রিজভীর উপন্যাসটি পড়া শেষ। এবার তার ভাবতে হবে। নিজেকে নিয়ে, নিজের ভাবনার প্রেক্ষণবিন্দুতে রেখে উপন্যাসটি নিয়ে। কিন্তু সত্যি কি সে ভাবতে পারবে? ভাবনার গতিপ্রবাহ দিয়ে কী হবে এখানে? এ তো সেই বোধের আপেক্ষিক প্রকাশ, যেখানে সব ভাবনা স্থবির হয়ে যায় কেবল জেগে থাকে ভাবনার মানচিত্র। এখানেই মনে হয় সৃষ্টির সার্থকতা তা কখনো কখনো নিজেই স্রষ্টা হয়ে যায়। নতুন এক চিন্তার স্রষ্টা, নতুন এক দিগন্তরেখার স্রষ্টা। সেই স্রষ্টার ব্যবচ্ছেদ কী করবে রিজভী? শেষ ‘কনফ্লুয়েন্স?’ উপন্যাসটি নিয়ে রিজভীর গবেষণা শেষ হয়েছিল কিনা জানা যায়নি। রিজভীরও কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি। তার পরিচিতজনেরাও তার কোনো খবর দিতে পারেনি। একবার খবর এসেছিল সে কোনো এক মফস্বলের স্কুলে ইংরেজি পড়ায়, আবার শুনেছিলাম সে নাকি এখন প্রবাসী। স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে ইউরোপের কোনো দেশে। রিজভী আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবে উপন্যাসটি নিয়ে আমি খুব আগ্রহী ছিলাম। তাই জানতে ইচ্ছে করেছিল উপন্যাসটি সম্বন্ধে রিজভীর ভাবনা কী। কিন্তু তার কোনো উপায় থাকল না বলে বিষয়টি বাদ দিয়েছিলাম। আমাদের যুগে আমাদের মতো মানুষেরা কোনো বিষয় নিয়ে বেশি ভাবি না। আমাদের শেখানো হয়েছে চিন্তা করাটাই এক ধরনের ব্যাধি এতে সময়ের অপচয় হয়। তাই আমরা চিন্তা করতে ভুলে গেছি। আমাদের চিন্তার সুতোতে টান পড়লেও আমাদের হুঁশ হয় না। পুনশ্চ তারপর। বহু বছর পেরিয়ে গেলে এক অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থী নেত্রকোনার বিশ্বরপাশার একটি স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে ‘গবেষকের নোটবুক’ নামের একটি নোটবই খুঁজে পায়। নান্দনিক ভাষার প্রয়োগে অনেকগুলো লেখা ছিল ওই নোটবুকটাতে। একেবারের শেষের পাতাগুলোতে যা লেখা আছে তার কোনো অর্থ খুঁজে পেল না সেই শিক্ষার্থী। কেমন যেন নিছক অর্থহীন কিংবা সামঞ্জস্যহীন কিছু লেখা। আর সেই সঙ্গে আছে অনেকগুলো নারীর পেন্সিল স্কেচ। অস্পষ্ট এবং ফিকে হয়ে যাওয়া হাতের লেখায় শেষ পাতাগুলো যেন কথা বলছিল। ‘ঔপন্যাসিক নিজেই এ উপন্যাসের চরিত্র। রেবেকা মাহমুদ, তুমি ধরা পড়ে গেছ। নিজের জীবনের গল্পটা যখন উঠে এসেছে সত্য রঙের ধ্রুব আলোতে তখন ভয় পেয়ে উপন্যাসটি তুমি নিজেই বাজেয়াপ্ত করেছ। তাই নিজের মতো তৈরি চরিত্রটিকে তুমি নামকরণ করোনি। তুমি ধরা পড়ে গেছ রেবেকা মাহমুদ। আর এ কথাও সত্যি তুমি শেষদিন পর্যন্ত ভালোবেসেছিলে গালিবকে। আমি জেনে গেছি রেবেকা হাসান গালিব মাহমুদকে ভালোবেসে তোমার রেবেকা হাসান নামটা রেবেকা মাহমুদ হয়ে গেছে’ এই কথাগুলো কে যেন এসে পড়ে দিয়ে যায়। ওই তরুণ শিক্ষার্থী একটু নড়েচড়ে বসে। অনেকগুলো নারীর মুখাবয়ব এঁকে অবশেষে লিখেছেন নোটবইয়ের লেখক যদি বর্ণনা চিত্রকল্পের চেয়েও শক্তিশালী হয় তাহলে আমার বিবেচনা ভুল হতে পারে। তবে এ কথা ঠিক যে আমি যতবার আঁকতে গিয়েছি অনামিকার ছবি, ততবারই তা রেবেকা মাহমুদের মতো হয়ে যাচ্ছে। আমি আর মেলাতে পারছি না। কেবল এইটুকু জানি এই দুই সত্তাতে কোনো ভেদ নেই। নোটবুকের একেবারে শেষের পাতায় লেখা আছে ভালোবাসার এই এক মাহাত্ম্য, এখানে ক্ষমা করা যায়। এরপর ‘মুক্তি’ কথাটি লেখা আছে একেবারে শেষে। এতটাই নিচে এর নিচে আর কিছুই লেখা সম্ভব নয়। ‘মুক্তি’র পরে আর কী-ই-বা লেখার থাকতে পারে? রেবেকা মাহমুদের উপন্যাস ‘কনফ্লুয়েন্স?’ আর সেই বইটা নিয়ে রিজভীর গবেষণা, তার পাঠ এবং বোধগম্যতা এবং এখন সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যাওয়া। আর এখন? নতুন এক শিক্ষার্থী খুঁজে বের করল রিজভীর লেখা গবেষকের নোটবুক। এই তিন প্রজন্মের কাছে আমাদের কেটে গেছে কত বছর তার কোনো হিসেব নাই। এই বেহিসেবী জীবনের কোনো দাম পাওয়া গেছে কি? ‘ভালোবাসার এই এক মাহাত্ম্য, এখানে ক্ষমা করা যায়’ কথাটি তাই আজও নতুন, চির নবীনের মতো। এখানে প্রজন্মের ব্যবধানের কোনো দায় নেই। আবার সবকিছু পেরিয়ে কেবল ‘মুক্তি’র জন্যই তো এইভাবে পথচলা। এই পথচলা থেকেই জীবনের আদি-মধ্য-অন্ত। এখানেই লুকিয়ে থাকে জীবনের ছন্দ। থাকে না কি?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App