×

সাময়িকী

বাউলগুরু লালন সাঁইয়ের ‘নতুন আইন’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০১৯, ০৮:৪৮ পিএম

বাউলগুরু লালন সাঁইয়ের ‘নতুন আইন’
বাউলগুরু লালন সাঁই মূলত ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিক থেকে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর অঞ্চলের হিন্দু, মুসলিম, বৈষ্ণব ও নাথ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন। সে সময়ে এভাবে বিভিন্ন ধর্মাচারী মানুষের মধ্যে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা খুব একটা সহজ ছিল না। কারণ, জাত-পাত তথা হিন্দু-মুসলিমের সহাবস্থান সমাজে স্বীকৃত ছিল না; আবার লৌকিক ধর্ম তথা ইসলামী সুফিমত, সনাতনীয় বৈষ্ণবমত এবং নাথদের দেহকেন্দ্রিক সাধনার মধ্যেও তেমন কোনো নৈকট্য ছিল না। কিন্তু লালন সাঁই আবির্ভূত হয়ে নানা ধরনের লৌকিক ও প্রতিষ্ঠিত ধর্মমত দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত সমাজের মানুষের মধ্যে মানবিক ঐক্য রচনায় তৎপর হন এবং প্রবর্তন করেন ‘নতুন আইন’। কিন্তু এই ‘নতুন আইন’টি কী? লালন সাঁইজি তাঁর একটি গানের বাণীতে বলেছেন- “এনেছে এক নবীন গোরা নতুন আইন এই নদীয়াতে বেদ-পুরাণ সব দিচ্ছে দুষে সে আইনে বিচার মতে॥ সাতবার খায় একবার স্নান, নাই পূজা নাই পাপ পুণ্য জ্ঞান অসাধ্যরে সাধন বিধান শিখাচ্ছে সব ঘাটে পথে॥ না করে সে জাতের বিচার কেবল শুদ্ধ প্রেমের আচার সত্য মিথ্যা দেখ প্রকাশ সাঙ্গপাঙ্গ জাত অজাতে॥ শুদ্ধ ঈশ্বরের চরণা তাই বলে সে বেদ মানে না লালন কয় তার উপাসনা কর দেখি মন কি দোষ তাতে॥” (শক্তিনাথ ঝা, ২০০৫, ১৩২) এখানে লালন সাঁই মূলত নদীয়ায় ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে আবির্ভূত ‘এক নবীন গোরা’ তথা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু [চৈতন্য মহাপ্রভু] প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্মকে ‘নতুন আইন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই ‘নতুন আইনে’র বিচারমতে ‘বেদ-পুরাণ সব’-এর দোষ প্রকাশ করা হয়; এমনকি প্রচলিত ধর্মজীবনের খাদ্য গ্রহণ ও স্নানের রীতি ভেঙে দেওয়া হয়। কেননা, চৈতন্য মহাপ্রভুর ‘নতুন আইনে’ সাতবার খেয়ে একবার স্নানের রীতি প্রবর্তিত হয়, সনাতনী পূজা প্রথা মানা হয় না, আর তাতে ‘পাপ-পুণ্য জ্ঞান’ থাকে না। ঘাটে পথে সর্বত্র ‘অসাধ্যরে সাধন বিধান’ শেখানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া, এই নতুন আইনে ‘জাতের বিচার’ করা হয় না, কেবল ‘শুদ্ধ প্রেমের আচার’ পালন করা হয়। এ ধরনের ‘নতুন আইন’ পালনকারী ‘সাঙ্গপাঙ্গ জাত অজাতে’ সত্য মিথ্যার ভেদ প্রকাশিত হয়। এই ‘নতুন আইন’ আনয়নকারী ব্যক্তি তথা ‘নবীন গোরা’ যে ‘শুদ্ধ ঈশ্বরের চরণা’র কথা বলে ‘বেদ মানে না’ তাও লালন সাঁই উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি [লালন সাঁই] সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, এই ‘নতুন আইন’-এর ‘উপাসনা কর দেখি মন, দোষ কি তাতে’। অর্থাৎ, লালন সাঁই বেদ-পুরাণ ও প্রচলিত পাপপুণ্য জ্ঞান সর্বস্ব জাত তথা ধর্মাদর্শকে অস্বীকার পূর্বক ‘শুদ্ধ প্রেমের আচার’ ও ‘শুদ্ধ ঈশ্বর চরণা’কে ‘নতুন আইন’ হিসেবে শনাক্ত করেছেন।রর গভীরভাবে বিবেচনা করলে এই ‘শুদ্ধ প্রেম’ ও ‘শুদ্ধ ঈশ্বর’কে লালন সাঁইজির ‘মানুষতত্ত্বে’র প্রধান বিবেচনা ‘মনের মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। আসলে, এক ও অদ্বিতীয় সত্ত্বাকে ‘মনের মানুষে’ রূপান্তরের মাধ্যমে লালন সাঁই তাঁর ‘নতুন আইনে’ জাতি-ধর্ম দিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত সমাজের মানুষকে মিলনের প্রয়াস গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। এতো গেল বৈদিকযুগের বেদকে সমালোচনা করে, বেদের আচারকে পরিত্যাগ করে, জাত-অজাতের বিচারকে অস্বীকার করে এক ধরনের নতুন আইনের কথা, যেখানে প্রেমের আচারই শ্রেষ্ঠ বিবেচ্য। বাংলায় হিন্দু-মুসলমান দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত সমাজের দ্বন্দ্ব ঘোচাতে লালন সাঁই সম্ভবত তাঁর জীবনের প্রথম থেকেই অত্যন্ত সচেতন হয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর জীবদ্দশায় নিজের জন্ম পরিচয়ের কোনো সন্ধান দেননি, এমনকি গানের ভাষার ইশারাতেও বলেননি নিজের জন্ম পরিচয়ের কোনো নির্দেশনা। কিন্তু লালন সাঁই যে জীবনব্যাপী সমাজের নানান মানুষের কাছে নিজের জাত পরিচয় নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন- তার প্রমাণ রয়েছে তাঁর একাধিক গানের বাণীতে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, লালনের সে সকল গানও তাঁর ‘নতুন আইন’-এর মর্মবাণীকে ধারণ করেছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় লালন সাঁইজির জাত (ধর্ম) পরিচয়ের প্রশ্ন থেকে উদ্ভূত একটি গানের উদ্ধৃতি দেওয়া যাক। গানটি হলো- “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে॥ কেউ মালা কেউ তসবি গলায় তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায় যাওয়া কিংবা আসার বেলায় জেতের চিহ্ন কার রয় রে॥ যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান নারীলোকের কি হয় বিধান বামন চিনি পৈতা প্রমাণ বামনি চিনি কিসে রে॥ জগৎ বেড়ে জাতের কথা লোকে গৌরব করে যথাতথা লালন সে জাতের ফাতা বিকিয়েছে সাধ বাজারে॥” (শক্তিনাথ ঝা, ২০০৫, ১১২) এখানে লালন সাঁই যুক্তি দিয়ে সমাজের হিন্দু ও মুসলিমদের ধর্মাচারের দুটি চিহ্ন বা প্রতীক সুন্নত ও পৈতার উদাহরণ দিয়ে পুরুষ শাসিত ধর্মসমাজের সমালোচনা করেছেন। একই সঙ্গে এই ধর্মের অসাড়তাকে অস্বীকার করে নিজেকে প্রচলিত ধর্মদেশের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। লালন এখানে তাঁর নিজের ‘নতুন আইন’ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের ধর্ম পরিচয়কে লুপ্ত করেছেন এবং সে কথা এই গানের বাণীর ভেতর দিয়ে তিনি ঈঙ্গিতপূর্ণ উপায়ে ঘোষণায় দিয়েছেন। এ কারণে, লালন সাঁই হিন্দু কি মুসলমান, বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান- এ সকল প্রশ্নের দ্বিধায় না পড়ে সমাজের সাধারণ মানুষের পক্ষে লালন মতে দীক্ষা নেওয়া বা লালন প্রবর্তিত বাউল মতের অনুসরণ করা অনেকটাই সহজ হয়েছে এবং সমাজের প্রায় সকল ধর্মের মানুষ লালন মতে দীক্ষা নিয়ে একই সাথে সাধুসঙ্গ করে আসছেন। সকল ধর্মের মানুষের ভেতরেই কোনো না কোনোভাবে মানবিক প্রেম সুপ্ত রয়েছে। কিন্তু নানান দেশের নানান সংস্কৃতি, ধর্মের আচার, পাপ-পুণ্য জ্ঞান, এমনকি খাদ্যাভ্যাস মানুষের ভেতরে লুকানো সেই মানবিক প্রেম প্রকাশ করতে দেয় না। বাউলগুরু লালন সাঁই এটা গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। তাই তিনি গানের ভাষায় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন- “পাপ পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই এদেশে যা পাপ গণ্য, অন্যদেশে পুণ্য তাই। তিব্বত নিয়ম অনুসারে এক নারী বহু পতি করে এদেশেতে হলে পারে ব্যাভিচারী দ- তায়॥ শুকর গরু দুটি পশু খাইতে বলেছেন যিশু এখন কেন মুসলমান হিন্দু পিছেতে হঠায়॥ দেশ সমস্যা অনুসারে ভিন্ন বিধান প্রচারে লালন বলে বিচার করলে পাপপুণ্যের নাহি বালাই॥ পুণ্য করলে স্বর্গবাসী, পাপ হলে ভবে আসি লালন বলে নামে উদাসী নিত্য নিত্য প্রমাণ পাই॥” (শক্তিনাথ ঝা, ২০০৫, ১১৩) এই গানের ভেতর বাউলগুরু লালন সাঁইয়ের যুক্তিবাদী ও উদার মনোভাবের প্রকাশ আছে। এখানে নানা দেশের মানুষের মধ্যে প্রচলিত জৈবিক সম্পর্কের ভিন্নতার কথা যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি ধর্মভেদে খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে লালন সাঁই শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন যে- আসলে, নানান দেশে, নানান ধর্মে ভিন্ন বিধান প্রচার পায়; কিন্তু কেউ যখন এ সকল সমস্যার কথা খোলা মনে বিচার করে দেখেন তখনই সকল সমস্যার সমাধান ঘটে, পাপপুণ্যের ভেদ লুপ্ত হয়। এখানে লালন সাঁইজির ‘নতুন আইনে’র স্বরূপ ও উদারতা প্রকাশ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এ ধরনের গানের বাণী লালনের প্রতি সকল ধর্মের ও দেশ-কালের মানুষকে আকৃষ্ট করে। কেননা, এখানে যুক্তির প্রাবল্য আছে। আর এই অখ-নীয় যুক্তি ও উদার মানবিক অনুভব বাউলগুরু লালন সাঁইয়ের ‘নতুন আইন’ তথা নতুন পথের প্রতি সকল ধর্মের মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাই লালন সাঁইয়ের বাউলমতে খুব সহজে অনুপ্রবেশ ঘটেছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বৈষ্ণব সকল ধর্মের মানুষের। ভারতের তামিলনাড়–র খ্রিস্টান ফাদার সৃজন, জাপানের হিরোসিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসাহিকো তোগাওয়া লালনমতে দীক্ষা নিয়েছেন, এবং আমেরিকার কালিফরনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি. স্কলার কিথ ই. কান্তু ও ওয়াসিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ম্যাডেলিন বেকের দীর্ঘদিন ধরে বাউলমত অনুসরণ করছেন। আমার উপস্থাপনার এ পর্যায়ে তাঁদের বাউলমতে দীক্ষা গ্রহণ ও বাউলমত চর্চা সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই। আমাদের বিশ্বাস, তাঁদের মতামত ও কথার ভেতর দিয়ে আধুনিক যুগের ধর্ম হিসেবে লালন সাঁইজির ‘নতুন আইন’ সম্পর্কে কিছু বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ পাওয়া যাবে। তামিলনাড়–র খ্রিস্টীয় ফাদার ড. সৃজন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে অবস্থিত শান্তিনিকেতনে এসে বাউলদের মুখে গান শুনে প্রথমে মুগ্ধ হন। তারপর তিনি গানের বাণীর ভেতর নানাবিধ যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন ও নতুন পথের ঠিকানা আবিষ্কার করেন এবং বাংলাদেশের গাজীপুর অঞ্চলের লালনপন্থী বাউলসাধকের কাছে দীক্ষা নেন। তিনি বলেন-“আমরা খ্রিস্টীয় ফাদার, যিশুর সাথে একাত্ম হয়ে যে সাধনা করি, বাউলমতে দীক্ষা নেবার পর- আমার মনের মানুষ হিসেবে তাঁকে আমি অনুভব করতে সক্ষম হয়েছি। আমার গুরু কখনই আমাকে খ্রিস্টীয় ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলেননি। তাই আমি একজন বাউল হিসেবে নিয়মিত সাধুসঙ্গ করি। বাউলমতের দেহসাধনা, ধ্যানযোগ ও গুরু ভজনার দ্বার দিয়ে আমি একজন খ্রিস্টীয় ফাদার হয়েও অবলীলায় ভাবসাধনা করি। আরেকটি বিষয়, আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে- বাউলরা নিতান্ত সাধারণ জীবনযাপন করে একদিকে যেমন দেহকেন্দ্রিক সাধনা করে, অন্যদিকে তেমনি মনুষ্যজ্ঞানের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে। এটা সাধারণত আমরা প্রচলিত সমাজের মানুষের মধ্যে পাই না। কিন্তু বাউল সমাজে পাই।” ফাদার ড. সৃজনের উপর্যুক্ত মন্তব্যে স্পষ্ট ফুটে ওঠে যে, বাউলগুরু লালন সাঁইয়ের ‘নতুন আইন’ একজন ভিন্নদেশী খ্রিস্টীয় ফাদারকেও বাউলমতে স্থান দেয়। ফাদার সৃজনের মতো লালনপন্থার মনুষ্যজ্ঞানকে গ্রহণ করেছেন ইটালি থেকে আগত ফাদার রিগন। তিনি দীর্ঘ বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের মোংলায় অবস্থান নিয়ে লালনতত্ত্বের প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং ইটালিয়ান ভাষায় বেশ কিছু লালনের গানের অনুবাদ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। জাপানের হিরোসিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যাপক মাসাহিকো তোগাওয়া জানান- “জন্মসূত্রে একজন বৌদ্ধ হিসেবে বাউলমতের সাথে অনেক নৈকট্য খুঁজে পাই। আমি দীক্ষা নিয়েছি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামের আলাউদ্দীন শাহের কাছে। কিন্তু আমি বাউলতত্ত্বের নানা বিষয় সাধুসঙ্গে গিয়ে জানতে সক্ষম হয়েছি। আসলে, বাউলগুরু লালন সাঁইজির ঘরে ঢুকতে কোনোদিনই আমি কোনো জাত-অজাতের বিচার করা হয় না। এমনকি একজন ভিনদেশী হয়েও সাধুসঙ্গে সবাই আমাকে খুব সমাদর করেছে।“রা আমেরিকার কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি. স্কলার কিথ ই কান্তু ও ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ম্যাডেলিন বেকের বাউলমতে যুগল সাধনা করছেন। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাউল-সাধুগুরুদের গৃহে অবস্থান ও সাধুসঙ্গ করে আসছেন। তাঁরা জানান- “বাউলদের ভাবসাধনায় অনেক স্বাধীনতা পাওয়া যায়। আমাদের মন যা চায় তার সব কিছু বাউল সাধনার গভীরে প্রত্যক্ষ করি। সে আমাকে কিছুই করতে বাধ্য করে না, কিন্তু ভক্তি ও প্রেম দিয়ে বাউল সাধনার সব কিছু করতে আমাকে অনুপ্রাণিত করে।” ভিন্নভাষী, ভিন্নদেশী এবং ভিন্নধর্মীয় ব্যক্তিদের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন ব্যক্তি বাউলগুরু লালন সাঁইয়ের ‘নতুন আইনে’ দীক্ষা-শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে মুসলিম ধর্ম হতে আগত বাউলসাধক-শিল্পী ফকির আব্দুর রব শাহ বলেন- “সাঁইজির ঘরে দীক্ষা নিয়ে আমাদের চক্ষুদানী ঘটেছে। তা না হলে কী বুঝতাম যে, শরিয়তি বিধানের চেয়ে, এমনকি তরিকত হাকিকতের চেয়ে মারফতি সাধক লালন সাঁইজির পথটি উত্তম। কেননা, সাঁইজির গানে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে- আল্লাহর সমান। অর্থাৎ নিজের ভেতর আল্লাহ স্বরূপ আবিষ্কার করা শেখায়। যেমন- দেখেন লালন সাঁইজি বলেছেন-‘আল্লাহ কে বোঝে তোমার অপার লীলে/তুমি আপনি আল্লাহ, ডাকো আল্লাহ বলে।’ এই যে আমার ভেতর বোধ এলো, এটা কোথায় পেলাম আমি? গুরুর কাছে। গুরু কোথায় পেয়েছেন? তাঁর গুরুর কাছে, মানে আমার দাদাগুরুর কাছে। তিনি শিখেছিলেন- তাঁরও গুরুর কাছ থেকে, এভাবে লালন সাঁই হয়ে ওঠেন আমাদের আদিগুরু। আরেকটি কথা, আমরা লালনপন্থীরা কিন্তু মানুষগুরুর উপাসনা করি। যদি প্রশ্ন করেন- তা কীভাবে করি? তবে, সাঁইজির গানের কথা দিয়েই উত্তর দিতে পারি। যেমন- সাঁইজি বললেন- ‘ধড়ো আজাজিল সেজদা বাকি রেখেছেন কোনখানে। কর রে মন সেজদা সেই জায়গা চিনে।’ অর্থাৎ আজাজিল ফেরস্তা স্বর্গমর্ত্যপাতালের সর্বত্র সেজদা দিয়েছেন, কিন্তু এক মানুষের পায়ে সেজদা দেননি। তাই তাঁর সব সাধনা বিফল হয়েছে, শয়তানের খাতায় তাঁর নাম উঠেছে। আমাদের বাউলগুরু লালন সাঁইজি সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে তাই মানুষের পায়েই সেজদা দিয়ে সবার উপরের নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন।” এভাবেই বাউলগুরু লালন সাঁইয়ের ‘নতুন আইনে’র স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাঁইজি যে আইনের বিচার মতে সকল ধর্মের আচার সর্বস্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরের সমস্যা সম্পর্কে যুক্তিনিষ্ঠ কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছেন। আসলে, তুলনামূলক সমালোচনা-পদ্ধতি প্রয়োগ করে তিনি তাঁর ‘নতুন আইন’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।ারর এই উপস্থাপনায় লালন প্রবর্তিত ‘নতুন আইন’-এর পরিভাষা ও ব্যবহারিক তাৎপর্য অনুভবের প্রতি কিছু ইঙ্গিত করা হলো মাত্র। পরবর্তীতে এ বিষয়ে বিস্তৃত গবেষণার সুযোগ রয়েছে। আধুনিক যুগের ধর্মের স্বরূপ কেমন হতে পারে- তার কিছু দৃষ্টান্ত লালন সাঁইয়ের ‘নতুন আইন’ হতে উপলব্ধি করা যেতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App