×

সাময়িকী

নরম্যান্ডির পথে পথে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০১৯, ০৮:৫৩ পিএম

নরম্যান্ডির পথে পথে
সাহিত্যের অনেক শাখা। মহাকাব্য, নাটক, কাব্য, গীতিকাব্য সৃষ্টি হয়েছে সেই কবে, খ্রিস্ট জন্মাবার কয়েক শতাব্দী আগে। পরে এসেছে এসব সাহিত্যকে উপভোগ করার জন্য সমালোচনা-সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব। ভ্রমণ সাহিত্যও লুকিয়েছিল মহাকাব্য ও কাব্যের বিক্ষিপ্ত কাহিনীগুলোর মধ্যে। এই উপমহাদেশের রচিত ‘কথাসরিত সাগর’ ও ‘জাতক’ এক অর্থে ছোট গল্পের প্রথম প্রকাশ বা আধার। কথাসরিত সাগরের গল্পেরই রূপান্তরিত রূপ ঈশপের গল্প কাহিনী (Aesop’s Fables)। প্রকৃত ভ্রমণ সাহিত্য বা ভ্রমণকে নিয়ে লেখা সাহিত্য অনেক পরের সৃষ্টি হলেও বেশ কয়েকটি প্রাচীন মহাকাব্যে ভ্রমণ সাহিত্য লুকিয়ে রয়েছে। যেমন মহাকবি হোমারের ইউলিসিস মহাকাব্য হলেও সেখানে রয়েছে ট্রয় থেকে ইউলিসিসের জন্মভূমি ইথাকায় ফিরে আসার ভ্রমণগাথা। রামায়ণের অরণ্য কাণ্ডেও রয়েছে অযোধ্যা থেকে দণ্ডকারণ্যের মধ্য দিয়ে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতার দক্ষিণ ভারতের শেষ প্রান্ত শ্রীলঙ্কায় পৌঁছানোর বর্ণনা। হনুমানের সীতা অন্বেষণেও রয়েছে তাই। কালিদাসের অপূর্ব কাব্য ‘মেঘদূতেও’ বিরহী প্রেমিকের মুখ দিয়ে বর্ণিত হয়েছে ভারত ভূমির ওপর দিয়ে মেঘের যাত্রার এক অভূতপূর্ব কাহিনী। কারো কারা মতে, কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ কাব্যে নিম্নের এই দুটি পঙ্তিতে যে চিত্র আঁকা হয়েছে তা সমুদ্র উপকূলবর্তী তাল-তমাল বৃক্ষ আচ্ছাদিত বাংলার’ই। দুরাদয়শ্চক্র নিভস্য তন্বী তমালতালি বনরাজিনীলা আভাতিবেলা লবণাম্বুরাশের্ধারা নিবদ্ধেব কলঙ্করেখা দুই. ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা গদ্য-সাহিত্যের যে অভিনব জাগরণ ঘটে তা অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই বিশ্ব সাহিত্যের সমৃদ্ধ গদ্য সাহিত্যের চূড়াকে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিল। তখন থেকেই গদ্য সাহিত্যে আমরা পেয়েছি অসাধারণ নাটক, উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ সাহিত্য যার মধ্যে রয়েছে সমৃদ্ধ সমালোচনা-সাহিত্য। কিন্তু আমরা পাইনি খুব বেশি মৌলিক ভ্রমণ কাহিনী যা আমাদের মনকে দেশ থেকে দেশান্তরে নিয়ে যেতে পেরেছে, পরিচয় করিয়ে দিতে পেরেছে বিচিত্রসব প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড় ভাই সঞ্জিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্ভবত প্রথম মৌলিক-সার্থক ও মনকাড়া ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন। তাঁর ‘পালামৌ’ই বাংলা ভাষার প্রথম ও আজ পর্যন্ত লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ আলেখ্য। এই ভ্রমণ কাহিনীতে তিনি পালামৌ’র পাহাড়-বনভূমি ও আদি জনজীবনের সঙ্গে তাঁর একাত্মতার পরিচয় তুলে ধরেছেন। এই ভ্রমণ কাহিনীরই বহুল উদ্ধৃত একটি লাইন অনেকেরই জানা- ‘বন্যেরা বনে সুন্দর- শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ মাইকেল কোনো ভ্রমণ কাহিনী লেখেননি। কিন্তু তাঁর বিদেশে বসে লেখা সনেটগুলোয় প্রবাসী জীবনের আনন্দ-বেদনা ও স্বদেশের জন্য তীব্র আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে রয়েছে আকাশের সীমাহীনতা, মহাসাগরের কল্লোল ধ্বনি ও অতলান্ত গভীরতা। কোনো বিষয়ই কি আছে যা নিয়ে তিনি লেখেননি! রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রবন্ধ সাহিত্যও অবিস্মরণীয়। বিংশতি বর্ষ পেরোনোর আগেই তাঁকে পাঠানো হয়েছিল ইংল্যান্ডে পড়াশুনা ক’রতে। সেখানেই বসেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রবাসী-জীবনের অভিজ্ঞতা যা ছাপা হয়ে বেরিয়েছিল ‘য়ুরোপ প্রবাসী পত্র’ ও ‘য়ুরোপে যাত্রীর ডাইরী’ নামে। ‘য়ুরোপ প্রবাসী পত্রে’ দেখা যায় যুবক রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছেন ইংরেজ সমাজের গতিবেগ ও তারুণ্য দেখে। এই সমাজের অন্তর-ঐশ্বর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল; অবশ্য, পরবর্তীকালে জীবন-সায়াহ্নে ‘সভ্যতার সংকটে’ এই সভ্যতার যে একটা কুৎসিত রূপ, ধ্বংসের রূপ রয়েছে তাও তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তীব্র ভাষায়, কঠোর ভর্ৎসনা বাক্যে। ১৮৯০-এর দশকে তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে শিলাইদহের জমিদারির ভার দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি অনেক দিন শিলাইদহে প্রমত্ত পদ্মার অদূরে কুঠি বাড়িতে এবং নদীর উপরে নৌকায় বা বোটে ছিলেন। সে সময়েই তিনি গ্রাম বাংলার অসাধারণ মানুষগুলোর ছবি ও চরিত্র এঁকেছেন তুলনাহীন ছোট গল্পগুলোতে। এসব ছোট গল্প আজ বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ছোট গল্প হিসেবে অভিহিত। এছাড়াও এ সময় বিভিন্ন জনকে যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন সেগুলোও ভ্রমণ-সাহিত্যের এক তুলনাহীন আলেখ্য। সেখানে যেমন ফুটে উঠেছে পূর্ব বাংলার প্রকৃতির মেদুর মায়াময় ছায়াচ্ছন্ন রূপ, বর্ষা-শরৎ ও বসন্তের অনিন্দ সৌন্দর্য তেমনি তার ভয়াল ও রুদ্র রূপও। আশপাশের জনজীবনের কথাও এসব চিঠির ছত্রে ছত্রে রয়েছে। এক কথায় রবীন্দ্রনাথের পত্র কেবলমাত্র প্রবন্ধ সাহিত্যেরই নয় ভ্রমণ সাহিত্যেরও এক অপূর্বগাথা। বিশেষত গ্রাম বাংলার ও পদ্মার প্রকৃতির যে সীমাহীন ঐশ্বর্য তুলে ধরা হয়েছে এসব পত্রে তা পাঠকের অন্তর্লোকে প্রকৃতিকে চেনার এক তৃতীয় চোখের উন্মিলন ঘটায়। রবীন্দ্রনাথ অনেক দেশে গেছেন, তাঁর মতো পরিব্রাজক খুব কমই আছেন। ইউরোপ, দুই আমেরিকা মহাদেশ ও এশিয়ার বহু দেশই তিনি ভ্রমণ করেছেন। সেসব দেশের খ-চিত্র তাঁর গদ্যে ও পদ্যে উঠে এসেছে। পুরো দেশের সার্বিক এমনকি আর্থ-সামাজিক জীবনের বিশ্লেষণ উঠে এসেছে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে। তৎকালীন রাশিয়ায় শিক্ষার ও চিন্তামুক্তির যে-আন্দোলন চলছিল তা তাঁকে নিবিড়ভাবে মুগ্ধ করেছিল। ভ্রমণ সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথ এক অনন্য স্তরে উন্নীত করেন। তাঁরই পথ ধরে পরবর্তীকালে আরো বেশ কয়েকজন বাঙালি ভ্রমণ সাহিত্য রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’ ও সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’ বহু খ্যাতি কুড়িয়েছে- জনচিত্তে আসন পেয়েছে। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্তের’ দ্বিতীয় খ-ে সমুদ্রের বর্ণনা ও প্রবোধ কুমার সান্যালের ‘দেবতাত্মা হিমালয়’-এর বর্ণনা খুবই চিত্তাকর্ষক। যদিও এই দুটি গ্রন্থ প্রকৃত অর্থে ভ্রমণকাহিনী নয়। এ রকম আরো কিছু লেখায় যেমন : বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যকে’ প্রকৃতির বিচিত্র ও বহু বৈভবের চিত্র রয়েছে। হিমালয়ের বর্ণনায় উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এসব খ্যাতিমান লেখকদের লেখা সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় ভ্রমণ সাহিত্যের চর্চা যে খুব বেশি হয়েছে তা বলা যাবে না। অধুনাকালে কোলকাতা থেকে ‘ভ্রমণ’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের হয়। এখানে কিছু জায়গার নাম থাকে-কিভাবে সেখানে যাওয়া যায় এবং কোথায় থাকা যায় তার বর্ণনা থাকে। অর্থাৎ ভ্রমণের জন্য তথ্যচিত্র। আধুনিককাল প্রকৃত অর্থেই তথ্যের কাল। সেখানে তথ্যেই শুরু, তথ্যেই শেষ। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জায়গায় মানুষ ভ্রমণে যায় কখনো দল বেঁধে, কখনো একাকী বা সস্ত্রীক। তিন. এই তথ্যের যুগে তরুণ বড়–য়ার লেখা ‘নরম্যান্ডির ট্রেইন’ ভ্রমণ কাহিনীটি কেবল তথ্যের ভারে আক্রান্ত একটি শুষ্ক ভ্রমণের বৃত্তান্ত নয়, এটি একটি অসাধারণ সুন্দর ভ্রমণ-আলেখ্য। সাধারণত ভ্রমণ আলেখ্য বলতে এখন আমরা যা বুঝি, এটি তা নয়। এই আলেখ্যে মুখ্যত পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা তথ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সেখানে রয়েছে কতো প্রসঙ্গ কতো অজানা কথা। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে তিনি গেছেন, ভ্রমণের এক কাহিনীর মধ্যে কতো কাহিনীর যে-বুনট, তা মনকে ভরিয়ে তোলে, শিল্প ও সাহিত্যের নিত্যনতুন ঐশ্বর্যের সন্ধান দেয়। বর্ণনা তিনি শুরু করেন একটি স্থানের, কিন্তু সেখানে তিনি স্থির থাকেন না, জানতে চান বা জানাতে চান কবে কখন কী হয়েছিল সেখানে, কী অসাধারণত্বে সে-জায়গা অনন্য, কোন্ অনশ্বর-মাহাত্ম্য ধন্য করছে সে-স্থানকে বা কোন্ মর্মন্তুদ ঘটনা? তরুণ বর্তমানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তিনি প্রবাসী। প্রবাস জীবনের দোলাচল তাঁর ভ্রমণ কাহিনীকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। শেকড়হীন এক মানুষ, অন্য দেশে তাঁর শেকড় গড়ার চেষ্টা করছেন। দেশের শেকড়ের প্রতি রয়েছে তাঁর নিবিড় ভালোবাসা। অন্য দেশগুলোকেও তিনি ভালোবাসতে চাইছেন। তাই তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে অন্য দেশগুলোর অভিনবত্ব যখন তিনি বর্ণনা করছেন সেখানে উঠে আসছে সেই দেশগুলোর শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-ললিতকলার বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য, তার গণমানসের গভীরতার কথা। তুলনায় দেশের কথাও উঠে আসছে তার ভালো-মন্দ সবকিছু মিলিয়ে। সেখানে যেমন রয়েছে অন্যায় ও কুৎসিতের বর্ণনা, দৈন্যের কথা, তেমনি রয়েছে বাঙালি জীবনের সারল্য ও মায়া-মমতার কথা, অল্পকে নিয়ে সন্তুষ্টি ও বেঁচে থাকার কথা, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শী, শিক্ষক-বন্ধু সবার কথা। বাবার কথা বলতে যেয়ে তাঁর লেখায় উঠে এসেছে অষ্টাদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্রের কথা যিনি বাঙালির জন্য বিশাল ঐশ্বর্য চাননি; আর্তি জানিয়েছেন সে যেন সুখে থাকে- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ তরুণের বাবাও তরুণের জন্য ঐশ্বর্য চাননি। চেয়েছেন তরুণ যেন সুখে থাকে। সন্তানের জন্য শান্তি কামনা করেছেন ঐশ্বর্য নয়, এটিই বাঙালি জীবনের বৈশিষ্ট্য। পাশ্চাত্যে ঐশ্বর্যের আলোকছটায় বসে তরুণের ভারতচন্দ্রের এই কথাটি মনে এসেছে। এর মধ্যেই সে জীবনের মৌল বাণীর সন্ধান পেয়েছে। ‘নরম্যান্ডির ট্রেইন’ শুরু হয়েছে নরম্যান্ডি ভ্রমণ দিয়ে। আগেই উল্লেখ করেছি তরুণ যে দেশে গেছেন সে দেশকে ভালোবাসতে চেয়েছেন অর্থাৎ আমেরিকাকে। নরম্যান্ডির ওমাহা বীচ দেখার ইচ্ছে কেন তাঁর মধ্যে জেগেছে? কারণ তিনি পড়েছেন, জেনেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার অসংখ্য সৈন্য ফ্রান্সের এই ওমাহা বীচে আত্মোৎসর্গ করেছিল ফ্রান্সকে, ইউরোপকে হিটলারের অর্থাৎ নাজি জার্মানির দখল মুক্ত করতে। এই ওমাহা বীচে বা নরম্যান্ডি বীচেই শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই অসাধারণ দিনটি, যে দিনটি ইতিহাসের পাতায় সবসময় জ্বল জ্বল করে জ্বলবে, কোনদিন ভোলা যাবে না- মৃত্যুর তিমিরসঞ্জাত মরণাতীত আলোকে উদ্ভাসিত সেই ১৯৪৪ সালের ৬ জুন। এই দিনটি ইতিহাসে স্থান পেয়েছে (Day of Deliverance) যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বিশ্ব মানবতার মুক্তির সূচনা দিবস হিসেবে। এই দিন প্রায় দেড় লাখ আমেরিকান, কানাডিয়ান ও ব্রিটিশ সৈন্য অবতরণ করেছিল ফ্রান্সের তীরভূমিতে যার মধ্যে নরম্যান্ডি অন্যতম। এখানে এমফিবিয়ান জলযান থেকে বীচে নেমে বা নামতে যেয়ে একই দিনে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় দুই হাজার আমেরিকান সৈন্য। নরম্যান্ডির কথা লিখতে যেয়ে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে ফ্রান্সের কথা, ফ্রান্সের প্রসিদ্ধ সব মিওজিয়ামের কথা, যেগুলো নেপোলিয়ন সম্ভারপূর্ণ করেছিলেন সারা ইউরোপ থেকে অসাধারণ-সব শিল্পকর্ম নিয়ে এসে যখন তিনি প্রায় সারা ইউরোপই জয় করেছিলেন। ‘ল্যুভে’ তরুণ দেখেছেন ভেনেসিয় শিল্পী ক্যানোভার অসাধারণ ভাস্কর্য ‘কিউপিডস কিস’-নব্য ধ্রুপদী বা নিও-ক্লাসিকাল শিল্পের তুলনাহীন সৌন্দর্য সৃষ্টি- গ্রিক দেবী, সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির ছেলে কিউপিডের সঙ্গে সাইকির মিলনের মর্মরে তুলে-ধরা অমর প্রেম। ক্যানোভার কাজটি আহৃত নয়। ক্যানোভা নেপোলিয়নের আনুকূল্য ধন্য ছিলেন। ক্যানোভার প্রসঙ্গ এসেছে র‌্যফায়েল, লিওনার্দো ও মাইকেল এঞ্জোলোর সূত্র ধরে; ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁসের উন্মেষ হয়েছিল এসব মহাপ্রাণ শিল্পী এবং দান্তে ও পেত্রার্কের মতো কবি জন্ম নিয়েছিলেন বা কাজ করেছিলেন বলেই। তরুণ এঁদের কথা বলতে বলতে চলে এসেছেন এঁদেরই উত্তরসূরী নারী-সৌন্দর্যের অসাধারণ স্রষ্টা ফরাসি শিল্পী ইনগ্রেসে, কেনোভায়। কোনো জায়গার দেশকালের পরিচয় তরুণের লেখায় বারবার ফুটে উঠেছে সেখানকার সংস্কৃতি-শিল্পের কুশীলবদের পরিচয়ের মাধ্যমে- স্থাপত্যশিল্পী, ভাস্কর্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী, কবি, নাট্যকার, কথা সাহিত্যিকের পরিচয়ে, তাঁদের শিল্পের অনিন্দ্যতায়। তিনি যেমন দেলাক্রয়েক্স, কুরবেটে ও অন্যান্য সব মহৎ শিল্পীর কথা জানাতে চান, তাঁদের শিল্পকর্ম কেন অমিত-সুন্দরের আধার বুঝতে চান, তেমনি পাঠকদের জানাতে চান, তাদের হৃদয়ের উপলব্ধির তারে সাড়া জাগাতে চান শেক্সপিয়র, জেমস জয়েস ও রবার্ট ফ্রস্ট, কিটস, হেমিংওয়ে, অরওয়েল, আঁদ্রে জিদ, লুই এ্যরাগঁ, স্যামুয়েল বেকেট, অডেনের সৃষ্টিকর্মের মহত্ত্বের কথা কেবলমাত্র উল্লেখ করেই নয়, তাঁদের লেখার অতলান্ত গভীরতা ও বিশালতার অন্তত কিছুটা পরিচয়ও তুলে ধরে। তরুণের ভ্রমণ কাহিনীর একটা অসাধারণ বৈশিষ্ট্য শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিষয়ে আগ্রহ জাগিয়ে তোলা। মনে রাখা ভালো তরুণ সাহিত্যের-ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। ফ্রান্স বা প্যারিস ভ্রমণ পিপাসুদের পরম আগ্রহের জায়গা। অনেকেই এ’দেশ, এ’নগর ভ্রমণ করেছেন; এমনকি অনেকে তার মিউজিয়ামগুলো, বিশেষত ল্যুভের কথাও লিখেছেন; কিন্তু কেউ-কি সিলভিয়া-বিচ প্রতিষ্ঠিত ‘শেসক্সপিয়র এন্ড কোম্পানি’ প্রকাশনা সংস্থা ও লাইব্রেরির কথা এমন গভীর-বোধের মাধ্যমে জানিয়েছেন? বোধ শব্দটি উল্লেখ করলাম এ-জন্য, কারণ এই লাইব্রেরি এই প্রকাশনা সংস্থাই জেমস জয়েস বা হেমিংওয়ের লেখক বা অসাধারণ স্রষ্টা হিসেবে উন্মেষের ধাত্রী বা আঁতুর ঘর হিসেবে কাজ করেছে। সিলভিয়া-বীচের শেক্সপিয়র এন্ড কোম্পানিই জেমস জয়েসের লেখা বিংশ শতকের (কারো কারো মতে (Timb) শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ইউলিসিসের প্রকাশক। সিলভিয়া বীচ সেই-সুদূর আমেরিকার নিউজার্সি থেকে সেইন নদীর পাড়ে এসে এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ঠিক এক বছর পরে ১৯১৯ সালে, ‘মা’র কাছ থেকে তখনকার দিনের তিন হাজার ডলার ধার নিয়ে। তাঁর বাবা সিলভিস্টার-বীচ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের বন্ধু ছিলেন। সিলভিয়া আমেরিকাতেই প্রতিষ্ঠা পেতে পারতেন। তবুও তিনি কোনো এক অজানা টানে- তরুণের লেখা থেকে তা-ই মনে হয়- প্যারিসে এসে এই লাইব্রেরি ও প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করে বহু লেখকের (পাঠকেরও) প্রেরণার উৎসে পরিণত হন। ইংরেজির ছাত্র তরুণ। তার পক্ষে তো শেক্সপিয়রকে ক্ষণিকের জন্যও ভোলা সম্ভব নয়। তাই এ মহাকবির শ্রেষ্ঠ রচনা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নাটক হেমলেটের যে দুর্গ ডেনমার্কের ক্রোববুর্গে তা দেখতে তিনি ছুটে গিয়েছেন সেখানে, ‘ক্রোববুর্গ ক্যাশল অব হেলসিংগরে’। আরো বহু জায়গায় তরুণ গেছেন, যেমন ইতালি ও আয়ারল্যান্ড। আয়ারল্যান্ডে যেয়ে যখন তিনি সেখানকার সপ্তদশ শতকের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করেছেন তখন তাঁর স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়েছে গ্রেট বেঙ্গল ফেমিনের কথা- বাংলার ১৯৪৩-৪৪ এর মহাদুর্ভিক্ষের কথা, যে দুর্ভিক্ষে চল্লিশ লক্ষ লোক মারা যায়। দুর্ভিক্ষের সময় দুটি দেশই ছিল ইংরেজ-উপনিবেশ। আগেই উল্লেখ করেছি, তরুণের লেখায় বারবার প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যেন একটা প্রসঙ্গের মালা গাঁথা। এই মালাকে অনিন্দ্যসুন্দর এক সূত্রে সূত্রাবদ্ধ করা হয়েছে। সেই সূত্রটি হলো সাহিত্য-শিল্প ও সংস্কৃতির, যা জীবনকে গভীরতর উপলব্ধির সন্ধান দেয়। তরুণের ভ্রমণ কাহিনী নিছক ভ্রমণ-বর্ণনা নয়, এটি জীবনরসে সিঞ্চিত ঋদ্ধ এক আলেখ্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App