×

সাময়িকী

পাখির ঠোঁটে প্রজাপতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০১৯, ০৫:৪৩ পিএম

পাখির ঠোঁটে প্রজাপতি
মর্গের গেটে রিকশা থেকে নামলে শুদ্ধর মনে হয় দম আটকে আসছে। অথচ রুচিরার লাশের কী ব্যবস্থা হলো তা জানার জন্য প্রচণ্ড উদ্বেগ নিয়ে এসেও একদম থিতিয়ে যায় এখন। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করবে না বলে রিকশা ভাড়াটা হাতের মুঠোয় নিয়ে রেখেছিল। মুঠিভরা টাকাটা রিকশাঅলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, টাকাগুলো দুমড়ে গেছে, কিন্তু যা চেয়েছিলে তাই আছে। নাও। গেটের দিকে দু’পা ফেলতেই দেখতে পায় রাকিব আর প্রমিতাকে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ওদের ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি দেখে ও আঁচ করে যে দুজনের সম্পর্কে দানা বেঁধেছে, অর্থাৎ ভালোবাসার কথা বলা হয়ে গেছে। তাই দুজনেরই এমন হাসিখুশি উজ্জ্বল চেহারা। লাশের গন্ধভরা এই মৃত্যুপুরীতে ওরা জীবনীশক্তির সন্ধান পেয়েছে। শুদ্ধ দ্রুত ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাকিব ওর হাত ধরে বলে, আর যেও না। রুচিরাকে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়িতে তুলে দেয়া হয়েছে। শুদ্ধ চেঁচিয়ে ওঠে, কেন? কারণ ওকে শনাক্ত করার কেউ নেই। প্রমিতার কণ্ঠে ঝাঁঝ। তোমরা শনাক্ত করলে না কেন? আমরা তো ওকে অস্বীকার করার জন্য এই শহরে দিন কাটাচ্ছি না। আমরা তো বেঁচেই আছি। তোমাদের কি হয়েছিল? দুজনে চুপ করে থাকে। পরস্পরের দিকে তাকায়। দুজনেরই বুকের ভেতর একই বোধ, তাই তো! আমরা কি করলাম। আমরা কেন সাহসী হলাম না! শুদ্ধ আবার তীক্ষ্ন কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, চুপ করে আছ যে? আমরা তোমার মতো বাহবা নিতে চাইনি। প্রমিতা ব্যঙ্গ করে। বাহবা? শুদ্ধ ভুরু কুঁচকায়। ওর রাগ বাড়ে। এই সামান্য কাজে বাহবা? শহরটাই এখন এমন। কেউ কারো দায়িত্ব নেয় না। শুদ্ধ আমরা সবাই যে কোনো সময়ে এই দেশে রেওয়ারিশ লাশ হবো। সময় এমন যে আমাদের কারো কারো লাশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা কেউ কেউ গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবো মাঠেঘাটে-পথে-প্রান্তরে। বাহ্, বেশ তো বক্তৃতা দিতে শিখেছো। শুদ্ধের কণ্ঠের ধার দুজনের বুকে বেঁধে। কিন্তু ওরা আর বিতর্ক বাড়াতে চায় না। শুদ্ধরও দম ফুরিয়েছে। কার সঙ্গে লড়াই? রাকিব আর প্রমিতা তো ওর প্রতিপক্ষ নয়। ওকে উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলছে সে পর্যন্ত ওর কণ্ঠস্বর কখনো পৌঁছাবে না। রাকিব হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, হাত মিলাও বন্ধু। তারপর রাকিব আগ বাড়িয়ে বলে, আরো খবর আছে এবং তা মৃত্যুর খরব নয়। সে জন্য তোমাদের চেহারা এমন অন্যরকম- ঝকঝকে হাসিখুশিতে উজ্জ্বল। শুদ্ধ ওর হাত ছাড়ে না, বাম হাতটা প্রমিতার দিকে বাড়িয়ে বলে, তোমার হাতটাও ধরতে দাও। আমিও তোমাদের অনুভব নিজের মধ্যে গ্রহণ করি। প্রমিতা হাত বাড়িয়ে দিলে শুদ্ধ আঁকড়ে ধরে। ওর মনে হয় ওরা দুজনে ঘর পেয়েছে। ওরা বেওয়ারিশ হবে না। এই শহরে সবাই কেন বেওয়ারিশ হবে, কেউ না কেউ তো বেওয়ারিশের দায় মুছে দেয়ার জন্য এগিয়ে আসবেই। আচমকা হেসে ওঠে দুজনে। রাকিব বলে, আমাদের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা নাটকের দৃশ্যের মতো। শুদ্ধ হাসতে হাসতে বলে, তাহলে তোমরা নাটকের পর্দাটা উন্মোচন কর। আমি ঘটনাটা জানি। আমরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই মর্গে দাঁড়িয়ে? আর জায়গা কোথায়? এই মুহূর্তে রাষ্ট্র নিজেই আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি! লাশ বহন করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। তাহলে তোমাদের সিদ্ধান্ত দুটো। একটি ভালোবাসার গল্প, অন্যটি রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নির্ণয়। তা বলতে পারো। চলো চা খাই। প্রাণেশকে দেখেছ? ও কি ভেতরে আছে? আছে। মুষড়ে আছে লোকটা। ওর কী যেন হয়েছে। আমাদের সঙ্গে কথাই বলল না। তোমরা যাও। আমি ওকে দেখে আসি। ওরা চলে যাওয়ার মুহূর্তে ফিরে দাঁড়ায় শুদ্ধ। বলে, তোমরা কী শব্দে ভালোবাসার কথা জানিয়েছ? কোনো নতুন শব্দ বলতে পেরেছ? দু’জনে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে, তোমার ছেলেমানুষি গেল না শুদ্ধ। ভালোবাসার ফসল ঘরে ওঠালে আর আমি আমোদ করতে পারব না? প্রমিতা বাধা দিচ্ছ কেন? বাধা দিচ্ছি না তোমাকে। আমরা কোনো শব্দ ব্যবহার করেছি সেটা নাইবা জানলে। দেখতে পাচ্ছ না চারদিকে ভাষার এখন ভীষণ আকাল। প্রচলিত শব্দে না কুলালে তোমরা শব্দ বানাও। রাকিব হাসতে হাসতে বলে, আমরা অন্য কৌশল নিয়েছিলাম নিজেদের প্রকাশ করার জন্য। ভাষা দিয়ে চেষ্টা করিনি। ব্রেভো। বুঝেছি। অভিনন্দন। শুদ্ধ হাত ছেড়ে দেয়। বলে, তোমরা পারবে এই শহরে টিকে থাকতে। টিকে থাকতে তো হবেই। না হলে যাবো কোন চুলোয়। রাকিব প্রমিতার ঘাড়ে হাত রাখে। প্রমিতা রাকিবের হাতটা ধরে বলে, আমাদের অনেক কাজ পড়ে আছে। যাও, যেদিকে দুচোখ যায়, যাও। শুদ্ধ হাত নেড়ে চলে যায়। প্রাণেশকে খুঁজে পেতে সময় লাগল না। ও এককোনায় দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুকছে। মুখ দেখে বোঝা যায় কোনো কারণে বিপর্যস্ত। শুদ্ধকে দেখে একমুখ ধোয়া ছেড়ে এগিয়ে আসে। কেমন আছিস স্যার? তুই কেমন আছিস? শুদ্ধ ডান হাত নেড়ে ওর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ধোয়া সরায়। বিরক্ত হয়ে বলে, ভালো সিগারেট খেতে পারিস না? পারি না। ওইসব বাজে মাল খেয়ে যুৎ পাই না। ওগুলো খেলে মড়া কাটতে পারতাম না। মনে হয় মড়া কেটে ভীষণ ফুর্তিতে থাকিস। বাজে পাঁচাল পাড়িস না স্যার। কেন এসেছিস? শুদ্ধ এক মুহূর্ত প্রাণেশ ডোমকে দেখে। বউ মরে যাওয়ার পরে স্বাস্থ্য ভেঙেছে। জওয়ানকীর জৌলুস নেই। তোবড়ানো গালে ভাঁজ পড়েছে। ও আর আগের মতো নেই।। তো কী হয়েছে? শুদ্ধ নিজেকেই প্রশ্ন করে। ও আমার বন্ধু। ওর বন্ধুত্ব আমি উপভোগ করি। প্রাণেশ বিড়ির টুকরো দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে, বললি না কেন এসেছিস? তোর কাছে আসতে কি আমার কারণ লাগে রে প্রাণেশ?। প্রাণেশ হা... হা... করে হাসে। শুদ্ধর মনে হয় ওর হাসি আশ্চর্য সজীব। প্রাণেশ স্বাস্থ্য হারিয়েছে, কিন্তু ওর হাসি থেকে প্রাণ যায়নি। ও আসলে দারুণ মানুষ। এখন প্রাণেশ ওর দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে বলে, তুই কিছু একটা জানতে এসেছিলি স্যার। তোর মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছে। আমি রুচিরার লাশের খবর নিতে এসেছিলাম। শুনেছি ওকে আঞ্জুমানের গাড়ি নিয়ে গেছে। আচ্ছা বল তো, ওর মা মেয়েটার লাশ শনাক্ত করল না কেন? এসব পারিবারিক ব্যাপার আমি কী করে জানব? তুই বা নাক গলাচ্ছিস কেন? প্রাণেশ লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বলে, আমার ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোরও কিছু হয়েছে। হ্যাঁ, আমার একটা কিছু হয়েছে। আমার ভীষণ ভয় করছে। রাতদিন মড়া কাটিস। তোর আবার ভয় কী? আমার বাড়িতে চল। তেলে বলছি। এখানে কথা বলতে পারব না। ঠিক আছে, চল। শুদ্ধ ওকে নিয়ে রিকশায় ওঠে। ওর বৌ আত্মহত্যা করার পর ওর বাড়িতে আর যাওয়া হয়নি। ওর ছেলেটার সঙ্গেও দেখা হয়নি। হঠাৎ করে শুদ্ধর মনে হয়, ওর নিজেরও ভয় করছে। মৃত্যু ভয়। ওর গা ছমছম করে। প্রাণেশের মুখ থেকে বিড়ির উৎকট গন্ধ আসছে। বমি পাচ্ছে শুদ্ধর, কিন্তু একথা প্রাণেশকে বলা যাবে না। ও দম বন্ধ রাখে কিছুক্ষণ, তারপর ফুস করে ছেড়ে দেয়। তখন প্রাণেশ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আবার বলে, তোর যেন কী হয়েছে স্যার। তোর বউ ভালো আছে তো? আছে। বাবা, মা, ভাই? সবাই ভালো আছে। তাহলে তুই এমন এলোমেলো নিঃশ্বাস ফেলছিস কেন? আমার ভালো লাগছে না। আমি তো তোকে বলেছি, রুচিরার লাশের ব্যবস্থা কী হবে জানতে আমি মর্গে এসেছিলাম। তোর পরিচিত অনেক লোকই মর্গে আসছে। তোর বন্ধুরা তো মর্গ দখল করেছে। দেখতে পাচ্ছি তোর সঙ্গে মর্গের নাড়ির টান হয়েছে। হবে না, তুই যে আমার প্রাণের বন্ধু! প্রাণেশ শব্দ করে হাসে। শুদ্ধ বুঝতে পারে যে ওর এমন সরল স্বীকারোক্তিতে প্রাণেশ মজা পেয়েছে। উহ্! মানুষকে আনন্দ দিতে পারা বড় ব্যাপার। সরাসরি কারো শরীরে ঢুকে গিয়ে ওর ভেতরটা একডুবে দেখে আসা যায়। ওর মনে হচ্ছে প্রাণেশের চেয়েও বেশি আনন্দ এখন ওর নিজের। বিম্ববতী কাছে থাকলে ও বলত, চলো ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর এক্সিবিশন দেখে আসি। বিম্ববতী সঙ্গে সঙ্গে বলত, এক্সিবিশন একটা বাজে শব্দ। আমি এক্সিবিশন বলতে চাই না। তাহলে কী বলতে চাও তুমি? বিম্ববতী গলা ফুলিয়ে কীর্তন গাওয়ার মতো করে বলত, শিল্পভুবন।। চলো প্রিয়ভাষিণীর শিল্পভুবন দেখে আসি। এভাবে দুজনে নিজেদের নিজস্ব শব্দমালা তৈরি করে। সেইসব শব্দ অন্যদের মাঝে চালু করার চেষ্টা করে। এভাবে ওদের দিনগুলোতে নানাকিছু। সংযোজন হয়। যেমন হয়েছিল গতকাল প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্যগুলোর সামনে অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে। কোনটা ছেড়ে কোনটাকে ওরা সুন্দর বলবে? শুদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকে ‘স্মৃতির জানালা’ মানে ভাস্কর্যের সামনে, বিম্ববতী বিমোহিত হয় চারটি শ্রমজীবী মানুষের ফিগার দেখে। তারপর ওকে হাত ধরে টেনে ঘরের কোনায় নিয়ে যেয়ে বলে, আমি মরে গেলে শরীরটা প্রিয়ভাষিণীকে দিও। ও হয়তো শরীরটাকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে পারবে। শুদ্ধ বলেছিল, শরীরের সবটুকু তো নেয়া যাবে না। শুধু হাড় এবং চুল কাজে লাগতে পারে। আমি প্রিয়ভাষিণীকে বলতে পারি যে বিম্ববতীর হাড় আর চুল লাগিয়ে তুমি শিল্প বানাও প্রিয়ভাষিণী। তাহলে আমার চোখের সামনে বিম্ববতী বেঁচে থাকবে। বিম্ববতী দুহাত ওপরে তুলে চোখেমুখে আনন্দ ছিটিয়ে বলেছিল, দারুণ হবে। ভাবতেই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। শুদ্ধ ওর চোখে চোখ রেখে বলেছিল, মরণ এখনি না। আমাদের মরণ আবিষ্কার করতে হবে। সাধারণভাবে মরতে চাই না আমি।। বিম্ববতী ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল, মরণের আবার আবিষ্কার কী? শুদ্ধ সে প্রশ্নের জবাব দেয়নি। বলেছিল, দেখো গাছের কেমন অপূর্ব নির্মাণ। প্রিয়ভাষিণী জাতশিল্পী। ফেলে দেয়া, ভাঙাচোরা এইসব কাঠ আর নাড়াকুটো দিয়ে কেমন করে বদলে দিয়েছে সবকিছু আদল! ওর কল্পনাশক্তিতে জাদু আছে। বিম্ববতী গম্ভীর হয়ে বলেছিল, ও একটা মায়াবিনী। মায়াবিনী ছাড়া কেউ এভাবে একটি বস্তুকে আর একটি বস্তুতে বদলে ফেলতে পারে! ওর চোখ আবিষ্কার করে, শিল্পের আবিষ্কার। এই সব শুকনো ডাল আর কাঠে সজীব গাছের স্পর্শ দিয়ে ও এগুলোকে আরো প্রাণময় করেছে। দেখো মানব-মানবীর এই যুগল ফিগার কী অদ্ভুত! শুদ্ধ কাঠের ওপরে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাঁসটাকে দেখিয়ে বলেছিল, আমার ইচ্ছে করে এমন হাঁস হই। বিম্ববতী নিজেকেই বলে, প্রিয়ভাষিণী বোধহয় পাখি খুব ভালোবাসে। মহাকাশের সবটুকু শক্তির আঁধার ওর করোটিতে ঢুকছে। যা কিছু স্থির তাতে ও গতি দিয়েছে। ওর কল্পনায় পাখির ডানা আছে, বিস্তার আছে। আমি তোমার মুগ্ধ দর্শক প্রিয়ভাষিণী। তুমি তা কখনো জানবে না। দুজনে সারাটা সময় সেখানে কাটিয়ে একটি ভাস্কর্য কিনে, যেখানে একটি তুলসির চারা লাগানো হয়েছে, দুটি গাছের সঙ্গে। তালিকায় লাল রঙের গোল্লা দেয়ার সময় বিম্ববতী বলেছিল, এটা পছন্দ করছি কেন জান না? শুদ্ধ আবলীলায় বলেছিল, জানি। ভুরু কুঁচকে বিম্ববতী বিস্ময়ে বলেছিল, জান না? তাহলে বলো দেখি কী জানো? শুদ্ধ বিনা দ্বিধায় বলেছিল, আমি জানি তোমার আনন্দের সময় তুলসির একটি পাতা ছিঁড়ে তুমি প্রিয়ভাষিণীর গায়ের গন্ধ নেবে। ভাববে, তুমি নিজেও প্রিয়ভাষিণী হয়ে গেছ। বিম্ববতী কণ্ঠস্বর আয়ত্তে রাখতে পারে না। একটু জোরেই বলে, ঠিক ঠিক বলেছ। এজন্যই তোমাকে আমার পছন্দ শুদ্ধ। আশপাশের লোকে ওদের দিকে তাকায়। ওরা খানিকটা বিব্রত হয়ে অন্যপাশে চলে যায়। একটু নিরিবিলিতে, যেখানে দুজনের মুগ্ধতায় ছেদ পড়ার মতো মানুষের দৃষ্টি নেই। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে দুজনে একই গল্প করে। ঘুমুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওদের গল্প ফুরোয় না। খাওয়ার টেবিলে বসে মা আর রুদ্রকে ওদের উচ্ছ্বাসের কথা শুনতে হয়। ঘুমুতে যাওয়ার আগে বিম্ববতী বলে, আমি দিন গুনছি যে কবে এই শিল্পভুবনের মেয়াদ শেষ হবে। কবে আমরা এই ভাস্কর্যটি ঘরে আনতে পারব। তখন প্রাণেশ বলে, তুই কী ভাবছিস স্যার? ভাবছি, ঢাকা একটা কুৎসিত বিশ্রী শহর। এর কোনো সৌন্দর্য নেই। এটা মানুষের বাসের উপযোগী না। ঠিক বলেছিস। আমারো তাই মনে হয়। ইদানীং মর্গে লাশ আসার ধুম পড়েছে যেন। জীবন রাখতে আর ভালো লাগছে না।। প্রাণেশের কণ্ঠস্বরে বিষাদ এবং আর্তনাদ একসঙ্গে ধ্বনিত হয়। শুদ্ধ। ধাম করে ওর দিকে তাকায়। লোকটির প্রাণের ভেতর এমন আর্তনাদ আছে তা ও কোনোদিন টের পায়নি। নিজে নিজে লজ্জিত হয়। ওকে ও বন্ধু করেছে, কিন্তু বন্ধুত্বের টান তৈরি করতে পারেনি। পারলে তো প্রাণেশকে বুঝতেই পারত, পারল না তো। তখন প্রাণেশ ওর বাম হাতে চাপ দিয়ে বলে, আমার মনে হয় ঢাকা শহরই একটা মর্গ হয়ে গেছে। মানুষ এখন নিজের ঘর ছেড়ে লাশকাটা ঘরে থাকছে। প্রাণেশ ডোম হলে কী হবে ওর ভেতরেও ভাবনা আছে। ও নিজের চারপাশ নিয়ে ভাবে। শুদ্ধ ওর দিকে না তাকিয়ে বলে, একটু আগে আমি ভেবেছিলাম ঢাকা শহরটাই একটা ডাস্টবিন। আঁস্তাকুড়ে। ঠিক রনবীর আঁকা আঁস্তাকুড়ের মতো। আমরা সবাই ওটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টোকাই। রনবী কে? মস্ত বড় শিল্পী। টোকাই একটা ছেলে। তাঁর আঁকা ছবিতে টোকাই একটি দারুণ ছেলে। কী করে ও? ও মেলাকিছু করে। সবচেয়ে বেশি করে প্রতিবাদ। ব্যঙ্গ হলো ওর প্রতিবাদের ভাষা। আর ওই ব্যঙ্গকে শিল্প করেছেন রফিকুন নবী। তুই ভাবতে পারবি না প্রাণেশ যে ব্যঙ্গের ভাষা কত তীক্ষ্ন হতে পারে। জানো রনবীর শিল্পভুবন দেখে আমার মনে হয়েছিল, শিল্পীই পারে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পিপাসা মেটাতে। আমরা নিজেদের প্রকাশ করার জন্য যখন ভাষা খুঁজি তখন শিল্পীর ছবির সামনে দাঁড়ালে মনে হয় এটাই তো খুঁজছিলাম। রনবীর ছবিতে টোকাইরা এই শহরের মানুষদের ছবি হয়। এই পাগলা শহরে এসব হয় স্যার? হয়, হয়। হয় বলেই তো আমরা ঠিকঠাক মতো খানিকটুকু বাঁচি। বাকিটা উল্টো করে বাঁচা। মাথাটা নিচে, পা জোড়া ওপরে। ভালোই বলেছ। প্রাণেশ হি... হি... করে হাসে। তখন রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, স্যার মোর মনে অয় মুইও আপনেগো লগে একখানে বইয়ে কথা কই। আপনেরা যা কইতেছেন এইডা আমাগোও মনের কথা। মুই, মোর বউ, মোর মাইয়া হগলে একটা কথাই ভাবি। বাব্বা, তুমি দেখছি একটি পরিপূর্ণ পরিবারের মানুষ। তোমার নাম কী? আজাহার। আজাহার আলী। বউয়ের নাম সুরাতুন। মাইয়ার নাম আলতা। মাইয়াডা ইস্কুলে যায়। নাইনে পড়ে। মাইয়াডার মাথা খুব ভালা। এত ভালো মাথা নিয়েও ও একটা টোকাই ছাড়া কিছু না আজাহার আলী। এই শহরে তোমার মেয়ে পার্কের কাঠের বেঞ্চের ওপর উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। ভীষণ একা। ওর চারপাশে কেউ থাকবে না। শুধু ভয়াল অন্ধকার ছাড়া। ভুল বলেছিস স্যার। ওর চারপাশে কাকেরা থাকবে। কালো রঙের কাক। হ্যাঁ সত্যি, ওর চারপাশে কাকেরা থাকবে। রনবীর ছবিতে টোকাইর পাশে কাকেদের অবস্থান। কাকেরা এইসব ছবিতে নানা অর্থের প্রতীক। তুই স্যার মাঝে মাঝে আমাদের ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাস। তোর। ভাষা অন্যরকম হয়ে যায়। শুদ্ধ হা... হা... করে হাসে। প্রাণেশ ঠিকই বলেছে। ও কখনো নিজের জগতে ঢোকে। যে ভাষা ওরা বোঝে না। যে শিল্পীর কথা বললি তুই তাকে ভালোবাসিস স্যার? হ্যাঁ, ভীষণ ভালোবাসি। আমার প্রিয় মানুষ। তোর শিল্পী তোর একথা জানে? জানে না। আমার সঙ্গে তো তার কথা হয়নি কোনোদিন। দেখেছ? দেখেছি দূর থেকে। কাছে যাইনি। যাও না কেন? ভয় পাই। ভীষণ ভয় পাই। শিল্পীকে আবার ভয় কিসের? সে তো বাঘও না ভালুকও না। সে তুই বুঝবি না প্রাণেশ। আজাহার আলী আবার ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, মোর মাইয়াডারে ওই ছবি দেহাইবেন স্যার? হ্যাঁ, দেখাব। আজ বিকেলেই দেখাব। তুমি ওকে নিয়ে আসতে পারবে? পারমু স্যার। খুব পারমু। মোর বউরেও লইয়া আসুম। কোথায় থাক? কামরাঙ্গীর চরে। ঠিক আছে তোমরা আসো। বিকেল পাঁচটায় তোমরা আসবে ধানম-ি চার নম্বর রোডে চিত্রক গ্যালারিতে। পারবে তো আসতে? রিকশা চালাই স্যার। রাস্তা খুঁইজা বাইর করতে পারুম না? কী যে কন! মোর মাইয়াডা খুব খুশি অইব। প্রাণেশ বলে, আজাহার ভাই, তুমি ওই দিকে যাও। আমরা এসে পড়েছি। সামনে আমার বাড়ি। এইখানে থামো। আজাহারের আর ভাড়া নেয়া হয় না। লজ্জা পায়। রিকশা ঘুরিয়ে কোনো কথা না বলে চলে আসে। শুদ্ধর মনে হয় ও দক্ষিণাঞ্চলের কোনো একটি চরের মানুষ হবে। নদী ভাঙনে সব খুইয়ে শহরবাসী হয়েছে। উদ্বাস্তু জীবনের গ্লানি ভুলতে টোকাইয়ের মতো হাসিমুখে বেঁচে থাকা সহজ করতে চায়। কে জানে মেয়ের গল্পটি সত্য কিনা! মেয়ের কথা ভালো বলে গল্প সাজিয়ে নিজেকে বড় করে তোলার ভিন্ন প্রয়াস। পরক্ষণে নিজের ভাবনায় লজ্জিত হয় শুদ্ধ। ভাবে, লোকটিকে আমি অবিশ্বাস করছি কেন? অবিশ্বাস করার মতো অন্যায় কাজ তো ও করেনি। ওতো বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মানুষ। আঁস্তাকুড়ের ভেতরে বাস করা বুড়ো টোকাই। যৌবনহীন, স্বপ্নহীন, প্রাণহীন এবং ছায়াহীন মানুষ। ওর নিজের সঙ্গে আজাহার আলীর বড় কোনো পার্থক্য নেই। শুদ্ধ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মোছে। ধুলো এবং ঘামে চ্যাটচ্যাট করছে তুক। মোছার ফলে তা আরো চেপে বসে এবং মুখজুড়ে চুলকানির ভাব হয়। প্রাণেশ পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলছে। শুদ্ধ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, সোমেন কৈ? স্কুলে গেছে। শুদ্ধ জানে বাবা-ছেলের কাছে দুটো চাবি আছে। যে যখন আসে সে তখন ঘর খোলে। যে যেমন পারে রান্নাবান্না করে। দুজনের তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। প্রাণেশ দুকাপ চা বানিয়ে আনে। লেবু চা। সঙ্গে একডালা মুড়ি। শুদ্ধর এতক্ষণে মনে হয় ওর খিদে পেয়েছে। ও একমুঠি মুড়ি মুখে পোরে। প্রাণেশ এক চুমুক চা গিলে বলে, আজ ওই ছেলেটি এসেছিল। শুদ্ধ ভুরু কুঁচকে তাকায়। কোন ছেলেটি? একটি মেয়ে রোকেয়া হলের সামনে বাস চাপা পড়ে মারা গেলে তুই ওকে নিয়ে এসেছিলি। আমার নাম মনে নেই। ওর নাম সুনন্দ। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। কিন্তু ও মর্গে এসেছিল কেন? ভোরবেলা এসে আমাকে বলল, প্রাণেশদা আমাকে অল্পক্ষণের জন্য মর্গের ভেতরে নিয়ে যাও না। ও যেখানে শুয়েছিল আমি সেখানে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে চাই। এই দেখ আমি মাটির খুপরি আর সলতে এনেছি। আমি তো ওর কথা শুনে হ্যাঁ বলি, বলছেন কী দাদা! কতক্ষণ জ্বলবে আপনার প্রদীপ? ও বলল, আপনার যখন ইচ্ছা হবে তখন নিভিয়ে দেবেন। আর ওটা যদি জ্বলে জ্বলে শেষ হাওয়ার সময় পায় তাহলে জ্বালিয়ে রাখবেন। সঙ্গে আমি একটি পদ্মকুঁড়ি রাখব। পদ্মকুঁড়ি ওর খুব পছন্দ ছিল। আপনি আমাকে একটু সুযোগ করে দেন দাদা। তুমি কী করলে? চলে যেতে বললানি তো? প্রাণেশ চুপ থাকে। চা শেষ করে বলে, আমি ওকে ভেতরে নিয়ে গেলাম। না নিয়ে কি উপায় ছিল? ওর বড় বড় চোখ দুটোতে জল টলমল করছিল। আহারে, পুরুষ মানুষের এত মায়াবী চেহারা আমি কখনো দেখিনি। বিশ্বাস কর স্যার আমার মনে হচ্ছিল প্রীতির মৃত্যুতেও আমি এমন কষ্ট পাইনি। আমার বুক ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। আমি ওকে নিয়ে ভেতরে গেলাম। ও প্রদীপ জ্বালিয়ে চুপ করে বসে থাকল, কাঁদল। আমিও ওর পাশে বসে থাকলাম। মনে মনে ভগবানকে ডেকে বললাম, ছেলেটার মনে শান্তি দাও প্রভু। ওর কষ্ট ভুলিয়ে দাও প্রভু। শুদ্ধর আর চা খাওয়া হয় না। মুড়িও না। সুনন্দর মুখটা খুব মনে পড়ে। ও তো অন্যরকম ছেলেই ছিল, কম কথা বলা, ভুরু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করা, খারাপ-মন্দ ব্যবহার করে কেউ কথা বললে রেগে যাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে ঘুরে বেড়ানো পথশিশুদের মুড়ি আর পাউরুটি দেয়া, দিনের বেশিরভাগ সময় লাইব্রেরি বা শাহবাগের বইয়ের দোকানে কাটানো, মহিলা সমিতিতে নাটক দেখা ইত্যাদি নিয়ে ওর দিনগুলো ওর মতোই ছিল। অনিতা কি ওকে ভালোবাসত? শুদ্ধ ভুরু কুঁচকে তাকায়। স্পষ্ট মনে পড়ে ওর যে অনিতা ওকে একদিন কী কথা প্রসঙ্গে যেন বলেছিল, সুনন্দ একটা পাগল। ও এতই ভালো যে ওর সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকলে সবকিছু শীতল হয়ে যায়। সুনন্দ একতরফা অনিতাকে ভালোবেসেছে। প্রাণেশের কাছে আজকের ঘটনা শুনে শুদ্ধর বুক তোলপাড় করে। প্রাণেশ ওকে মিথ্যা বলেনি। তাহলে সুনন্দর আবেগ কি এতই গভীর! মর্গে এসে প্রদীপ জ্বালিয়ে ভালোবাসা স্মরণ করে? এও কি সম্ভব? ঠা-া হয়ে যাওয়া চা ও একটানে শেষ করে। বুঝতে পারে না মানুষের ভেতরের রহস্যকে। ও ভাবল, থাকুক মানুষের ভেতরের রহস্যটুকু থাকুক, এই রহস্যই মানুষের জীবনকে গতি দেয়। তাই কি? থমকে যায় শুদ্ধ। না বোধহয়, ওর চিন্তাটা ঠিক হলো না। রহস্য কোনো সমাধান দেয় না। রহস্য মানুষের জীবনকে জটিল করে। আজকের ঘটনায় সুনন্দকে নিয়ে ও ভীষণ ভাবনায় পড়ে। ও কি পারবে ওর এই মানসিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে। স্যার, তুই কী ভাবছিস? সুনন্দর কথা। তুই যা বললি তা শুনে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোর চারপাশে যারা আছে তাদের অনেকের নানা সমস্যা আছে। তোকে ঘিরে ওরা সবাই ঘুরপাক খায়। তুই যেন ওদের দুই হাতে সামাল দেওয়ার জন্য জন্মেছিস। আমিও তোর জীবনের একটা কাঁটা। তোর কাঁটা ফুটো করলে আমি আনন্দ পাই। তুই আমার ভীষণ কাছের মানুষ প্রাণেশ। একসময় তুই আমাকে ভুলে যাবি। কেন ভুলব? কখনোই ভুলব না। তোকে ভোলা কঠিন। প্রাণেশ গড় হয়ে ওকে প্রণাম করে। পা জড়িয়ে ধরে। শুদ্ধ ব্যস্ত হয়ে পা টানতে টানতে বলে, কী পাগলামি করছিস প্রাণেশ! তুই আমাকে অপমান করলি। তুই না আমার বন্ধু? প্রাণেশ চোখ মুছতে মুছতে বলে, অত কিছু বুঝি না। মন চাইল করলাম। ভালোবাসি বলেই তো করতে পারলাম। আজ তোর ওই ছেলেটা আমাকে খুব শিক্ষা দিয়েছে। মানুষকে ভালোবাসলে এমন করেই বাসতে হয়। প্রাণেশ গামছা দিয়ে চোখ মোছে। বিড়বিড় করে কী যেন বলে। হয়তো কারো জন্য প্রার্থনা করছে- হয়তো কারো জন্য ওর বুকের ভেতর প্রবল টান উঠেছে। ও বলেছে শহরটা মর্গ, আমি বলেছি ডাস্টবিন। তাহলে দুটো মিলে শহরটা কী! শুদ্ধ প্রাণেশের মুখ দেখে একদৃষ্টে। তারপর মৃদু স্বরে বলে, তুই কার জন্য প্রার্থনা করছিস? নিজের জন্য। নিজের জন্য? অবাক করলি। তোর কী হয়েছে যে নিজের জন্য প্রার্থনা করতে হবে? সে কথা বলতেই তো তোকে ডেকে এনেছি। আশ্চর্য, আমি ভুলে গিয়েছি যে তোর কথা শুনব বলে আমরা এখানে এসেছি। আমি ভুলিনি। তোর সঙ্গে সময় কাটিয়ে আমি নিজের ভেতরে সাহস জুগিয়েছি। সময় নিয়েছি। মনে মনে ভেবেছি এরমধ্যে তুই যেন আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করিস। কী হয়েছে প্রাণেশ? আমাকে একদল সন্ত্রাসী মানুষ খুন করে টুকরো টুকরো করে দিতে বলেছে। প্রাণেশ!- শুদ্ধ লাফিয়ে ওঠে। ওর ছোট্ট ঘরে ভূমিকম্প হলে মানুষ যেমন বিহ্বল হতো, তেমন বিহ্বলতায় ও অস্থির হয়ে একবার বাইরে যায়, একবার ভেতরে আসে। কিন্তু স্থির হয়ে বসে থাকে প্রাণেশ। শুদ্ধ শান্ত হয়ে ফিরে আসে ঘরে। ওর পাশে বসে বলে, সন্ত্রাসীরা তো গুলি করলেই একজন মানুষ মরে যায়। প্রাণেশ নিরস কণ্ঠে বলে, ওরা চায় গুলি করা দেহের টুকরো টুকরো খ-। যেন আমি মানুষ জবাইয়ের কসাই। ওই টুকরোগুলো শেয়াল-কুকুরের জন্য ছড়িয়ে দেয়া হবে। আহ্, চুপ কর প্রাণেশ! প্রাণেশ আপন মনে বলতে থাকে, আমি ওদেরকে চিনি না। ওরা কাকে খুন করবে জানি না। শুধু জানি ওরা তারিখ ঠিক করলে আমাকে নিতে আসবে। আমাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাবে। আর এ কথা যদি কাউকে বলি তাহলে আমাকে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু তোকে না বলে তো আমি থাকতে পারব না। আমার কিছু ঘটলে তোকেই তো জানতে হবে। আমার ছেলে সোমেনকে তোর দেখতে হবে। দেখবি না? শুদ্ধ কথা বলে না। ওর স্তব্ধতার ঘোর কাটে না। ও নিশ্চুপ বসে থাকে। বুঝতে পরে না যে এটা কেমন সময়! এ কেমন দুর্ভিক্ষ মানুষের জীবনে! তখন গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে প্রাণেশ। বলে, দু’মুঠো ভাত চাপাই। খাবি তো? খাব। শুদ্ধর মনে হয় ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। একবুক তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। ও চারদিকে তাকায়। মুহূর্তে মনে হয় ঘরটা নড়ছে- এই বুঝি পড়ে যাবে। ও প্রাণেশের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতে পারে না ভয়ে। ও কি ভেঙে পড়া ঘরের ইট-বালুর নিচে চাপা পড়ে যাবে! ও তাকিয়ে থাকে ছাদের দিকে। স্যার? প্রাণেশ এসে বিছানার পাশে দাঁড়ায়। কী বলবে বলো। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। গত রাতে শূকরের মাংস রান্না করেছিলাম। তুই খাবি? খাব, প্রীতির মতো রান্না করেছিস তো? আমি কি ওর মতো রাঁধতে পারি! রান্না গুবলেট হলে সব তোর থালায় যাবে কিন্তু। নিষ্ঠুরের মতো কথা বলিস না। ওই যে আমার ছেলে আসছে। যাই থালাগুলো ধুয়ে ফেলি। জলের গ্লাসগুলো মাজতে হবে। সোমেন ঢোকে ঘরে। ও স্কুলের ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে ঘরের কোনায়। কৃষ্ণবর্ণ গায়ের রঙ ওর। হাসলে দাঁতের সারি চকচক করে। স্বাস্থ্য ভালো। ওর বালক বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। বয়সের সন্ধিক্ষণ এখন। কণ্ঠস্বর ভেঙে গেছে। ওর সঙ্গে বেশ জমে শুদ্ধর। ও শুদ্ধকে দেখে একগাল হেসে বলে, কাকু তুই কখন এসেছিস? সকাল থেকেই তোর বাপের সঙ্গে লেগে আছি। আমার বাপটার মধ্যে তুই যে কী মজা খুঁজে পাস আমি বুঝি না। তোর মধ্যেও আমি খুব মজা খুঁজে পাই রে সোম। তা জানি। তুই আমাকে ভালোবাসিস কেন? হয়েছে এসব হেঁদো কথা রাখ। আয় আমরা দেখি তোর বাপকে সাহায্য করতে পারি কি না। বাবা কি তোকে ভাত খেতে বলেছে? আমিই খেতে চেয়েছি। শূকরের মাংসটা কেমন বেঁধেছে রে? রাতে খেয়েছিস না? রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। কেন? ওই মাংসের তরকারি খেতে পারিনি বলে। বাবা যা রেঁধেছে না! তোমারও আজকের খাওয়া মাটি! চুপ, আস্তে বল। তুই বলে ভালোই করেছিস। আমি বেশ মজা করে খাব। কেন? বাবাকে খুশি করতে? হ্যাঁ, তাই। তাহলে দশটা টাকা দাও। ডিম কিনে আনি। আমি ডিম-ভাজি খাব। শুদ্ধ ওকে টাকা দেয়। সোমেন দু’লাফে বাড়ির দরজা পার হয়ে যায়। প্রাণেশ বলে, আমি ছেলের কথা সব শুনেছি। আসলে ও আমার রান্না খেতে চায় না। কেবলই মায়ের সঙ্গে তুলনা করে। বলে, মায়ের মতো রাঁধতে পারো না কেন? মাইরি বলছি, আমি কিন্তু খারাপ রাঁধিনিরে স্যার। হয়েছে, আমার সঙ্গে ভনিতা করতে হবে না। আমি সব খাব দেখিস। আমার খিদে পেয়েছে প্রাণেশ। আয় বোস। আমি দিচ্ছি। প্রাণেশ ঘরের মেঝেতে পিঁড়া পেতে দেয়। হাঁড়িকুড়ি, থালাবাসন নিয়ে আসে। থালায় ভাত বাড়ে। শুদ্ধ নিজের থালাটা টেনে নিয়ে গোগ্রাসে খায়। খেতে ওর ভালোই লাগে। একটানে কয়েকটা লোকমা খেয়ে ঘাড় নেড়ে মৃদু হেসে প্রাণেশকে বলে, ভালো রেঁধেছিস। সত্যি? সোমেনকে বল। আমি শুনেছি বাবা। আর বলতে হবে না। আমার ডিম ভাজা হয়ে এলো। কাকু তুমি আস্তে খাও। তারপর বলবে কারটা ভালো হয়েছে। এত বলাবলির মধ্যে আমি নেই। তুই ডিম ভাজি নিয়ে আয়। বলেই শুদ্ধ হা... হা... করে হাসে। কিন্তু বেশিক্ষণ হাসতে পারে না, ভুরু কুঁচকে বলে, প্রীতি মরে তোদের একটা প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দিয়েছে। ও বেঁচে থাকলে তোরা বাপ-বেটা কি এমন সুযোগ পেতি? প্রাণেশ ঘাড় গোঁজ করে বলে, প্রীতি কি কাজটা ভালো করেছে? শুদ্ধ চুপ করে থাকে। বিষয়টা এভাবে ওঠানো ওর খুব অন্যায় হয়েছে। অপরাধের গ্লানিতে মুষড়ে পড়ে শুদ্ধ। চুপচাপ শূকরের মাংস চিবোয়। সোমেন ডিম ভাজা নিয়ে এলে বলে, দারুণ ভাজা হয়েছে। গন্ধেই টের পাচ্ছি। দে, আমাকে ছোট এক টুকরো দে। সোমেন থালা টেনে খেতে বসলে ওদের আর কোনো কথা হয় না। তিনজনের বুকের ভেতর প্রীতি ভর করে। একটু আগে শুদ্ধ যে কথা বলেছে তা তিনজনকেই পীড়িত করে। সোমেন দু’মুঠো খেয়ে থালা ঠেলে উঠে পড়ে। আমি আর খেতে পারছি না বাবা। আমি বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে হাঁড়িকুড়ি, থালা-গ্লাস মেজে রাখব। তুমি রেখে দিও। ধরবে না কিন্তু। আসছি কাকু। সোমেন কারো কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে দুই লাফে বেরিয়ে যায়। শুদ্ধ বলে, ও কোথায় গেল রে? গেল না, পালাল। এখন মন্দিরে বসে মায়ের কথা মনে করে কাঁদবে। আমাকে তুই ক্ষমা করে দে প্রাণেশ। প্রাণেশ উত্তর দেয় না। ওর দিকে তাকায় না। মুখ নিচু করে থালার ভাত ক’টা শেষ করে ঢকঢকিয়ে জল খায়। সে শব্দ শুনে শুদ্ধর মনে হয় লোকটার বুকের ভেতরে দারুণ পিপাসা! তারপর বাম হাত দিয়ে প্রাণেশের ঘাড় খামচে ধরে বলে, তোর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের শেষ কথা কী হয়েছে রে? কোনো শেষ কথা নেই। হয় ওদের কথা শুনে গরুর মতো মানুষ কেটে টুকরো বানাব, নয় মরণ। ওদের মানুষ টুকরো করে দিলেও কি বাঁচতে পারবি? প্রাণেশ নির্বিকার কণ্ঠে বলে, না। তুই এতকিছু বুঝিস আর এটা বুঝতে পারিস না স্যার? খুনিদের চেহারা চিনে রাখার অপরাধে আমাকে মরতে হবে। শুদ্ধ হাত ধোয়ার জন্য গ্লাসের পানি নিয়ে ঘরের পেছন দিকে যায়। উঠোনে ভর দুপুরের রোদ বিছিয়ে আছে। গাছের ডালে বসে থাকা কাকের কর্কশ কণ্ঠের ডাক চারদিকে চৌচির করছে। পাখিটাকে ভালোবাসা যেত যদি ডাকটা মধুর হতো, শুদ্ধর ভাবনা চিড় খেয়ে যায়। বুকটা কেমন করে। বিম্ববতীর কথা মনে হয়। একদিন বিম্ববতী কি প্রীতির মতো আত্মহত্যা করবে! ওর লাশটা কেটে দু’ফাঁক করবে প্রাণেশ! শরীর শিউরে ওঠে ওর। নাকি সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়ে ও নিজেই লাশকাটা ঘরে চালান হয়ে যাবে? উফ, কী হলো আজ। শুদ্ধ একটা ঢিল ছুড়ে কাক তাড়িয়ে দেয়, কিন্তু নিজের ভেতরটা খালি করতে পারে না। ওখানে রাজ্যের আবর্জনা জমেছে। এই মুহূর্তে ওর নিজের বুকটাই একটা ডাস্টবিন। একটু পরে প্রাণেশ ওর জন্য একটা মিষ্টি পানের খিলি নিয়ে আসে। নে খা। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি তোকে টাইম মতো জাগিয়ে দেব। ঘুমুব না। ঘুম আসবে না। তারচেয়ে বরং চিলক গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে আজাহার আলীর জন্য অপেক্ষা করি। ওর মেয়ে আলতাকে দেখার খুব সাধ হয়েছে। আজাহার আলীর মতে, ওর মাথা ভালো। আমি ওকে টোকাই বোঝাব। এই শহরে আমরা সবাই টোকাই সে কথা বলব। ওকে আর একটি কথা বলব! শুদ্ধকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে, কী বলবি? বল আমি শুনব। সবার আগে ভালো কথা শুনতে চাই। ভালো কথা নয় রে প্রাণেশ। আলতাকে বলব, মামণি তুমি মা হবে। বিয়ে করে বা না করে কোনোভাবেই না। এই শহর শিশুদের বাসের উপযুক্ত নেই। হা... হা... করে হাসে প্রাণেশ। হাসতে হাসতে বলে, তাহলে তুই কী করবি স্যার? আমি আর বিম্ববতী ঠিক করেছি আমরাও কোনো বাচ্চা নেব না। আমি সোমেনকেও তাই বলব। ওরা তোর কথা শুনবে কেন? শুনবে না। তবু আমি বলে যাব। যাই রে প্রাণেশ। আবার কবে দেখা হবে? কাল, পরশু, প্রতিদিন। মনে রাখিস প্রতিদিন। যদি আমি নিখোঁজ হয়ে যাই খোঁজার চেষ্টা করিস না। শুদ্ধ কথা না বলে বেরিয়ে আসে। রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। নিজেকে বলে, কৃষ্ণবর্ণ চকচকে ঘাম চমকানো রিকশাওয়ালার পঙ্খিরাজে সওয়ার হয়েছি। আসলে এত মানুষের মধ্যে ও যে নিঃসঙ্গ সে কথাই ওকে পেয়ে বসে। নিঃসঙ্গতা বড় বিচিত্র, বড় দ্রুতগামী- অল্প সময়ে প্লাবিত করে অনেকটা জমি। বুঝে পায় না, দুঃখ কিসের এবং কোথায়। ওর ঘর আছে। পৈতৃক বাড়ি আছে। বাবার ব্যবসায় সঙ্গী হয়েছে। মা ঘর-দুয়ার সামলায়। ছোটভাই আড়ার সঙ্গী হয়। বিম্ববতীর ভালোবাসায় অবিশ্বস্ততা নেই। তবু মাঝে মাঝে নিজেকে টেনে তোলা কঠিন হয়। রিকশাওয়ালা ভিড় ঠেলে এগুচ্ছে। লালবাতির সামনে থেমে থাকছে। আর ওর মনে হয় যানজটে আক্রান্ত এলিফ্যান্ট রোডটা বুঝি অসীমে গিয়ে মিশেছে। সসীম থেকে অসীমে লালবাতি আর অসীম থেকে সসীমে এসে মিশেছে হলুদ বাতি। লাল বুঝি বিদায়ের ঘণ্টা বাজায় অর্থাৎ থেমে যাও, এগিও না। আর হলুদ মানুষের সামনে সরষে ফুলের ভ্রান্তি তুলে ধরে। তাহলে সত্যটা কোথায়? ওটা কি এই শহরে আর নেই? সবুজ বলে কোনো রঙ আছে কি এই শহরের মানুষের দৃষ্টির সামনে? গাড়িগুলোকে মানুষ মনে হয় ওর। অকারণে দৌড়াচ্ছে, আর মানুষেরা অদৃশ্য হয়ে গেছে। বড় অদ্ভুত দৃশ্য! এমন কি একটা সিনেমা হতে পারে? তাহলে ও নিজে ক্যাফে আড়ংয়ের দড়িতে কাঠের চেয়ারে বসে কফি খেতে খেতে আট ফুট উঁচু কাচের মনিটরে দেখত সিনেমাটা, তাহলে সিনেমাটার নাম কী হতো? বোকা, এমন ভাবনার কোনো যুক্তি নেই। আসলে প্রাণেশের জীবনের হুমকি এখন ওর ভাবনার বিষয় বলে ও ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর এমন অলীক ভাবনার ভেতরে আশ্রয় খুঁজছে। খোঁজাটাই সত্য। এর ভেতরে যুক্তি-অযুক্তির প্রশ্ন নেই। ও মাথা পেছনে হেলিয়ে আকাশ দেখে। মানুষের আকৃতি ওর কাছে এই মুহূর্তে কঠিন সমস্যা। সব মানুষই একরকম এবং প্রত্যেকের দৃষ্টি বুনো। একজন খুনি যেভাবে তাকায় সেরকম। প্রত্যেকের দৃষ্টি তাক করে আছে প্রাণেশের হৃৎপি-। মৃত্যু খুব কাছে। শুদ্ধর শরীর শীতল হয়ে জমাট হতে থাকে। ওর আর আকাশ দেখা হয় না। ও বুঝতে পারে ওর দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে। ও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, কুন দিকে যামু স্যার? ডানে যাও। রিকশা ধানম-ির চার নম্বর রাস্তায় ঢোকে। শুদ্ধ ওকে দেখিয়ে দিলে চিলক গ্যালারির সামনে এসে দাঁড়ায়। ও চারদিকে তাকায়। কোথাও আজাহার আলী নেই। ও ভেবেছিল আজাহার আলী হয়তো অধীর আগ্রহে ওর বউ আর মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ওর মাথা ভালো আলতা নামের মেয়েটি উৎসুক হয়ে থাকবে শিল্পের ক্যানভাসে টোকাইকে দেখার। কিন্তু না, সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরও আজাহার আলী ওদের নিয়ে আসে না। প্রবল মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফেরে শুদ্ধ। দরজা খুলে দেয় ওর মা। বাড়িটা বেশ সুনসান। অন্যরা আছে বলে মনে হয় না। ছেলেকে দেখেই মায়ের জিজ্ঞাসা, সারাদিন কোথায় ছিলি বাবা? দুপুরে খেতে আসিসনি। একটা ফোন করিসনি। মাগো, তোমার সব কথার জবাব পরে দিচ্ছি। আগে গোসল করে নেই। বিম্ববতী কই? ভাইবোনদের কাছে গেছে। ছোটভাইটি অসুস্থ। ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। রাতে ফিরবে না বলেছে। তুমি চা দাও মা। আমি আসছি। তোর আর একটি খবর আছে বাবা। সুনন্দ এসেছিল। একটা প্যাকেট রেখে গেছে। বলেছে, ওর ভেতরে একটা লেখা আছে। তুই যেন পড়িস। শুদ্ধ আচ্ছা বলে বাথরুমে ঢোকে। দ্রুত গোসল সারে। বেশ আরাম লাগছে। এতক্ষণে বুঝতে পারে যে সারাদিনে ওর ওপর দিয়ে ধকলই গেছে। কোনো সময়ই ওর আনন্দের ছিল না। যেটুকু হেসেছে সেটা জোর করে হাসা। যেটুকু আড্ডা দিয়েছে তার ভেতর কাঁটা ছিল। যেটুকু ভেবেছে শুধু সেটুকুতেই ওর খানিকটা আশ্রয় ছিল। মাকে কি প্রাণেশের কথা বলবে? হ্যাঁ, বলবে। বলাটাই ঠিক হবে। বললে নিজের ভার লাঘব হবে। চা আর সুজির হালুয়া খেতে খেতে শুদ্ধ প্রাণেশের হুমকির ঘটনা বললে আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে যায় মায়ের চোখ। ওর বাম হাতটা কঠিন করে চেপে ধরে বলে, ডোম প্রাণেশের সঙ্গে তোর বন্ধুত্ব হলে আমি কত রাগারাগি করেছিলাম। বলেছিলাম, ডোমের সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব হয় নাকি! এখন দেখছি তোর আর আমার চেয়ে ওর জীবন বেশি হুমকির মুখে পড়েছে। ও মোটেই ছোট মাপের মানুষ নারে শুদ্ধ। মায়ের তীব্র আকুতি শুদ্ধকে স্পর্শ করে গভীরভাবে। ওর চোখে জল এসে যায়। তখন ফোন বাজলে ফোন ধরার জন্য উঠে যায়। অপরপ্রান্তে সুনন্দ। শুদ্ধ ভাই, আমি একটা লেখা আপনার পড়ার জন্য রেখে এসেছি। মা দিয়েছে। মাত্র বাড়ি এসেছি। পড়া হলে আমি তোমাকে ফোন করব। রাত বেশি হলে তোমার অসুবিধা নেই তো? কত রাতে করবেন? বারোটার পরে। তখন আমি বাড়ি থেকে বের হব। তিনটা পর্যন্ত বাইরে থাকব। এত রাতে কোথায় যাবে? রোকেয়া হলের সামনে যেখানে অনিতার দুর্ঘটনা হয়েছিল সেখানে গিয়ে বসে থাকব। প্রদীপ জ্বালাব। রবীন্দ্রসংগীত গাইব। ও গান শুনতে ভালোবাসত। আপনি তো জানেন শুদ্ধ ভাই, আমি রবীন্দ্রসংগীত ভালো গাই। আপনাকে ফোনে একটা গান শুনাই? শুদ্ধর উত্তরের অপেক্ষা না করে ও গাইতে থাকে, আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনই লীলা তব। গাইতে গাইতে সুনন্দ কেঁদে ফেলে। শুদ্ধরও চোখ জলে ভিজে যায়। গান শেষ না করে লাইন কেটে দেয় ও। ছেলেটা কি পাগল হয়ে যাবে? ভয়ে শুদ্ধর বুক কাঁপে। ও দ্রুতপায়ে ঘরে আসে। বিছানার দিকে নজর পড়তেই অবাক হয়। বিছানার ওপর বিম্ববতীর ব্রা, প্যান্টি, একটি গোলাপের কুঁড়ি এবং সাদা কাগজে লেখা, ‘আজ রাতে কাছে থাকছি না। এগুলো তোমারই জন্য।’ শুদ্ধ মৃদু হেসে কাগজটা পড়ে আবার গোলাপ কুঁড়ির নিচে রেখে দেয়। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সুনন্দর পাঠানো খামটা খুলে বের করে। প্রতিটি কাগজের পৃষ্ঠায় সুগন্ধী মাখানো। ভয়ে শিউরে ওঠে শুদ্ধ। ছেলেটির কী হবে বলা মুশকিল। ও পড়তে শুরু করে। তার ছিল দুটি চোখ, অবিশ্বাস্য রকমের, তার দিকে তাকালে আমার হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যেত। মনে হতো মানুষ কেমন করে এই চোখ নিয়ে তাকায়, কিংবা ঘুমোয়, এই চোখ কি প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য, নাকি অলৌকিক আলো ছড়িয়ে রাখার জন্য, যে দীপশিখায় উড়ে আসে শত শত পতঙ্গ? আমি কিছুতেই মানতে পারতাম না যে এই চোখ ব্যবহার্য অঙ্গ, যে অঙ্গ না থাকলে মানুষের দিন-রাত ফুরিয়ে যায়, অনন্ত। অন্ধকার তাকে গ্রাস করে। আমি যখন তার দিকে তাকাই আমি বিশ্বাস করি ওই চোখ আমারই এবং ওই চোখের ভাষা শুধু আমিই পড়তে পারি, আর কেউ না, আর কেউ পারবে না। ওই ভাষা পড়ার জন্য আমার তৃতীয় নয়ন আছে, সাধারণ দুই চোখের সাধ্য নেই ওই ভাষা পড়ার। আমি আশাবাদী হই, ভাবি ও ঠিকই একদিন আমার দিকে তাকাবে, ওকে তাকাতে হবে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার কয়েকটি বই তো আমার ফেরত দেয়া হয়নি, দিয়ে দেব একদিন, হঠাৎ করেই, একটুও ভাববেন না। কথাগুলো বলে একটু হাসলে ওর মোহনীয় ভঙ্গি আমার হৃদপি-ের ধুকপুক শব্দ বাড়িয়ে দেয়। ও কত সহজ, স্বাভাবিক, আর আমি আড়ষ্ট হয়ে থাকি, কারণ আমার হৃদয়ে ভালোবাসার হামাগুড়ি দুহাত ছড়িয়ে সবটুকু জায়গা দখল করে রেখেছে, আমি সহজ হতে পারি না। আমি শুধু মাথা নাড়ি। ও চলে যায় বান্ধবীদের সঙ্গে। আমি নিজেকে বলি, আমার কাছে যে রয়ে যায় কত কিছুই পাওনা তোমার, সেই কথা আমি বলি না তো, একদম না। একবারও না। সেই তো শুরু, আমার ভালোবাসার, বড়ই একতরফা, বড়ই অপ্রকাশিত। তবু কখনো ও যেন আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে না পারে সেজন্য আমি সরাসরি ওর দিকে তাকাই না, দৃষ্টি নত রাখি, আমি সুনন্দ অমরজ্যোতি হক। আমার বাবা অসীম মোহন হক, আমার মা আয়শা মধুমালা হক, আমার বোন সোনিয়া দীপান্বিতা হক, আমাদের পরিবার। আমার গোপন ভালোবাসার কথা কেউ জানে না, কাউকে জানাই না, অনেক সময় গভীর রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা গুনতে দেখলে মা জিজ্ঞেস করে, কি করছিস সুনন্দ? আমি বলি, বিশ্বের রহস্য তুমি বুঝতে পারো মা? আমার মা পাশে এসে দাঁড়ায়, ঘাড়ে হাত রাখে, আদর করে, তারপর আদুরে গলায় বলে, আমি কি তোর মতো রাতদিন মোটা বই পড়ি যে বিশ্বের রহস্য বুঝব? যা ঘুমুতে যা। তুমি ঘুমোও মা। তুমি যাও। বেশি রাত জাগিস না কিন্তু। মা চলে যায়। আমি মাকে বলতে পারি না রাত জাগা আমার নিয়তি। রাত না জেগে আমার উপায় থাকে না, আমার চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে যায়। আমার সামনে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকে অপ্রতিরোধ্য অনিতা হাসান, পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা, ছিপছিপে শরীর, দারুণ ফিগার। বন্ধুরা কেউ কেউ বলে, মেয়েটি মাধুরী দীক্ষিতের মতো। ঈর্ষায় আমার বুক পুড়ে যায়, সেদিন আর ক্লাসে মন বসে না আমার। অধ্যাপকের মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সীমানা খুঁজতে চাই, নতুন দেশ আবিষ্কার করতে চাই, ইতিহাসের সময়ে চলে যেতে চাই, শুধু ইচ্ছে করে সকলের চোখের আড়াল থেকে অনিতাকে সরিয়ে রাখতে। আমি চাই অনিতার জীবনকে আমার আয়ু দিয়ে একটি লক্ষ্মণরেখা টেনে দিতে, এই গ-ির বাইরে আমি যাব না, ও যাবে না, আমরা দুজনে এখনো একসঙ্গেও ওই রেখা অতিক্রম করব না। কিন্তু আমি জানি গ-িরেখা পার হওয়ার উপায় অনিতা জানে। আমি জানি না। আমি কী করে জানব অনিতা, আমি যে তোমাকে ছাড়া আর কিছু বুঝি না, তুমি আমার সবটুকু দখল করে রেখেছ, যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে আপেল মাটিতে নামে, আমার জীবনে তুমি সেই শক্তি, যে আমার সবটুকু কেড়ে রেখে মাটিতে নামে। আমার আর কোনো আশ্রয় নেই, থাকেও না। খুব সহজে বড় একটি পঙ্ক্তি লিখলাম, এই লেখার ভেতরে তুমি যে কোথায় তা তুমি ঠিকই বুঝবে। এখন আমি নিজেকে বলি, মোটা মোটা বইয়ে ভালোবাসার এসব কথা লেখা নেই, তাই গভীর রাতে আমি নিজে ভালোবাসার একটি বই লিখতে শুরু করি, যেটা শুধুই অনিতাকে নিয়ে আমার কথা। এসব না লিখলে আমার উপায় নেই, এটি এই মুহূর্তের বেঁচে থাকার সম্বল। আমি গোলাপকুঁড়ির কথা লিখি, একদিন ওই কুঁড়িটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে টিএসসির মাঠে হাঁটার সময় অনিতার চুল থেকে খসে পড়ে। সবার অলক্ষে ওই কুঁড়িটি কুড়িয়ে আমি পকেটে রাখি। ভাবি, এটা কি শুধুই একটা গোলাপ কুঁড়ি, নাকি অন্যকিছু? লুকিয়ে এনেছি কুঁড়িটি, সযতেœ, মাঝে মাঝে দেখি, লজ্জা পাই, তাও দেখে ফেলি টুক করে, দেখার প্রবল ইচ্ছা হয় যে, নিজেকে সামলাতে পারি না, অনুভব হয় সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে টের পাই, যা না হবার কথা, তাই। হয়ে যায়, সত্যিই হয়ে যায়। অনিতা হাসান প্রেমে পড়ে আর একজনের। জেনেশুনে আমি ভান করি যে আমি কিছুই দেখতে পাইনি, আমি এক জন্মান্ধ, কোনো এক ভালোবাসার হাত আমার চোখের ওপর পরশ দিলে আমার দৃষ্টি খুলে যাবে। আমি সেই অপেক্ষায় থাকি। ধৈর্য যেন না হারাই সে জন্য রাত জেগে এইসব কথা লিখি, আবোলতাবোল কথা, না লিখে আমার উপায় নেই, ভীষণ আশা আমার, তুমি যদি কোনোদিন আমার এই লেখাটা পড়ো! পড়ে যদি তোমার অবাক বিস্ময়ে আমাকে আবিষ্কারের ইচ্ছে হয়! ভাবতে পারি না এই লেখার এত দাম হবে কি! আমিও তো বলতে পারতাম পৃথিবীর সেই আদিম একটি বাক্য, ‘তোমাকে ভালোবাসি’, কিন্তু বলিনি, ভেব না বলার মতো সাহস আমার ছিল না, আমি একটা কাপুরুষ। অথবা আমার বলার সময় হয়নি, সময়ের অপেক্ষায় আছি, না তাও নয় অনিতা হাসান, আমার অনুভবের প্রগাঢ়তায় তোমাকে রাখি বলে তোমার সামনে দাঁড়ালে আমার সমুদয় শব্দরাজি নিঃশেষ হয়ে যায়। যা আমি বলতে পারি না, তার মাত্র কিছু কিছু লিখি, যে বাক্য সবাই লেখে সেটা আমি লিখতে চাই না অনিতা হাসান। তার মানে এই নয় যে আমি একজন বড় লিখিয়ে, আমার লেখার যোগ্যতা যে কত তুচ্ছ সেটা আমার জানা আছে। আমার ভেতরে ফাঁকি নেই। চতুর্থ দিন আমি যখন অন্যের সঙ্গে তোমাকে রিকশায় দেখি তখন আমার খেদ হয় এই ভেবে যে, তোমার সঙ্গে আমার আগে কেন দেখা হলো না। তারপরও আমি জানি মানুষ আশাবাদী, আশাবাদী না হয়ে মানুষের বেঁচে থাকার উপায় নেই। তাই আমি লেখার আফিমে আশাবাদী হয়ে থাকব। আমরা এই মানসিক পরিস্থিতিতেই সেই ছেলেটির আগমন, যে আমাকে একটি খবরের কথা বলে। তোমার যে কোনো কথা, হাসি, ঘটনা আমাদের এখানকার ছেলেগুলোর কাছে ঘটনাই তো অনিতা হাসান, সেসব খবরের কাগজে প্রকাশিত হয় না, কিন্তু মুখে মুখে চাউর হতে থাকে। তুমি একটি বিশাল নিউজ আইটেম। দিন তো যাবেই, কয়েকদিন পার হয়ে যায়। চায়ের টেবিলে ঝড় উঠলে তুমি হয়ে যাও আলোচনার বিষয়। ইদানীং আরো একটু বেশি আলোচিত হচ্ছ। চায়ের কাপ ঠক্ করে টেবিলের ওপরে রেখে আনন্দ ধাম করে বলো, অনিতা হাসান মাথা বনবন করার যোগ্যতা রাখে, এতই সুন্দর। আমি মনে মনে হাসি, নিঃশব্দে চা খাই, নিজেকে বলি, তোমরা ওর সৌন্দর্যের কিছুই দেখোনি, তোমাদের দেখার চোখ নেই, দেখতে পাই আমি, আমি ওর মস্তিষ্কের উর্বরতা দেখি, দারুণ মেধাবী, ছোট ছোট কথাগুলোর চমৎকার বিশ্লেষণ করে, সে ব্যাখ্যা শুনে আমার মাথা বনবন করে। মেধার সৌন্দর্য ওকে দীপ্ত করে রাখে। বলি, তোমরা ওর চোখ দেখোনি, চোখের ভাষায় অসাধারণ সৌন্দর্যের তলে তোমাদের অবগাহন হয়নি, তোমরা কী করে বুঝবে যে চোখের ভাষা কত অসাধারণ সুন্দর হতে পারে! তোমরা ওর ভেতরটা দেখোনি, ওর ভেতরে চমৎকার মানবিকতাবোধ আছে, ও ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাইকে সহযোগিতা করে, কার খাতা কেনার টাকা নেই, কার পরীক্ষার ফিস দিতে অসুবিধা হচ্ছে। ইত্যাদি ও হাসিমুখে সামলে দিত, পারলে নিজে দিত, নইলে সবার কাছ থেকে দশ-বিশ টাকা করে চাঁদা নিত। ওর এই সবকিছু অপার সৌন্দর্যের বিষয় ছিল। ওরা সৌন্দর্য বোঝে না অনিতা, ওরা সৌন্দর্য বোঝার ভান করে। আমি ওদের মতো ভাবতে পারি না, তুমি আমার পৃথিবীর সবটুকু, যেখানে যা আছে, যার দিকে শুধুই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা, তাই তা নাকি। তোমাকে দেখা কী যে কষ্ট, শ্বাসকষ্ট, বুকের গভীর থেকে উঠে আসা খাস, বেঁচে থাকা ভীষণ কঠিন, যেমন কঠিন পাথরের পাহাড় ডিঙিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর দেখা, নীল জলরাশির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার শান্তি। নিজেকে বলি, তার দিকে অপলক তাকাও

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App