×

সাময়িকী

প্রথম কুসুম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০১৯, ০৬:০১ পিএম

প্রথম কুসুম

আমার একটা গল্প আছে। লুকানো গল্প, বুকের গভীরে, অনেক গহীনে। গল্পটা অনেক দিন ধরে বহন করে চলেছি একা একা, গভীর সঙ্গোপনে। বিশাল সমুদ্রের হিমশীতল ঠাণ্ডা জলে একখ- সাদা বরফের মতো গল্পটা আমার বুকে, আমার অস্তিত্বে, আমার সুখ ও সর্বনাশের মতো হাসতে হাসতে ভেসে বেড়াচ্ছে। অবশ্য আমি আশ্চর্য হবো না- যদি আমার গল্পের মতো আপনাদেরও এই রকম দু’একটি স্মৃতিভারাতুর, আনন্দ-বিহ্বল গল্প থাকে। গল্প ছাড়া কি মানুষ হয়? জীবন চক্র কি চলে গল্প ছাড়া? না, আর বাক্যালাপ নয়, চলুন শীত কাঁথায় মোড়ানো গল্পটাকে সফেন সমুদ্রের স্রোত থেকে ডাঙায় তুলে আনি। পাশাপাশি বাড়ি আমাদের আর রাবু আপাদের। রাবু আপাকে চেনেন না? রাবু আপাই আমার গল্পের অস্থি, সুখ ও অসুখের জলতরঙ্গ। দু’টো বাড়ির মাঝখানে ছোট্ট একটা জলের স্রোত পশ্চিম থেকে পূর্বে বয়ে যায়। আমরা ডিঙিয়ে পার হতাম। ভালো কথা, সেই জলের স্রোতটা এখন আর নেই। স্রোত সরিয়ে এখন সেখানে রচনা করা হয়েছে আড়াআড়ি মাটির রাস্তা। রাস্তা যতোই হোক আমার স্মৃতির সর্বনাশ থেকে কেউ কখনও সেই জলের স্রোতটাকে সরিয়ে বা শুষে নিতে অথবা মুছে দিতে পারবে না। সেই শৈশব থেকে দেখতাম রাবু আপা এক অদৃশ্য অমোঘ টানে আমাকে একটু প্রশ্রয়ই দেন। সময়ে অসময়ে দেখতাম রাবু আপা মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে, উঠোনে, পুকুর পাড়ে গল্প করছেন, হাসছেন খলবল করে আর আমাকে কাছে পেলেই গাল টিপে দিতেন। ঐ গাল টিপুনি উপভোগের জন্য তার পাশে পাশে আমি ঘুরঘুর করতাম আহ্লাদি বেড়ালের মতো। এছাড়াও আছে বাড়ির বরই গাছে বরই পেকেছে, আমাকে ডাকতো বরই পারার জন্য। বাগানে বকুল তলায় শীত সকালে বকুল জমেছে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর- আমি সঙ্গী হতাম তার বকুল কুড়োনোর। পাশের গ্রামে বিয়ে হচ্ছে- আলপনা সাজাতে রাবু আপার একমাত্র সঙ্গী এই আমি। এই কারণে বড়রা কি এক তীক্ষ্ন চোখে আমার দিকে তাকাতো! পাশের বাড়ির শানু ভাই একদিন আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে রাবু আপাকে একটা চিঠি পৌঁছে দিতে বলেছিল। আমি চিঠিটি আনিনি।

রাবু আপা স্কুলে যেতেন। এখনও আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছি- শ্যাম বর্ণের কলমীডাঁটার রাবু আপা সাদা সালোয়ার, নীল বা কমলা কামিজ পরে, মাথায় সাদা রঙের ওড়না জড়িয়ে আলতো নিচু করে নিষিদ্ধ ডাকহরকরার মতো মৃদু পা ফেলে ফেলে যাচ্ছেন গ্রামীণ পথ ধরে। আমার মনে হতো পথের ঘাসফুল রাবু আপার জন্য ফোটে। সবুজ ঘাসের হাসে তার অবাক আগমনে। আমি যে বছর পঞ্চম শ্রেণির বালক- সেই বছর রাবু আপা দিলেন মেট্রিক পরীক্ষা। আমাদের চারবাড়ির মধ্যে প্রথম কোনো মেয়ে মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে- চারদিকে একটা সাজ সাজ রব। রাবু আপা যেন আশ্চর্য মানুষ। আমাদের মতো স্বাভাবিক রক্ত-মাংসের মানুষ নন- এমন একটা ধারণা আমার মনে জন্ম নেয়। আহা, আমি যদি তার মতো হতে পারতাম! আমাদের বাড়ি থেকে আট নয় কিলোমিটার দূরের থানায় রাবু আপা চলে গেলেন মেট্রিক পরীক্ষা দিতে। যাবার আগে আমাকে গাল টিপে যেতে ভোলেননি। সুযোগ বুঝে একবার আমিও তার কাছে বায়না ধরেছিলাম- যেখানে থানা শহর মেট্রিক পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, সেখানে আমিও যাবো। প্রথমে একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও সামান্য ভেবে বললেন রাবু আপা- নয়ন, তোর প্রস্তাবটা খুব ভালো, তুই সঙ্গে থাকলে আমার অনেক উপকার হবে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে তোকে জানাবো। জানিস তো, বাবা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। বাবা প্রসঙ্গটাই একটা বিদঘুটে ব্যাপার। রাবু আপার বাবাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। সুতরাং রাবু আপার সঙ্গে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বুকের মধ্যে কি এক দুরূহ কালো কষ্ট, কি এক সবুজ রঙের ব্যথা যে গুমরিয়ে কেঁদেছিল- বলতে পারবো না। রাবু আপা চলে গেলেন মেট্রিক পরীক্ষা দিতে। রাবু আপার জন্য রাতে ঘুমুতে যাবার সময় আমার দুচোখে পানি আসতো। আমি তখনও মায়ের সঙ্গে ঘুমাই। মা এসব দেখে বলতেন- পরীক্ষাটা দিয়ে রাবু আসুক, ওর সঙ্গে তোর বিয়ে দিয়ে দেবো। তখন বুঝবি মজা! লজ্জায় বালিশের সঙ্গে মিশে যেতাম। সামান্য দূরে বাবা মুচকি মুচকি হাসতেন। হাসতে হাসতে বলতেন- ষোলো বছরের কন্যার দশ বছরের বর। ব্যাপারটা এ যুগে ভালোই জমবে!

রাবু আপা মাসখানেক পর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসলেন, আবার আগের মতো মায়ের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলেন, পুকুর পাড়ে দলবেঁধে যেতেন গোসল করতে, আমাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতেন ঠিকই, কিন্তু তার হাতের গাল টেপা মধুস্বাদ থেকে বঞ্চিত হলাম। তিনি আর আমার গাল স্পর্শ করতেন না। এক অপার্থিব আহত অভিমানে আমি স্কুলে যাবার পথে একা একা কেঁদেছি, কাশফুল, চালতাফুল, ঘুঘুর বাসা, নদীর স্রোত, সবুজ ঘাস আর শালিক দোয়েলের কাছে নালিশ করেছি। বলেছি- আজ স্কুল থেকে এসে রাবু আপার মরা মুখ দেখি। মনে মনে অভিশাপ দিয়েছি মেট্রিক পরীক্ষাকে। বুকের গোপন দেয়ালে অজস্রবার প্রশ্নটি মাথা কুটেছে- মেট্রিক পরীক্ষা দিলে কি গাল টেপা বন্ধ করে দিতে হয়? তাহলে রাবু আপা কেন মেট্রিক পরীক্ষা দিতে গেলেন? পরীক্ষা না দিলে কি এমন ক্ষতি হতো? আমার অভিশাপ বুঝি বৃক্ষের ফলের মতো আনত ছিল, অভিশাপটা ফললো, তবে অন্যভাবে। আমার পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার পরপরই রাবু আপার বিয়ের বাদ্য বেজে ওঠে। বিয়ে হলে রাবু আপু দূরের কোনো দেশে চলে যাবেন, অভিমানী বুকে আমার আনন্দ বাদ্য বাজে। খুব ভালো হবে- মনে মনে বাড়ির পাশের বিশাল শিরীষ বৃক্ষটার সঙ্গে বলতাম- বুঝলি শিরীষ গাছ, এই যে রাবু আপার বিয়ে হচ্ছে, চলে যাচ্ছে- এটা আমার অভিশাপের ফসল। আমাকে চেনে না? কি এমন হয়- আমাকে আগের মতো সামান্য একটু আদর করলে? গাল টিপে দিলে! ওমা, আমি দেখি শিরীষ গাছটার বিরাট ডাল থেকে দু’একটি পাতা ঝরে পড়ছে। তার মানে! শিরীষ গাছটাও আমার দুঃখ বোঝে। বোঝে না কেবল রাবু আপা। যাক- দু’চোখ থেকে বাইরে, অনেক দূরে কোনো অচেনা দৈত্যদের দেশে চলে যাক, একা নিঃসঙ্গ এক ঝরাপাতার মতো আমি রাস্তায় রাস্তায় বনে বাদারে নদীর পাড়ে ঘুরি আর কাঁদি।

মা আমাকে নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছেন। বাবা মিটিমিটি হাসেন। স্কুল শিক্ষক বাবার সেই হাসিতে কি যে আছে- আমি মরমে মরে যাই। বালিশের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে বিছানায় পড়ে থাকি অবুঝ টিয়াপাখির মতো। রাতে মা আসেন আমার কাছে। মায়ের শরীরের উষ্ণ স্পর্শে, মধুর গন্ধে আমার চেতনার জগৎ আলোকিত হয়। কিরে নয়ন- এখনও ঘুমাসনি? মায়ের মুখে পানের লাল রস আর জর্দার মনকাড়া গন্ধ। না। কেন? আমার মাথা কাছে টেনে নেন। তুমি আসছো না- তাই। হাসেন- তুই কি এখনও ছোট্টটি আছিস! কতো বড় হয়েছিস- আর কমাস পর তুই সিক্সে পড়বি। এখন থেকে নিজেকে নিজে ঘুম পাড়াবি। একা একা জামা কাপড় পরবি- মা! কি? আমার ঘন চুলের মধ্যে মায়ের মিহি হাতের পরম স্পর্শ। বিয়ে হলে রাবু আপা কোথায় যাবে? শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ি কি? ঘুম জড়ানো চোখে মা হাই তোলেন- নয়ন, ঘুমো এখন। ঘুম আসে না যে মা! সংসারে মেয়ে বড় হলে তাকে বিয়ে দিতে হয়। যেমন আমার মা-বাবা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন তোদের বাবার সঙ্গে। তুইও বড় হবি- তোর জন্য রাবুর চেয়েও সুন্দর বৌ আনবো আমি- একেবারে রাজার কন্যে- সবাই দেখে অবাক হবে- এক অনাস্বাদিত লজ্জায় আমি কুঁকড়ে যাই। মায়ের গভীর নরম বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে নিঃসাড় পড়ে থাকি। মা যে কি! এসব শুনতে আমার লজ্জা লাগে না বুঝি! দুদিন পর রাবু আপাকে নিয়ে তার বর চলে যায়।

রাবু আপার বিয়েতে কতো লোক যে আসে! প্রচুর খাওয়া দাওয়া! দুটো গরু, তিনটে ছাগল রান্না হয়েছে। রাতে চার পাঁচটা হ্যাজাক লাইট জ্বালানো হয়। আমার দু’চোখে অপার বিস্ময় খেলা করে। খেলার পুকুরে মাছ ধরতে থাকি- হরেক রকম মাছ। কষ্ট, কিশোরের বুকে আইঢাই করা সবুজ কষ্ট বিরাণ দুপুরে শ্যাওলা জমা পুকুরে ছিপ ফেলে ফাতনাহীন মাছ ধরে। সারাটা দিন যায়, সন্ধ্যা নামে- মাছ টান দেয় না। কিশোর তবুও নিরাশ হয় না। ভাবে, রাবু আপা নিশ্চয়ই একবার ডাকবে। আদর করবে। শ্বশুরবাড়ির যাবার আগে অন্তত একবার ডাকবে। কাছে বসাবে। গাল টিপে বলবে- আমাকে নাইওর আনতে যাস। রাতে ঘুমিয়ে পড়ি- সকাল উঠে আর রাবু আপাকে পাই না। আহা- পৃথিবীর সব বিষণ্ন আর থোকা থোকা শোক, সব বিরহ আমার কৈশোর উত্তীর্ণ বুকে জমা হয়ে হয়ে পাথর হয়। পাথর বুক ফেটে দুঃখের ধারায় নামে জল। আমি পথ হারিয়ে ফেলি। একা একা হাঁটি, বাগানে বাগানে ঘুরি আর কাঁদি। আমার অভিমানী দু’চোখে এতো জল! কিভাবে জায়গা নিয়েছিল? আপনাদের কাছে বলতে গিয়ে আজ আমি নিজেই অবাক হচ্ছি। বিস্মিত হয়ে আমি আমার সেই আমিকে খুঁজি। কিন্তু ফেলে আসা পথ, পথের ঢেলা, বকুলের গন্ধ, তালের শাঁস খাওয়ার নিরেট আনন্দ, কচুপাতার ওপর বর্ষার টলটলানো পানি সব স্মৃতিরা সঙ্গে নিয়েছে আমাকে। মা এই আমাকে, সেই তখন আরও নিবিড় করে তার মমতার কোলে আশ্রয় দিলেন। কৈশোর উত্তীর্ণ এক অভিমানী বেড়াল বালকের শোক ও সুখ তার মা ছাড়া কে আর বুঝবে? মা ছায়ার মতো লেগে রইলেন। বোঝালেন-মানুষের জীবনে এই রকম হয়, সকালে এক রকম তো বিকেলে আবার অন্য রকম, রাতে একেবারে ভিন্ন। নয়ন, যতো বড়ো হবি, জীবনের নামতা এইভাবে পাল্টে যেতে দেখবি। কিন্তু ভয় পাবি না। জয় করবি জীবনকে।

এলাকায় দি রয়েল সার্কাস পার্টি এসেছে। আমি প্রতিরাতে জেগে জেগে বাবার অজান্তে সার্কাস দেখতে যেতাম। মা টাকা দিতেন। সঙ্গে ছিল আমার চেয়ে চার ক্লাস উঁচুতে পড়া- প্রায় বন্ধুর মতোই মানু। মানু আমাকে অনেক কিছু বোঝায়। ও সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। সার্কাসের মেয়েদের মধ্যে প্রথম দেখলাম মসৃণ নাভী, নাভীমূল। প্রথম দেখি অবাক বিস্ময়ে নৃত্যরত মেয়েদের স্তন। সামান্য বক্ষবন্ধনী উপরে, কোমরে জাঙ্গিয়া। পুরো শরীর অমৃত উদোম। কি উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল নাচ! সেই মেয়ে কেবল নয়- সার্কাস প্যান্ডেলের প্রায় হাজার খানেক মানুষ, লাইট, অন্যান্য আসবাবপত্র এক সঙ্গে নাচতে থাকে। দুলতে থাকে। তা থা থৈ থৈ নাচতে থাকে আমার বোধ, বোধন, চৈতন্য, সুখ, অসুখ। আমার জগৎ সংসার চিন্তা সব উলট পালট হয়ে যায়। এর নাম কি? আমার চারপাশের তরুণ, মধ্য বয়স্ক, বয়স্ক, পৌঢ়- অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে লালা ফেলছে। বিশ্রী লালা, গন্ধভরা লালা। আমি ঢোক গিলি। গলা শুকিয়ে কাঠ। মানু অনেকের সাথে সামনে পিছনে কোমর দুলিয়ে নাচে আর খিক খিক হাসে। জ্যান্তব হাসির সঙ্গে এই মেয়েলোকটির নাচ আমাকে অন্য ভুবনে নিয়ে যায়। কেউ কেউ মুখের মধ্যে কৌশলে দু’আঙুল ঢুকিয়ে তীব্র শিস দেয়। যৌবনবতীর উদোম-উদ্দাম নাচ দেখি, শিস শুনি আর আমি হারিয়ে যেতে থাকি অকূল গাঙের তীরে। নাচের শেষে দেখি ত্রিফলা বর্শার খেলা, মোটরসাইকেলে একসঙ্গে এগার জনের আরোহণ, মাথায় পানি ভরা কলসি নিয়ে গড়াগড়ি- দেখতে দেখতে পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে যায়। সার্কাসের মঞ্চে পর্দা নামে। আমি আর মানু শীতের গাঢ় কুয়াশায় ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরি। আমাদের মুখ থেকে কথায় কথায় ধোঁয়া বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মানু লুঙ্গিটা উঁচু করে ওর নুনু দেখায়। ওর নুনুটা শক্ত আর মোটা। নয়ন, আমি সাবিত্রীকে বিয়ে করবো। সাবিত্রী! হ্যাঁ! সাবিত্রী! দুর্বোধ্য হাসি মানুর ঠোঁটে- যে মেয়েটি নাংটো হয়ে নাচলো ওর নামই সাবিত্রী। খুব সুন্দর না মেয়েটা? তুই পারবি বিয়ে করতে? ওতো অনেক বড় তোর চেয়ে। আরে পাগল মনে মনে বিয়া করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওর সঙ্গে ইয়ে করবো- খিকখিক হাসিতে স্নিগ্ধ সকালটা নষ্ট করে মানু- তুই শালা এখনও খেলা বুঝিস না!

আমি নির্বোধ শামুকের মতো তাকিয়ে থাকি মানুর দিকে। মানুকে হঠাৎ এই শিশির ভেজা এই ঘনঘোর ভোরে মনে হয় রূপকথার ভয়ংকর দৈত্য। ও মানুষ নয়- পাঁঠা। অথবা ষাঁড়। কিংবা হারিয়ে যাওয়া কোনো অচেনা দেশের নিষ্ঠুর বংশীবাদক। যার বাঁশির সুরে দৈত্য রাক্ষস ছুটে আসে। ও আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! মানু হাঁটতে হাঁটতে ওর নুনু হাতের মধ্যে নেয় এবং অদ্ভুত কৌশলে নুনুটাকে হাতের মুঠোয় সরোদের মতো বাজাতে থাকে। আমি সত্যিই মাঠে নেই, ঘাটে নেই, হাওয়ায় নেই, আমি যে কোথায়-জানি না। নিশি পাওয়া মানুষের মতো আত্মভোলা হয়ে ঘরে ফিরি শীতার্ত ফ্যাকাসে ভোরে। মা দরজা খুলে দেন। তিনি এই মাত্র বাবার উষ্ণ বিছানা থেকে উঠে এসেছেন। চোখে ঘুম তারপরও কি গভীর প্রশান্তি ছড়িয়ে থাকে মায়ের উষ্ণ মুখে। তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়- মা বলেন। আমি মায়ের কথানুযায়ী বিছানায় শুয়ে পড়ি। বিছানায় শুয়ে পড়েছি ঠিকই- কিন্তু আমি চলে গেছি সার্কাসের প্যান্ডেলে, সাবিত্রীর কাছে। সাবিত্রীর নাভী, স্তনের নিবিড় খয়েরি সুষমায়। আমি হাঁটছি কুয়াশাভরা ভোরে, শিশিরের ঘাসে। সঙ্গে মানু। মানুর শিল্পীত অথচ কদর্য রূপান্তরের খেয়াঘাটে। আমার ভেতরের শুয়োপোকা খোলস বদলাতে থাকে। আমি দিগি¦দিক ছুটতে থাকি পাল ছেঁড়া নৌকার মতো। খেয়া পার হতে হতে ঘুমিয়ে পড়ি। এইভাবে দিন যায়, রাত আসে। রাত যায়, দিন আসে। দিন রাত্রির খেলায় আমার দিন চলে, চলে দিনরাত। আমার সঙ্গে মানুর যৌবনের শারীরিক কুৎসিত একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। কি এক অমোঘ আকর্ষণে টানে আমাদের গ্রামের গভীর কেয়া কাঁটার বন। আমরা দু’জনে ঢুকে পড়ি সেই বনে, ফুলের জন্যে নয়, কাঁটা তুলতে। মা হয়তো একটা কিছু বুঝতে পারেন। হঠাৎ আমার উপর ক্রুদ্ধ আচরণ আরম্ভ করেন। শাসনের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। মানুর সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেন। আমি মরমে মরে যাই। বাবা বাড়িতে থাকেন না। তিনি চাকরি নিয়ে দূরের থানায় চলে গেছেন। সামনে আমার মেট্রিক পরীক্ষা। রাত জেগে পড়তে হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমাদের স্কুলে নতুন একজন মেয়ে এসেছে। লোটাস মেয়েটি শ্যাম বর্ণের। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আয়ত চোখ। লোটাস হাঁটলে পৃথিবী দুলে ওঠে। ও কথা বললে মনে হয় কোকিল গায়। ঢাকায় থাকতো। ঢাকার মেয়ে-গ্রামে এসেছে! মেয়েটি যা কিছু দেখে অবাক হয়। আর লোটাসকে দেখে আমরা অবাক হই। মেয়েটি যেন হাঁটে না। চড়ুই পাখির ডানায় উড়ে বেড়ায়। কথা বলে দোয়েলের শিসে। তাকায় পালতোলা নৌকার আয়োজনে। লোটাসকে আমরা সবাই জয় করতে চাই। ওর প্রতিদ্বন্দ্বী আমরা চারজন। আমি, বরুণ, শ্যামল আর দোলন। আমাদের সবাইকে অতিক্রম করে দোলন অনেকটা কাছাকাছি চলে গেছে। দুদিন লোটাসের বাড়ি গেছে দোলন। রাগে ফুঁসছে বরুণ আর শ্যামল। ওরা প্ল্যান করেছে দোলনকে মার দেবে। মেরে একটা ঠ্যাঙ ভেঙে দিলে আর যেতে পারবে না লোটাসদের বাড়ি। আমি বাধা দেই। ওরা আমার দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকায়। বুকের মধ্যে লোটাস আর চোখে রাত জেগে মেট্রিক পরীক্ষার ক্লান্ত পৃষ্ঠায় যখন কাতর ঠিক তখন, এক সন্ধ্যাপাড়ের বিকেলে রাবু আপাকে দেখি রাস্তায় হাঁটছে। আমরা দু’জন অনেক দিন পর মুখোমুখি। রাবু আপাকে দেখে চমকে উঠি, বিষণ্ন হই আর অনেকদিনের সঞ্চিত ঘুঘু পাখির অভিমান আবার আমার মধ্যে ডাক পাড়ে বুকের গহীন থেকে। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। তার মুখে আবার সেই মৃদু হাসি। আমার চিবুক তুলে ধরে- কিরে নয়ন! তুই আমাকে একদম ভুলে গেলি! এখান থেকে আমার শ্বশুরবাড়ির পথ মাত্র একঘণ্টার। আমি কতোদিন তোর অপেক্ষা করেছি- আমার মুখে কথা নেই। ঘুঘুপাখির অভিমান ডানা ঝাপটায় বুকের বিষাদ চরে। কি রে! তুই কথা বলবি না? আমার সঙ্গে রাগ করেছিস? হঠাৎ আপু হেসে ওঠেন- আরে নয়ন! তুই দেখি বড়ো হয়ে গেছিস! তোর নাকের নিচে গোঁফ উঠেছেরে! চিনিমাকে বলতে হবে- তুই অনেক বড় হয়েছিস। তোকে একটা রাজকন্যা এনে দেবো- আমি ছুটে পালিয়ে যাই। পেছনে রাবু আপুর নিঃশব্দ মধুর হাসি আছড়ে পড়ে- নয়ন, বাড়ি আসিস। তোর সঙ্গে অনেক গল্প জমা হয়ে আছে।

কয়েক মাস ধরে আমাদের কানে একটা কথা আসে। রাবু আপা তার স্বামীর বাড়িতে সুখে নেই। স্বামী নাকি তাকে মারে। লোকটা নাকি বদমেজাজী। কি সব ময়লা টয়লা খায়। রাবু আপার কথা বলে মাকে বেশ কয়েকদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখেছি। বাবাকেও দেখেছি চিন্তিত। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগে- এখন বুঝো মজা! আমাকে কষ্ট দেয়া! পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। টেবিলে ঘাড় গুঁজে পড়ছি। পেছনে এসে দাঁড়ান রাবু আপা। মাথায় রাখেন হাত। চমকে পেছনে তাকাই। রাবু আপার মুখে বর্ণিল মধুর হাসি। কিরে! তোর পড়াশুনা কেমন হচ্ছে। ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে মার খাবি কিন্তু! রাবু আপা আমার ঝাঁকড়া চুলের উপর মুখ রাখলেন। আমার শরীর আছড়ে পড়ে অকুল দরিয়ার তীরে। মা আসেন- দু’জনে কথা বলতে বলতে চলে যান অন্য ঘরে। কিন্তু আমি কাঁপতে থাকি থরথর করে। আমার আর পড়ায় মন বসে না। ঘুরেফিরে লোটাস, নদী, সন্ধ্যাপাড়, হিজলের বন, রাবু আপা, আমার মনে উজ্জ্বল মেঘের মতো ভিড় করে। আমি মেঘের জলে ভিজতে থাকি- মেঘের জলে ভাসতে থাকি। অন্তহীন আগুনের সোনালি স্পর্শে আমার ভেতরের আমি পুড়তে থাকি। পরের দিন দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরতে ঘুরতে আমি রাবু আপাদের ঘরে যাই। এঘরে খুঁজি, ওঘরে খুঁজি, রাবু আপাকে পাই না। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠি। অবাক হয়ে দেখি রাবু আপা বিষণ্ন মুখে জানালায় চোখ রেখে বিছানায় উপর শুয়ে আছেন। নিষ্পলক চোখে কি দেখছেন রাবু আপা! আমি এসে পাশে দাঁড়াই, অথচ রাবু আপা ফিরেও দেখছেন না। তার কালো চোখে রূপালী জল। জল কি নিঃশব্দ আর আগুন রঙের হতে পারে রাবু আপার চোখ আর মুখ দেখে বুঝতে পারি। সেই জলের অপূর্ব সোনা রঙ আমি দেখতে থাকি । অপরূপ দৃশ্য। হঠাৎ আমাদের মাঝখানে একটি সাদা বিড়াল আসে- কোত্থেকে!। রাবু আপা ফিরে তাকান। আমাকে দেখে হেসে ওঠেন- কখন এসেছিস? কাছে আয়। আমি ভীরু ভীরু পায়ে তার কাছে যাই। রাবু আপা শোয়া থেকে আমার হাত ধরে বসান পাশে। রাবু আপার শরীরের কাপড় অসংবৃত। আমি দেখি মেঘের সাদা আকাশ। আমার শরীর চমকে ওঠে। কি হয়েছে তোর? তুমি কাঁদছো কেন? নয়ন, আমি কি করেছি! চারপাশের লোকেরা কেন আমার বিরুদ্ধে নানারকম কথা বলে? ও বাড়ির ছালাম আমার বিরুদ্ধে যা তা বলে বেড়াচ্ছে- আমার শ্বশুরবাড়িতে আমি থাকতে পারি আর না পারি ওইসব মানুষের কি? কেন আমার বিরুদ্ধে বদনাম করে? বলতে বলতে রাবু আপা আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন আর দু’হাতে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন। কয়েক মুহূর্ত আমি হতবিহ্বল থাকি। পরপরই আমিও দু’হাতে জড়িয়ে ধরি রাবু আপাকে। নারীর শরীর জড়িয়ে ধরলে এমন তীব্র অনুভূতির রস সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে? শরীর তাহলে এইভাবে গান গায়? আশ্চর্য এক সুখে আমি বিহ্বল আর অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ি। তীব্র আনন্দ, সুখে, উন্মাদনায় আমি রাবু আপাকে দু’হাতে ক্রমে ক্রমে আঁকড়ে ধরি। রাবু আপার গরম নিঃশ্বাস আর মধুর ঠোঁট নেমে আসে আমার ঠোঁটে, চোখে, মুখে। আমার চোখের তারায় নাচে সাবিত্রী, সাবিত্রীর স্তন, লোটাস আর মানুর কাছে শেখা শিল্পকারুকাজ। আমি সেদিন বালক থেকে পুরুষে রূপান্তরিত হই। আমি আমাকে বিসর্জন দেই রাবু আপার কাছে। রাবু আপা একসঙ্গে আমার শৈশবের ঘুড়ি, বয়সন্ধির নীল ময়ূর আর যৌবন দরজার প্রথম কুসুম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App