×

সাময়িকী

শিল্পের একটা পথ আছে, শিল্প আলাদা আলাদা কোন পর্ব হয় না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০১৯, ০৮:৪৬ পিএম

শিল্পের একটা পথ আছে, শিল্প আলাদা আলাদা কোন পর্ব হয় না
হাসান আজিজুল হক বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য কথাসাহিত্যিক। তিনি ১৯৩৯ সালে ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে চলে আসেন এদেশে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ দোয়া বখশ্ এবং মাতা জোহরা খাতুন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন রাজশাহীতে। অধ্যাপনা করেছেন রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ, দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজ এবং সবশেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: উপন্যাস- বৃত্তায়ন, শিউলি, আগুনপাখি; ছোটোগল্প- সমুদ্রের স্বপ্ন: শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, পাতালে হাসপাতালে, রাঢ়বঙ্গের গল্প ইত্যাদি। সাহিত্যে অবদানের জন্য লাভ করেছেন- বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, অমিয়ভূষণ সম্মাননা, হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি। এ ছাড়াও ২০১২ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও ২০১৮ সালে তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলেছেন অজয় কুমার রায়। প্রশ্ন : সাহিত্য চর্চায় আসার নৈপথ্যে আপনার কোনো অনুঘটক কাজ করেছে কি? হাসান আজিজুল হক : এখন আর বলতে পারব না। কেন যে লিখতে ইচ্ছে করেছে, কেন যে লিখতে গেলাম, কেন যে অন্য কাজে গেলাম না, কি দরকার ছিল লেখার। অন্যসব না করে আমি লিখতে গেলাম! প্রশ্ন : আপনার লেখালেখি করার পেছনে কোনো বিশেষ ব্যক্তির অনুপ্রেরণা কি ছিল দৃশ্যের আড়ালে? হাসান আজিজুল হক : না, না। আমার পিছনে কোনো ডা-া ছিল না। আমার জীবনে তেমন কেউ ছিল না। এমনি-ই। অনুপ্রেরণা আবার কি? অনুপ্রেরণা তো মানুষ চারপাশ থেকে পায়। যেমন পরিবারের পরিবেশ, পরিবারের ধরন, যৌথ পরিবার, হতে পারে আজকালকার পরিবারগুলোর মতোই। প্রশ্ন : আপনার গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমষ্টির লড়াই এবং ব্যক্তির মুক্তি। এই যে লড়াই এবং মুক্তি, তা কি আপনার জীবনকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে? হাসান আজিজুল হক : যত পার লিখো। এমন কোনো মানুষ কি আছে যে জীবন-সংগ্রাম করেনি! সংগ্রাম মানে নানান বিপরীতমুখী টান। আমার জীবনেও সংগ্রাম হয়েছে। অভাব-অনটনের মুখোমুখি হয়েছি। ছোটোবেলার একটা সময় খুব খারাপ ছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ওই সময়টাতে আবার শুরু হলো পঞ্চাশের মন্বন্তর। বহু মানুষ না খেয়ে মারা গেল। পঞ্চাশের মন্বত্বরের মতো খারাপ মন্বন্তর আর হয় না। তারপর হিন্দু-মুসলমান অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নটি সামনে এল। মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও অন্যান্য পার্টি, এক্কেবারে যাচ্ছে- তাই অবস্থা। তবে আমাদের গ্রামটা সেভাবে আক্রান্ত হয়নি। আমাদের গ্রামের স্কুলটাও ছিল ওই এলাকার সবচেয়ে ভালো স্কুল। এমন ভালো ছিল, অন্যান্য গ্রামের ছেলেমেয়েরাও আমাদের গ্রামে পড়তে আসত। স্কুলের পরিবেশও ছিল খুব সুন্দর। আমি তো সংস্কৃত পড়েছি। স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র ছিল হিন্দু। আমাদের সংস্কৃতের যিনি প-িত ছিলেন তিনি তো হিন্দু-ব্রাহ্মণ। সে সময় আমাদের গ্রামের আমরা দুই ভাই ছাড়া আর কোনো মুসলিম ছেলে স্কুলে যেতো না। আমাদের প্রতি তাদের কোনো খারাপ আচরণ ছিল না। কোনো রকম বিদ্বেষ তো দূরের কথা; আমরা যে অন্য ধর্মের, এটা কোনো বিষয় ছিল না। প্রশ্ন : আপনার লেখালেখির চর্চায় পরিবারের লোকজন সহায়ক ছিল, নাকি ছিল বিপরীত ভূমিকা। এখন কেমন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি? হাসান আজিজুল হক : ডিফারেন্ট। লিখছি, না-কী করছি কেউ জানে না। বাড়ির মধ্যে দশ-পনেরোটা সন্তান। মা-ও জানে না কে কী করছে। ফুফুই আমাদের খোঁজখবর রাখতো, বাবার কথা তো কোনো প্রশ্নই উঠে না। অতএব কে পড়ছে, কে পড়ছে না, কে লিখছে- এসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। স্কুলে যেতেই হবে, কেন স্কুলে গেলে- এসব কারও কোনো ব্যাপারই ছিল না। বনের ভেতর গাছ যেভাবে গজায়, ডালপালা কাটা হয় না, অর্থাৎ যেমন খুশি তেমনভাবে বেড়ে ওঠা। আমার জীবনও হয়েছে তা-ই। প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্য চর্চায় ও লেখালেখিতে মুসলমানদের দেরিতে আসার পেছনে ব্রিটিশদের কোনো চক্রান্ত ছিল কি? হাসান আজিজুল হক : ব্রিটিশদের চক্রান্ত ছিল এরকম- যারা শিখবে-টিকবে, তারা তো আমাদের অনুগত থাকবে এবং আমাদের হয়ে ভারতবর্ষকে শাসন করবে। আমরা নিজেরা না থেকে ওদের দিয়েও কাজ চালাতে পারব। এটা ছিল তাদের পলিসি। আবার অনেকে মনে করত- শিক্ষা মানে আলো। যখন অনেক কিছু শিখে ফেলে, তখন তারা বিদেশি ঔপনিবেশিক শক্তি বলে মনে করেছে- তা আরও বড়ো মুশকিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যদি বলে- ভাগো এখান থেকে। তখন কেমন লাগে? কিন্তু তাই হয়েছে। নেতাজি বলো, আর যার কথাই বলো- তাই তো করেছে। মুসলমান আর বাঙালি মুসলমানরা এটা খুব দেরিতে বুঝেছে। ওরা আগে মনে করত -আমরা নবাবের জাত, নবাব সিরাজদৌলার পরবর্তী বংশধর, আমরাই দেশের রাজা ছিলাম, আমরা তো পড়াশোনা করি নাই। এখন করতে যাব কেন? এমন কি যখন মুসলিম পিরিয়ড অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীতে যারা রাজ-কাজ করত। যেমন করণিকের কাজ; ফার্সি ভাষাতে হলেও কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরাই করেছে। বহুকাল ধরে তারা এ কাজ করে আসছে। আর মুসলমানেরা তো নিজেদের নবাব মনে করে কোনোকিছুই করল না। তবে কিছু কিছু অভিজাত মুসলিম পরিবারে চেষ্টা হয়েছে। তারা লেখাপড়াও শিখেছিল। তবে বাংলা পড়তে আগ্রহী ছিল না। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। এরা বাংলা ভাষাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত। এরা মনে করত মুসলমানের কথ্য ভাষা উর্দু। এ-বাংলায় বলো আর ওই বাংলায় বলো, মুসলিম অভিজাত পরিবারগুলোর বাড়িতে উর্দু ছিল কথ্যভাষা। এজন্য মুসলমানেরা অনেক পিছিয়ে পড়ে। প্রশ্ন : আপনি গল্প- না কবিতা দিয়ে লেখালেখি জীবন শুরু করেছেন। হাসান আজিজুল হক : কতকিছুই লেখে না মানুষ। তোমার হাতে কাগজ-কলম থাকলে কি কিছু লিখবে না? হয়তো এমনিই লিখছি। সেরকম কি লিখতাম এখন আর খেয়াল নেই। ‘লেখা আর মোছা, কালো ছায়া, তব ভাবনার প্রাঙ্গণে’ কার লেখা বলতে পার, আমি তো নিশ্চয় লিখিনি। বলতে পার রামধনু ভেঙেছিল কে? প্রশ্ন : রামধনুর গল্প তো রামায়ণের গল্প। হাসান আজিজুল হক : রাম ভাঙল তো। ইন্সপেক্টর যখন বলছে- আমি ভাঙিনি স্যার; আর প-িত মশাই ওকে দেখিয়ে বলছে- ও মিথ্যা বলছে, ওই ভেঙেছে। ব্যাপারটা এ রকমই। কবে প্রথম লিখলাম, কবে ধনুক ভাঙল, এসব। এসব বলা আসলে মুশকিল। তাছাড়া এমনিতেই সব গড়ে ওঠে। কেউ বলতে পারে নাকি, কি হবে কি হবে না! পরবর্তীকালে যখন সজ্ঞান হয় তখন অনেকে মনে করতে পারে- আমার এরকম পরিকল্পনা করা দরকার ছিল, সেরকম পরিকল্পনা করতে হবে এবং করা না হলে আফসোস হয়। অথবা সময়ের অপচয় হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাটা সবাইকে বলি- ‘যে জন্তুর লেজ গজাবে একসঙ্গেই গজাবে।’ লেখাটাও সেরকম। প্রশ্ন : আপনার অনেক কালজয়ী গল্পে রাঢ়ের ভাষা ও পটভূমি; এমনকি রাঢ়ের পরিবেশ ও রাঢ়ের মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রচ্ছন্ন থাকে। এ বিষয়গুলো আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? হাসান আজিজুল হক : সাধারণত হয় কি- যে জায়গার সঙ্গে অভিজ্ঞতার খুব একটা সম্পর্ক থেকে যায়, কিছু লেখার কথা মনে হলেই ওখানে চলে যায় স্মৃতি। আমি যে- সমাজে বসবাস করি, যে- দেশে বসবাস করি, তার সমস্ত কিছুর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি। কাজেই মানুষ যেখানে বসবাস করে, সেটার যে চতুর্পাশ, যেমন মনের মধ্যে আঁকা হয়ে যায়, সেটাকে কোনোভাবেই সরানো যায় না, সেটা সর্বক্ষেত্রেই হয়েছে। উইলিয়াম ফকনার দক্ষিণ আমেরিকার মিসিসিপির অধিবাসী ছিলেন, মার্ক টোয়েনকে বলা হয় মিসিসিপির পাড়ের লেখক; হেমিংওয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিলেও তাঁর বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাসের পটভূমি ইউরোপ বা কিউবা। প্রশ্ন : বর্তমানে অনেককে বলতে দেখি যে উপর থেকে নাজিল না হলে তিনি লিখতে পারেন না। একজন লেখকের জন্য এ বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখেন? আপনি কি মনে করেন নাজিল হওয়ার কোনো বিষয় আছে? হাসান আজিজুল হক : না। আমি এটা মানি না। এ রকম কোনো বিষয় নেই। প্রশ্ন : আপনি কখনও গল্পের ঘেরাটোপে আটকে পড়েছিলেন? হাসান আজিজুল হক : ও ভেতরের কথা। বলব না। নিশ্চয় পড়েছিলাম। প্রশ্ন : কেন বলা যায় না বিষয়টা পরিষ্কার করবেন। হাসান আজিজুল হক : ওটা লেখকের নিজস্ব ব্যাপার। বলা যাবে না। অনেকে তো অনেক কিছুই লিখেছে। লিখতে গিয়ে কি বিপত্তি হয়েছে; বহু লেখক কেন আত্মহত্যা করেছেন তা ভালোভাবে জানা যায় না। তবে কি লিখতে না পারা? হয়তো আর লিখতে পারছেন না। এমনও হতে পারে লিখতে বসেছেন, কিন্তু কিছুই লিখতে পারছেন না। হতাশা ঘিরে ধরেছে। একজন লেখক মনে করেন- লেখাটা লিখতে পারাই হচ্ছে একমাত্র সার্থকতা। কাজেই লেখক-জীবন কেউ পড়ে না। এতে অনেকের খুব প্রতিক্রিয়া হয়। এটাও হতে পারে। সেটা যে কোনো বয়সেই হতে পারে। বড়ো বড়ো লেখকদের ও অল্প বয়সের লেখকদের, যাদের এমন হয়েছে তারা আর লেখেননি। কবি শেলী তো ছাব্বিশ বছর বয়সে মারা গেলেন, আর আমাদের কবি সুকান্তও একুশ বছর বয়সে মারা গেলেন। তবে প্রতিভাস কীভাবে হয় তা বলা মুশকিল। তবে আমার মনে হয়- যারা বেশ অল্প বয়সে লেখেন তাদের লেখার পরিণতির জন্য একটু সময়ের দরকার, কাঁচা হাতটা কাটানোর জন্য। আবার এটাও ঠিক যে, কাঁচা হাতটা কেটে যাওয়ার পর অতি পেকে যাওয়া- সেটা আরও এক মহামুশকিল। এরকম অনেক ক্ষেত্রেই হয়েছে। আমাদের বড়ো বড়ো সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেও হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তো বেশিদিন বাঁচেননি। যখন চল্লিশ বছর বয়স তখন তার লেখার কনস্ট্রাকশন শুরু হয়েছে। তারপর মাত্র সাত বছর লিখতে পারলেন। প্রশ্ন : বঙ্কিমচন্দ্র শুধু উপন্যাসের ফর্মটা লেখার রাস্তাটা দেখালেন, ইচ্ছে করলে গল্পের ফর্মটার রাস্তাও তিনি দেখাতে পারতেন, আপনার অভিমত কী? হাসান আজিজুল হক : না, পারতেন না। এটা তিনিই ভালো জানতেন। প্রশ্ন : বাংলা ছোটোগল্পের প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেকে অনেক সময় রোমান্টিক লেখক বা কবি হিসেবে আখ্যা দেন। তবে তার গদ্যে তো সেভাবে রোমান্টিকতা কম খুঁজে পাওয়া যায়; যেমন পোস্টমাস্টার, রাম কানাইয়ের নিবুর্দ্ধিতা ও কঙ্কাল ইত্যাদি। এ গল্পগুলো তো অন্য ধাঁচের। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি? হাসান আজিজুল হক : রোমান্টিকতা আলোচনা করার কোনো দরকার নেই। এটা ঠিক যে ছোটোগল্প বহুকাল ধরে নানান ভাষায় চলছে। বাংলাতেও হয়তো অনেকের বেলায় হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম আধুনিক সাহিত্যিক যিনি গল্পের ফর্মটা দেখালেন। সেসময় তিনি দেখতে পেরেছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গল্পের ফর্ম। যেমন রাশিয়াতে হয়েছে, লন্ডনে হয়েছে। তা দেখে রবীন্দ্রনাথ বাংলা গল্পে এক্সপেরিমেন্ট করেন, দেখেন হয় কিনা। যিনি প্রথম করেন তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটোগল্পে নিজে শুরু এবং শেষ; এজন্য তিনি শ্রেষ্ঠ। প্রশ্ন : আপনি অনুবাদও করেছেন; বিদেশি সাহিত্য ও সংস্কৃতি আমাদের বাংলা সাহিত্যের জন্য কতটা জরুরি মনে করেন? হাসান আজিজুল হক : অত্যন্ত জরুরি। আর এখন তো আরও বেশি প্রয়োজন। আমি তো বসে বসে পুঁথি লিখছি না। মনে রাখতে হবে যে, পুঁথি লিখে নিজের বাড়ি থেকে দু-মাইল পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব ছিল না। যাব কী করে, গরুর গাড়িতে! আর এখন তো পুরো দুনিয়ার হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। এখন সাহিত্যের মধ্যে ওই ক্রিটিক্যাল বাঙালি বলতে কোনো জায়গা নেই। প্রশ্ন : আপনি তো কথাসাহিত্য নিয়ে কাজ করেছেন; সাহিত্য ও চিত্রশিল্পের মধ্যে সম্পর্ক কতটা? হাসান আজিজুল হক : এক শিল্পের সঙ্গে আরেক শিল্পের মধ্যে তো গভীর সম্পর্ক। সবটাকে শিল্প বলা হয় ওই কারণেই। তা না হলে আলাদা আলাদা করে বলা হতো। আমরা সাহিত্যকেও শিল্প বলছি, কবিতা ও চিত্রশিল্পকেও বটে। কাঠের তৈরি ফুটোর যে সৌন্দর্য- তার মধ্যে কি শিল্প নেই? শিল্প বলতে এটুকু বুঝায়- এ এক ধরনের সৃজনশীলতা। যা আগে ছিল তা পরিস্ফুট করা। আমাদের ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী নিজের হাতে কিছুই করেননি। তার কাছে যেটা মনে হয়েছে ভালো- সেটা ভালো। একটা জায়গায় দেখল- একটা কাঠের গুঁড়ি পড়ে আছে, গুঁড়িটা তুলে এমন একটা ভঙ্গিতে রেখে দিলেন; আরে সেটাই তো আর্ট। কাজেই শিল্পের একটা পথ আছে। শিল্প আলাদা আলাদা কোনো পর্ব হয় না। আর জীবনে কারও সঙ্গে কিছু বললাম না তাও হয় না। প্রশ্ন : উপন্যাস এবং উপন্যাসিকা বলতে আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন? সাধারণ পাঠক কিন্তু উপন্যাস শব্দটার সঙ্গে পরিচিত, উপন্যাসিকার সঙ্গে নয়। হাসান আজিজুল হক : ওই একটা নাম দিতে হয়, দেওয়া হয়েছে। ওর কোনো বিশেষত্ব নেই। পাশাপাশি দুটো শিশু থাকলে; ধরো ১৬ বছরের একটা শিশু আর ৩ বছরের একটা শিশু- ওটাকে তুমি কি বলবে? ওখানে তো একজনকে তরুণ যুবক, আর যুবক হয়নি- হয়নি প্রায়-যুবক যেমন বলে না, এরকমই। সাহিত্যকে ওভাবে দেখতে হয়। সাহিত্যের একটা একটা করে ডানা বেড়েছে। প্রশ্ন : আপনার ‘চালচিত্রের খুঁটিনাটি’ বইটি আদৌ প্রবন্ধের কিনা আমার সন্দেহ হয় কারণ বইটির লেখাগুলো পড়লে গল্পের যে আনন্দ তা আমি উপলব্ধি করি। এটা কেন? পরিষ্কার করবেন? হাসান আজিজুল হক : পরিষ্কার করে কোনো লাভ নেই। ওটা কেউ পড়ে না, ছাপতে নিষেধ করেছি। আর পরিষ্কার করার মতো কিছু নেই, পরিষ্কার করে লেখাই হয়েছে। তারপরও যদি কেউ এটা বলে তা হতে পারে। না হওয়ার কিছু নেই। প্রশ্ন : একজন কবি বা সাহিত্যিকের জন্য পুরস্কার কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এবং অনেকে পুরস্কার পেলেও তারা তা গ্রহণ করেন না বা করতে চান না; এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন? হাসান আজিজুল হক : পুরস্কার লেখকের তলায় থাকে। বিশেষভাবে কেউ সম্মান করছে- তাতে প্রভাবিত হওয়ার কিছু নেই। পুরস্কার দ্বারা যে প্রভাবিত হয় সে লেখকই না। যে পুরস্কার পায়নি বলে হায়রে পুরস্কার পেলাম না যেমন, আবার বহু বছর পরে অনেক পুরস্কার পেলাম, এটা ঠিক নয়। মানুষ নতুন জামা পরলে মানুষটি কি বদলে যায়। আবার কেউ রাজার পোশাক পরলে কেউ কি আকবর হয়ে যাবে- সেরকমই। পুরস্কার পেলে কেউ বিশেষ কিছু হয় না। একজন লেখকের লেখাটাই থেকে যায়। লেখকের জন্য লেখাটাই মূল কাজ। লেখাটাইকে মানুষ মনে রাখে। আর পুরস্কার হচ্ছে- কিছু টাকা আর সম্মান দেখানো। এইতো। পুরস্কার আসলেই সম্মান হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। প্রশ্ন : ধন্যবাদ আপনাকে। হাসান আজিজুল হক : ধন্যবাদ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App