×

সাময়িকী

চোখ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০১৯, ০৮:১৩ পিএম

একটা ঘোরের ভেতরে পাখির দিনগুলো কাটছে আজকাল। পাখি কি সচেতনের সংজ্ঞা কাকে বলে ভুলে গেছে? পাখি জানে না তার মনের ভেতরে কী সব, কারা সব খেলা করে। তারা চেনা কি অচেনা, দৃশ্য কি অদৃশ্য, ছায়াছায়া না স্পষ্ট, পাখি সেটা জানে না। পাখির কাছে আজকাল দুনিয়াটা উল্টোপাল্টা লাগে। উল্টোপাল্টা। একেকসময় মনে হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাখি চিৎকার দিয়ে ওঠে। চিৎকারে চিৎকারে গলা দিয়ে রক্ত তুলে ফেলে। ও হো হো হো, ও হো হো হো, আমাকে দেখ, আমাকে দেখ। আমি পাখি, আমার বয়স একুশ, আমার শরীরে যৌবন ছলছল, আমার চেহারায় কুমারীর শুভ্রতা, আমার মগজে শিল্পের সম্ভার, শুধু আমার চোখ ভালো নেই! আর চোখ ভালো নেই বলে আমার কিছু আর ভালো নেই। আমাকে দেখ, আমাকে দেখ! ও হো হো হো। কিন্তু পাখি এসব কিছুই করতে পারে না। পাখি আজকাল ভালো মেয়ে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে বসে থাকে বাড়িতে, কখনো বিছানায়, কখনো কলতলায়, কখনো কুয়োপাড়ে। পাখি আর্ট কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্রী। সেশন জটের জন্যে এখনও ফাইনাল দিতে পারেনি। পাখি চারুকলার ছাত্রী যেখানে রঙের খেলা, শরীরের খেলা, সৌকর্যের খেলা, স্থাপত্যের খেলা। এ এক অদ্ভুত জীবন। মানুষের ভেতরে মানুষ, রঙের ভেতরে রঙ, প্রকৃতির ভেতরে প্রকৃতি, এই দেখার চোখ তৈরি করে দেয় এই আর্ট কলেজ। এখানের শিক্ষকরা সকলেই তাদের কর্মক্ষেত্রে স্বমহিমায় বিরাজমান। পাখির এখানে আসার কথা নয়, সে তার শহরের কলেজেই বিএ পড়ার চেষ্টা করছিল, এমন সময় মেজমামা তার মায়ের কাছে দুদিনের জন্যে দেখা করতে গেল, সেসময় পাখি শখ করে রঙপেন্সিলে ছবি আঁকছিল খাতার পাতায়, আর তা দেখে মেজমামা বলল, চল, তোকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে দিই। তোর আঁকার হাত ভালো। পাখিদের কলেজে একজন মডেল আসত অনেক আগে। নারী মডেল। না খেতে পেয়ে নারী মডেলের চেহারা হয়েছিল শুকিয়ে পাক খাওয়া একটা পাটের দড়ির মতো। পাখিদের জন্যে যেদিন মডেলিং করতে আসত মহিলাটি, পাখিরা তাকে খেতে দিত। কিন্তু সে কোনোদিন পাখিদের সামনে বসে খেত না। সব খাবার জমিয়ে রাখত। ছেঁড়া আঁচল দিয়ে লুকিয়ে রাখত খাবার। জিজ্ঞাসা করলে বলত তার বাচ্চাদের সে আগে খেতে দেবে তারপর খাবে। তার কথা শুনে থার্ড ইয়ারের মুকাদ্দেস ঠাট্টা করে বলত, বাচ্চা খাইবে, নাকি তোমার ফিঁয়াসে? মুকাদ্দেসটা বরাবর ফাজিল ছিল। মেয়েদের ভালো কিছু স্বীকার করত না সহজে। যাকে বলে সিনিক। ছেলেবেলায় তার মা ঘর ছেড়ে চলে যাবার জন্যে হয়ত হবে। মুকাদ্দেস তার বাবা আর সৎমায়ের কাছে মানুষ। কিন্তু অভুক্ত নারীর এরকম সন্তানপ্রীতি দেখে অবাক হয়ে যেত পাখিরা। তার ক’টা সন্তান জিজ্ঞেস করলে আঙুল তুলে বলত, আল্লার মাল ওরা চাইরজন। চারজন? অবাক হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল সাকিনা, পাখিদের ক্লাসের বন্ধু। উত্তরে জমিরুন বলেছিল, চোখ দিবে না না গো, বুজি। ওরা বাইচ্যা আছে বইলাই আমি আছি। নাতো আমার এই জীবনের আর দাম কি! একদিন জমিরুনকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে নিয়ে পাখি তার ন্যুড এঁকেছিল। আর্ট কলেজের পশ্চিমদিকে তখন বেশ জঙ্গল ছিল। পাখি তাকে আগে থেকেই বলে রেখেছিল যে সে তার ন্যুড আঁকবে। আর তার কথা শুনে অবলীলায় মাথা নেড়েছিল জমিরুন। তারপর যেদিন এই কাজটা করতে যাবে সেদিন হঠাৎ করে কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন হরতাল ডেকে বসেছিল। কেন ডেকেছিল পাখি অতোসতো জানে না। পাখি রাজনীতি ভালোবাসে না, তখনও বাসত না। কিন্তু সে এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিল। জমিরুনকে সাথে করে একেবারে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। আর পাখি তার ইজেল টাঙাতে না টাঙাতে জমিরুন ন্যাংটো হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েছিল। দেখে মনে মনে একটু চমকে গিয়েছিল পাখি। কেন যেন তার মনে একটু অস্বস্তিও হয়েছিল। কিন্তু জমিরুনের শরীর দেখে যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল পাখি। মাংসহীন এক মহিলার শরীর। পাঁজরের হাড়গুলো গুনে তোলা যায়। সবচেয়ে বড়কথা তার বুকে কোনো স্তন নেই! আছে শুধু দু’টো স্তনের বোঁটা। পাখির বিস্মিত দৃষ্টি দেখে জমিরুন বলে উঠেছিল, এত কী দেখেন বুজি? আমার কিছুই নাই! কিন্তু এই দুইখান বাইন রাতের বেলা চুইসা খায় হারামজাদা পোলাপানেরা। ওগো জ্বালায় রাইতে ঘুমানো মুশকিল। কোন পোলাপান, আপনার নিজের? পাখির কথা শুনে হেসে উঠেছিল জমিরুন। বলেছিল আমার পোলাপান এত খারাপ না বুজি, এইসব পোলপান হইল গিয়া আপনাগো কলেজের পোলাপান। রাইতে ঘুমাইমু কই, তাই আপনাগো ঐ পার্কের ভিতরে ঘুমাই। জমিরুনের কথা শুনে হঠাৎ করে যেন বমি চলে এসেছিল পাখির। সে তখন কল্পনাও করতে পারত না যে রাতের বেলা এই এলাকার ছেলেরা এই ভাগ্য নিপীড়িত মহিলার কাছে শরীরের সুখ খুঁজতে যায়। তখন তার জুবায়েরের কথা মনে হয়েছিল। জুবায়ের ভার্সিটিতে পড়ত তখন। পাখির সাথে তার একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল তখন। এখন আর নেই। পাখির বর্তমান অবস্থার কথা শুনে সে কেটে পড়েছে। হায় জুবায়ের, হায়। মনে মনে বিলাপ করে ওঠে পাখি আজকাল মাঝে মাঝে। এই এক অবস্থা হয়েছে আজকাল পাখির, হঠাৎ হঠাৎ বিলাপ করে ওঠা। তবে সেদিন বড় ক্ষোভের সাথে জমিরুনের ন্যুড এঁকেছিল পাখি। তার কঙ্কালসার শরীরে এঁকেছিল স্তনছাড়া বিশাল দু’টি বোঁটা। যা প্রায় পঁচাত্তর ভাগ ছবির ক্যানভাসের স্থান অধিকার করে রেখেছিল। আর সেই বোঁটার অগ্রভাগ থেকে তীব্রবেগে বেরোচ্ছিল দুধের ঝরনা নয়, যেন জলোচ্ছ্বাস। এতই তীব্রবেগ সে জলোচ্ছ্বাসের যে তার ক্লাস টিচার ছবি দেখে একটু থমকে গিয়ে বলে উঠেছিলেন, এই ছবিতে আমি তোমার রাগ দেখছি পাখি। এত রাগ কীসের জন্যে? এ রাগ কি তোমার প্রকৃতির প্রতি নাকি মানুষের প্রতি? তার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি সেদিন পাখি। এখন হলে পাখি উত্তর দিত। পাখি বলত, এ রাগ না স্যার, এটা হলো আমার ক্ষোভ। ক্ষোভ সমাজের পুরুষের প্রতি। আয়, কত চুষে খাবি আয়, শুষ্ক এই স্তনজোড়া তোদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে দুধে, তোদের প্লবিত করবে, তোদের সমাজের নোংরামি থেকে, ইতরামি থেকে, অসভ্যতা থেকে একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ভাসিয়ে একেবারে সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলবে! হ্যাঁ, মাত্র এই কিছুদিন আগেই পাখি কত ছোট ছিল যে মনের ভাব মানুষকে খুলে বলতে পারত না। এখন আর পাখির ওরকম মনোভাব নেই। এখন পাখি মুক্ত হয়েছে সমাজের সব বিধিনিষেধ থেকে। কারণ পাখি এখন জানে প্রকৃতি তার ওপর এক ধরনের প্রতিশোধ নেবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে, সেটা হলো পাখিকে সে অন্ধ করে দেবে। পাখি অন্ধত্বের দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। এ এমনই এক অন্ধত্ব, যা পাখিকে চিরদিনের জন্যে আলাদা করে ফেলবে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতির রূপ রঙ রস, কোনো কিছুই আর পাখিকে দোলা দিতে পারবে না। রঙের খেলোয়াড় যে পাখি, সেই রঙই তাকে পরিত্যাগ করবে বলে মনস্থির করেছে। দুই. ব্যাপারটা ঘটল যেন তেলেসমাতির মতো। একদিন ভোরবেলা পাখি ঘুম থেকে উঠে চোখে ঝাপসা দেখতে লাগল। প্রথমে অতো আমল দিতে চায়নি সে। ঐ অবস্থাতেই সে সেদিন কলেজে গেছে। নন্দনতত্ত্বের ক্লাস ছিল। কিন্তু পাখি মনোযোগ দিতে পারছিল না। তার চোখের ভেতরে কেমন যেন ব্যথা করতে শুরু করল। তারপর পানি পড়তে শুরু করল। মনে মনে ভয় পেয়ে গেল পাখি। তাড়াহুড়ো করে ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে এল সে। বাড়ি মানে তার মামার বাড়ি। পাখির মা একজন গ্রাম্য মহিলা। স্বামী মারা যাবার পর স্বামীর ভিটাতেই থেকে গেছেন। কিন্তু তার মনে অনেক দুঃখ। তার বড় মেয়েটি পনেরো বছর বয়সে লুকিয়ে একজনকে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। পাখিকে তিনি আর নিজের কাছে রাখতে সাহস পাননি। পাখির মামাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পাখির তিন মামা। কিন্তু তাদের ভেতরে মিল মহব্বত কম। আর মিল মহব্বত কম বলেই তাদের বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি এখনও ভাইবোনদের ভেতরে ঠিকমতো বিলি বাটোয়ারা হয়নি। নইলে যে বাড়িতে পাখি থাকে সেটা এতদিনে মাল্টিস্টোরি হয়ে যাওয়ার কথা। নিজেদের ভেতরে সমস্যার সমাধান হয়নি বলেই এখনও বাড়িটা নানার আমলের মতোই রয়ে গেছে। পাখির অবশ্য এতে কোনো ক্ষতি নেই। সে লেখাপড়া শেষ না করা পর্যন্ত বাড়িটা এমনি থাকলেই বরং খুশি। তবে চোখ থাকতে থাকতে পাখি লেখাপড়া শেষ করতে পারবে বলে ভরসা হয় না। পাখি অন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে, পাখির কাছে এখন প্রতিটি সময় মহামূল্যবান বলে সেশন জট রাতারাতি খুলে যাচ্ছে না। এ এমন এক জট যার কোনো গিট্টু চোখে দেখা যায় না। হয়ত পাখি সম্পূর্ণভাবে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললেও সেশন জট খুলবে না। পাখি তার চারুকলার ফাইনাল শেষ করার আগেই অন্ধ হয়ে যাবে। পাখি প্রথম প্রথম ভেবেছিল সে পরীক্ষা দেবে না। অন্ধ হয়ে গেলে লেখাপড়া শিখে আর কী হবে? কিন্তু না, মেজমামার কথা শুনে পাখি পরীক্ষা দেবে বলে মনস্থির করেছে। মেজমামা পাখিকে বলেছে, পাখি, একেক মানুষের জীবন একেকরকম। তোর জীবন তোকে নিয়ে এক ভীষণ পরীক্ষা করছে, সেটা হলো তুই জীবনের কাছে হার মেনে যাবি কীনা। কিন্তু আমি বলি, না, পাখি হার মানলে চলবে না। জীবনের ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ তুই গ্রহণ করবি। পাখি তার মেজমামার কাছেই থাকে। মেজমামাকে পাখির সবকটা মামার ভেতরে বেশি মানবিক মনে হয়। আর দু’জন মামার ভেতরে একজন থাকে চট্টগ্রামে আরেকজন নরসিংদী। চাকরি সুবাদে এদের দূরে থাকতে হয়। ছোট মামা প্রায় ঢাকা আসে আর মেজমামার সাথে তর্কবিতর্ক করে যায়। পাখি একদিন নিজের কানে শুনেছে ছোটমামা মেজমামাকে বলছে, তোমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বাড়িঘর আর ভাগ হবে বলে মনে হয় না। আর উত্তরে মেজমামা বলেছে, না, তার আগেই ভাগ হবে, তবে তুমি যেভাবে চাও, সেভাবে ভাগ হবে না। পাখির মন ভারী হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সম্পত্তি রেখে যাওয়া খুব খারাপ বলে মনে হয়েছিল তার। সে হাজার বছর বেঁচে থাকলেও কোনোদিন সম্পত্তি করবে না বলে মনস্থির করেছিল। মেজমামার জন্যেও কষ্ট হয়েছিল তার। মেজমামা তাকে যেভাবে নিজের কাছে এনে রেখেছে, সেভাবে আর কোনো মামা কি তাকে কাছে এনে রাখত? এ প্রশ্নের উত্তর পাখি জানে না। তবে বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় ছোটমামা এবার এত ক্ষেপে গিয়েছিল যে পাখির দিকে তাকিয়ে একটা কথা পর্যন্ত বলেনি, যেন মেজমামার সাথে তার সংসারে আছে বলেই পাখি যেন মেজমামার দলেই হয়ে গেছে। অথচ পাখি এখন পর্যন্ত কোনো দলের না। তার কাছে সব মামাই সমান। এরকম একটা সংসারে পাখি হঠাৎ করে চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছিল। তারপর কত কিছু হলো। সেসব কথা এখন ভাবলে পাখির মাথার ভেতরে কেমন যেন লাগে। ডাক্তারের সেই বিশাল মুখটার কথা মনে হয়। মেশিনে পাখির চোখ দুটোকে একপ্রকার দলাইমলাই করে পরীক্ষা শেষ করে সে পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তোমার সাথে কেউ আসেনি? একটু হতবুদ্ধি হয়ে পাখি বলেছিল, জি, হ্যাঁ, আমার এক বন্ধু আমার সাথে এসেছে। আসলে সেদিন তার সাথে তার বন্ধু ছিল জুবায়ের। তার আগে, ডাক্তারের কাছে আসার আগে জুবায়ের তার দু’চোখে চুমো খেয়ে বলেছিল, এত সুন্দর চোখের আবার কী অসুখ হলো? তার সেই আদর ভালো লেগেছিল পাখির। তার আগে মোবাইল করে জুবায়েরকে সে হল থেকে ডেকে এনেছিল। জুবায়েরকে না এনে পাখি তার ক্লাসের সতীর্থ নিনা বা জাহিদাকে আনতে পারত। এরা সব হলে থাকে। অবাধ স্বাধীন জীবনের অধিকারী সব। পাখির সাথে তাদের নিগূঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক, কিন্তু কেন জানি পাখি ওদের কাউকে সঙ্গে আনেনি। কেন যেন মনে হয়েছিল জুবায়ের তার সাথে থাকলে সে বেশি ভরসা পাবে। কিন্তু পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার তার বন্ধুর কথা শুনে বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট না হয়ে বলেছিল, সরি, কোনো বন্ধুকে নয়, তোমার কোনো আত্মীয়ের সাথে আমি কথা বলতে চাই। আগামীকাল তোমার কোনো আত্মীয়কে সাথে করে নিয়ে এসো। ডাক্তারের কথা শুনে হঠাৎ ভয় লেগে গিয়েছিল পাখির। সে বিড়বিড় করে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কোনো খারাপ সংবাদ, স্যার? ডাক্তার তার কথার উত্তর না দিয়ে, মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কোমল স্বরে বলে উঠেছিল, কি পড়? চারুকলায় পড়ি স্যার, এবার ফোর্থ ইয়ারে উঠেছি। চারুকলায় পড়ো? ডাক্তার যেন কথা শোনেনি এমনভাবে বলে উঠেছিল। জি। উত্তরে বলেছিল পাখি। পাখির মুখের দিকে এবার গভীর চোখে তাকিয়ে ডাক্তার কেমন একটা স্বরে বলে উঠেছিল, তার মানে রঙ নিয়ে খেলা কর তুমি? মানে রঙ দিয়ে ছবি আঁকো? এ কথার উত্তরে নীরব ছিল পাখি। কিন্তু ডাক্তারের গভীর চোখের ভেতরে ভাষাটা যেন পড়ে ফেলেছিল পাখি। হঠাৎ করে তার ভেতরে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল। জোর গলায় পাখি বলে উঠেছিল, আমার চোখের সমস্যাটা কি বলবেন স্যার? না, তোমাকে এখন আমি কিছু বলব না, আমি আগে তোমার গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলব। তার আগে তুমি এখনই চোখের সিটিস্ক্যানটা করে আমার কাছে নিয়ে আসো। তাই করেছিল পাখি। তার কাছে সিটিস্ক্যান করার মতো পয়সা ছিল না। কিন্তু সে জুবায়েরের কাছ থেকে পয়সা ধার করেছিল। জুবায়েরের চোখে মুখেও কেমন যেন একটা ভয়ের ছায়া দেখেছিল পাখি। জুবায়ের কি ডাক্তারের কথাগুলো শুনতে পেয়েছিল বাইরে থেকে? পাখি তা জানতে পারেনি কোনোদিন। একটা ঘোরের মধ্যে সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিল পাখি। ডাক্তার তাকে তাই করতে বলেছিলেন। একেবারে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিলেন। নিজের কাছে সিটিস্ক্যানের রিপোর্টটা রেখে দিয়েছিলেন। পরদিন গার্ডিয়ানসহ তার কাছে যেতে বলেছিলেন। পরদিনের রোগীর নামের লিস্টে পাখির নামটা সবচেয়ে প্রথমেই লিখে রেখেছিলেন। সবচেয়ে প্রথমে পাখিকে দেখে দেবেন বলেছিলেন। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে জুবায়ের বার ক’য়েক তার সাথে আলাপ জমাতে চেয়েছিল, কিন্তু পাখির কাছে সবকিছু কেমন ছাড়াছাড়া মনে হচ্ছিল। জুবায়ের এমন কথাও বলেছিল ডাক্তার কি বলে শুনে আবার অন্য ডাক্তারের মতামত নেয়া যাবে। সেদিন দু’জনে রিকশা করে যাচ্ছিল। লক্ষ্মীবাজার কাছে আসার অনেক আগেই রিকশা থেকে নেমে গিয়েছিল জুবায়ের। পাখির বাড়ির কারো চোখে পড়ে এটা সে চায়নি। এরকম মাঝেমাঝেই তারা রিকশা করে বেড়াত সে সময়। মাঝে মাঝেই চুমো খাওয়াখায়ি হতো। সেদিন রিকশা থেকে নামার আগে জুবায়ের তার মুখে চুমো খায়নি। কেন খায়নি? এ নিয়ে পাখির মনে একটা কষ্ট আছে। পাখি তো সেদিনই আর অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল না। বস্তুত আজ একবছর ধরেই তো পাখি একটু একটু করে দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। এখনও তো পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়নি। এখনও চোখের কোনা দু’টো দিয়ে পাখি অনেকখানিই দেখতে পায়। এখনও পাখি রিকশা থেকে নেমে পয়সা গুনে দিতে পারে। জেব্রাক্রসিং দিয়ে পার হয়ে যেতে পারে রাস্তা। শুধু পার হবার সময় খেয়াল রাখে যেন মেয়েদের সাথে সে রাস্তা পার হয়, কখনো ছেলেদের সাথে সে রাস্তা পার হয় না। কারণ ছেলেরা দ্রুত হাঁটে। আর মেয়েরা হাঁটে একটু ধীরে ধীরে। ছেলেদের সাথে হেঁটে সে কুলিয়ে উঠতে পারে না। প্রায়শ রাস্তার মাঝে সে নিজেকে একাকী দেখতে পায়, তখন তার মনে ভয় লাগে। ভয় হয় সে বুঝি গাড়ি চাপা পড়বে। এখনও তো পাখি বাসে করে তার মায়ের কাছে দেশে ফিরে যেতে পারে। এখনও তো পাখি চোখে রঙ দেখতে পায়। রংতুলি দিয়ে ক্যানভাসে ছবি আঁকে। শুধু পাখি বই পড়তে পারে না। কারণ তাতে তার চোখে বেশি চাপ পড়ে যাবে। কিন্তু পাখি এখনও ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে টান দিতে পারে ক্যানভাসে। সেজানের মতো আঁকতে পারে স্টিললাইফ। ভ্যানগঁগের মতো আঁকতে পারে সানফ্লাওয়ার। এল গ্রেকোর মতো আঁকতে পারে দীর্ঘটানের সব ছবি, যে ছবির ভেতরে পাখির মনে হয় এক ধরনের ভয়, এক ধরনের দীর্ঘশ্বাস লেগে আছে। এডওয়ার্ড মাঞ্চের মতো পাখি এখনও আঁকতে পারে দ্য স্ক্রিম। এই ছবিটিতে পাখি তার মানসিক পরিম-ল খুঁজে পায়। এই চিৎকার পাখির অস্তিত্বের ভেতরে আজকাল ভাঙচুর শুরু করে দিচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, তত পাখি তার ভেতরে গলাফাটা একটা চিৎকারের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। না, পাখি এখনও এরকমভাবে চিৎকার করে ওঠেনি। এমনকি পাখি যখন চেন্নাইতে গিয়েছিল, শঙ্কর নেত্রালয়ে গিয়ে বাবু রাজেন্দ্রকে দেখিয়েছিল, তিনি অনেকক্ষণ ধরে পাখির চোখ দেখে, সিটিস্ক্যান দেখে, তারপর বিষাদিত মুখে পাখির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ব্যাড লাক মাই সিস্টার। রেটিনা পিগমেনটোসা এ বয়সে হতে পারে। তবে কার যে হবে কেউ বলতে পারে না। আমি খাওয়ার ওষুধ লিখে দিচ্ছি, চোখের ফোঁটাও দিচ্ছি দু’ঘণ্টা পরপর লাগাবার জন্যে, তুমি ইচ্ছে করলে ছ’মাস বাদে আবার একবার দেখিয়ে যেতে পারো, তবে কোনো আশা দিতে পারব না। চেন্নাই থেকে ফিরে এসে পাখি ব্যাংকক যাবার জন্যে উতলা হয়েছিল। মেজমামার কাছে পাখির মা দেশগ্রামের জমি বেঁচে টাকাও পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাংকক আর যাওয়া হয়নি পাখির বরং মেজমামা ঢাকা থেকে সব কাগজপত্র ও প্রেসক্রিপশন একজনের হাতে পাঠিয়ে ব্যাংককের চোখের ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছিলেন, তারা দেখেশুনে ঢাকা ও চেন্নায়ের বক্তব্যই সমর্থন করে পাঠিয়েছিল। ব্যাংকক থেকে যখন লিখিত রিপোর্ট আসে নেতিবাচক, সেদিন সারারাত কেঁদেছিল পাখি। চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু চোখের পানি ফেলাও তার জন্যে ছিল তখন বিপজ্জনক, কোনো অবস্থাতেই চোখকে কষ্ট দেয়া যাবে না! বুক ভেঙে গেলেও নয়। ব্যাংককের রিপোর্ট যেদিন হাতে আসে তার পরদিন পাখি জুবায়েরকে ডেকেছিল দেখা করার জন্যে। জুবায়ের এসেছিল, কিন্তু অচেনা এক জুবায়েরকে দেখেছিল সেদিন পাখি। জুবায়ের খুব আন্তরিকতার সাথে পাখির কুশল জিজ্ঞেস করেছিল। ভরসা দিয়েছিল ভেঙে না পড়ার জন্যে। তারপর পাখি যখন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিল এরপর তাদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তখন জুবায়ের ধীর স্বরে বলেছিল, তারা বন্ধুর মতো থাকবে। তার বেশি আর কিছু না! জুবায়েরের কথা শুনে পাখি সেদিন কাঁদেনি। কারণ চোখের পানি ফেলে চোখকে সে ব্যতিব্যস্ত করতে আর চায়নি। বাস্তব জীবনের দর্শন ততদিনে পাখিকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। তিন. মাঝে মাঝে আজকাল আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে পাখি। মসৃণ ত্বক তার। নাকের দু’পাশে হালকা ভাঁজ। চোখ দুটো উজ্জ্বল ভাষাময় এখন পর্যন্ত। তবু চেহারার ভেতরে এক ধরনের অন্যমনস্কতার ছাপ। যেন কিছু হারিয়ে ফেলার আগে এক ধরনের হতবুদ্ধিতা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আয়নায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাখি বিড়বিড় করে আপন মনে বলে, আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি, হে আল্লা, হে মাবুদ, হে ইশ্বর, আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। হে ইশ্বর, আমাকে অন্ধ করো না! আমি তোমার কাছে এ জীবনে আর কিছু চাইনে, শুধু তুমি আমাকে অন্ধ করো না, ঈশ্বর! না, চোখের পানি ফেলা যাবে না। যত চোখের পানি ফেলবে তত তার চোখ দুর্বল হয়ে যাবে। উদ্গত অশ্রু বুকে চেপে রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে পাখি। বুকে তখন কষ্ট হয়। প্রচ- কষ্ট হয়। তখন সে অতি দ্রুত বাইরে বেরিয়ে পড়ে। নিরাপদ পথ ধরে হাঁটতে থাকে রাস্তায়। রাস্তায় রাস্তায় আজকাল কত কিছুর দোকানপাট। এসব দিকে কোনোদিন আগে নজর দেয়নি পাখি। অনন্ত স্রোতের মতো রাস্তার জীবনকে সে তুলে নিয়েছিল নিজের জীবনে, তাই আগে কোনোদিন এমনভাবে সে খেয়াল করতে পারেনি। কিন্তু এখন রাস্তার ধারের একটা বুনো ঝোপও পাখিকে কীভাবে যে আনন্দ দেয়। কীভাবে তাকে জীবন উপভোগ করতে বলে! মাঝে মাঝে রাস্তার ধারেই পা থেবড়ে মাটিতে বসে পড়ে পাখি। বিভিন্ন রকমের মাটির পুতুল রঙ দিয়ে নকশা কেটে পথের ধারে বসে গেছে দোকানি। পাখি বসে বসে পুতুলগুলো হাত দিয়ে ধরে বড় আগ্রহ করে তাদের দেখে। চোখ থেকে রোদ চশমা খুলে পাখি পুতুলগুলোর চোখ দেখে। চোখগুলো কীরকম জীবন্ত হয়ে পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে। পটুয়ার একটুখানি তুলির টানে সামান্য পুতুলও কত জীবন্ত হয়ে ওঠে। একমাত্র চোখ এঁকেই পটুয়া তার মনের কথা পুতুলের ভেতর দিয়ে যেন পাখির কাছে পৌঁছে দেয়। পাখির বুক চেপে আসে। চোখ দিয়ে অশ্রু ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়। পাখি তাড়াতাড়ি পথ ছেড়ে উঠে আসে। পটুয়া কামরুল হাসান স্যারের কথা মনে হয়। আ. কামরুল হাসান। কত বড় পটুয়া তিনি। তাঁর হাতের জাদু দিয়ে মুহূর্তে টান দিয়ে খুলে ফেলেন অনির্বচনীয় সব অনুভূতির সব দরোজা। কিন্তু তিনি আর নেই। মাত্র কিছু বছর আগেই তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কবিদের কবিতা উৎসবের সময় প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিশ্ববেহায়া ছবিটি এঁকেই তিনি ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে। আর শেখ হাসিনা, তখন তিনি শুধুই শেখ হাসিনা, তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এটুকু জানতে যে তিনি ততক্ষণে মারা গেছেন। না, ছবি তাঁকেও চোখে দেখেনি। এসব তার ঢাকায় এসে আর্ট কলেজে ভর্তি হবার অনেকই আগের কথা। কিন্তু এসব ঘটনা তো জনশ্রুতি হয়ে আছে বাঙলা ও বাঙালির নিরন্তর সংগ্রামের ইতিহাসে। আজও রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল পাখি। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য মনে রেখে বাইরে বেরিয়েছিল। আজ সে তার পালিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া বোনটিকে খুঁজে বের করবে। একজনের কাছ থেকে ঠিকানা বের করেছিল পাখি। বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর দশ বছর পাখিদের সাথে রাখীর কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু পাখি মনে মনে স্থির করেছে এই বোনটিকে একবার চোখে না দেখে পাখি অন্ধ হবে না! সিদ্ধেশ্বরীর একটা অন্ধকার গলির ভেতরে তার বোন সংসার পেতেছে। তার দু’টো ছোট ছোট বাচ্চাও হয়েছে পাখি খবর পেয়েছে। কিন্তু কোনোদিন তাদের সে চোখে দেখেনি। রাখী বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে মামারা খুব রাগ করেছিল। পাখির মাও খুব ভেঙে পড়েছিল। গ্রামে বেড়াতে আসা এক বখাটে ছেলের সাথে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল পনেরো বছরের রাখী। তারপর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। অবশ্য খোঁজ পাওয়া যায়নি ঠিক না, মামারা ঠিকই রাখীর খোঁজ পেয়েছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কেউ আর রাখীকে যত্ন করে আবার ঘরে তুলে নেয়নি। একটাই অবশ্য ভয় ছিল, রাখীকে কোনো খারাপ জায়গায় পাওয়া যায় নাকি, কিন্তু না, রাখী বিয়ে করেছিল বয়স লুকিয়ে। এবং রাখী তার শ্বশুরবাড়ির কাছেও গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল তার ব্যবহার এবং চরিত্র মাধুর্যে। কিন্তু যার সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেই ছেলেটি যে ভালো নয় বা ছিল না, এ খবরটুকু তারা পেয়েছিল। পাখি জানে তার মা এখনও রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে রাখীর জন্যে। কিন্তু ঐ কান্নাটুকুই মাত্র তার আছে। আর কিছু নয়। কোনোদিন কেউ দিনের বেলা রাখীর কথা তার মায়ের মুখে উচ্চারিত হতে শোনেনি। মায়েরা কি এরকম নিষ্ঠুর হতে পারে? পাখি আজকাল মনে মনে ভাবে। কিন্তু এটা নিষ্ঠুরতা কীনা তাও পাখি জানে না। এটা নিষ্ঠুরতা নাকি হারিয়ে ফেলার শোকের স্তব্ধতা তা পাখি জানে না। পাখি এক জায়গায় থেমে একটা রিকশা নিল। উঠেছিল সে বায়তুল মোকাররম থেকে। রিকশা অলিগলি দিয়ে চলতে লাগল। অনেকক্ষণ বাদে সিদ্ধেশ্বরীতে এসে নামল পাখি। তখন তার বুকের ভেতরে ধুকপুক করে উঠল। একবার ভাবল ফিরে যায়। আবার ভাবল, না। ছেলেবেলায় দুইবোন জড়াজড়ি করে বিছানায় শুয়ে থাকত। কত যে গল্প বলত তাকে রাখী। পাখি এখন বোঝে সব বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলত রাখী। ছোট বোনের মন বুঝে সব গল্প বানিয়ে বলত সে। এরকম কল্পনাশক্তির অধিকারী ছিল বলেই না একদিন কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে তার বোন স্বল্পচেনা একজনের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিল। গলির ভেতরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল পাখি। তার মনের ভেতরে উথাল পাথাল করতে লাগল। এতদিন বাদে রাখী যদি তাকে আর চিনতে না পারে, তখন কী হবে? যদি রাখী রাগ করে বলে, না, আমার কোনো ছোটবোন নেই, আপনাকে আমি চিনি না। পাখি পায়ে পায়ে আবার বেরিয়ে আসতে গেল গলি থেকে। নোংরার পাহাড় জমে আছে গলির মুখে। দুর্গন্ধে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা দায়। এবার সাহসে ভর করে এগিয়ে গেল পাখি। হলুদ রঙের তিনতলা একটা দালান। দালানের রঙ ক্ষয়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে। প্রবেশ পথে ঢুকলে একটু পরেই ওপরে ওঠার সিঁড়ি চোখে দেখা যায়। সিঁড়িগুলো ভাঙাচোরা, এবড়ো থেবড়ো, রেলিংয়ের কাঠ কব্জা থেকে খুলে এসেছে। সিঁড়ি ভেঙে একেবারে তিনতলায় উঠে গেল পাখি। এবার তার বুকে যেন হাতুড়ি পড়ছে। যেন ভীষণ এক নিষিদ্ধ কাজ করছে পাখি এমনি অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। দরজার মুখে বেল ছিল। বেল টিপল পাখি। টেপার সময় হাত কেঁপে গেল তার। কে? ভেতর থেকে আওয়াজ বেরোল। কী উত্তর দেবে পাখি? সে যেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল চুপ করে। একটু পরে দরজা খুলে গেল আপন মনে। আর সামনে এসে দাঁড়াল রাখী। চার. রাখী তাকে দেখে হতবাক হয়ে গেল। দশ বছর আগে ছেড়ে আসা স্মৃতি যেন তার মন আলোড়িত করে তুলল। চেনা অচেনার গণ্ডির ভেতরে হঠাৎ দরজার সামনে থেকে একবার সরে গেল রাখী। তারপর আবার এগিয়ে এসে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, তুই, তুমি পাখি? পাখি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছিল রাখীকে। এইকি তার বোন রাখী? মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই সে পৃথুলা এবং বয়স্কা এক রমণী। মাথার সামনে থেকে তার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। নাকে একটা নাকফুল। প্যাসেজের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটি ছেলে ন্যাংটো হয়ে মাটিতে বসে কী যেন বাটির ভেতর থেকে তুলে নিয়ে খাচ্ছে। দৃশ্য দেখে পাখির একবার মনে হলো সে এখান থেকে পালিয়ে চলে যায়, আর কোনোদিন এখানে সে আসবে না। কিন্তু তার ভাবনার ভেতরেই রাখী হঠাৎ করে এগিয়ে এসে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। তখন রাখীর শরীরে তেল হলুদের গাঢ় এক গন্ধ পেল পাখি। যে গন্ধের ভেতরে একটা দুঃখের জীবন যেন নীরবে কথা বলে উঠল পাখির সাথে। যেন এক শোকের বার্তা বয়ে গেল চারপাশে। রাখী তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বোনটি আমার, এতদিন বাদে এলি? এতক্ষণ নিজেকে বেশ শক্ত রাখতে পেরেছিল পাখি। এমনকি এখানে এসে সে ভুল করেছে এমনও মনে হয়েছিল তার। কিন্তু রাখীর এরকম ব্যবহারে সে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল। রাগ না, ভালোবাসা না, বিতৃষ্ণা না, কেমন এক নৈর্ব্যক্তিক মনোভাব তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। রাখী তাকে ঘরে টেনে নিয়ে এল। ন্যাংটো ছেলেটি এতক্ষণ অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিল। রাখী পাখিকে ঘরের ভেতরে টেনে নিতে নিতে বলল, তোমার খালামনি এসেছে মন্টু, যাও ঘরে গিয়ে প্যান্ট পরে এস। অনেকক্ষণ বাদে পাখি একটু মনে মনে স্থির হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ঘরদোর যতদূর সম্ভব অপরিষ্কার। ভেতরে পেতে রাখা ডাইনিং টেবিলে তখনও সকালে নাস্তা করে যাওয়ার থালাবাসন পড়ে আছে। মেঝের ওপর চিত্রবিচিত্র সব দাগ। মেঝেয় দাগ দিতে চারুকলার ছেলেমেয়েরাও পারে, কিন্তু এ দাগ সে দাগ নয়। এ দাগের ভেতরে কোনো শিল্প নেই, কোনো আনন্দ নেই, বরং এর প্রতিটি দাগের ভেতরে আছে যাপিত জীবনের আশাভঙ্গের কথা। হতাশার কথা। পাখি জানে না সে ঠিক বুঝল কীনা। কিন্তু এরকমই মনে হতে লাগল তার। রাখী বলল, মা কেমন আছে পাখি? উত্তরে কী বলবে ভাবতে লাগল পাখি। অনেকক্ষণ ভেবে সে বলল, মা ভালো আছে। এরপর যেন আর কী বলবে কিছু বুঝে পেল না রাখী। আবার কিছক্ষণ পরে বলল, আর খোকন, খোকন কেমন আছে? ভালো। সংক্ষিপ্ত স্বরে বলল পাখি। এটুকু বলল না যে খোকন বারো বছরের হলেও তার বুদ্ধিবৃত্তি পাঁচ বছরের ছেলের মতো থেকে গেছে। তার কথা শুনে যেন আক্ষেপ করে রাখী বলল, সেই কবে ভাইটিকে দেখেছি। আমার যখন বিয়ে হয়, তখন ওকে আমি দু’বছরের দেখে এসেছিলাম। রাখী এ কথাটা বলল না যে কীভাবে তার বিয়েটা হয়েছিল। কীভাবে সে মাকে, আত্মীয়-স্বজনকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে। কিছু খাবে না, খাবে না, বললেও পাখিকে খেতে হলো কিছু। একবাটি মুড়ি আর একবাটি আম। বাচ্চা ছেলেটির সাথে কথাও বলতে হলো। রাখী তাকে বলল, মন্টু, তোমার খালামনিকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করো। কিন্তু মন্টু সালাম করল না। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকল। তখন লজ্জা পেয়ে রাখী তাকে ধমক দিয়ে বলল, অ্যাই দুষ্টু, মার খাবি? তারপর পাখির দিকে তাকিয়ে বলল, বড়টা স্কুলে গেছে, ফিরবে বেলা তিনটেয়। তার নাম কি? যেন ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করল পাখি। ঝন্টু। ডাক নাম ঝন্টু। কথাটা বলার সময় রাখীর ঠোঁটে যেন এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। সে তার বড় ছেলেকে বেশি ভালোবাসে। ভাবল পাখি। ঘণ্টাখানেক সেখানে থাকার পর পাখি হঠাৎ বলে উঠল, এবার যাই। যাই কথা শুনে রাখীর ভেতরে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। রাখী বোনের পাশে এসে বসল। তার হাত ধরল। অনেকক্ষণ হাত ধরে বসে থাকল রাখী। তারপর যেন আপন মনে সে বলল, তোদের ফেলে আমি একদিন বাড়ি ছেড়ে এসেছিলাম পাখি, তখন তোরা ছোট ছিলি আর আমিও ততটা বড় ছিলাম না। এখন জীবনকে যেভাবে বুঝি, তখন সেভাবে আমি বুঝতাম না। তাছাড়া বাবা হঠাৎ মারা গিয়েছিলেন বলে বাবার জন্যে মনের ভেতরে এক ধরনের হাহাকার ছিল। তাই সুলেমান যখন আমাকে প্রস্তাব পাঠায়, আমি কোনোদিকে চিন্তা না করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। এখন বুঝতে পারি পাখি, আমার সেটা ভুল একটা কাজ হয়েছিল, অন্যায় একটা কাজ হয়েছিল। কিন্তু অন্যায় শোধরাবার জন্যে আমি আর সুযোগ পাইনি। তাছাড়া সুলেমানের সঙ্গে সাথে আমার তো জীবনে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না। ওর বাবা গঞ্জে মোট বইত মানুষের, আর সুলেমান মাত্র টেনেটুনে আইএ পর্যন্ত পড়েছিল, কী করে তার সাথে আমার সম্পর্ক হতো বল? এখন আমি কী ভুল করেছি তা বুঝতে পারি পাখি। আমার মতো ভুল তুই জীবনে করবিনে। এর চেয়ে অবিবাহিত থাকবি তাও ভালো। তুমি কি এই সংসারে আর সুখী নও আপা? পাখির প্রশ্ন শুনে থমকে গেল রাখী। পাখির চোখের সামনে রাখীর মুখটা যেন ভাঙচুর হয়ে যাওয়ার মতো দেখাল। প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। না, এ প্রশ্ন করাটা একেবারে পাখির উচিত হয়নি, মনে মনে ভাবতে লাগল পাখি। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার ছিল তা হয়ে গেছে। রাখী কাঁদতে লাগল। নীরবে কাঁদতে লাগল। কপালে তিনটে আঙুল রেখে তারপর চোখের পানি মুছে পাখির দিকে তাকিয়ে থাকল। কিন্তু না, পাখি এ দৃশ্য দেখে কাঁদবে না। পাখির নিজের জীবনেও কোনো সুখ নেই। কিন্তু তবু বোনের যন্ত্রণা দেখে সে কাঁদবে না। পাখি বুঝতে পারল এত নিষেধের পরেও তার চোখ প্লাবিত হয়ে উঠতে চাচ্ছে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। রাখী নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, সুখ কোথাও নেইরে পাখি, পরিবেশ হারালে মানুষের সুখ থাকে না। পরিবেশ হারালে সুখ থাকে না, কথাটা পাখির বুকের ভেতরে ধক করে লাগল। পরিবেশ মানে কি? পাখি ভাবতে লাগল। এরপর সে ছোট ছেলেটার মুখের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল। বোনকে আর বলা হলো না, পাখি নিজেও তার পরিবেশ হারিয়ে ফেলছে। পাঁচ. চোখের ওপরে হাত চেপে রেখে পাখি এখন ভাবতে লাগল। তার মাথার ওপরে ঘুরতে লাগল বনবন করে ফ্যান। আর মাথার ভেতরে জটিল, কুটিল সব চিন্তা। একদা পাখি নামের একটি মেয়ে কল্পনা করত সে একদিন আল্পস পর্বত দেখবে। পাহাড়ের মাথায় সফেদ বরফের চাঙড়ের দিকে তাকিয়ে প্রেমিকের কাছে খুলে দেবে মনের দরজা। সে প্রেমিকের হাত ধরে পার হবে খামকোরান পর্বতমালা। সে উটের পিঠে চড়বে। সে রাজস্থানে যাবে। খুঁজে বের করবে সোনার কেল্লার রহস্য। সে যাবে ইংল্যান্ড, যাবে তাজিকিস্তান, যাবে তাহিতি আর ক্রিট। সে যাবে বিশ্বময় লাফিয়ে লাফিয়ে। সে যাবে স্পেন; আলতামিরায় বসে সে কল্পনা করবে প্রাগৈতিহাসিক যুগের গৌরবময় অতীত। সে যাবে ফ্রান্স, যাবে ল্যুভর। যাবে মিশরের লুক্সর। ভ্যালি অব দি কিং এবং ভ্যালি অব দি কুইনের কাছে হাত পেতে সে দাঁড়াবে সভ্যতার ভিখারি হয়ে। সে ফ্রান্সের রাস্তায় বসে আঠারোশো শতকের রোকোকো পেইন্টার পিয়ের আগস্ত রোনোয়ার মতো ছাই রঙের ভারী ক্যানভাসের ওপর হালকা পাতলা রঙ ছড়িয়ে রঙের খেলা দেখাবে মানুষকে। সূর্যের আলোয় নারীর আবক্ষ পাল্টে সে আঁকবে পুরুষের আবক্ষ। রেনোয়ার মতোই সে রঙ মেশাবে ছবিতে। মেশাবে ফ্লেক হোয়াইট, নেপেলস ইয়োলো, ক্রোম ইয়োলো, কোবাল্ট, আলট্রামেরিন ব্লু, আলিজারিন লাল, এমারেল্ড গ্রিন আর ভার্মিলিয়ন বা সিঁদুর। নতুনভাবে রঙ ছড়াবে পাখি। বাংলাদেশের মেয়ে হয়ে সে ফ্রান্সের পেইন্টার শাহাবুদ্দিনের হাত ধরে চলবে, সে স্পেনের মুনিরকে করবে তার সতীর্থ। পাখি হার মানবে না। কিন্তু, কিন্তু প্রকৃতির এ কেমন নিষ্ঠুরতা চোখের রঙ কেড়ে নেয়া? একবার পৃথিবীর রঙ দেখিয়ে আবার তা মুছে ফেলা, এ কেমন জঘন্য প্রতিশোধ, হা ঈশ্বর? ভাবতে ভাবতে পাখি উঠে বসল বিছানায়। তাকিয়ে দেখল প্রকৃতিতে তখন ঘোর দুপুর চলছে। তাড়াহুড়ো করে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল পাখি। বাইরে বেরিয়ে সে রিকশা নিল একটা। অনেকক্ষণ লাগল তার গোপীবাগে আসতে। সে ভাবেনি রামেশ সোবহানকে দেখতে পাবে। রামেশ তার স্টুডিওতে বসে কাজ করছিল। পাখিকে দেখে অবাক হয়ে গেল রামেশ। পাখির চেয়ে আট বছরের বড় রামেশ। বউ-বাচ্চাদের বছর দুই আগে রেখে এসেছে ফ্রান্সে। নিজে এসে একা থাকে তার পৈতৃক বাড়িতে। কিছুদিন থেকে আবার ফিরে যায় পরিবারের কাছে। রামেশের সুবিধে সে বাবা-মায়ের সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকার। আর্ট কলেজ থেকে পাস করার পর রামেশ কিছুদিন কলেজে শিক্ষকতা করেছিল। কিন্তু পাগলা টাইপের রামেশ সেখানে নিজেকে স্থির করতে পারেনি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে চলে গিয়েছিল বিদেশে। স্টুডেন্ট থাকাকালীনই বিয়ে করেছিল রামেশ। একদিন কলেজের দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে হঠাৎ দেখা হয়েছিল রামেশের সাথে পাখির। পাখি তখন মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আর পাখিকে দেখে থমকে গিয়ে রামেশ বলেছিল, কোন ইয়ার? পাখি তার চোখের দৃষ্টি দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিল, সেকেন্ড ইয়ার, স্যার। ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু কল মি স্যার। আই এ্যাম নট ইয়োর টিচার। চট করে উত্তর দিয়েছিল রামেশ। তারপর পাখির কাছে, অনেক কাছে এগিয়ে এসে হঠাৎ তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল, বিউটিফুল আইজ, ভেরি ভেরি বিউটিফুল আইজ! তার চেহারা আর তাকানো দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল পাখি। তাই দেখে রামেশ বলেছিল, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি এ্য পেইন্টার, ইউ হ্যাভ টু বি ব্রেভ। ভেরি, ভেরি ব্রেভ। এ্যান্ড ট্যাক্টফুল। এ্যান্ড কারেজিয়াস। পরে কলেজের ছেলেমেয়েদের কাছে শুনেছিল রামেশ প্যারিসে বেশ ক’য়েকটা আর্ট এক্সিবিশনে ন্যুড এঁকে নাম করেছে। খেয়ালি বলে কোথাও এক জায়গায় থিতু হতে পারেনি। বছরের প্রায় ছ’মাস সে থাকে দেশে। আবার মন হলে ক্যানভাস গুটিয়ে রওনা দেয় বিদেশে। রামেশ যেমন অবাক হয়েছে, তেমনি পাখিও অবাক হয়েছে রামেশকে দেখে। প্রায় দু’বছরের বেশি রামেশের সাথে তার কোনো এক্সিবিশনে দেখা হয়নি। সাধারণত রামেশের সাথে দেখা হয় নতুন বা পুরাতন কোনো পেইন্টারের আর্ট এক্সিবিশনের উদ্বোধনের দিন। পাখি ভাবতেও পারেনি রামেশ এখন দেশে আছে। রামেশ তার শ্যামল চেহারায় উজ্জ্বল দু’টো চোখে পাখির দিকে ফেলে বলল, পাখি, তুমি? আপনার স্টুডিও দেখতে এলাম, রামেশ ভাই। কথাটা বলতে গিয়ে পাখির গলা কেঁপে গেল। ভাবল রামেশ না হঠাৎ করে রেগে গিয়ে বলে, হোয়াই হ্যাভ ইউ কাম টু ভিজিট মি নাও? ডোঞ্চ ইউ সি, আই এ্যাম ভেরি বিজি উইথ মাই ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক? কিন্তু রামেশ সেসব কিছু বলল না। পাখির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এস, ঘরে এস। পাখি পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। বাড়ির ভেতরটা গোছানো, কিন্তু নিস্তব্ধ। রামেশ বলল, এটা আমাদের সকলের বসার ঘর। আমার স্টুডিও একটু ভেতরে। কথা বলতে বলতে বাড়ির উঠোনে তাকে নিয়ে এল রামেশ। তারপর হাত উঠিয়ে দেখিয়ে বলল, ওটা হলো আমার স্টুডিও। পাখি তাকিয়ে দেখল উঠোনের প্রান্তে লাল টালির ছাদ দেয়া কাচ ঘেরা একটা জায়গা। ভেতরে সাদা পর্দা ঝোলানো আছে বোঝা যাচ্ছে। উঠোনের বাইরে অনেকগুলো গাছের গুড়ি। পাখি বুঝল রামেশ শুধু ছবি আঁকে না, স্থাপত্যের দিকেও তার ঝোঁক আছে। দু’একটা গাছের গুড়ির গা ছেলা হয়েছে পাখি দেখতে পেল। তাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে মেয়েলি সব শরীরের অবয়ব। একবার ইচ্ছে হলো এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে, কিন্তু কী ভেবে সে চুপ থাকল। স্টুডিওর ভেতরে ঢুকে শরীর ঠা-া হয়ে গেল পাখির। হালকা ঠা-া। বিশাল বড় ঘরজুড়ে রামেশের স্টুডিও। পুরোটাই কাচ দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের চারপাশ ঘিরে হালকা বাদামি পর্দা টাঙানো। ঘরের ঠিক মাঝখানে ক্যানভাস পেতেছে রামেশ। কিন্তু সেটা সাদা ক্যানভাস। তার চারদিকে রঙ তুলি ছড়ানো ছিটানো। মেঝের ওপর একটা হালকা হলুদ রঙের ক্যানভাস পাতা। সেই ক্যানভাসে অসংখ্য চোখ এঁকেছে রামেশ। দেখে বুক শূন্য হয়ে গেল পাখির। এটা কী ধরনের কাকতালীয় ব্যাপার, বিমর্ষ হয়ে উঠল পাখির মন। মাটির ভাড়ে তার্পিন তেল। রঙের তুলির সাইজ বিভিন্ন প্রকারের। প্যালেটে রঙ ছড়ানো। ঘরের অদূরে ডিভান পাতা। কাজ করতে করতে রামেশ যে এখানে মাঝে মাঝে শুয়ে পড়ে সেটা বুঝতে পারল পাখি কারণ ডিভানের ওপর রাখা আছে একটা সাদা ওয়ার পরানো বালিশ। কোনো রকমে ভদ্রতা করে পাখি বলে উঠল,আপনার স্টুডিওটা সুন্দর, রামেশ ভাই। তোমারও এরকম সুন্দর স্টুডিও হবে। আমার মতো বয়স হোক। এখন কফি খাবে? মাথা নেড়ে পাখি হ্যাঁ জানাল। ঘরের এক কোণে ইলেকট্রিক কেতলি, চায়ের কাপ, চিনি, দুধ সব সাজানো ছিল। কাছে গিয়ে কেতলির সুইচ অন করে দিল রামেশ। ঘরে ছোট ছোট মোড়া পাতা ছিল। তার একটা পাখিকে দেখিয়ে রামেশ বলল, বসো পাখি। পাখি বসল। তারপর চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকল ক্যানভাসের দিকে। ক্যানভাসে কত ধরনের যে চোখ এঁকেছে রামেশ। একেকটা চোখের দৃষ্টি একেকরকম। এবং আরও ভালো করে দেখতে গেলে কোনো চোখ যেন শুধুমাত্র চোখ নয়, তারও বাইরে কিছু একটা তারা বলতে চাচ্ছে। তাদের অঙ্কনভঙ্গী তীর্যক, ডানা মেলা পাখির মতো তীর্যক। কী বলতে চাচ্ছে চোখ? কোন বোধ, কোন সংজ্ঞায় চোখগুলো মানুষের চৈতন্যের দ্বারে আঘাত করতে চাচ্ছে? ভাবল পাখি। পাখির মনের ভাব যেন বুঝে ফেলে হেসে ফেলল রামেশ সোবহান। অনেকক্ষণ ধরে হেসে সে বলল, আসলে ওগুলো আজ যা দেখছ কাল তা আর থাকবে না। ওপটিক্যাল ইলিউশন একটা হচ্ছে বুঝতে পারছি। আমি আসলে পাখির সাথে চোখকে মেলাতে চাই। ঐ দেখ তোমার নামও আবার পাখি। সম্পূর্ণ কাকতালীয় একটা ব্যাপার। তবে তুমি নিশ্চয় আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করবে। দেখ পাখি, আমি কিন্তু মানুষের চোখকে খুব মূল্য দিই। না, না, শুধু চোখে দেখার জন্যে না, আরও অনেক কিছু। চোখ হচ্ছে মানুষের জীবনের একটা সহজিয়া চেতনা। একটা রূপরসগন্ধ, দেখ গন্ধ আমরা নাকে ঘ্রাণ নিই, কিন্তু তুমি কি বিশ্বাস করবে আমাদের চোখও ঘ্রাণ নিতে পারে? কথাটা বলে হেঁটে গিয়ে তার ডিভানে বসল রামেশ। আয়েশ করে পা ছড়িয়ে পাখির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, শোন তাহলে, আমি সেদিন গাড়িতে ফার্মগেট পার হচ্ছিলাম, তখন ঘোর বিকেল, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি রাস্তার মোড়ে একজন মহিলা বসে আছে একটা ঝুড়ি সামনে নিয়ে আর সেই ঝুড়ি থেকে উপচে পড়ছে বেলফুলের ছোট ছোট মালা। আবার মহিলার হাত ভর্তি সেই মালার ঝাড় উঁচু হয়ে আছে, শ্বেতশুভ্র বেলফুল। আঃ, আমি সেই ফুল থেকে কত দূরে, অথচ আমার চোখের ভেতর দিয়ে সেই বেলফুলের গন্ধ যেন আমার নাকে এসে লাগল, আমি মুহূর্তের ভেতরে বেভুল, আনমনা হয়ে গেলাম! প্রাণ ভরে গন্ধ নিলাম সেই বেলফুলের। শুচিস্নিগ্ধ ঘ্রাণে আমার মন ভরে গেল। আমি তাই আজকাল সবকিছুর সঙ্গে চোখকে মেলাতে চাই। চোখ কিন্তু মানুষের গায়ের গন্ধও তুলে নিতে পারে, তুমি জানো? চোখের ক্ষমতা আছে সেইসবকিছু অনুভব করার যা ভাষায় ব্যক্ত করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি বুঝতে পারছো, আমি কি বলতে চাচ্ছি? আমি তাই চোখের সাথে পাখিকে মেলাতে চাই, কারণ একমাত্র পাখিদের পক্ষেই সম্ভব চোখের বিশাল ব্যাপকতা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার। আমি মনে করি পাখি, এ পৃথিবীতে যা কিছুর সৃষ্টি হয়েছে, পাখির মতো সুন্দর সৃষ্টি আর একটাও হয়নি! ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, হোয়াট আই উড লাইক টু মিন, পাখি? পাখি তার কথা শুনতে শুনতে আন্দাজেই মাথা নাড়ল। সে তখন কিছু আর শুনছিল না। কারণ তার চোখ তখন ভেসে যাচ্ছিল জলে। কথা থামিয়ে হঠাৎ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল রামেশ সোবহান। তারপর মোড়া ছেড়ে উঠে এল পাখির কাছে এসে দু’হাতে তাকে টেনে তুলল সে আরেকটা মোড়া থেকে। একেবারে তার বুকের ওপর পাখির মাথা টেনে ধরে গভীর কণ্ঠে বলে উঠল, হোয়াট হ্যাজ হ্যাপেন্ড, পাখি? হ্যাভ আই হার্ট ইউ, বাই এ্যানি চান্স? পাখি কাঁদতে কাঁদতে বলল, না। রামেশ সোবহান কেমন বিহ্বলের মতো পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আই উড লাইক টু কিস ইউ ডারলিং, উড ইউ এ্যালাও মি টু ডু দ্যাট? প্লিইজ! রামেশ সোবহানের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, এমন একটা কিছু, যা কানে শুনে পাখির ভেতরটা গলে যেতে লাগল। পাখি বুঝল, তার জীবনের এই সঙ্কট সময়ে সে একটা আশ্রয় চায়, একটা সাহস চায়, একটু ভালোবাসা চায়। পাখি যা যা বর্তমানে চায়, তা তাকে কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু বর্তমানের এইটুকু স্নেহ যে পাখিকে কতখানি আনন্দ দিতে পারছে, সেটা কীভাবে পাখি অন্যকে বোঝাবে? পাখি চোখ বুজে থেকে নীরবে মাথা নাড়ল। পাখির দু’চোখের অশ্রু মুছে রামেশ মুখ নিচু করে চুম্বন করল পাখিকে। এ এক নতুন ধরনের চুম্বন। এরকম চুম্বনের সাথে ইতোপূর্বে পাখির কোনো পরিচয় ছিল না। জুবায়ের যখন তাকে ভালোবেসে চুম্বন করত, তখন সেটা ছিল ভালোবাসার চুম্বন। সেখানে ছিল মন দেয়া আর নেয়া। কিন্তু এই চুম্বন পাখিকে কোনো ভালোবাসার কথা বলল না। যা বলল তা হলো বুভুক্ষু এক হৃদয়ের কথা, যে হৃদয় শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। যে শুধু পেতে চায় তার শিল্পের মর্যাদা রাখার জন্যে। তার মরুভূমির মতো শুষ্ক হৃদয় যা গণ্ডুষে পাখির ঠোঁটের নির্যাস পান করে আরও বড় হয়ে উঠবে। আরও মহৎ শিল্পী হয়ে উঠবে। শিল্পের মহিমার বিস্তৃতির জন্যে যে বলি দিতেও রাজি আছে নিজের প্রিয়তম সত্তাকে। এইসব এলোমেলো চিন্তা মাথায় এসে পাখিকে কেমন বিভ্রান্ত করে দিতে লাগল। কিন্তু সে রামেশের গলা ছাড়ল না। যেন পাখি ডুবে যেতে বসেছিল, সেখানে সে একটা খড় ভেসে যেতে দেখেছে। সে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকল রামেশকে। রামেশের যৌবনদীপ্ত পুরুষালী গায়ের গন্ধ আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল তার নিজস্ব স্বকীয়তা। রামেশ তাকে পাগলের মতো আদর করতে করতে অস্ফুটে ডাকতে লাগল, ডারলিং, মাই ডারলিং। পাখি রামেশের শরীরের সাথে যেন মিশে যেতে লাগল। তার নিজস্ব অস্তিত্ব যেন বিলীন হতে লাগল রামেশের বাহুবন্ধনের নিপীড়নে। একসময় রামেশ তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যেতে লাগল ডিভানের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে পাখি চোখ বুজে ফেলল। ছয়. বাড়িতে ফিরে এল পাখি বিহ্বল হয়ে। যেন তার পা চলে না। হাঁটতে লাগল সে টিপিটিপি পায়ে। কেমন এক জ্বালাময় আচ্ছন্নতায় সে যেন নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়েছে। এরকম তো হবার কোনো কথা ছিল না। এরকম কেন হলো? রামেশ সোবহান একজন বিবাহিত পুরুষ। হোক সে শিল্পী, তবু সে একজন বিবাহিত পুরুষ। নিজের স্ত্রীর কাছে তার কিছু জবাবদিহিতা আছে। কিছু দেনাপাওনার হিসাব-নিকাশ আছে। আজ পাখিকে সে যেভাবে আদর করল এরকমভাবে যে কোনো নারী পুরুষের আদর খেতে পারে, এ ব্যাপারে তার কোনো ধারণা ছিল না। না, পাখির শরীরে সে প্রবিষ্ট হয়নি। কিন্তু পাখিকে সে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল বলা যেতে পারে। একসময় পাখি নিজেই সতর্ক হয়ে উঠে তাকে আর অগ্রসর হতে দেয়নি। আশ্চর্য এরপর রামেশও আর তাকে জোর করেনি। কেন জোর করেনি? কামনার এত তুঙ্গে উঠে কীভাবে একজন পুরুষ নিজেকে সামলে নিতে পারে পাখি তা জানে না। তবে তার গায়ের গন্ধ পাখির জীবনে এক নতুন পুরুষালী বোধ নিয়ে এসেছে। এত ঘনিষ্ঠভাবে এর আগে পাখি কাউকে চেনেনি। কিন্তু এতসবের ভেতরেও নিজেকে পাখির একটা অবান্তর অস্তিত্ব বলে মনে হচ্ছিল। যেন তার মনে হচ্ছিল রামেশ তাকে নয়, অন্য কোনো নারীকে বুঝি আদর করছে। যেন অন্য কোনো নারী রামেশকে তার অস্তিত্বের ভেতর থেকে নাড়া দিচ্ছে। যেন অন্য কোনো নারী তাকে স্বপ্নাচ্ছন্ন করে তুলছে, সেখানে পাখির কোনো ভূমিকা নেই! কী সাংঘাতিক আত্মপ্রতারণা। কী সাংঘাতিক আত্মঅবমাননা! কেন এরকম মনে হলো, পাখি তা জানে না। মন খারাপ হয়ে গেল পাখির। ভীষণ, ভীষণ মন খারাপ। এ ধরনের মন খারাপের সাথে আগে তার কোনোদিন পরিচয় হয়নি। এরপর দু’দিন সে বাসা থেকে বেরোল না। তাকে ভাবতে হবে। নিজের জীবন নিয়ে এরপর কী করবে তাকে ভাবতে হবে। ভাবতে গিয়ে তার মনে একটা তিক্ততার সৃষ্টি হলো। অন্ধের আবার জীবন কি? হাঃ, অন্ধের আবার জীবন কি? আগে পাখি সুযোগ পেলেই দুপুরে ঘুমোত। আজকাল সে আর দুপুরে ঘুমোয় না। যে কোনো প্রকারের সময় নষ্ট সে আর পছন্দ করতে পারে না। দুপুরের ঘুমটাকে সে সময়ের অপব্যহার বলে মনে করছে ইদানীং। অথচ চোখ খারাপ হবার আগে দুপুরে ভাত খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেয়া তার এক ধরনের বিলাসিতা ছিল। বিশেষ করে যেদিন তাদের বাইরের কোনো এ্যাসাইনমেন্ট ছিল না, সেদিন ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে ভাত খেয়ে চুটিয়ে ঘুম দিত পাখি। এখন পাখির জীবনে সেসব দিন গত। পাখি এখন সময়ের স্বর্ণালী চূড়ান্তে অবস্থান করছে। চোখে দেখার সময় বড় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে পাখির। এর পরে কী হবে পাখি জানে না। অথবা জানে কিন্তু ভাবতে সে ভয় পায়। জীবনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে সে ভয় পায়। বিকেলবেলা সাকিনা এল তার মামার বাসায়। সাকিনা হলে থাকে। সারাদিন ইচ্ছেমতো টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস সাকিনার। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে, সারাজীবন বাড়িতে বন্দি হয়ে কাটিয়েছি। এতদিন বাদে শিকলমুক্ত জীবন উপভোগ করছি। সাকিনাকে দেখে খুশি হয়ে উঠল পাখি। বন্ধুকে ধরে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসল। কলেজের খবর জিজ্ঞেস করল। সাকিনা বলল, তুই তো আর ক্লাস করিসনে ঠিকমতো। কিন্তু ভাই, চোখের অসুখ কার নেই বলতে পারিস? আমার তো মনে হয় আমাদের পুরো নেশন আজ বহুবছর ধরে চোখের অসুখে ভুগছে! এবং ভুগতে ভুগতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এবং অন্ধ হতে হতে বিপথে চলে যাচ্ছে। কোনটা নর্দমা, কোনটা কুয়ো আর কোনটা রাস্তা তা ঠাহর করতে পারছে না! সাকিনার কথা শুনে হাসল পাখি। সাকিনা খুব মজা করে কথা বলতে পারে। ক্লাসের ছেলে রাকিবের সাথে সাকিনার প্রেম চলছে ইদানীং। কিন্তু এই প্রেমের স্থায়িত্ব কতদিনের তা বলা মুশকিল। যার সাথে সাকিনা প্রেম করে সে রাকিবও খুব চৌকস ছেলে। এর আগে আরও দু’তিনজনের সাথে প্রেম হয়েছিল রাকিবের। একবার তো ইন্টারনেটে প্রেম করে একেবারে ল্যাজে গোবরে অবস্থা তার। সেই মেয়েটি ছিল ঘানার। একদিন ঘানা থেকে মেয়েটি এসে হাজির হলো আর্ট কলেজে। হোয়ার ইজ রাকিব? এ কথা বলে চেয়ারম্যানের ঘরে গিয়ে হাজির হলো মেয়েটি। মেয়েটির নাম ছিল অ্যাঞ্জেলা। কালো ভুষো তার গায়ের রং। হিলহিলে লম্বা। মাথায় ঘন কালো ও অসম্ভব কোঁকড়া এক ধামা চুল টোপরের মতো বসে আছে। লম্বায় অন্তত ছ’ফুটের কাছাকাছি। ঘানার কোনো অ্যামবাসি ছিল না তখন। কীভাবে সে বাংলাদেশে এসেছিল তা কেউ জানে না। রাকিব তার আগেই কলেজে রটিয়ে দিয়েছিল সে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাচ্ছে ছবি আঁকতে। সেখান থেকে এঁকে আনবে সে সমুদ্রতীরে নুড়ি কুড়োনো মেয়েদের। এঁকে আনবে স্নানরত যুবক-যুবতীদের। এঁকে আনবে বেলাভূমি ও সমুদ্রের নীল। আসলে সেসবই ছিল আইওয়াশ। আসলে অ্যাঞ্জেলার খবর পেয়ে সে পালিয়েছিল তার গ্রামে। ঝাড়া একমাস পালিয়েছিল সে। অ্যাঞ্জেলা তো চলে গেল সাতদিন পরেই। কিন্তু রাকিব আর ঢাকায় ফিরে আসে না। এত ভয় পেয়েছিল তা বলার মতো নয়। সেই থেকে ইন্টারনেটে প্রেম করা একটু কমেছে রাকিবের। কিন্তু চ্যাট করা একফোঁটাও কমেনি। একেকদিন সারারাত চ্যাট করে যখন সে কলেজে আসে, সেদিন তার চেহারা দেখার মতো হয়। আমি বাবা-মায়ের বখে যাওয়া একমাত্র সন্তান। রাকিব বলে, আমাকে তোমাদের বুঝতে হবে। আমার সাইকিক প্যাটার্ন তোমাদের বুঝতে হবে। আমি এই ইনস্টিটিউটে না পড়ে তো বখেও যেতে পারতাম। ইয়াবা ট্যাবলেট পকেটে ভরে ছিনতাই করতাম মেয়েদের হাতব্যাগ, তখন? তুই হাতব্যাগ ছিনতাই করলে আমাদের কী ক্ষতি হতো বল তো? একদিন জিজ্ঞেস করেছিল পাখি। তার উত্তরে রাকিব হেসে বলেছিল, সেই হাতব্যাগটা তো তোর হতে পারতো, পারতো না? সাকিনা খাটে পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করতে লাগল। আজ সন্ধ্যায় রাকিবের সাথে সে এক জায়গায় পার্টি করতে যাবে। পাখিকে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়। রাকিব তার চাচার গাড়িটা জোগাড় করেছে কায়দা করে। রাকিব গাড়ি চালাতে পারে। সুতরাং কোনো অসুবিধে নেই। সাকিনার কথা শুনে মাথা নাড়ল পাখি। তার মামা তাকে রাতের বেলা বাইরে থাকতে দেবে না। আমি কায়দা করে তার সম্মতি আদায় করছি, তুই দ্যাখ না। এই কথা বলে মেজমামার ঘরে গিয়ে তাকে লম্বা ও বিনীত একটা সালাম ঠুকল সাকিনা। তুমি কে? জিজ্ঞেস করল শাহাবউদ্দিন। আমি সাকিনা, মামা। আপনি আমাকে আগেও দেখেছেন। তাই নাকি? বলল শাহাবউদ্দিন। হ্যাঁ, মামা। মামা, আজ আমার জন্মদিন। আমরা ক্লাসের বন্ধুরা এক হয়ে রাতে চাইনিজ খাবো। তাই পাখিকে আমার সাথে করে নিয়ে যেতে চাই। পাখি তো একটু আগেই দেখলাম বাসায় ফিরল। সে কি আবার বাইরে যেতে চাইবে? না মামা, পাখি তো একেবারে যেতে চাচ্ছে না! আমি তাই জোর করে ওকে নিতে এসেছি। পাখি যদি আমার জন্মদিনের উৎসবে না থাকে, তাহলে আমার জন্মদিন আর হবে না, মামা। অম্লান মুখে একগাদা মিথ্যে বলে করুণ চোখে সাকিনা মামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। সাকিনা ভালো করেই জানত যদি মামা জানতে পারত পাখির রাতের বেলা বাইরে যেতে খুবই ইচ্ছে তাহলে তার কাছ থেকে সম্মতি আদায় করা কঠিন হয়ে যেত। পাখির বাইরে যেতে ইচ্ছে নেই শুনে মামা উদার হয়ে বললেন, না, না, সেকি, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মাঝে মাঝে বাইরে বেরোতে যাওয়া তো খুব ভালো। মনের ভেন্টিলেশন হয়। তুমি গিয়ে ওকে বলো যে আমি তাকে বাইরে যেতে বলছি। তবে তোমরা ওকে রাতের বেলা বাড়ি পৌঁছে দেবে। তা তো অবশ্যই মামা। মাথা নিচু করে আরও বিনীত ভঙ্গি করল সাকিনা। একটু পরে বাসা থেকে দুজনে বেরিয়ে এল। পাখি আর সাকিনা। রিকশা করে মগবাজারের মোড়ে আসতেই দেখা গেল রাকিব তার টয়োটা করোলা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে গাড়িতে আরও আছে নিনা, জাহিদা, সজিব, আর, আর জুবায়ের। জুবায়েরকে গাড়ির ভেতরে দেখে যেন বুক ধক করে উঠল জাহিদার। কিন্তু ব্যস ঐ পর্যন্তই। ব্যাপরটা বুঝে অবাক হয়ে গেল সে। আরে আশ্চর্য, এখন আর জুবায়েরকে দেখে তার ভেতরে কোনো আবেগজনিত প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। তার অর্থ, মানুষ ইচ্ছে করলেই কি সব ভুলতে পারে? মানুষ কি তার অতীত ভুলতে পারে? গাড়িটা ভ্যান জাতীয়। ভেতরে বেশ কিছু বসার জায়গা আছে। পাখি লক্ষ করে দেখেছে আজকাল অনেক মানুষ প্রাইভেট গাড়িও মাইক্রোবাস মডেলের মতো কেনে। গাড়ির ভেতরে আধো অন্ধকারের ভেতরে ঢুকে পাখি খুবই আবছাভাবে জুবায়েরকে দেখল। যতটুকু না দেখল তার চেয়ে যেন অনুভব করল বেশি। সেদিন দুপুরে রামেশ সোবহানের সাথে সে দেখা করেছিল। একটা খারাপ কাজ করেছিল। লোকটা তাকে জড়িয়ে ধরে তাকে চুমো খেয়ে তার ভেতরের কলকব্জাগুলোকে একেবারে যেন নড়ঘট করে দিয়েছে। পাখির ভেতরে একটা বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করেছে। আবার সেই সাথে এমন একটি বিতৃষ্ণার ভেতরে ডুবে যেতে ইচ্ছেও করছে! লোকটা যেন বড় চতুরতার সাথে পাখির ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা বাসনাগুলো মোচড় দিয়ে ফেলেছে! কিন্তু এখন জুবায়েরকে অনুভব করে পাখির ভেতরে একটা কান্নার গোপন নদী যেন নীরবে প্রবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু না, পাখি নিজেকে সামলে রাখার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। জীবনের অভিজ্ঞতা পাখিকে নিরাসক্ত করে তুলতে পেরেছে। পাখি তাই পেছন ফিরে জুবায়েরকে দেখে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠল, কেমন আছো জুবায়ের? পাখির এরকম স্বাভাবিক গলার স্বর শুনে জুবায়ের কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে বলে উঠল, আমি ভালো আছি পাখি, তুমি কেমন? তার কথা শুনে পরমুহূর্তে পাখির বলতে ইচ্ছে করল, আমি ভালো নেই জুবায়ের। আমি তোমাকে হারিয়ে ভালো নেই! কিন্তু না, এ কথা বলা চলবে না। নিজের চোখের উদ্গত অশ্রু চেপে রেখে পাখি বলল, আমি তো ভালো। মানে ভালো বলতে যতদূর বোঝা যায়। ছবি আঁকছি, বেড়াতে যাচ্ছি তোমাদের সঙ্গে, আবার কথা কি? নিজের গলার স্বর শুনে পাখি নিজেকে বিজয়ী বলে মনে করল। হ্যাঁ, পাখি দেখিয়ে দিয়েছে জুবায়েরকে যে জীবনের চ্যালেঞ্জ একা একাই পাখি নিতে সক্ষম। তার জন্যে জুবায়েরের মতো কোনো পুরুষের সাহায্য তার দরকার নেই। এই ক্ষমতাটুকু পাখি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে অর্জন করেছে। এটা একটা শক্তি। ইংরেজিতে যাকে বলে, পাওয়ার। এ পৃথিবী বর্তমানে পাওয়ার গেমে চলে। রামেশ সোবহান কথাটা তাকে বলেছে। রামেশ তাকে সে দিন কথায় কথায় বলেছে, এ পৃথিবী বর্তমানে পাওয়ার গেমের পৃথিবী, পাখি। বস্তুত পৃথিবীর সভ্যতা বলতে যা বোঝায়, তখন থেকেই এই পাওয়ার গেমের শুরু। কখনো সেটা খুব করে বোঝা যায়, কখনো সেটা থাকে চাপা। তবে একেক যুগে এর প্রকাশ থাকে ভিন্ন। রামেশ লোকটার জীবনে অভিজ্ঞতা প্রচুর। এরকম একজন ট্যালেন্টেড মানুষের ভেতরে এ রকমের চতুরতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পাখি শুনেছে রামেশ নাকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও গিয়েছিল। পাঁচ না সাত নম্বর সেক্টরে সে যুদ্ধও করেছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সে নেয়নি। কাকে নাকি রামেশ একদিন বলেছিল, হোয়াট সার্টিফিকেট? হোয়াট ফর? আই হেইট সার্টিফিকেট! সে কথা শুনে পাখিরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। অথচ তাদের চোখের সামনেই তারা দেখছিল মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট সরকারের কাছ থেকে আদায় করার জন্যে সচিবালয়ে ভিড় জমে যাচ্ছে প্রতিদিন। পাখি তাই মাঝে মাঝে আজকাল ভাবে, রামেশ আসলে কি একজন শিল্পী, নাকি একজন ঠগবাজ, যে নিজের স্ত্রীকে ক্রমাগত ঠকিয়ে চলেছে? তবু রামেশের কথাটা তাকে মুগ্ধ করেছে। রামেশ বলেছে, পাখি, পুরো পৃথিবীটা বর্তমানে পাওয়ার গেমের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই যে তুমি আমার কাছ থেকে নিজেকে এখন ছিনিয়ে নিলে, আমি জানি এটাও একটা পাওয়ার গেম, তোমার ভেতরে একটা মন এখন আমার সঙ্গ চাইছে, আমার শরীরের আদর চাইছে, আর আমিও সে আদর তোমাকে দিতে প্রস্তুত, কারণ আমরা দুজনেই নিজের নিজের জীবনযাপনের ভেতরে নিঃসঙ্গ, আমার সংসার আছে, ছেলে আছে, তবু আমি নিঃসঙ্গ, কারণ নিঃসঙ্গতার অভিশাপ নিয়ে আমরা এ পৃথিবীর বুকে পা রাখি, তবু আমি তোমাকে আর জোর করলাম না, কারণ আমাদের দুজনের ভেতরে তুমিই এখন শক্তিশালী বেশি। তোমার অমতে আমি কিছু করতে পারি না, বা করতে অক্ষম। যদি কোনোদিন তুমি আমার আরও কাছে আসতে চাও এবং আমারও মন সে পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে তোমার সাথে আমার আবার নতুন করে পরিচয় হবে। তার কথা শুনে হঠাৎ করে লোকটাকে তার অচেনা মনে হয়েছিল। আসলে আমরা মানুষকে কীভাবে চিনি? ভেবেছিল পাখি? অধিকাংশ মানুষকে কি আমরা অর্ধেক মাত্র চিনি জীবনে? কে কবে মানুষকে সম্পূর্ণভাবে চিনতে পেরেছে? এমন কি স্ত্রীও? যে স্ত্রী রামেশ সোবহানকে বছরের পর বছর দেখছে, এক সঙ্গে সংসার করছে? সাত. গাড়ি চালাতে চালতে রাকিব বলল, আমরা এখন যাবো অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। সেখানে স্বাধীন ভাইয়ের এক্সিবিশন হচ্ছে। মূলত এটা স্থাপত্যের একটা নতুন নিদর্শন। মনে হয় বাংলাদেশে যত ইঁদুর আছে, সব জড়ো হয়েছে অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এইসব ইঁদুর আমাদের সমাজেই বাস করে। আর তারা ক্রমাগত কুট কুট করে খেয়ে ফেলছে আমাদের পরিবার ও জাতীয় জীবনের যাবতীয় ভালো কিছু। প্লেগ যেভাবে ধ্বংস করে ফেলে। তবে সেখানে বসে আমরা চপ-কাটলেট খাবো, কফি খাবো আর কাচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার চত্বরে ইঁদুর দেখবো। তাহলে এই এক্সিবিশনের নাম কি? দি প্লেগ? বলে উঠল সজিব। তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে রাকিব বলল, এখানে কারও কোনো আপত্তি থাকলে বলতে পারো। জুবায়ের বলল, আমি তো ভেবেছি আমরা চাইনিজে যাচ্ছি। চাইনিজ কোনো খাবার হলো, ভাই? বুড়ো মানুষদের খাবার ওগুলো। যাদের গালে দাঁত নেই, তারা চাইনিজ খাবে, কুটি কুটি মাংস, প্যালপেলে স্যুপ, তার চে’ বরং ক্লাব স্যান্ডউইচ, এগরোল, চিকেন কাটলেট, ইয়া বড় হাত সাইজের সব কাটলেট, একটা খেলেই জান ঠা-া। সবশেষে ফ্রুটকেক। রাকিবের কথায় জুবায়ের চুপ থাকল। বোঝা গেল, সে রাজি আছে। জাহিদা পেছনে বসে হঠাৎ হি হি করে হাসল। সাকিনা রাকিবের পাশে বসে পেছন ফিরে বলল, হাসছিস যে? জাহিদা বলল, হাসবো না কেন? হাসতে কি আমার মানা আছে? তুই কীভাবে পাখির মামার কাছ থেকে পাখিকে বাইরে নিয়ে এলি, নিজের জন্মদিনের নাম করে, যেখানে গত মাসেই তোর জন্মদিন আমরা টিএসসির মাঠে বসে উদযাপন করলাম। এবার তার কথা শুনে হাসল সকলেই। অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে আজ সাংঘাতিক ভিড়। বেয়ারা চারদিকে ছোটাছুটি করছে। এদিকে চত্বরে এক্সিবিশন হচ্ছে। ওরা ঘুরে ঘুরে এক্সিবিশন দেখল। তারপর খেতে বসল একটা বড় টেবিলজুড়ে। ওদের কলকাকলীতে ভরে উঠল পরিবেশ। পাখি লক্ষ করল জুবায়ের বেশ চুপচাপ হয়ে বসে আছে। আসলে জুবায়ের তো আর্ট কলেজের নয়, তবে ওর বেশিরভাগ বন্ধু-বান্ধবই আর্ট কলেজের। পাখি অনুভব করল জুবায়ের মনমরা হয়ে গেছে হঠাৎ। তার কি মনের ভেতরে কোনো অপরাধবোধ হচ্ছে পাখিকে দেখে? নাকি পাখিকে স্বাভাবিক দেখে তার মন খারাপ? খাওয়ার টেবিলে আরও এক কাণ্ড করে বসল জুবায়ের, বন্ধু-বান্ধব সকলের সামনে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে পাখির হাত ধরে বলে উঠল, পাখি, আমি সরি। তার ব্যবহার দেখে সকলে একটু যেন হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর সাকিনা বেশ সপ্রভিত হয়ে বলে উঠল, সরি ফর হোয়াট? পাখি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে সে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, আমার অসুখ হয়েছে। চোখের অসুখ। আমার বন্ধুরা এ কথা জানে। এবং তারা এ জন্যে দুঃখিত। তোর সঙ্গে আমার একটু আলাদা সম্পর্ক ছিল বটে, কিন্তু তুই আমার অসুখ দেখে যত কষ্টই পাস, তবু তোকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, এ জন্যে আমার কোনো মন খারাপ হয়নি। আর তাছাড়া তোর আর আমার ভেতরে কোনো প্রতিশ্রুতি তো ছিল না কোনোদিন। সহজ স্বাভাবিক একটি সম্পর্ক ছিল। তুই চাইলে সে সম্পর্ক সবসময় বজায় থাকবে, জুবায়ের। এতগুলো কথা মাথা ঠা-া করে বন্ধুদের সামনে বলতে পেরে নিজেই অবাক হয়ে গেল পাখি। ভাবল, জীবনের পরিবর্তিত অবস্থা কি মানুষের ভেতরে এভাবে কাঠিন্য এনে দিতে পারে? পাখির কথা বন্ধুরা সকলেই শুনল। সকলেই হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্যে। সাকিনা এবার হৈ রৈ করে বলে উঠল, রাকিব, উই আর হাংরি। খাবার দিতে এত দেরি করছে কেন? রাকিব বলল, দেখছিস নে, দুজন বিদেশি এসেছে, মানে ফ্রেঞ্চ ম্যান, তাদের সার্ভিস দিতে তারা এখন ব্যস্ত আছে। তার মানে? সজিব শুনে যেন ক্ষেপে গেল। সাকিনা বলল, এই চুপ, চুপ। রাতে বাড়ি ফিরে এল পাখি হালকা একটা মন নিয়ে। রাত হলেও মামা বা মামি তাকে কিছু বলল না। বাড়ি ফিরে পাখি তার নিজের ঘরে ঢুকে রেডিও চালিয়ে দিল। রেডিওতে গান বাজতে লাগল। একটা মন খারাপ করা গান। কিন্তু পাখির মন এখন খারাপ না, পাখির মন ভালো। পাখি বিছানায় যাবার আগে বাথরুম সেরে আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ালো। নিজের চেহারার দিকে বেভুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে সে আয়নার সামনে মাটিতে বসে পড়ল। একেবারে মেঝেয় লেটিয়ে বসল। তারপর দুহাতে মুখ চেপে কাঁদতে লাগল। অথচ এখন তার কান্নার কথা ছিল না, তবু কেন যে চোখ ঝেপে পানি চলে এল তার, সে কিছুই বুঝল না। এটাও ভাবল যখন তার চোখ দুটো সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হয়ে যাবে, তখনও কি পাখি এভাবে কাঁদতে পারবে? দৃষ্টিহীনের কি কান্না আসে? পাখি জানে না। পাখি মেঝের ওপরে লুটিয়ে পড়ে থাকল, সারারাত। আট. পাখিকে দেখে আজ আর যেন রাখী অবাক হলো না। যেন জানত পাখি আবার আসবে। আজও পাখি সেদিনের মতো দুপুর বেলাতেই এসে হাজির হয়েছে। রাখীর বড় ছেলে স্কুলে। রাখীর স্বামী সুলেমান সেলসম্যান। প্রায় এ সময়টাতে সে বাইরে বাইরে ঘোরে। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘোরাফেরা করা তার কাজ। ডাক্তারদের কাছে গিয়ে হাসিমুখে প্রত্যয়ের সঙ্গে নিজের কোম্পানির ওষুধের গুণগান করা তার স্বভাবের সঙ্গে বর্তমানে এক হয়ে গেছে। সেই হিসেবে সে আশাবাদী। কোনোদিন দুপুরে বাড়ি ফেরে, ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার সে বেরিয়ে যায়, বিকেল বেলা তার টার্গেট হচ্ছে ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারগুলো। ধৈর্য ধরে সে ডাক্তারদের চেম্বারের সমুখে বসে থাকে। জানে, কোনোসময় না কোনোসময় ডাক আসবেই। ছোটখাটো উপহারের জিনিস সর্বদাই তার হাতে থাকে। বিশেষ কোনো উপহার হলে সে তখন বিশেষ বিশেষ ডাক্তারদেরই সেগুলো উপহার হিসেবে দেয়। তবে সুলেমান খেয়াল করে দেখেছে, কোনো কোনো ডাক্তারকে যত উপহারই দেওয়া হোক না কেন, ভবি ভোলে না। সে ডাক্তার যা প্রেসক্রিপশন করবে, সেটা তার মাথার ভেতরেই গেঁথে থাকে। এই গেঁথে থাকা ছাড়াতে অনেক বেগ পেতে হয় ড্রাগ রিপ্রেজেনটেটিভদের। তবে একবার ছাড়াতে পারলে আর চিন্তা নেই। তখন সুলেমানের কোম্পানির ওষুধই চলতে থাকবে অনাদিকাল ধরে। তাই সুলেমান আশাহত হয় না কখনো। সুলেমানের সঙ্গে পাখির এখনও চাক্ষুষ দেখা হয়নি। পাখি সেটা চায়ও না। তার কেন জানি মনে হয় সুলেমানকে সে দুলাভাই হিসেবে ডাকতে পারবে না। তার ইচ্ছেই হবে না ডাকতে। আর তাতে করে রাখী মন খারাপ করতে পারে। হাজার হোক সুলেমান তার স্বামী। পাখি বারবার করে ভেবেছে সুলেমান, তাদের সংসারের কোনো প্রাইমারি কালার নয়, মানে আদি রঙ নয়, রঙের জগতে তিনটে রঙই হচ্ছে আদি বা মূল রঙ। যাদের বলা হয় বেসিক কালার। তারা হলো লাল, নীল আর হলুদ। সেই হিসেবে সুলেমান হচ্ছে সেকেন্ডারি রঙ। অর্থাৎ দ্বিতীয় ক্যাটাগরির রঙ। যে রঙের প্রাধান্য প্রাইমারি রঙের চেয়ে অল্প মূল্যের। যেমন সে হতে পারে কমলা; লাল আর হলুদে মিশে যে রঙের সৃষ্টি। অথবা বেগুনি, লাল আর নীলে মেশানো যে রঙ, অরিজিনাল কিছু নয়! অথবা সুলেমান হতে পারে আরও তৃতীয় স্তরের কোনো রঙ, যেমন লাল আর সবুজে মিশে খয়েরি! কথাগুলো পাখির মনের ভেতরে বুদবুদের মতো ওঠে আর ডুবে যায়। স্থায়ী কিছু নয়। রাখীর ছোট ছেলেটা এখন ঘুমোচ্ছিল। পাখি তাকে ডাকতে দিল না। তবে ওদের জন্যে দুই প্যাকেট চকোলেট কিনে এনেছিল, সে দুটো সে রাখীর হাতে তুলে দিল। রাখী একটু ভদ্রতা করে বলতে গেল, কেন আবার এসব আনতে গেলি, বলতো? কিন্তু বলতে গিয়েও বলল না, কী ভেবে যেন চুপ করে গেল। মুখে বলল, ওরা এগুলো পেলে খুব খুশি হবে। এরপর রাখী জোর করতে লাগল দুপুরে ভাত খেয়ে যাবার জন্যে। কিন্তু পাখি বলল, না, খাবো না। আমার খিদে নেই। দুপুর বেলা খিদে নেই, বলিস কি পাখি? রাখী অবাক হয়ে বলল। পাখি বলল, এ সময়টাতে তো আমরা কলেজে থাকি, দুপুরে তাই ভাত খাওয়ার অভ্যেস নেই। তাহলে ভাজি আর রুটি খা? রাখী আগ্রহ করে বলে উঠল। পাখি আর কি করে। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। পাখির মাথা নাড়ানো দেখে রাখী যেন অবাক হয়ে গেল। যেন সে ভাবতে পারেনি পাখি তার বাসায় দুপুরে খেতে রাজি হবে। সে যেন একটা ঘোর ভেঙে অতি দ্রুততার সঙ্গে শরীরে মোচড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর কোমরে আঁচল জড়িয়ে দ্রুতপায়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। পাখি আপন মনে বারান্দায় বসে থাকল। মনে মনে ভাবল, দুপুরে খেতে রাজি হয়ে সে কি রাখীকে কোনো সমস্যায় ফেলে দিল? একটু পরে পাখি রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখল ছোট্ট সেই খুপরির মতো অন্ধকারে রাখী একটা গামলায় বসে বসে আটা মাখাচ্ছে। পাখিকে উঁকি মারতে দেখে বলল, এই পাঁচ মিনিটেই সব হয়ে যাবে দেখিস। কিন্তু পাঁচ মিনিটে কিছুই হলো না, পঁচিশ মিনিট লাগল। দুখানা রুটি, আলু ভাজা আর একটা ডিমভাজা এনে পাখির সামনে এনে রাখল রাখী। বসার ঘরেই খাওয়ার টেবিল পাতা। সেই টেবিলে খাবার এনে সাজিয়ে রাখল রাখী। পাখি খেতে বসে দেখল, রাখী আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে। পাখি বলল, কেন তুমি এত কষ্ট করতে গেলে বলো তো, বুবু? অনেকদিন বাদে যেন এই প্রথম আবার তাকে বুবু বলে সম্বোধন করল পাখি। করে নিজেই যেন মনে মনে চমকে গেল। রাখী ঘরের ফ্যান আরেকটু জোরে ছেড়ে দিয়ে বলল, এটা কোনো কষ্ট হলো পাখি? তুই ছোট থাকতে আমার কাছে কত বায়না ধরতিস সে সব বুঝি তোর মনে নেই? না, পাখির এসব কিছু মনে নেই। সে আপন মনে খেতে লাগল। তখন ফ্রিজ খুলে রাখী বের করে আনলো দুটো ছোট ছোট রসোগোল্লা। টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, খাওয়া শেষে এই মিষ্টি দুটো খাস। খাওয়ার সময় আর কোনো কথা হলো না দুজনের। পাখির মনের ভেতরে ক্রমাগত যেন ভাঙচুর হতে লাগল। আজ সে এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে রাখীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আর সেটা হলো নিজের দৃষ্টিহীনতার কথাটা বোনকে জানাতে। দৃষ্টি হারাবার পর পাখির কী হবে তা যেমন পাখি জানে না, তেমনি পৃথিবীর আর কেউ জানে না। তার মা জানে না, মামারা জানে না, বন্ধুরা জানে না, জুবায়ের জানে না, কে-উ জানে না। আর তার বোন রাখী তো জানেই না। তবু রাখীকে কথাটা বলতে হবে, মনে মনে ভেবেই আজ সে এসেছে এখানে। সময় করেই এসেছে। আজ দুপুরে তার কোনো ক্লাস নেই। বিকালে প্র্যাকটিকাল আছে, কিন্তু তার আগেই তো সে পৌঁছে যাবে। খাওয়া শেষে পাখি যখন নিজের মনে প্রস্তুত হচ্ছে কথাটা বলার জন্যে ঠিক তখুনি যেন একটা ঝড়ের মতো বাসায় এসে উপস্থিত হলো সুলেমান। দরজা খুলতে একটু দেরি হয়েছিল, ঘরে ঢুকেই সুলেমান চিৎকার করে বলল, অ্যাই খানকি, দোর খুলতে এত দেরি করিস কেন, অ্যাঁ? আমাকে এখুনি আবার বেরোতে হবে, তোর মতো সুখে থাকি আমি, তাই না? কথাগুলো বলে ঝড়ের বেগে সে তার হাতের পেটমোটা ওষুধের ব্যাগটা ছুড়ে ফেলল ডাইনিং টেবিলের ওপর। বসার ঘরের ফাঁক দিয়ে শোবার ঘরটা দেখা যাচ্ছিল, সুলেমানের চিৎকারে ছোট ছেলেটি ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল, পরমুহূর্তে যেন বিপদের আঁচ করে সে চুপ করে গেল। পাখি দাঁড়িয়েছিল দরজার আড়ালে। সুলেমানের চোখ তখনো তার দিকে পড়েনি। যখন পড়ল, সে হতভম্ব এবং রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে থাকল রাখীর দিকে। রাখী খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, পাখি, আমার বোন। তুমি একে ছোটবেলায় দেখেছো। সুলেমানের হতভম্ব ভাব তখনো কাটেনি। এখন তার সঙ্গে যোগ হলো ক্ষুব্ধতা। সে বলল, তা সে হঠাৎ আমাদের এখানে কেন? কোনো মতলব নেই তো? পাখি লোকটার ব্যবহার দেখে অবাক হয়ে গেল। এই লোকটাকে তার বোন ভালোবেসে বিয়ে করেছে? এর জন্যে সে তার স্নেহের আশ্রয় ছেড়ে ছেলেবেলায় পালিয়েছে? হা, আল্লা! পাখির মনের ভেতরে কী যে হতে লাগল সে বুঝতে পারল না। সে একবার রাখীর দিকে আরেকবার শূন্যে দৃষ্টি ফেলে বলে উঠল, যাই রাখী বু’। রাখী দরজা খুলে ধরে শোনা যায় কি যায় না স্বরে বলল, আবার আসিস, বোন। নয়. আজ রামেশের পোশাক দেখে অবাক হলো পাখি। একবারে যেন অন্যরকম। আজ সে লেভিস-এর প্যান্ট পরেছে। গায়ে মেরিন ব্লু জিনসের ঢোলা শার্ট। বড় ঝাঁকড়া চুলগুলো এলেমেলো হলেও বোঝা যাচ্ছে সে ছেলেদের সেলুনে গিয়ে চুলের পরিচর্যা করেছে। তার বড় বড় চোখ ঢেকে আজ শোভা পাচ্ছে সানগ্লাস। রামেশও অবাক হলো পাখিকে দেখে। বলল, আমি এক্ষুনি একটা সভা থেকে ফিরলাম। তুমি হঠাৎ যে? তার কথা শুনে মনে মনে অপ্রতিভ হয়ে গেল পাখি। সে কি হঠাৎ এসে ভুল করল? তারপর সেই অনুভব কাটাতে যেন রাগ করে বলে উঠল, কেন, আমি কি হঠাৎ আসতে পারিনে? আমার যেন মনে হয়েছিল সেদিন আপনি বলেছিলেন আমার যখনই মন চায় আমি আপনার কাছে আসতে পারবো। অবশ্যই, পাখি অবশ্যই। টেনে টেনে কথাটা বলে উঠল রামেশ। তারপর বলল, এসো আমার স্টুডিওতে গিয়ে বসি, ওখানে ঠা-া আছে। একটু পরে পাখি পায়ে পায়ে তার স্টুডিও ঘরে ঢুকল। একটা ছোট চৌকো গদি আঁটা বেদের টুলে বসে চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। একটু পরে পাখি যেন আপন মনে বলে উঠল, আমি আবার ছবি আঁকতে শুরু করেছি, রামেশ ভাই। তাই? বলে উঠল রামেশ। তারপর বলল, আমি তো মনে করি স্টুডেন্টরা সর্বদাই হাতে রংতুলি নিয়ে বসে থাকে। হয় তার কলেজে, অথবা বুড়িগঙ্গায়, অথবা শালবনে। আমাদের সময় তো তাই ছিল। পাখি তার কথা শুনে বলল, আমাদের সময় আর আপনাদের সময়ের ভেতরে অনেক তফাৎ আছে। আপনারা পেয়েছেন জয়নুল আবেদিনকে, পেয়েছেন কামরুল হাসানকে, পেয়েছেন আনোয়ার ভাইকে। আজকাল হিসাব করে কাজ করতে হয়। রঙ, তুলি, কাগজ সব দিনে দিনে মহার্ঘ্য হয়ে যাচ্ছে। তাই নাকি? রামেশ একটু যেন অপ্রতিভ হয়ে বলে উঠল। পাখি বলল, কিন্তু আমার কাছে এসব বাধা এখন বাতুল। এখন আমাকে প্রাণপণে এঁকে যেতে হচ্ছে জলরঙ, এক্রিলিক বা তেল রঙ। কারণ অচিরেই আমার রঙের খেলা তো বন্ধ হয়ে যাবে, রামেশ ভাই। তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না তো পাখি? রামেশ যেন কিছুটা হতাশ স্বরে বলে উঠল। পাখি বলল, খুব যেন স্বাভাবিক স্বরেই বলল, আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি, রামেশ ভাই। কী বললে? রামেশ যেন তার কথা বুঝতে পারলো না। আমার চোখে এমন একটা অসুখ হয়েছে যা ধীরে ধীরে আমার দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিচ্ছে। আমি আর বেশিদিন ছবি আঁকতে পারবো না। ক্যানভাসে আপনাদের মতো রং ছড়াতে পারবো না, রঙের কম্বিনেশন করতে পারবো না। আমি একটা গন কেস হয়ে যাচ্ছি, রামেশ ভাই। আমি পড়াশোনা শেষ করে বিদেশ যেতে পারবো না, প্যারিস, স্পেন, ফ্লোরেন্স, মাদ্রিদ, রোম কিছুই চোখে দেখতে পারবো না, আমি আমার চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। আমি ল্যুভর দেখতে পারবো না, বার্সিলোনায় গিয়ে দেখতে পারবো না সেখানকার শিল্পীদের হাতের কাজ। আমি কিছুই দেখতে পারবো না। এমন কি আমি জয়নুল, আমিনুল, কামরুল, কাইয়ুমও আর কিছুদিন বাদে চোখে দেখতে পারবো না। কথা বলতে বলতে যেন আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল পাখি। বলতে লাগল, আবেদিন ভাইয়ের সেই দুর্ভিক্ষের ছবি, যা দেখে ভারতের ধনকুবের বিরলা একদিন বলেছিলেন, প্লিজ, ছবিটি দেয়াল থেকে নামিয়ে ফ্যালো, যত টাকা লাগে আমি দেবো। সেই ছবিটিও আমি আর প্রাণভরে দেখতে পারবো না। আমি কামরুল ভাইয়ের সেই পলিরঙা গাভীটিও আর দেখতে পারবো না, যার ওলান দিয়ে ঝরে পড়ছে অনর্গল সেই অমিয় দুধের ধারা যা আমাদের ক্ষুধার জঠরে লেপে দিচ্ছে স্নিগ্ধ সুশীতল একটি প্রলেপ। আর আমিনুল ইসলাম ভাইয়ের সেই আহ্বান, আমাদের দৃষ্টিকে ফেরানো স্থলভাগ থেকে জলে, যে জল থেকে জীবনের উৎপত্তি, যে জলতলের ঠিক নিচেই রয়েছে পৃথিবীর আদি রহস্য, সেই ভেষজ, মৎস্যজ, কীটজ জগৎ। সেই জগৎও আমার চোখের সামনে থেকে হয়ে যাবে অদৃশ্য। আমি একটা গন কেস হয়ে যাচ্ছি, রামেশ ভাই! পাখি এবার ছোট মোড়া থেকে উঠে দুহাতে মুখ ঢেকে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। রামেশ ছুটে এল পাখির কাছে। দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, আমি তোমার ন্যুড আঁকতে চাই পাখি, আমাকে আঁকতে দেবে? পাখি তার কথা শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। এ কী শুনলো সে রামেশের মুখে? রামেশ পাখির দিকে না তাকিয়ে যেন আপন মনে বলতে লাগল, আমি মাতিসের রমণীর মতো তোমার শরীরকে বেঁকে, দুমড়ে, ডিফরমড্ করে নতুন এক সৃষ্টি তৈরি করবো। তুমি কি তোমার শরীরের দিকে কোনোদিন ভালো করে তাকিয়ে দেখেছো পাখি? তুমি কি মাতিসের ‘লা ডান্স্’ কখনো মন দিয়ে দেখেছো? দেখেছো সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে নারীর শরীর তার সমস্ত পেলবতা নিয়ে নিজেই সঙ্গীত হয়ে যায়? পাখি আস্তে করে রামেশের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, না। আমি তা দেখিনি। কিন্তু আমি নিজে শিল্পী হতে চাই, মানে চেয়েছিলাম, আমি জীবন দেখতে চেয়েছিলাম, মৃত্যু দেখতে চাইনি। কখনো শিল্পের ন্যুড হতে চাইনি, রামেশ। এবার ইচ্ছে করেই রামেশকে সে ভাই বলল না। রামেশ যেন তার কথা মন দিয়ে শোনেনি এমনিভাবে বলে চলল, পাখি, পৃথিবীর অনন্ত চেতনা প্রবাহে কোথায় জীবন, কোথায় মৃত্যু, সবই একাকার! এই আছে, এই নেই! কোথাও কোনো থিতু নেই পাখি। কথাটা বলে রামেশ তার ক্যানভাসের কাছে ফিরে গেল। তুলির মোটা মোটা পোঁচ দিয়ে আঁকতে লাগল নীল আকাশ, তারপর একসময় মুখ ফিরিয়ে বলল, দেখ পাখি, আমি মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ রণাঙ্গন থেকে ফেরা একজন মানুষ। আমি আমার চোখের সামনে ভার্সিটিতে পড়া সহযোদ্ধাকে বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখেছি, কতবার যে একটুর জন্যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছি, কতবার যে কানের পাশ দিয়ে গোলা ছুটে গিয়েছে, কতবার যে মৃত্যু পথযাত্রী সহযোদ্ধার মুখে একফোঁটা পানীয় পানিও দিতে পারিনি, ডোবা থেকে লুঙ্গি ভিজিয়ে এনে সেই পানি সহযোদ্ধার মুখে ঢেলে শেষ বিদায় দিয়েছি। খিদের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ব্যাং পুড়িয়ে খেয়েছি, বেজি ধরে পুড়িয়ে খেয়েছি, পানির অভাবে গরম চা দিয়ে তিনদিনের বাসি মুুখ ধুয়েছি, তারপরও আমি গ্রেনেড হাতে করে শত্রুর ডেরায় অকুতোভয়ে প্রবেশ করেছি, কিন্তু তুমি যদি বলো এখন আবার আমাকে সেই কাজগুলো করতে, তো আমি পারবো না! আমার মনে ভয় এসে গেছে পাখি, জীবন যে কত মূল্যবান, কত মহার্ঘ্য, এখন আমি বুঝেছি, আমি এই জীবনকে ভালোবাসি পাখি, এই জীবন আমি জীবনের মতো করে উপভোগ করতে চাই। আমি তোমার ন্যুড আঁকতে চাই, আমার কেন জানি মনে হয়, তোমার আছে সেই সৌন্দর্য যা ঢেকে রাখার জন্যে নয়, যা পৃথিবীর বৃহৎ মহৎ সৌন্দর্যের সাথে তার হতে হবে সম্মিলন। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো, পাখি? উত্তরে পাখি জোর গলায় বলে উঠল, না! দশ. এই ক’দিন পাখি আর ঘর থেকে আর বেরোলো না। ঘরের ভেতরে বসে একভাবে ছবি আঁকতে লাগল। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যতদিন সে চোখে দেখতে পায়, সে এঁকে যাবে ছবি। প্রকৃতি পাখির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, কিন্তু পাখিও হাল ছেড়ে দেবে না। দৃষ্টিহীন হলে পাখির কী হবে পাখি জানে না, তবে সে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে সে গ্রামে চলে যাবে, মায়ের কাছে চলে যাবে। বোকাহাবা ভাইটার কাছে সে থাকবে। দু’ভাইবোন জড়াজড়ি করে থাকবে। প্রকৃতি তার ভাইটিকে করেছে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী আর তাকে করছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। বেশ, তাই সই। পাখিও দেখে নেবে একহাত। কারণ সে তার জানামতে এমন কোনো পাপ করেনি যে জন্যে তাকে এইভাবে জীবনের কাছে হার মানতে হবে। মায়ের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে একেরপর এক পাখি কিনতে লাগল ছবির ক্যানভাস। বড়-ছোট মাঝারি সব ক্যানভাস। একটার ওপরে একটা সে ডাঁই করে রাখল নিজের ঘরে। বাড়ির সকলে যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন পাখি উঠে ঘরের আলো জ¦ালায়। তীব্র আলোয় ভরে ফেলে সে ঘর। তারপর ক্যানভাসে রঙ চড়াতে থাকে। প্রইমারি, সেকেন্ডারি, টারসিয়ারি সব রঙের কম্বিনেশনে সে ভরে তোলো ইজেলে টাঙিয়ে রাখা ক্যানভাস। যেন রঙের ভূত ঘাড়ে চেপেছে পাখির ঘাড়ে। সেদিন সাকিনা এসেছিল পাখির কাছে। পাখির কাজ দেখে সে অবাক। বলল, এ কি, তোর আঁকার ভেতরে নতুন কিছু দেখতে পাচ্ছি পাখি। এবারের ফাইনাল পরীক্ষায় তুই নিশ্চয় খুব ভালো করবি। আর ফাইনাল। ফাইনাল আর আমার দেওয়া হবে না ভাই। কেন, তারিখ দিয়ে দিয়েছে তো, তুই জানিসনে? আর দু’মাসের ভেতরেই তো পরীক্ষা শুরু। সাকিনার কথা শুনে চুপ করে থাকল পাখি। ভাবতে লাগল, সে কি পরীক্ষা সত্যি দিতে পারবে? আর যদি দিতে পারেও, তাহলেই বা কী লাভ? সাকিনা বলল, দেখ ভাই, তোর এই অসুখে শুধু তুই তো হতাশ না, আমরা সকলেই হতাশ। কিন্তু তাই বলে আমরা তো হাল ছেড়ে দেবো না। কত মানুষ জন্মান্ধ হয়, এ পৃথিবীর রূপ রস জৌলুশ কিছুই চোখে দেখতে পায় না, তারা নিজেদের মনের মধ্যে একটা জগত গড়ে নেয়, সেই জগতে গাছ আছে কীনা, পাখি আছে কীনা, সূর্য আছে কীনা, চাঁদ আছে কীনা, আকাশে তারা আছে কীনা জানেনা, তারা শুধু মানুষের মুখে শোনে এসব কথা। আর তাদের কল্পনায় এগুলোকে স্থাপিত করে একের পর এক। তাদের কথা একবার চিন্তা করে দ্যাখ। তুই তো তবু কিছুদিনের জন্যে এ পৃথিবীর রূপরসগন্ধ উপভোগ করতে পারছিস। কে জানে হয়ত আমারও তোর মতো কোনো অসুখ হবে। তখন আমারও তোর মতো অবস্থাই হবে। রাকিব হয়ত আমাকে ছেড়ে তখন চলে যাবে। রাকিব তো এমনিতেই চঞ্চল, তোরা জানিস। আমরা তো কেউ এখন পর্যন্ত জীবন দেখিনি ভাই। কথাটা বলার সময় করুণ শোনালো সাকিনার কণ্ঠ। সাকিনা চলে গেলে মেজমামি ঘরে এসে ঢুকল। সাধারণত মেজমামি পাখির ঘরে ঢোকে না। বাইরে থেকে কথা বলে। কারণ মামি জানে পাখির ঘর শুধু একটা ঘর তো নয়, রঙ, তুলি, ইজেল আর ক্যানভাসের জঙ্গল। উঠোনের জামতলার কাছেও পাখির কিছু কাঠের ফ্রেম জমা হয়ে পড়ে আছে। তার এই মেজ মামা-মামির একটিই ছেলে যে এখন খুলনার ক্যাডেট স্কুলে পড়ছে। মাঝে মাঝে বন্ধের সময় ঢাকায় আসে বিজয়। কিছুদিন থাকে। পাখির সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। যখন সে থাকে পাখিকে অনেক সাহায্য করে। তার ছবির ত্রিভুজাকৃতি ইজেল তৈরি করে দেয়, ফ্রেম করে দেয়, রঙ গুলিয়ে দেয়, ইজেলগুলো পেরেক মেরে ঠিকঠাক করে দেয়। ওর ভেতরে একটা শিল্পীর মন আবিষ্কার করে পাখি। করে খুব খুশি হয়। বিজয় এখন খুলনায়। গরমের ছুটিতে বাড়ি আসবে। মেজমামি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, সাকিনা চলে গেছে? পাখি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। চা টা কিছু খেতে দিলি নে? মাথা নেড়ে পাখি বলল, না। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু বলল, খাবে না। মামি যে শুধু এ কারণে ঘরে এসেছে পাখির সেটা মনে হলো না, তার মনে হলো মামি আরও কিছু বলতে চায়। ঠিক তাই। মামি বলল, দ্যাখ পাখি, যে অবস্থা দেখছি, তাতে ভবিষ্যতের কথা একটু চিন্তা করতে হয়। যদি তোর অসুখটা বেড়েই যায়, তখন তুই কি করবি? তোর মামা বলছিল, পাখিকে বলো সে তার মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে কীনা। যদি থাকে তাহলে তোর মামা মাসে মাসে তোকে কিছু সাহায্য করতে পারবে। অবশ্য এসব কিছু নির্ভর করে তুই কি চাস। পাখি মন দিয়ে মামির কথা শুনতে শুনতে কাগজে রঙের আঁচড় কাটতে লাগল। সে যেন আন্দাজ করতে পেরেছিল মামি কী বলবে। পাখি মাথা নিচু করে বলল, মামি, আমার পরীক্ষা সামনে, আর মাত্র দু’মাস বাকি আছে, মামাও চান আমি পরীক্ষাটা দিই। পরীক্ষার পরে আমি তোমাদের জানাবো। পাখির কথা শুনে মামি বলল, তুই কি পরীক্ষা দিতে পারবি? তোর চোখের ক্ষতি হবে না? পাখি মামির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ক্ষতি হলেও পরীক্ষাটা দিতে চাই। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন অন্তত একটা সফল হোক, মামি। এগারো. মামির সাথে এরকমের একটা কথোপকথনের পর পরই পাখির মন কেন যেন উতলা হলো মায়ের মুখ দেখার জন্যে। এই মা’টি তার স্বামী মারা যাবার পরে কত যে কষ্ট করেছেন পাখিদের মানুষ করে তুলতে। কত যে মানুষের হাতে পায়ে ধরেছেন। নিজে কোনোদিন স্কুলের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারেননি, তবু তার কী আপ্রাণ চেষ্টা ছিল মেয়েদের মানুষ করে তুলতে। শিক্ষিত করে তুলতে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের গ্রাস উপার্জন করতে। নিজের স্বামী বেঁচে থাকাকালীন তার কাছ থেকে সারাজীবন শুধু লাথি ঝাঁটা খেয়েছেন, তাই তার স্বপ্ন ছিল মেয়েদের শিক্ষিত করে মানুষ করে তুলতে, কিন্তু মহিলার এই স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল। বাস্তবের মুখ আর দেখতে পেল না। একটি মাত্র ছেলে তার, সেটিও হলো মানসিক প্রতিবন্ধী। বড় মেয়েটি অল্প বয়সে কিছু বোঝার আগেই পাড়ার এক বখাটে ছেলের হাত ধরে হয়ে গেল উধাও। তবু এটুকু সান্ত¡না যে মেয়েটি ঘরসংসার করছে। সেই বখে যাওয়া ছেলেটি তো তাকে পতিতা পল্লীতে বিক্রি করেও দিতে পারতো। অন্তত সেটা তো সে করেনি। মেয়ে তার সুখে নেই জমিরন বিবি জানেন, কিন্তু তার তো এখন করার আর কিছু নেই। রাখীর মামারা এসব নিয়ে আর কথা বলতেও চায় না। তাদের মনোভাব যে গেছে সে গেছে তাকে নিয়ে মাথাব্যথার দরকার নেই। আর রাখীর চাচারা নিজেরাই নিজেদের সংসার সামলাতে, ছেলেমেয়ে সামলাতে হিমশিম, তবু রাখীর এক চাচা ঢাকায় গিয়ে রাখীর সন্ধান করেছিল। ফিরে এসে বলেছিল, বিয়ে থাওয়া করে রাখী এখন থিতু। কোনো খারাপ পথে যায়নি। তাছাড়া রাখীকে জোর করে ফিরিয়ে এনেই বা কী লাভ হতো। কেউ কি জেনেশুনে রাখীকে বিয়ে করতে চাইতো? না। তাছাড়া টাকাপয়সাও এমন অঢেল নেই যে রাখীকে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে সাহায্য করা যেত। সেসব ভেবে কেউ কোনো মামলা মোকদ্দমায় আর নিজেদের জড়ায়নি। পাখিকে বাড়ি ফিরতে দেখে জমিরন খুব খানিকটা কাঁদলেন। গোয়াল ঘরের পেছনে বসে কাঁদলেন। তাঁর কান্না পাখির চোখের জন্যে। মেয়েটি তার ধীরে ধীরে অন্ধত্বের দিকে চলে যাচ্ছে, এই ক্ষত, এই বেদনার উপসম কীভাবে হবে? জমিরনের জন্মই হয়েছিল যেন দুঃখের গহনে নিমজ্জিত হয়ে মানবজীবন পার হয়ে যেতে। এ কেমন জীবন হলো তার? সেই কোন ছেলেবেলায় বাবা তাকে নিজের চেনাশোনা এক ব্যবসায়ীর ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। জমিরন তখন মাত্র ক্লাস এইটে পড়তেন। অথচ তার ভাইয়েরা প্রত্যেকে লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হয়েছে। জমিরন কিছু না হোক সাধারণ বিএটা কি পাস করতে পারতেন না? হতে পারতেন না গ্রামের স্কুলের কোনো শিক্ষক? না তা হয়নি। এর জন্যে ভাগ্য লাগে। লেখাপড়া শেখার জন্যে মেয়েদের ভাগ্য লাগে। মাঝে মাঝে ভাবেন জমিরন । পাখি অতোসতো জানে না, সে মাকে জড়িয়ে ধরে খুব খানিকটা কাঁদল। তারপর চোখ মুছে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল, মা, আমি ফাইনাল পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। জমিরন শুনে কিছুক্ষণ পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে ভীত স্বরে বলে উঠলেন, আর চোখ? ক্ষতি হবে না? এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কী হবে, মা? বলল পাখি। একটু থেমে বলল, আপনার কত শখ ছিল যে আপনার মেয়েরা লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। কিন্তু ভাগ্যের বিপাকে তা হয়ে উঠতে পারলো না। কিন্তু আমি অন্তত বিএফএ পাস করে আপনার মনের কষ্ট কিছুটা হলেও সারিয়ে তুলবো মা। আপনি অন্তত মানুষকে বলতে পারবেন আমার মেয়ে আর্ট কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হতে পেরেছে, তাই না মা? কথা বলে মাকে জড়িয়ে ধরল পাখি। আর মায়ের শরীর থেকে পেল সেই পুরনো ঘ্রাণ; হলুদ, জিরে, ধনে, শুকনো মরিচ বাটার ঘ্রাণ। এ ঘ্রাণ হচ্ছে আমাদের শাশ্বত বাঙালি মায়ের ঘ্রাণ, আর এই ঘ্রাণই হচ্ছে আমার বাংলা মায়ের ঘ্রাণ! এই ঘ্রাণটিকে আমি কি আমার ছবি আঁকার ভেতরে নিয়ে আসতে পারিনে? কীভাবে আনবো? ভাবতে লাগল পাখি। আর ভাবতে ভাবতে দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খোকন। বারো বছরের খোকন। চেহারায় সে এই বারো বছরেই দশাসই হয়ে উঠেছে। পরনে তার হাফ প্যান্ট, আর গায়ে হাফ হাতা রঙিন একটা গেঞ্জি। পাখিকে দেখে একগাল গেসে সে কাছে এস দাঁড়ালো। বলল, ভোঁকাটা হয়ে গেল আমার ঘুড়িটা, বুঝলি বুবু? ভেঁ ভোঁ ভোঁ ভোঁ কাটা! পাখি জিজ্ঞেস করল, তুই আজ স্কুলে যাসনি? উত্তরে খোকন একগাল হেসে বলল, ভোঁ কাটা হয়ে গেল আমার ঘুড়িটা! না, ইসকুলে যাইনি, কেউ আমার সঙ্গে খেলা করে নাতো। জমিরন বললেন, আমি ইসকুলের হেডসারকে অনেক অনুরোধ করে ওকে ক্লাস ফাইভে ঢুকিয়েছি। কোনো রকমে ক্লাস ফাইভ যদি পাস করতে পারে একটা অফিসে খোকন পিয়নের চাকরি পাবে না? কি বলিস? পাখি এ কথা শুনে হাঁ করে তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই মহিলা মরে যাবে তবুও কি স্বপ্ন দেখতে ছাড়বে না? হতাশ হয়ে ভাবতে লাগল পাখি। বারো. আজ অনেক দিন বাদে রাস্তায় বেরোলো পাখি। পরীক্ষাটা সে কোনোমতে দিতে পেরেছে। দিতে পেরে সে খুশি হয়েছে। না, চোখ কে সে যতদূর সম্ভব কষ্ট দেয়নি। সে ধীরেসুস্থে সমস্ত দিন ধরে পড়াশোনা করেছে, কলেজে গিয়ে টিচারদের লেকচার মন দিয়ে শুনেছে। তার ভালো লাগে কাইয়ুম সারের লেকচার, আলফি স্যারের লেকচার, হাশেম স্যারের লেকচার, রফিকুন্নবী স্যারের লেকচার। সে মন দিয়ে লেকচার শোনে। শিল্পের পথের কত বাধাবিঘ্ন পার করে তবে না এই দেশ আজ এখানে পৌঁছেছে। সে জানে যখন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুরান ঢাকার জনসন রোডে ছবি আঁকার ক্লাস খোলেন তখন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা লাঠিসোটা নিয়ে তাকে আক্রমণ করেছিল, এইসব বিধর্মী কাজ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে হতে দেবে না বলে। সেখান থেকে সরে গিয়ে আবেদিন ভাই সেগুন বাগিচায় আর্টস্কুল খোলেন, তাপর সেখান থেকে চলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। কত বন্ধুর পথ পেরিয়ে আজ শামীম সিকদারের জন্ম হয়েছে, রফিকুন্নবীর জন্ম হয়েছে, কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম হয়েছে, আমিনুল ইসলামের জন্ম হয়েছে, মৃণাল হকের জন্ম হয়েছে, মুর্তজা বশিরের জন্ম হয়েছে, স্পেনের মনিরুল ইসলামের জন্ম হয়েছে, ফ্রান্সের শাহাবুদ্দিনের জন্ম হয়েছে। পরবর্তীতে জয়নুল আবেদিন ভাই স্থাপন করে গেছেন আর্ট কলেজের, যে আর্ট কলেজ এখন ফ্যাকালটি অব ফাইন আর্টসে পরিণত বড় গৌরবের সঙ্গে। নমস্য আমাদের জয়নুল আবেদিন, নমস্য আমাদের পটুয়া কামরুল হাসাম, নমস্য শফিউদ্দিন স্যার। নমস্য, সব নমস্য। আমি খুব ভাগ্যবান যে এই কলেজে পড়তে পেরেছি। পাখির এখন মনে পড়ল তাদের ক্লাসের একজন স্যার একবার শিল্পাচার্য জয়নুলের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, জয়নুল স্যার বলতেন যে প্রকৃতি যে রঙ মানুষকে দেখায়, যেমন কাঁঠালের হলুদ, কলমিলতার সবুজ, আকাশে বেলাশেষের রঙ, সেরকম রঙ মানুষ এখনও তৈরি করতে পারেনি। নকল করতে পেরেছে কিন্তু ন্যাচারাল করতে পারেনি, এটা করা সম্ভবও নয়, এখানেই ঈশ্বরের জিৎ। না, শিল্পাচার্য জয়নুলকে চোখে দেখেনি পাখি, কামরুল হাসানকেও চোখে দেখেনি, এমনকি যে মুর্তজা বশির এখনও বেঁচে আছেন বলে জানে, তাঁকেও পাখি চোখে দেখেনি। শুনছে তিনি অসুস্থ, অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে আছেন, কারও সঙ্গে দেখা করতে চান না। পাখি রিকশা ভাড়া করে চলেছে, আপন মনে চলেছে, সাকিনার সঙ্গে তার কথা হয়েছে, অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে সে যাবে, সেখানে আরও কেউ কেউ আসবে, হয়তো জুবায়েরও আসতে পারে, না, পাখি আর তাকে বাসনা করে না, কিন্তু তবু কোথায় যেন একটা মায়া থেকে গেছে। বিজয়নগর খেকে পাখির রিকশাটা মোড় নেবার সময় আরেকটা রিকশার দিকে চোখ গেল পাখির। আর পাখি দেখল খোলা রিকশায় অচেনা একটি মেয়ের কোমর জড়িয়ে বসে আছে জুবায়ের। মেয়েটির মাথায় হেজাব, শরীরে বোরকা জড়ানো। মেয়েটির চোখ দুটো মাত্র খোলা। কিন্তু কী সুন্দর সেই চোখ! দেখে মনে মনে যেন মুগ্ধ হয়ে গেল পাখি। জুবায়ের হাসতে হাসতে মেয়েটির কানে কানে কিছু বলতে যেতেই হুডখোলা রাস্তায় পাখির দিকে চোখ গেল জুবায়েরের। সে হঠাৎ করে মেয়েটির বোরকার আড়ালে মুখ ঢাকার চেষ্টা করতে লাগল। ততক্ষণে পাখি তাকে দেখে ফেলেছে। জুবায়েরও দেখেছে পাখিকে। পাখির মাথার ভেতরে সব কিছু যেন গুবলেট হয়ে গেল এক মুহূর্তে। পাখি চোখ ফিরিয়ে নিল। জুবায়ের পার হয়ে গেল একটু পরেই। পাখির মাথার ভেতরে যেন ঝাঁঝাঁ করে উঠল। এই তাহলে জীবন? ভাবল পাখি। এই জুবায়েরই না তাকে একদিন তার চোখে চুমো খেয়ে বলেছিল, তোমার চোখ দুটো খুব সুন্দর পাখি, দেখলেই আমার চুমো খেতে ইচ্ছে করে! এখন পাখিকে বাতিল করে আরেকটি সুন্দর চোখের নারীকে আবিষ্কার করেছে জুবায়ের। সে নারীর শরীর বোরকা মোড়া, তাতে জুবায়েরের কোনো অসুবিধে হয়নি, কারণ তার চোখ দুটো সে কাজল পরিয়ে মাসকারা দিয়ে সুন্দর আকর্ষণীয় করে রেখেছে। জুবায়েরকে কীভাবে ছিপ খেলে ধরে রাখা যায়, মেয়েটি বুঝে ফেলেছে! কথাটা ভাবতে গিয়ে মন তিতো হয়ে গেল পাখির। এখন সে কী করবে? কোথায় যাবে? রিকশা ঘুরিয়ে সে গোপীবাগে চলে এল। যখন রামেশের বাড়ির কাছে এল তখন ঘোর বিকেল। রাত হয়ে গেলে বাড়ি ফিরবে কী করে এ চিন্তা মাথায় না রেখে সে রামেশের বাড়ির দরজার বেল সজোরে টিপতে লাগল। তেরো. রামেশ তাকে দেখে আজ অবাক হলো না। বিস্মিতও হলো না। হয়ত আগের বারের কথা তার মনে থাকবে। সে তার স্টুডিওতে ঢুকল আজ দুরু বুকে। কেন সে জানে না। রামেশ ক্যানভাসে কাজ করছিল। পাখিকে বসিয়ে সে আপন মনে করতে লাগল কাজ। এর মধ্যে বাড়ির ভেতরে বেল টিপে সে কাজের লোককে চা দিতে বলেছিল। পাখি আপন মনে বসে বসে রামেশের কাজ দেখতে লাগল। সেদিন যে চোখগুলো পাখি দেখে গিয়েছিল, আজ সেই চোখের ভেতরে পরিবর্তন দেখল ছবি, চোখ আর চোখ নেই, চোখের ভেতরে উঠে এসেছে গ্রাম, সবুজের ঢেউ, আকাশের মেদুর এক রঙ, বালিকার ছবি। পাখি অবাক হয়ে চোখের পল্লবের ভেতরে আবিষ্কার করতে পারল ছায়া ছায়া কিছু যাদের ভাষা আলাদা, যাদের ভঙ্গিমা সম্পূর্ণভাবে পাখির অচেনা। রামেশ পাখির দিকে পেছন ফিরে কাজ করছিল, সে কাজ করতে করতে আপন মনে পাখির সঙ্গে কথা বলতে লাগল। বলল পাখি, আমি ছবির জগতে ইমপ্রেশনিজমকে খুব মূল্য দিই। যেখানে বুদ্ধি, বা সংস্কৃতির, এমন কি মনেরও কোনো আধিপত্য থাকবে না। থাকবে শুধু দৃষ্টির আধিপত্য এবং তারই ভেতর থেকে সত্যের উন্মোচন। যখন ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই পেইনটিংয়ের চল হলো, তখন আর্ট সমালোচকরা লিখলেন, এগুলো হচ্ছে মূর্খ এবং অল্পবুদ্ধির আর্টিস্টদের কাজ, এদের লেখাপড়া কম, নাই বললেই চলে, আর আর্ট বা চিত্রকলা সম্পর্কে এরা সম্পূর্ণই অজ্ঞ। অথচ এইসব ইমপ্রেশনিস্টরা বহু আগেই ল্যুভর মিউজিয়ামে গিয়ে দিনরাত পড়ে থেকে তাদের পূর্বসূরিদের কাজ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন, অবলোকন করেছিলেন। ১৮৬২ সালে ক্লদ মানে সেখানেই দেখা পেয়েছিলেন দেগার, যিনি তখনও ব্যালে নর্তকীদের চিত্র এঁকে পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি। দেগা সে সময় সেখানে বসে নকল করছিলেন ভেলাকুয়েজকে। যে ভেলাকুয়েজ, যার পুরো নাম ডিয়েগো ভেলাকুয়েজ, মাত্র ছব্বিশ বছর বয়সে মাদ্রিদের চতুর্থ ফিলিপের সভাসদ আঁকিয়ে ছিলেন, তাঁর আগেই তিনি এঁকে ফেলেছিলেন ‘অ্যান ওল্ড্ উওম্যান কুকিং এগস্’। সেই বিশ্ববিখ্যাত ছবিটি আঁকছিলেন বা নকল করছিলেন দেগা। তো সেখান থেকে ইমপ্রেশনিজম ধীরে ধীরে পৃথিবীর শিল্পরসিকদের হৃদয় জয় করলো। তারপর তো শুরু হলো পোস্ট ইমপ্রেশানিজিমের। সে আরেক কাহিনী। রামেশ একভাবে কথা বলতে লাগলো আর তার হাতের ব্রাশ চলতে লাগল সবেগে। পাখি বুঝল রামেশ এখন একটা ঘোরের ভেতরে আছে। সে এখন তার কাজ করছে। পাখি বসে থাকা অবস্থাতেই তার জন্যে ঘন দুধের কফি চলে এল। ইদানীং রাজধানীতে কফির চল খুব বেড়েছে। কফির সঙ্গে যেন মানসিকভাবে যোগ হয়ে গেছে আধুনিকতার! এ এক আশ্চর্য সংযোগ, পাখির মনে মনে ভাবলো। আমরা কীভাবে যেন আমাদের মনের ভেতরে আধুনিকতার সংজ্ঞা গড়ে নিই। এখন কোথাও আর চায়ের সন্ধান সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর শুধু কফি নয়, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নানাবিধ নাম করনের। ক্যাপুচিনো, ক্যাফে লাটে, ব্ল্যাক কফি, নরমাল কফি, আরও অন্যান্য সব নাম। পাখি এতসব নামও জানে না। এখন পাখির জন্যে ঘন দুধের কফিই এল। রামেশের ঘরের মধ্যেই চা কফি বানাবার সবকিছু মজুদ আছে। কিন্ত এসব নির্ভর করে রামেশের মুডের ওপর। কখনো সে নিজের হাতে বন্ধুদের চা করে খাওয়ায়, কখানো বাড়ির ভেতরে খবর দিয়ে আনায়। বড়ির মধ্যে দারোয়ান আয়া সবই মজুদ আছে রামেশের। নইলে এতবড় বাড়ি দেখভাল করে রাখে কারা? রামেশের পক্ষে তো এসব করা সম্ভব নয়। পাখি কফি খেতে খেতে হঠাৎ রামেশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আপনার ছবি কি ফ্রান্সে বিক্রি হয়? রামেশ তখনও তার দিকে পেছন ফেরা। সে আপন মনে কাজ করছে। পাখির প্রশ্ন শুনে রামেশের হাতের কাজ যেন মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর একটা স্লো মোশনের মতো রামেশ ঘুরে দাঁড়ালো পাখির দিকে। ভালো করে পাখির মুখ দেখল যেন। অবস্থা দেখে মনে মনে ভয় পেয়ে গেল পাখি। খুব কি একটা বাজে প্রশ্ন করে বসেছে সে শিল্পী রামেশ কে? কিন্তু না, রামেশ রাগ করেনি। সে শুধু পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, এই যে আমার এতসব কাণ্ডকারখানা দেখ, এই যে এত রকমারি পোশাক-আশাক, এই যে হাতে আমার এত দামি সোনার চেইন, গলায় এই যে আসল মুক্তোর লকেট বসানো হার, এই যে বাড়ি ঘরের মেইনটেন্যান্স, আর আমার বউ-বাচ্চার বিদেশে থাকার খরচ, এসব কোত্থেকে আসে, পাখি? এসব কে দেয়? পাখি এর কি উত্তর দেবে? জানলে তো দেবে। রামেশ একটু থেমে বলল, বিদেশ, সব বিদেশ। তুমি জানো, বিদেশে আমার কত ধনকুবের মহিলা ও মুগ্ধ গ্রাহক আছে? না, পাখি এ খবর জানতো না। সে লজ্জা পেল। খুবই লজ্জা পেল। সত্যি, সে একটা বোকার মতো প্রশ্ন করে বসেছে রামেশকে। সে তো জানে ফ্রান্সে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ভক্ত গ্রাহকরা আছে, স্পেনের মুনীরের কত ভক্ত গ্রাহক আছে, তবে রামেশেরই বা থাকবে না কেন? রামেশ তার অবস্থাটা যেন মনে মনে উপভোগ করতে করতে বলল, তবে হ্যাঁ, তোমাকে আমি আজ পিকাসোর কথাটাও একটু বলতে চাই। এই শিল্পস¤্রাটের কথাটা তো তোমাকে বলবার সময়ই করে উঠতে পারিনি। পিকাসোর বয়স যখন চৌদ্দ, যখন সে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তার শিল্পী পিতার স্টুডিওতে বসে আপন মনে ছবি আঁকছে, তখন তার আঁকার মুন্সিয়ানা দেখে মুগ্ধ পিতা নিজের হাতের ছবি আঁকার তুলিটি পুত্রের হাতে তুলে দিয়ে নীরবে নিজের স্টুডিও থেকে সরে পড়েছিলেন। জীবনে আর কোনোদিন তিনি নিজে ছবি আঁকেননি। তুমি কি এটা কল্পনা করতে পারো? পাখি মুগ্ধ হয়ে গেল কথাটা শুনে। মাথা নেড়ে সে বলল, না, এ কথা তো আমি জানতাম না। রামেশ বলল, তাহলে আমার কাছ থেকে জানো। শোনো, এই পিকাসো যখন প্যারিসে, তার থাকার জায়গা নেই, পকেটে পয়সা নেই খাবার কেনার, তখন তিনি তার মতোই গরিব এক বন্ধু ম্যাক্স জেকবের ভাড়া করা একটা রুমে গিয়ে উঠলেন। সেই রুম এতই ছোট যে একসঙ্গে বিছানা পেতে দুই বন্ধুর ঘুমোবার জায়গা হয় না, তবে সুখের বিষয় ছিল যে বন্ধু জেকব দিনের বেলা একটা দোকানে কাজ করতেন, সারাদিন থাকতেন ঘরছাড়া, সেই সময় পিকাসো জেকবের বিছানায় লম্বা হয়ে ঘুমোতেন। আর কাজ থেকে ফিরে জেকব যখন বিছানায় ঘুমোতেন, তখন সেই ঘরের ভেতরে মোমবাতি জ¦ালিয়ে পিকাসো আঁকতে বসতেন ছবি। বছরখানেক এভাবে চলার পর একদিন হঠাৎ করে বেচারা জেকবের চাকরিটা চলে গেল, তখন চিন্তা করো দু’বন্ধুর কী অবস্থা! এইটুকু বলেই রামেশ আবার তার ইজেলের কাছে ফিরে গিয়ে হাতে তুলে নিল তুলি। তারপর পাখির দিকে পেছন ফিরেই সে বলতে লাগল কথা। পূর্বের কথার জের টেনে বলে চলল, পকেটে পয়সা নেই, গায়ে শীতের বস্ত্র নেই, আর ফ্রান্সের শীত, তার কামড় যে না খেয়েছে তার পক্ষে অবস্থাটা বোঝা অসম্ভব, ঘরে আগুন জ¦ালিয়ে ঘর গরম করার ব্যবস্থা নেই, এমনকি হাতের কাছে অন্য কোনো বন্ধুও নেই, কঠিন সব দিন এবং রাত। সারা সারারাত দুই বন্ধু, পিকাসো এবং জেকব, শীতে কাঁপেন এবং অনাহারে থাকেন, এভাবেই পার হয়ে গেল ১৯০২ সাল। চলে এল নতুন সাল ১৯০৩। জানুয়ারি মাসে অবস্থা এমন করুণ হয়ে দাঁড়ালো যে শীতের কামড় সহ্য করতে না পেরে ভবিষ্যতের শিল্প সম্রাট পিকাসো তাঁর রাত জেগে আঁকা ছবিগুলোয় আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেই উত্তাপে দু’বন্ধু শীতের নিষ্ঠুর হাত থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করতে লাগলেন! রামেশের কথা শুনে যেন ভয়ে শিরশির করে উঠল পাখির শরীর। এরকম কাহিনী সে আগে শোনেনি। তাহলে কি পৃথিবীতে কষ্ট এবং যন্ত্রণার হাত ধরেই মানুষকে সাফল্যের দিকে অগ্রসর হতে হয়, জীবনে সাফল্যের কি কোনো শর্টকাট নেই? রামেশ এবার হাতের তুলি মাটিতে ছুড়ে ফেলে পাখির কাছে এগিয়ে এল। একেবারে যেন কাছে চলে এল তার। বসে থাকা পাখির কাছে এসে প্রায় নিচু হয়ে তার কানে ফিশফিশ করতে করতে বলল, আর এই যে আমাকে চোখে দেখছো, আমারও আছে একটা অতীত। ভয়াবহ একটা অতীত। অচেনা ফ্রান্সের রাস্তায় রাস্তায় অভুক্ত, অনিদ্র হয়ে ঘুরে বেড়াবার ইতিহাস। আছে ফ্র্যান্সের মিউজিয়ামগুলোয়, বিশেষ করে ল্যুভরে দিনের পর দিন শুকনো রুটি চিবিয়ে খেয়ে মাস্টারপিসগুলোর সমুখে হত্যা দিয়ে পড়ে থাকা। আছে সমকামীদের ডেরায় ঢুকে তাদের মনোরঞ্জনের ইতিহাস নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যে। আর সেটিই সব নয়, সেই দেখার সঙ্গে নিজের দেশ, নিজের ইতিহাস, নিজের স্বাধীনতা সংগ্রামকে মিলিয়ে দেখা। সে বড় কঠিন সংগ্রামের সময় ছিল আমার জীবনে, পাখি। পাখি চুপ করে তার কথা শুনছিল। রামেশের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এবার তার মুখে বুকে পড়তে লাগল। রামেশ বলল, তোমাকে একটু চুমো খাই, পাখি? পাখি উঠে দাঁড়ালো সোফা থেকে। মুখ নিচু করে বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে বলল, না, রামেশ ভাই। তবে আপনাকে ধন্যবাদ। চৌদ্দ. পাখি যেন ইদানীং বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। সে পাস করেছে পরীক্ষায়, বর্তমানে সদ্য পাস করা ছাত্রছাত্রীদের যে ছবির এক্সিবিশন চলছে দৃক গ্যালারিতে, সেখানে পাখির ছবি ঝুলছে। কিন্তু পাখির মনে কোনো সুখ নেই। সে আজকাল চোখে আরও কম দেখছে। বরং সরাসরি আজকাল সে প্রায় দেখতে পাচ্ছে না চোখে, কিন্তু কোনাকুনি একটু ভালো দেখতে পাচ্ছে। মেজমামা শাহাবউদ্দিন আজকাল কেন জানি মাঝে মাঝেই পাখির ঘরে এসে বসে। ঘুরে ঘুরে চোখ চালিয়ে দেখে পাখির হাতের কাজ। দেখে তার বুক থেকে মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়। ভাবে তার এই প্রতিভাবান ভাগ্নীটির কপালে এরকম দুঃখ লেখা ছিল কেন? কেন সে আর দশটা মেয়ের মতো সুন্দর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারল না। এই ভাগ্নীটির ভবিষ্যৎ কি? ঢাকার জমির একটা গতি হলে তার বোনও সামান্য একটি অংশ পেত। কিন্তু সেরকম কোনো ব্যবস্থাও তো বর্তমানে হওয়া সম্ভব নয়। কারণ তার ছোট ভাই আফিলুদ্দিন বোনকে কোনো অংশ দিতে রাজি নয়। তার বক্তব্য পাখির মায়ের বিয়ের সময় তাকে একখ- গ্রামের জমি যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। সেটিই ছিল তার প্রাপ্য। ঢাকার জমির ওপরে বোনের কোনো অংশ নেই। সেই যৌতুকের সময় পাওয়া জমি বিক্রি করে বোন জমিরন স্বামী মারা যাবার পর সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। তারওপর ছেলেটি তার মানসিক প্রতিবন্ধী। যখন তার বোনের আরও বয়স হবে, তখন তার ভবিষ্যৎ কি? বসত বাড়ি বিক্রি করে তো তার বোন জীবন নির্বাহ করতে পারে না। সে টাকাই বা আর কতদূর টেনে নিয়ে যেতে পারবে? মেজমামার মনের এই খবর পাখি জানে না। তার মেজমামা যে এত ভালো মনের মানুষ সেটুকু এখন পর্যন্ত পাখির অজানা থেকে গেছে। সে শুধু জানে তার মেজমামা আর দু’জন মামার চেয়ে বেশি মানবিক। ব্যস, এই পর্যন্ত। পাখি আজকাল তার বন্ধুদের সঙ্গে বেশি বাইরে টাইরে যায় না। তার যেতে ইচ্ছে করে না। পাখি স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার মনের ভেতরে জগতের বিষাদ এসে জড়ো হচ্ছে। এই বিষাদের কোনো কূলকিনারা নেই। এই বিষাদ আত্মবিধ্বংসী কাল-বিষাদ। আজকাল অতীতের কথা খুব মনে হয় পাখির। মনে হয় তার ছেলেবেলার কথা। যখন সে আর যা কিছু কল্পনা করুক না কেন দৃষ্টিহীনতার কথা জীবনেও কল্পনা করতে পারেনি, কারণ এই অবস্থা তার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। রেটিনা পিগমেন্টোসা। অদ্ভুত এই অসুখটি যেন পাখির জন্যেই এ পৃথিবীতে তৈরি হয়েছিল। পাখির জানা মতে পৃথিবীর আর কোনো চিত্রকরের এই অসুখ হয়েছে বলে সে শোনেনি। পৃথিবীর কত চিত্রকর অভাবে পড়ে পাগল হয়ে গেছে, কত চিত্রকর আত্মহত্যা করেছে, কত চিত্রকর অসুখ ভুগে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছে, কিন্তু রেটিনা পিগমেন্টোসায় এভাবে ধীরে ধীরে দৃষ্টি হারানো, এ যেন স্বপ্নেরও অতীত পৃথিবীর চিত্রকরদের কাছে। কিন্তু পাখির এইসব এলোমেলো দিন এবং ভাবনার অস্থিরতার ভেতরেও যেন ওয়েসিসের মতো তার বন্ধুরা আছে। তারা মাঝে মাঝেই তার বাড়িতে আসে। তাকে জোর করে বাইরে নিয়ে যায়। আজকাল প্রায় পাখি কথা বলতে বলতে জোর করে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তারপর আবার চোখ খোলে। এতে মনে হয় সে কিছুক্ষণের জন্যে একটু ভালো চোখে দেখতে পায়। মাঝে মাঝে আজকাল ঘুম ভেঙে পাখি অন্ধকারে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। এরকম ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। মেজমামি সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিন পাখিকে বলেনি যে সে দেশের বাড়িতে ফিরে যাবে কীনা, হয়ত এ নিয়ে তার মামার সাথে কোনো কথা হতে পারে মামির, যে খবর পাখি জানে না। তবে নিজেকে তার আজকাল মনে হয় সে যেন মামা-মামির ঘাড়ে একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কেউ কিছু না বললেও তার এরকম মনে হয়। সেদিন বিকেলে অন্ধকার ঘরে যখন চুপ করে বসেছিল পাখি, ইচ্ছে করে ঘরের বাতি জ¦ালায়নি, তখন এসে হাজির হলো সাকিনা। সাকিনা আজ ঝলমলে কাপড় পরে এসে হাজির হয়েছে। সবটা ভালো না দেখতে পেলেও চোখের কোণ দিয়ে কিছুটা দেখল পাখি। পাখি তাকে দেখে খুশি হলো, কিন্তু অবাক হলো না। কিন্তু আজ সাকিনাকে দেখে যেন একটু অন্যরকম মনে হলো পাখির। সে ঘরে ঢুকেই প্রথমে ঘরের দুদিকের দুটো একশো পাওয়ারের বালব সুইচ টিপে জ¦ালালো। তারপর একটা মোড়া টেনে নিয়ে বেশ শব্দ করে বসলো। পাখি তার অবস্থা দেখে বলে উঠল, কী ব্যাপার রে, সাকি? আমি চোখে ভালো দেখিনে সেটা ঠিক, কিন্তু কানে তো ঠিকই শুনি, বরং তোদের চেয়ে একটু বেশিই শুনি আজকাল। সাকিনা তার কথা কানে না তুলে হাসতে হাসতে বলল, ভাই, তুই যদি আজ দৃক গ্যালারিতে যেতিস তো অবাক হয়ে যেতিস। কত মানুষ যে আমাদের এক্সিবিশন দেখতে আসছে তুই কল্পনাও করতে পারবি নে। একজন তো রোজই আসে। আর তোর ছবির সামনে যেন স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর তুই তো জানিস প্রত্যেক পেইনটিংয়ের পাশে পাশে ছোট্ট করে আমাদের ফটোগ্রাফ সাঁটা আছে। এটিও আমাদের গিয়াস ভাইয়ের আইডিয়া। তার আইডিয়া হলো যে শিল্পীদের ছবি তাদের কাজের পাশে একটু দূরত্ব রেখে ছোট্ট করে সাঁটা থাকবে। তোর সেই ছবির দিকেও ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে! সাকিনার কথা শুনে পাখি মুখ ঝামটা মেরে বলে উঠল, দ্যাখ সাকি, ফাজলামো করবিনে। সাকিনা হাসতে হাসতে বলল, বিদ্যার কসম ভাই, সত্যি কথা বলছি। তো আমি প্রথমে খেয়াল করিনি, কত মানুষই তো রোজ আসে, কিন্তু রাকিব আমাকে বলল, সাকি, এই ভদ্রলোককে খেয়াল করিস। ইনি প্রায় আমাদের এক্সিবিশন দেখতে আসেন। আমি তার কথা শুনে বললাম, হয়ত ধানমন্ডিতেই থাকেন। অবসর কাটাবার জন্যে আসেন। কিন্তু এ কথা মুখে বললেও আমার মনে ভদ্রলোক ছাপ ফেলে দিলেন। আবার সবুজও একদিন এই কথা বলল। সেও লক্ষ করেছে। আমি তখন নিজে যেচে ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে তাকে সালাম জানালাম। তিনিও খুব সহজভাবেই আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। একটা প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধে একবার তিনি আহতও হন। দেশ স্বাধীন হলে আবার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ফিরে লেখাপড়া শেষ করেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। এখন তিনি তার পৈতৃক বাড়িতেই থাকেন। সেখানে একটা অফিস খুলেছেন। সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আর বিকেল বেলাটা ঘুরে ফিরে বেড়ান। তারপর ভাই, গতকাল আমাকে তিনি সরাসরি তোর কথা জিজ্ঞেস করলেন। তোর আঁকা ছবি দেখে তিনি মুগ্ধ। মন দিয়ে পাখি তার বন্ধুর কথা শুনতে লাগল। তার মনে এত দুঃখ এবং হতাশার জরিবুটির ভেতরেও কেমন যেন একটা সুখের অনুভূতি হচ্ছে। সাকিনা বলল, এরপর আমি একটা ভীষণ খারাপ কাজ করে ফেলেছি ভাই, তোর কাছ থেকে আগে না শুনে। আমি তাকে আমার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তার গাড়িতেই আমি এসেছি। তিনি তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। তোর বর্তমান অবস্থার কথা তিনি জানেন, তুই যে আজকাল বাড়ি ছেড়ে বেরোস না, কারও সঙ্গে দেখা করতে চাস না, সব কথা তাকে আমি বলেছি। আমার সঙ্গে রাকিবও ছিল। সে সবকিছু জানে। এই ভদ্রলোককে সে কীভাবে যেন চেনেও। আমাকে রাকিব বলেছে, শওকত ভাই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাকিনার কথা শুনে নিজের ভেতরে কেমন যেন অস্থিরতা হতে লাগল পাখির। সে বিরক্ত গলায় বলল, করেছিস কি, আমার মামা-মামি শুনলে কি ভাববে? সাকিনা ভয়ে ভয়ে বলল, সেটাই তো বলতে চাচ্ছিলাম তখন থেকে। ভদ্রলোক তোর মামার সঙ্গেই তো এতক্ষণ ধরে কথা বলছেন বসার ঘরে বসে। মামাও দেখলাম খুব সহজেই তার সঙ্গে আলাপ করছেন। তারওপর তোর মামাও তো মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকে ছাত্রলীগ করতেন শুনলাম। সাকিনার কথা শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল পাখি। তাহলে এতদূর? তার আঁকা ছবি পছন্দ হয়েছে বলে এতদূর? কথাটা ভাবতে গিয়ে তার মাথার ভেতরে কেমন যেন সব গুবলেট হয়ে গেল। এখন পাখি কী করবে? তার ভাবনার ভেতরেই ঘরে নক করে মেজমামা শাহাবউদ্দিন ঘরে ঢুকলেন। খুব যেন স্বাভাবিক গলায় বললেন, পাখি, এক ভদ্রলোক তোর ছবি দেখে খুব খুশি হয়েছেন। তো তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। আমি অবশ্য আগেই কথা বলে সেরেছি। ভালো মানুষ। আবার শুনলাম একজন মুক্তিযোদ্ধাও। মামা এমন নিরাসক্তভাবে কথা বললেন যে পাখি মনে মনে একটু অবাক হলো। যেন খুশি না আবার বিরক্তও না। সাকিনা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল, পাখি আমরা বসার ঘরে যাই। পাখি এরপরও কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর বন্ধুর হাত ধরে বসার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো। এর মধ্যেই সাকিনা তার মাথার চুল আঁচড়ে দিয়েছে, মুখে হালকা প্রসাধন ঘষে দিয়েছে। শাড়িটাও পাল্টে দিয়েছে জোর করে। গাঢ় নীল কল্কা আঁকা একটা শাড়ি পরেছে পাখি। চোখে জোর করে কাজলও পরিয়েছে। সাকিনার বক্তব্য পাখি যেন একজন পেইন্টারের মতোই স্বাভাবিকভাবে কথা বলে ভদ্রলোকের সঙ্গে। গলায় তিনচার রঙা জরিবুটির হারও পরিয়েছে। হাতের জড়িয়ে দিয়েছে নানারঙের চুড়ি বালা। একজন বোহেমিয়ান আর্টিস্ট এখন পাখি। মানুষের প্রশংসা শুনে যে অভ্যস্ত! পনেরো. পাখি সাকিনার হাত ধরে বসার ঘরে আসতেই সশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে শওকত। তার বুকের ভেতরে খুব জোরে জোরে এখন ধুকপুক শুরু হয়েছে। এতক্ষণ পাখির মামার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যা তার হয়নি। পাখি ঘরে ঢুকে শওকতের দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল, স্লামালাইকুম। সালামের উত্তর দিয়ে শওকত বলল, আমি খুব লজ্জিত যে এভাবে আপনাকে বিরক্ত করছি। আসলে বেশ ক’দিন ধরেই আপনাদের এক্সিবিশনে আমি একজন নিয়মিত দর্শক। পাখি তার কথার উত্তর না দিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল, আপনি বসুন। সাকিনা এই ফাঁকে বলে উঠল, আমি ভেতর থেকে চা বলে আসি। শওকত যে সোফায় এতক্ষণ বসে ছিল সেখানে বসে পড়ে বলল, আপনিও বসুন, মিস্। পাখিও বসল। এরপর একটু নীরবতা। পাখি ভাবতে লাগল। এতক্ষণ তার মনে যে ইতস্তত ভাব ছিল এখন আর তা নেই। শওকত বলল, আসলে বেশ ক’দিন ধরেই আমি দৃক গ্যালারিতে যাচ্ছি। এর আগেও গিয়েছি। গ্যালারিটা আমার বাড়ির বেশ কাছেই। তো আমার সন্ধ্যাবেলাটা মাঝে মাঝে বেশ ভালো কাটে। অবশ্য যেদিন কাজ থাকে সেদিনের কথা আলাদা। আমি আপনার একটা কাজ দেখে বেশ বিস্মিত হয়েছি। কোন কাজটা? আমার তো সেখানে তিনটে কাজ আছে। পাখি কৌতূহলী স্বরে বলে উঠল। উত্তরে শওকত বলল, আপনার সব কাজই আমার ভালো লেগেছে। বিশেষ করে ঐ কাজটা, যেখানে একেবারে কঙ্কালসার পাটাতনের মতো মাতৃবুকের চাতালে, শুকনো দুটি স্তনের বোঁটা থেকে উৎক্ষিপ্ত ঝর্নার মতো বয়ে যাচ্ছে মাতৃদুগ্ধের ধারা। এটা তো মিস কোনো স্বাভাবিক চিত্র নয়, এর ভেতর দিয়ে আমি দেখতে পাই আমার দেশের বর্তমান করুণ অবস্থা। আমার মাতৃভূমির দলিত, গলিত, ক্ষয়ে যাওয়া চেহারা। কিন্তু তার পরেও আমাদের মাতৃভূমি, আমাদের মা জননী পরাভূত নন। তিনি তার কঙ্কালসার দেহের ভেতর থেকেই বড় সগৌরবে তার সন্তানদের লালন করে চলেছেন। তিনি বলছেন, বেঁচে থাকো আমার বাছারা, বেঁচে থাকো তোমরা ধনে, বলে, সম্পদে, ঐশ্বর্যে। আমার স্তন্যপান করে তোমার দৃপ্তবলে এগিয়ে যাও সমুখে, পরাভূত করো দেশের শত্রু! পাখি চুপ করে বসে কথা শুনছিল। এখন যেন ভদ্রলোকের কথা শুনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। হ্যাঁ, পাখি এই ছবি এঁকেছে বটে। বহু আগের একটি কাজ। কিন্তু ছবিটি আঁকার সময় তো এতসব ভেবে আঁকেনি। একটা ঝোঁকের মাথায় এঁকেছে। তাদের কলেজের সামনের পার্কের সেই কঙ্কালসার মহিলা মডেলকে নিয়ে। যে খাবার হাতে পেলে আঁচলের নিচে লুকিয়ে রাখতো, তার সন্তানদের খেতে দেবে বলে। বলত, আল্লার মাল, তার চারটি সন্তান। যে ছবি দেখে তার ক্লাসের স্যার বলেছিলেন, পাখি তোমার এই ছবির ভেতরে আমি ক্রোধ দেখতে পাচ্ছি। আসলে তো সেটা ক্রোধ ছিল না, ছিল আশা, ছিল সাহস, ছিল দেশের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। পাখি এবার একটু যেন হতবিহ্বল তাকিয়ে থাকল ঘরের দেয়ালের দিকে। যে দেয়ালের রঙ হালকা হলুদ। যেন লোকটির দিকে তাকাবার সাহস সে তখনো মনের ভেতরে গড়ে তুলতে পারছিল না। আর ঠিক এই সময় তার বন্ধু সাকিনা সেই যে চায়ের কথা বলতে বাড়ির ভেতরে গেল! এখনও ফিরে এলো না। ভদ্রলোক এবার নিচু গলায় বড় বিনীত স্বরে যেন বলে উঠলেন, মিস্, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ আমাকে সরাসরি কথা বলতে শিখিয়েছে। কারণ জীবনের সময় বড় অপ্রতুল। চোখের নিমেষে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। আমি আপনার কাছে এসেছি একটি বিশেষ প্রস্তাব নিয়ে। আমি এখন পর্যন্ত অবিবাহিত। কিন্তু আপনি রাজি হলে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। পাখি তার কথা শুনে যেন হতবাক হয়ে গেল। সে বিস্মিত হয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল সাকিনাকে। কিন্তু সাকিনা সেই যে ভেতরে চায়ের কথা বলতে গেছে আর তার টিকির দেখা নেই। পাখির গলা শুকয়ে আসছে এখন। সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে কোনো রকমে বলতে পারলো, সেটা তো সম্ভব নয়! কেন? করুণ একটা স্বর বেরোলো এবার শওকতের গলা থেকে। আমি এমন একটা অসুখে ভুগছি, যার কোনো নিরাময় নেই। আমি জানি সে অসুখের কথা। শওকত বলে উঠল এবার। আপনি জানেন? হতবাক হয়ে বলে উঠল পাখি। তারপরও আপনি- এই পর্যন্ত বলে পাখি চুপ করে গেল। শওকত বলল, হ্যাঁ, তারপরও। তবে আমিও তো নিখুঁত নই, মিস। আমি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে আমার ডান পা-টা হারিয়েছি। এখন আমি নকল পা লাগিয়ে হাঁটি। পাখি তার কথা শুনে চুপ করে থাকল। তারপর কী ভেবে আস্তে আস্তে তার মুখের ভাব কঠিন হতে লাগল। সে বেশ জোর গলায় বলে উঠল, কিন্তু আপনি আমার চরিত্রের কথা জানেন না, আমি ভালো কি খারাপ জানেন না, আমার কোনো ফিঁয়াসে ছিল কীনা জানেন না, আপনি আমার কিছুই জানেন না। আমি তো সেসব জানতে চাইনে, মিস। বিষাদিত স্বরে এবার বলে উঠল শওকত, যেন জীবনের সব দুঃখ, বেদনার হাত ধরে চলে ফিরে বেড়াবার পরে মানুষের যে বোধ হয়, সেই বোধের ভেতর দিয়ে চলে যেতে যেতে শওকত মুখ ফিরিয়ে বলতে লাগল, আর কোনোদিন জানতেও চাইবো না। আমি শুধু জানি আপনি একজন প্রতিভাবান চিত্রকর। আপনি মহৎ। আপনার ভেতরে আছে সেই শক্তি যা মানুষকে মহতের পথে চালিত করতে পারে। আর মিস, আমার চরিত্রের কথাটাও তাহলে আপনাকে বলি। মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগে আমি একজনকে ভালোবাসতাম, মুক্তিযুদ্ধে আমি পঙ্গু হয়ে গেলে আমার সেই ফিঁয়াসে আমাকে ত্যাগ করে চলে যায়। জীবন তো এরকমই মিস। কেউ কারও জন্যে অপেক্ষা করে না! পাখির ভেতরে এতক্ষণে যেন চৈতন্যের উদয় হচ্ছে। এ কি, এসব কী? আমি কোথায়? হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে পাখি চেঁচিয়ে ডাকল, সাকি? সাকিনা কোথায় যেন ঘাপটি মেরে ছিল। এতক্ষণে সামনে এসে বলল, আমি তো তোর পাশেই আছি, বন্ধু। আমি তোর পাশেই।  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App