মায়া ও আমার পুত্র
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ জুন ২০১৯, ০৮:০৭ পিএম
আমি যখন বাড়ি ঢুকেছি তখন ফুরিয়ে এসেছিল দিনের আলো। সন্ধ্যা নামছে। বর্ষাকালের সন্ধ্যা। পূর্ণিমা সন্ধ্যা বলে দিনের মতো স্পষ্ট চারদিক। তোমাদের দেখতে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না।
২৫ শে মার্চের রাতও ভোর হয়েছিল।
এই রাতও ভোর হবে।
এই তো আর দুতিন ঘণ্টা পরই ভোর হবে। আমার কাজও ততোক্ষণে শেষ হয়ে আসবে...
কিন্তু মায়া, আমি আর পারছি না।
আমার শরীর আর চলছে না।
একে এ রকম ঘটনা, পুরো পরিবার ধ্বংস, সেই শোকতাপ, মাথা তালগোল পাকিয়ে যাওয়া অবস্থা, আরেকদিকে যোদ্ধার দায়িত্ব, আমি কোনদিকে যাই, মায়া!
বাবার লাশ দেখে আমি কাঁদতে পারি না।
মায়ের লাশ দেখে কাঁদতে পারি না।
বোনের শরীরের ওপর দিয়ে ওরকম ঘটনা ঘটে যাওয়া, তার করুণ কাতর মৃতমুখ...
আমি কাঁদতে পারি না, মায়া। আমি কাঁদতে পারি না। আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। শোক করতে ভুলে গেছি।
তারপর তুমি!
তারপর আমার সন্তান।
আমি কাঁদতে পারি না, মায়া।
আমার চোখে পানি নেই।
যোদ্ধার চোখে পানি আসতে নেই।
কিন্তু যোদ্ধাও তো মানুষ! যোদ্ধাই আসলে পরিপূর্ণ মানুষ। এ কথা শিখিয়েছিলেন বাবা।
আমি তারপর যোদ্ধা হয়ে গেলাম। সব হারাবার পরও যোদ্ধার দায়িত্ব নিলাম। গোয়ালঘরের ওদিক থেকে খুঁজে আনলাম কোদাল। উঠানে খুঁড়তে শুরু করলাম কবর।
বাবার কবর।
মায়ের কবর।
বোনের কবর।
এখন স্ত্রীর কবর।
তারপর...
আমি আর পারি না, মায়া। আমার শরীর চলে না। আমার ইচ্ছে করে এই যে তোমার আর আমার পুত্রের লাশ এনে রাখলাম উঠানে, তোমাদের পাশে আমি একটু বসি। আমি একটু জিরিয়ে নেই। আমি একটু তোমার সঙ্গে কথা বলি। আমি একটু তোমার কোলে মাথা রাখি।
কোলে মাথা রাখলে তুমি যেভাবে আমার বুকে হাত বুলাতে, মাথায় হাত বুলাতে, মায়া, তুমি আমাকে একটু সেই ভাবে আদর করো। তোমার আদরে স্পর্শে, ভালোবাসার নরম আঙুলে কাটিয়ে দাও আমার সব ক্লান্তি। আমাকে আবার সবল করো, সতেজ করো। খানিকপর তাহলে আমি আবার শুরু করতে পারি আমার যুদ্ধ।
কবর খোঁড়ার যুদ্ধ।
গোড়খোদকের কাজ।
ওদের বুট আর গুলির শব্দে স্তব্ধ হয়েছিল প্রকৃতি। সব পাখি উড়ে গিয়েছিল অচিন গাঁয়ে, নিরাপদ গাঁয়ে। ডাকতে ভুলে গিয়েছিল পাখিরা। বাড়ি এসে আমি কোনও পাখির ডাক শুনিনি।
আমি কি পোকামাকড় ঝিঁঝিদের ডাক শুনেছিলাম?
শুনিনি।
তারাও স্তব্ধ হয়েছিল।
তারাও থেমে গিয়েছিল ঘাসবন বা ঝোঁপের অন্ধকারে।
নৈঃশব্দ।
চরম নৈঃশব্দ।
চূড়ান্ত নৈঃশব্দ।
বল্টুটা কোথায় গেল? বল্টু বিড়ালটা?
বাড়ি পাহারা দেওয়া এতদিনকার কুকুরটা?
কদম, বারেকের মা, পারুল?
গরুগুলো তো নিশ্চয় এই দেশীয়...গুলো নিয়ে গেছে। বাড়ির আসবাবপত্র নিয়ে গেছে। আমাদের বাড়ি হয়ে গেছে মৃত্যুপুরি। কবরখানা।
মায়া, এই যে দেখো আমি ঠিকই তোমার পাশে বসেছি। আমার পুত্রের পাশে বসেছি। আমার ডানপাশে তিনটি কবর। বা পাশে তোমার কবর এখনও পুরোপুরি খোঁড়া হয়নি। কিছুটা হয়েছে। এসো কাজের ফাঁকে গল্প করি আমরা। একটু ভালোবাসার কথা বলি। একটুখানি প্রেম করি তোমার সঙ্গে।
সকালবেলা ঘটে যাওয়া ঘটনা, মায়া। প্রখর রোদের দিন ছিল। তোমাদের শরীর পচতে শুরু করেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য আমি কোনও গন্ধ পাচ্ছি না। রক্ত মাংসের গন্ধ আমি পাচ্ছি না। আমি পাচ্ছি সুবাস। সুঘ্রাণ। প্রেমিকার দেহের ঘ্রাণ, স্ত্রীর দেহের সুগন্ধ। পুত্রের কোমল মায়াবী শিশুগন্ধ।
আহ, এরচে পবিত্র গন্ধ আর কী হতে পারে!
ভালোবাসার গন্ধই তো পবিত্রতম গন্ধ।
এখন ডাকছে ঝিঁঝিরা। ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে গলা খুলেছে কীটপতঙ্গ। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে খোলা উঠান। বাঁশঝাড় আর গাছপালায় মৃদু একটু হাওয়া আছে। সেই হাওয়ায় নড়াচড়া করছে তলার ছায়া।
অদ্ভুত এক নীরবতা!
অদ্ভুত!
বাড়ির চারপাশে বর্ষার জল। কত মাছ শ্বাস ফেলতে ওঠে। কত মাছ ঘাই দিয়ে যায়। শেষ বিকেল থেকে এই এতটা রাত পর্যন্ত একটা মাছও বুঝি শ্বাস ফেলতে ওঠেনি! একটা মাছও ঘাই দেয়নি। ওদের নিষ্ঠুরতায় পানির তলার মাছও বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেছে। দমবন্ধ করে পড়ে আছে পানির তলায়।
আমাদের কবুতরগুলো কোথায় গেল?
গ্রাম পাখিদের সঙ্গে ওরাও কি চলে গেছে অচিন নিরাপদ গাঁয়ে!
মায়া, এই যে দেখো আমি তোমার গালে হাত বুলাচ্ছি। একহাত তোমার গালে আরেক হাত আমার পুত্রের গালে!
আহ, কী যে ভাল লাগছে!
কী যে ভাল!
ও যেকথা বলতে চাইলাম। তোমাকে পাথালিকোলে মানে পাঁজাকোলে নেওয়ার কথা। জানুয়ারি মাস...
না তার আগে সেই নৃশংস ঘটনার কথা বলি। ১৩ জুন। সৈয়দপুর রেল স্টেশান। ১৩ সংখ্যাটা কি সত্যি অশুভ? নয়তো ওই তারিখেই কেন ঘটেছিল পৃথিবীর নৃশংসতম এই ঘটনা?
চেঞ্জার নামে একটা গানের যন্ত্র বেরিয়েছে।
সেভেনটি এইট আরপিএমের ভারী রেকর্ডগুলো তো আছেই, লং প্লেয়িং রেকর্ড বেরিয়েছে। বিশাল সাইজ। পাতলা, প্লাস্টিকের। থারটি থ্রি আরপিএম। একেক পিঠে ছয়টা করে গান। এপিঠ ওপিঠ মিলিয়ে বারোটা গান।
চেঞ্জার অদ্ভুত যন্ত্র। একবারে ছয়টা রেকর্ড চাপানো যায়। বক্সটার মাঝামাঝি জায়গায় শূন্যে, একটা স্ট্যান্ডের ওপর ঝুলে থাকবে ছয়টা রেকর্ড। অন করলে একটা রেকর্ড প্রায় নিঃশব্দে পড়বে। পিন যেখানটায় বসানো থাকে সেই হ্যান্ডেলটা এসে বসবে রেকর্ডে। গান শুরু হবে। অর্থাৎ সব কিছুই অটোমেটিক। স্বয়ংক্রিয়।
যদি থারটি থ্রি আরপিএমের লং প্লেয়িং ছয়টা চাপানো হয় তাহলে একেকটা রেকর্ডের একেক পিঠে ছয়টা করে গান, এক লং প্লেয়িংয়ের ছয়টা শেষ হলে নামবে আরেকটা রেকর্ড, এভাবে ছয়টা। অর্থাৎ ছয় ছয় ছত্রিশ। একবারে ছত্রিশটা গান শোনা যাবে। তবে যন্ত্রটা চালাতে হবে ইলেকট্রিসিটিতে। প্লাগপয়েন্ট ইত্যাদি লাগবে।
বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি তো আছেই!
খালাকে তুমি পাগল করে ফেললে চেঞ্জার একটা কিনে দিতেই হবে।
প্রথম প্রথম খালা রাজি হচ্ছিলেন না। কেন চেঞ্জার কিনতে হবে? কলের গান তো আছেই! পাটুয়াটুলি থেকে রেকর্ড কিনছিস মাসে মাসে। বাড়িতে থাকলেই তো গান শুনছিস! টেলিভিশনও কিনে দিয়েছি। এত কিছু কিনতে হবে কেন?
তোমার ওই এক কথা। না আমি কিনবোই। বিনাদের বাড়িতে চেঞ্জার কিনেছে, আমিও কিনবো। চেঞ্জারের সঙ্গে লং প্লেয়িং রেকর্ড কিনবো অনেকগুলো। রাতেরবেলা চেঞ্জারে ছয়টা করে রেকর্ড চাপিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বো। কিনে দাও।
শেষ পর্যন্ত খালা রাজি। তোমার কথা কি না রেখে পারেন?
একমাত্র মেয়ে।
মহা আদরের মেয়ে।
মাসখানেকের মধ্যে চেঞ্জার কেনা হলো। স্টেডিয়ামের নিচতলায় ইলেকট্রনিক্সের বড় বড় দোকান হয়েছে। ওখান থেকে কেনা হলো। হালকা সবুজ রংয়ের চারকোনা একটা বক্স। লং প্লেয়িং কিনলে অনেকগুলো। তারপর ওই যন্ত্র নিয়ে মাতামাতি। দুপুরের পর চেঞ্জারে লং প্লেয়িং চাপিয়ে তুমি দোতলায়, তোমার বিছানায় শুয়ে মুগ্ধ হয়ে গান শুনছো।
সেই সন্ধ্যায়ও শুনছিলে।
মনে আছে, মায়া?
সেই সন্ধ্যার কথা তোমার মনে আছে?
সেই মনোরম সন্ধ্যা!
সেই ঘোরলাগা সন্ধ্যা!
আমাদের তখন গভীর আনন্দে থাকার কথা। আমি, বাচ্চু আর আমার বন্ধু সবারই থাকার কথা আনন্দে। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় যাবেন। এই প্রথম পাকিস্তান শাসন করবে পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা। এই তো ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হলো। পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ পেল ১৬০। তাও বিপুল ভোটের ব্যবধানে। মনোনিত মহিলা আসনসহ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩১৩ আসনের ১৬৭ আসনই পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর দল। ভুট্টোর পিপলস পার্টি পেয়েছে ৮৮, অন্য সব দল মিলে পেয়েছে ৫৮।
বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা করবেন, দেশ পরিচালিত হবে ছয় দফার ভিত্তিতে। কারণ ছয় দফার কথা বলে তিনি জনগণের ভোট পেয়েছেন।
কিন্তু না, আমরা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। পাকিস্তানিরা কি বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতায় যেতে দেবে?
জানুয়ারি থেকেই আমাদের সন্দেহ তীব্র হতে লাগলো। সারাদিন ওই নিয়েই আলোচনা করি। বঙ্গবন্ধুর মিটিং থাকলেই দৌড়ে যাচ্ছি সেখানে। তাঁর বক্তব্য শুনি মন দিয়ে। একদিকে উদ্বেলিত হই, অন্যদিকে হই চিন্তিত। সন্দেহ বাসা বাঁধে মনে।
গত বছরের নির্বাচন আমাদের জন্য যেমন আনন্দের ছিল, ঠিক তার আগের মাসে, ১২ নভেম্বর, আহা, আমাদের এই দেশটির উপকূল এলাকায়, কী ঘটে গেল! পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় সাইক্লোন, এমন প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আর কি কখনও হয়েছে? দশবিশ হাজার না, এক দুই লাখও না, মারা গেল দশ লাখ লোক। যারা বেঁচে থাকলো তারাও অনেকে মারা গেল খাবারের অভাবে, পানির অভাবে, অষুদের অভাবে।
আহা রে, আহা!
সাইক্লোনের একটা ঘটনা বলি।
চর ফ্যাসানের ঘটনা। সাইক্লোন শুরু হয়েছে। একজন স্কুল মাস্টার, তরুণ স্কুল মাস্টার, সাতাশ আঠাশ বছর বয়স। সংসারে বাপ মা ভাইয়েরা আছে। সাইক্লোন শুরু হলো। বাপ মা কোনদিকে উড়ে গেল বা ভেসে গেল কে জানে! দুই ভাই ঘরের চালায় উঠে, মানে দিশেহারা তো, কী করবে না করবে, কীভাবে বাঁচতে পারবে বুঝে উঠতে পারছে না, প্রাণ বাঁচাতে উঠেছে ঘরের চালায়।
দুমড়ানো কাগজের মতো দুমড়ে গেল চালা। কোথায় উড়ে গেল মাস্টারের দুভাই, কে জানে!
মাস্টার ছিলেন ঘরের ভিতর। স্ত্রী পিছন থেকে ধরে রেখেছে তাঁর গলা, দুইহাতে ধরা দুই ছেলে। একজনের বয়স সাত আরেকজনের চার। দুমড়ানো চালা পড়লো মানুষগুলোর ওপর। ওদিকে কোত্থেকে তীরের মতো ছুটে এলো তালগাছের ধারালো একটা ফালি। মাস্টার সাহেবের উরুতে গেঁথে গেল।
তখনও স্ত্রী পিছন থেকে ধরে রেখেছে গলা, দুইহাতে দুই ছেলে। ঝিমধরা লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে বয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, সঙ্গে প্রবল জলোচ্ছ্বাস।
কিয়ামত।
কিয়ামত।
প্রথমে এক ঝাটকায় চলে গেল স্ত্রী। ওই দলা মোচড়া চালার কোন ফাঁক দিয়ে কোথায় ভেসে গেল সে, তার চিৎকার, আর্তনাদ শুনতেই পেল না কেউ।
তারপর গেল এক ছেলে।
তারপর গেল আরেক ছেলে।
ভদ্রলোকের উরুতে গেঁথে আছে বল্লমের মতো তালগাছের ফালি। সংসারের প্রতিটি মানুষ গেল, বেঁচে গেলেন শুধু তিনি।
এই বাঁচার কী অর্থ, মায়া?
এই যেমন তোমরা সবাই চলে গেছো, প্রকৃতিসৃষ্ট সাইক্লোনের চেয়েও ভয়ঙ্কর একদল... তোমাদের কেড়ে নিল, আমার বাবাকে আমার মাকে, আমার বোনকে আমার স্ত্রীকে, আমার সন্তানকে, বেঁচে আছি শুধু আমি। সেই মাস্টারের মতো। কোথাও কেউ নেই, এত বড় পৃথিবীতে মানুষটি একা।
মায়া, আমার নিজের জন্য খুব মায়া লাগছে।
আমার নিজের জন্য খুব কান্না পাচ্ছে।
কিন্তু যোদ্ধাদের কাঁদতে নেই, মায়া। যোদ্ধার চোখে অশ্রু মানায় না।
আচ্ছা শোনো, তারপর, তারপর ইয়াহিয়া সরকারের মনোভাবের কথা শোনো। বাঙালিদের প্রতি ওদের অবজ্ঞার কথা শোনো।
এত বড় দুর্যোগের পর, দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পর উপকূলীয় এলাকায় যেভাবে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসার কথা পাকিস্তান সরকারের, তারা একদমই সেভাবে এগিয়ে এলো না। ঘূর্ণিঝড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি এরকম নিষ্ঠুরতা, এরকম অবহেলা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা, আমরা, বাঙালিরা ইয়াহিয়া সরকারের ওপর ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলাম। তীব্র ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা ওদের ওপর। মাওলানা ভাসানী প্রচ- ক্ষোভে প্রকাশ্য এক সভায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি করে একটি ঘোষণা দিলেন।
পরের মাসেই এই বেদনা অনেকখানি কাটলো আমাদের।
সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়। পাকিস্তান শাসন করবেন বঙ্গবন্ধু, তাঁর দল। ছয় দফার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে দেশ। স্বপ্ন পূরণের দিন আসছে।
সেই সন্ধ্যার কথা বলি মায়া।
সেই সন্ধ্যার কথা বলি।
সন্ধ্যাবেলাই সেদিন বাড়ি ফিরেছি। ফিরে দেখি তুমি ধীরে পায়ে হাঁটছো। গেটের ওদিকটায়, লিচুগাছগুলোর ওদিকটায়। এরকম হাঁটাকে বলে পায়চারি করা।
তুমি পায়চারি করছো।
আমাকে দেখে অবাক। তুমি এত তাড়াতাড়ি আজ? কী মনে করে?
আমি হাসলাম। তোমার কথা মনে করে!
ইস, আমার কথা মনে করে! আমার কথা তুমি ভাবো নাকি! বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই তো ভুলে যাও যে তোমার একটা বউ আছে।
না গো, ভুলি না।
তুমি মুখ ভেংচে বললে, না গো, ভুলি না। আল্লাদ।
আমি কথা ঘোরাবার জন্য বললাম, দেখো, আজকের সন্ধ্যাটা কী অসাধারণ! আকাশটা কী সুন্দর! আলোটা কী সুন্দর! সন্ধাবেলার আলো...
প্রথমে খেয়াল করিনি যে চেঞ্জারে রেকর্ড চাপিয়ে এখানে এসে পায়চারি করছো আর গান শুনছো তুমি। তোমার কথায় খেয়াল হলো।
গানটা শোনো।
আমি কান পাতলাম। শ্যামল মিত্রের গান হচ্ছে।
সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যায়
আর এমনি মায়াবী রাত মিলে
দুজনে শুধাই যদি
তোমারে কী দিয়েছি
আমারেই তুমি কী বা দিলে...
তুমি বললে, আমাকে তুমি কী দিয়েছো না দিয়েছো তা আমি বলতে চাই না, তবে তোমাকে আজ আমি অসামান্য এক উপহার দিতে চাই।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
শুনি কী উপহার। না না, শোনার দরকার নেই। দাও সেই উপহার। দেরি করছো কেন?
তুমি আমার গায়ের কাছে অনেকটা ঘেঁষে এলে। বাঁদিককার বাহু দুহাতে ধরে বুকের কাছে মুখ রেখে বললে, তোমাকে আমি সন্তান উপহার দিচ্ছি। তুমি বাবা হতে যাচ্ছো...
শুনে আমি কী রেখে কী করবো বুঝতে পারি না।
প্রথমে স্তম্ভিত হলাম, তারপর দিশেহারা, তারপর তীব্র আনন্দে ফেটে পড়া মানুষ। পাগল হয়ে যাওয়া মানুষ। আনন্দে পাগল হয়ে যাওয়া।
সত্যি মায়া? সত্যি?
সত্যি।
কেউ দেখে ফেলবে কিনা, দেখে ফেললে তুমি লজ্জা পাবে কিনা, কিছুই আমি ভাবলাম না, দুহাতে পাঁজাকোলে নিলাম তোমাকে। পাথালি কোলে। গভীর আনন্দে দুতিনটা পাক খেলাম তোমাকে কোলে নিয়ে। তুমি শুধু বলছিলে, ছাড়ো ছাড়ো। এমন করো না। কেউ দেখে ফেলবে...
সেদিনও কেউ আমাদের দেখেনি, আজও কেউ দেখছে না।
না না, দেখেছে, দেখেছে। সেদিন তোমাকে পাঁজাকোলে নিতে দেখেছিল সন্ধ্যাবেলার আকাশ, চারপাশের প্রকৃতি, লিচুগাছের সবুজ পাতা আর আজ দেখেছে মধ্যরাতের চাঁদ, বাড়ির নিঝুম হয়ে থাকা গাছপালা মাটি, বাড়ির চারপাশ ঘিরে থাকা বর্ষারজল।
হাওয়াও কি দেখে?
কবরের ভিতর শুয়ে থাকা আমার বাবা মা বোন কি দেখে?
আমার লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া পুত্র কি দেখে?
আর তুমি?
তোমার কী অনুভূতি মায়া!
এই যে আমি তোমার গালে মুখে হাত বুলাচ্ছি, মায়া, মায়া তুমি টের পাচ্ছো?
না না, ‘টের পাওয়া’ কথাটা ঠিক হলো না। মায়া, তুমি কি অনুভব করছো? অনুভব?
ভালোবাসার অনুভব!
প্রেমের অনুভব!
দুজন দুজনকে জড়িয়ে বেঁচে থাকার অনুভব!
আর আমাদের মাঝখানে থাকতো আমাদের সন্তান! সেই অনুভব!