×

সাময়িকী

তৈরি করা সত্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০১৯, ০৬:১১ পিএম

তৈরি করা সত্য
আরামবাগের ময়লাময় অযোগ্য এক চিপাগলি থেকে বেরিয়ে আজাদ তাঁর সামনাসামনি আসছে দেখে মান্নান দুশ্চিন্তা ছেড়ে বেঁচে যায়। এমন জায়গায় অসময়ে মান্নানকে দেখে কৌতূহলে আজাদের পা থেমে যায়। তাঁর হাত ধরে মান্নানকে স্ট্রিটলাইটের নিচে নিয়ে আসে সে। রাত প্রায় নয়টা। এখন অত দূর কীভাবে বাসায় ফিরবে ভেবে দুশ্চিন্তায় মান্নান ঘায়েল ছিল। রাস্তার ভিড়ভাট্টা, গাড়ির জ্যাম ভেঙে নয়াবাজারের ওদিকে যেতে যেতে রাতের বয়স আরো লম্বা হবে। তখন সেই মুশকিল, ছায়া সঙ্গী হয়ে তাঁকে জব্দ করতে চাইবে। আজকাল রাত যত বাড়ে চলাফেরায় ছায়া ক্রমেই তাঁর শরীরের কাছাকাছি চলে আসে, গা-লাগোয়া হয়ে নিঃশব্দে তাঁর শরীরে ঢুকে যায়। মনের মধ্যে ঘন ঘন চমকানি- যে কোনো মুহূর্তে কাঁধের ওপর ছায়া এই বুঝি নিকেশ চুকানো চূড়ান্ত শ্বাস ফেলে। হাঁটার বদলে মান্নানের শুরু হয় তখন দৌড়চাল। আজকাল ছায়া খুব ভোগাচ্ছে, ধারণা তাঁর সর্বক্ষণ মান্নানকে অনুসরণ করছে। গোপনে জীবননাশে তৎপর সাংঘাতিক এই ছায়া থেকে রেহাই পেতে এখন যদি নয়াবাজার অব্দি যেতে সে না চায়, তাহলে রাতে থাকবে কোথায়? মুসিবত যখন মাথাচাড়া দিতে যাচ্ছে, তখুনি একসময়ের দিললাগি দোস্ত আজাদের সঙ্গে অনেক দিন পর সাক্ষাৎ। মান্নান জানে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আজাদ বিয়ে করেনি, একা একা রুমে ইচ্ছাময় তাঁর দিনযাপন। রাতটা তাঁর সঙ্গে পার করার কথা জানাতেই আজাদ স্কুলজীবনের বন্ধুকে বেশ তুষ্টি নিয়ে জড়িয়ে ধরে। মান্নানকে পাশে রেখে পানির ট্যাঙ্কের সামনে দিয়ে সে রাস্তায় পার হয়। পুরানা পল্টনের শুরুর মুখে ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা রাস্তার আরো ভেতরে মোচড়কাটা দুস্থ এক গলির শেষ মাথায় এসে আজাদ পা গুটিয়ে আনে। জমানো বহু কথা উজাড় করে বলতে বলতে তাঁরা মুখ আজ ব্যথা করে ফেলবে। হোটেল থেকে তন্দুর রুটি সঙ্গে শিক কাবাব এনে রাতের ছিলকা পর্যন্ত তাঁরা আস্ত রাখবে না। জংধরা, ক্ষয়াটে, বাসি খুপরির চিড় খাওয়া ফ্লোরে পা রেখে মান্নান চারপাশে খোকা দৃষ্টি টেনে তখুনি শুতে চায়। তাঁর কেবল জিজ্ঞাসা- পেছন ধরে কোনো ছায়া এখানে ঢুকেছে কিনা। শৈশবের তুইতোকারি বন্ধুটির রসাল কথায় সাড়া দিতে গিয়ে আজাদ হঠাৎ নিভে যায়- সে কি শুনলো, শুনলো কি? মান্নানের স্বরে ভয় জড়ানো কেন? আজাদের অপলক বিস্মিত চাহনি লক্ষ করে মান্নানের চোখ ছোট হতে থাকে। বন্ধুর জানাশোনা মুখটা ধীরে গায়েব হয়ে ছায়ায় পরিণত হলে মান্নান খাটিয়ার বিছানায় ঢলে পড়ে। গল্পগুজব নয় বাদ দেয়া গেল, কিন্তু মানুষটা না-খেয়ে রুমে ঢুকেই ঘুমাতে চাইলে আজাদের জন্য রীতিমতো তা অস্বস্তির। ঘটনা কী! হুট করে থাকতে এসে ছায়া খোঁজা, কিসের ছায়া, এমন অদ্ভুত আচরণে চোখবোজা মান্নানের হকিকত সে তদন্ত করে। ফ্লোরে মাদুর পেতে ঘুমে কাদা হয়ে ছিল আজাদ, অনেক দিন বাদে নিজের খাট ছেড়ে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে শানের ঠাণ্ডায় ঘুম তাঁকে নিবিড়ভাবে পেয়েছিল। টানটান পা-জোড়া ছড়িয়ে পড়ে থাকাই আরামের। মনে লাগা পুলকে ডুবে থাকতে থাকতে তাঁকে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে উঠতে হচ্ছে। কোনো ধ্বনি কি কানে আসছে? উহ্, টিনের চালের ওপর কোত্থেকে এত শব্দ এসে পড়ছে! নাকি ফজর যাওয়ার পর আকাশে সুবেহ সাদেক ওঠার আওয়াজ হচ্ছে- কোনটা? দূর, এমন কাণ্ড ঘটে নাকি? আজাদ পাশ ফিরে শোয়। অত ভাবনার চাপ যদি এসে পড়ে, চোখের আঠা আর কতক্ষণ স্থায়ী হবে? সে বোঝে বাইরে প্রতিদিনের পুরনো ঘটনাই চলছে। মসজিদের কল থেকে খাওয়ার ফ্রেশ পানি নিতে আসা মহল্লাবাসীর নিত্য অশ্লীল বচসার কারণে তাঁর চোখের ঢাকনায় ঘুম জমাট থাকছে না। ইশ্; শোয়ায় মান্নানের বুঝি অসুবিধা হচ্ছে- এখানে সে নতুন। আজাদ ধাঁ করে উঠে দেখে খাট খালি, দরজাটা টেনে মান্নান কখন হাওয়া হয়ে গেছে। তাঁকে না-ডেকে মানুষটা এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে চলে যেতে পারলো! যে লোক স্কুলে মাস্টারি করে, সে এত আক্কেলশূন্য হয় কীভাবে! এই বিস্ময় আরো জমাট বাঁধে পরে মান্নানের সঙ্গে এখানে-সেখানে মুখোমুখি দেখা হলে তাঁর পুরোপুরি অচেনা চাহনিতে। হনহন পায়ে মান্নানের কেটে পড়া দেখে আজাদ থ হতে গিয়ে টের পায়, তাঁর মনে লঘু কষ্ট টাটিয়ে উঠেছে। ভাবনা-চিন্তা খোঁড়াখুঁড়ি করেও মান্নানের এই অদ্ভুত আচরণের কারণ সে খুঁজে পায় না। ফুরিয়ে আসা এক বিষণ্ন বিকেলে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে পারিবারিক আলাপ সেরে আজাদ শর্টকাটে নিজের কুঠুরিতে ফিরছিল। পুরান ঢাকার চিপা এক রাস্তার চা-পুরির দোকানের সামনে অনেক দিন পর শওকতের সঙ্গে তাঁর দেখা। দুই বন্ধু এখন জীবিকার তাগিদে দুদিকে ছিটকে গেছে। মেলামেশার নিয়মিত সুযোগ হয় না। আরেক বন্ধু মান্নানসহ তিনজন ছিল স্কুলজীবনে এক বেঞ্চের এক প্রাণ। এক সময় আজাদ নিজের ভরণ-পোষণের কারণে বাস মধ্যপল্টনের সরু এক গলিতে গুটিয়ে আনে। মান্নান আর শওকত থেকে যায় নয়াবাজারের মহল্লায়। দুজনে কলেজে পড়ার সময় বিভাগ আলাদা হলেও দেখা-সাক্ষাৎ বজায় রাখে। আজাদ জমানো কথার ঝাঁপি খুলে ধরে। হঠাৎ মান্নানের রাতে রাস্তায় দেখা পাওয়া, তার ডেরায় ঘুমাতে যাওয়া ও হেঁয়ালিপূর্ণ ব্যবহারের বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত সে পেশ করে। শুনে শওকত হতাশ স্বরে জানায়, তার সঙ্গেও মান্নান একই ধরনের চাল করেছে। আরো পেছনের প্রসঙ্গ টেনে আনে সে- কলেজে পড়ার শেষ পর্যায়ে এসে কেন জানি মান্নান লেখাপড়া থেকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। কলেজে অনিয়মিত হতে হতে কখন সে নাই হয়েছে, শওকত তা ধরতে পারেনি। বছরখানেক পর জানা গেল, মান্নান এক স্কুলে বাংলা বিষয়ে মাস্টারি পেয়েছে। শওকতও থার্ড ডিভিশনে বিএসসি পাস করে বিজ্ঞানের শিক্ষক পদে একই স্কুলে যোগ দেয়। দু’জন আবার তখন কাছাকাছি হয়ে বন্ধুত্ব নবায়ন করে। আশ্চর্য, এই মান্নান কিনা তাঁদের সঙ্গে অবাঞ্ছিত ব্যবহার করল! তাহলে বোঝা যচ্ছে, মান্নানের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা হয়েছে। শওকত কথা চালু রেখে স্মরণের ওপর পড়া বিগত দিনের ধুলো ঝাড়তে থাকে। মাস ছয় আগে এক জুমার নামাজের পর তাঁতীবাজারের গিট্টু রাস্তায় দেখা হলে মান্নান আত্মগরজি হয়ে শওকতের বাসায় খেতে যায়। শওকতের বউ তাহেরা তখন অসুস্থ। খাবার টেবিলে দেখভাল করা, কি পর্দা সরিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করার মতো শারীরিকভাবে সবল সে ছিল না। ছেলের বন্ধু আকস্মিক হাজির, তা-ও মধ্যদুপুরে, শওকতের প্রৌঢ় আম্মা পরমানন্দে আলুভর্তা, ডিমভাজি এই দুই পদও বাড়তি খেতে দেন। তাঁর আদর-যত্নে বুঁদ হয়ে মান্নান আকুল স্বরে বলে, নিজের আম্মার মুখটা ধরতে চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পাচ্ছে না। বলে কী মানুষটা- অবাক হয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকে শওকত! চোখবোজা মান্নানের ধারণা, তাঁর সামনে শওকতের চৌকো মুখটা চলে এসেছে। এই মুখও আবছা হতে হতে একখ- ভীতিকর ছায়া হয়ে যাচ্ছে তা দ্রুত জানিয়ে শওকতের বাসা ছেড়ে তখুনি মান্নান চলে আসে। শওকতকে পরদিন থেকে মান্নান আর চেনে না। মুখোমুখি সাক্ষাতেও অপরিচিত পায়ে পাশ কেটে যায়। এদিকে পড়াতে পড়াতে মান্নান ক্লাসে খেই হারাতে থাকে। মুখ নিশ্চুপ রেখে জানালার বাইরে সে দৃষ্টি উধাও করে আনমনা হয়। স্যারের এমন আউলা চেহারা দেখে ক্লাসের ছাত্ররা মহাখুশি, লেখাপড়া গোল্লায় যাক- হাসাহাসি, গল্পগুজবে স্বর তারা উচ্চলয়ে নিয়ে যায়। স্যারের নামে কেউ কেউ জয়ধ্বনি দেয়। এই কোলাহল পাশের ক্লাসকে প্রভাবিত করে পৌঁছে যায় বারান্দার শেষ মাথায় দক্ষিণমুখি টিচার্স রুমেও। একদিন হেডস্যারের রুমে মান্নানের ডাক পড়ে : ‘আর ইউ সিক?’ হেডস্যার তাঁর পাওয়ারফুল চশমার ভেতর দিয়ে ধারালো নজরে মান্নানকে জরিপ করেন। মান্নানের চোখের নিচে কালির পোঁচ। তার লম্বাটে মুখে নাকটা অস্বাভাবিক মোটা। নাকে যেন একখ- অতিরিক্ত মাংস সেট করা। মান্নানের জোড়া লাল চোখ হেডস্যারের মুখের ওপর গাড়ির হেডলাইটের মতো স্থির জ্বলে থাকে। এভাবে চেয়ে থাকতে থাকতে বড্ড ঘুম পায় তাঁর। চেয়ারে হেলান দিয়ে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। হেডস্যার আসমত আলী বেচারা অসুস্থ ভেবে স্নেহাষ্পদকে ঘুমের সুযোগ দিতে নিজ হাতে ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দেন। পিয়নকে ডেকে অফিসের দরজা ভেজাতে বলে তিনি বাইরে চলে যান। প্রায় এক দুপুর ঘুমিয়ে স্কুল থেকে জড় পায়ে বাসায় ফেরে মান্নান। সে ক্লাস নিতে পারেনি। মুখ তাঁর শুকনো। অগোছালো মলিন রুমে সে একা থাকে। বছর দেড় হলো স্ত্রী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে সে সংসার করে না। অথচ স্ত্রীকে চূড়ান্ত তালাকও সে দেয়নি। তাঁর এমন সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড দেখে নিজের মা-বোন পর্যন্ত ঘোর নাখোশ। মেহেরুন্নেসার নাম শুনে মান্নানের বিয়েতে মত ছিল না। বড়ই সেকেলে নাম। মেয়ে বুঝি পর্দাটানা অন্দরে তোরঙ্গের ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা জরির কাজের বা চুমকি বসানো শাড়ি পরে। ভাঙচুর গলি, উপগলির ভেতরের শ্বাসচাপা কোনো এক চুন-সুরকির খুপরির এই মেয়ে সকাল-বিকেল পুরি-পেঁয়াজু খায়। হয়তো তেলেভাজা খাওয়ার দোষে মুখময় ব্রণভর্তি। অথচ আগাম ধারণার কোনো খুঁতই মেহেরুন্নেসার নেই। পারতপক্ষে বাইরের কেনা খাবার সে খায় না। এলাকার মধ্যে স্বর্ণময়ী বিদ্যানিকেতন নামের পুরনো এক স্কুলে আট ক্লাসের পর তার পাঠ চুকেবুকে গেলেও সে ভারি সুরেলা কণ্ঠে কোরআন শরিফ পড়তে পারে। ননদ-শাশুড়ি সওয়াব কামিয়াবে বিভোর হয়ে তাঁর পাঠ শোনে। ঘরকন্নায় সে নিপুণ- রান্না করে চমৎকার। ছোট শব্দ থেকে নামের বানান, র‌্যাপিং পেপারে মোড়ানো প্যাকেটে উপহার বাংলা-ইংরেজিতে নির্ভুল সে লিখতে পারে। কথাবার্তায় কখনোই বোঝার উপায় নেই ওপর শ্রেণিতে মেয়েটি পড়েনি। তার হাতের ছোঁয়ায় সংসারে পরিচ্ছন্নতা ফিরে আসে। কেবল মান্নানের ঝাল চানাচুর দিয়ে চাকুম-চুকুম শব্দে আটার রুটি ভক্ষণ, টেবিলে চায়ের কাপের পাশে একটা সাদা বিড়ালবাচ্চা নির্দয় বসিয়ে রাখা, রাতে আলো নিভিয়ে শুতে অহেতুক ভয় মেহেরুন্নেসার স্বাভাবিক জীবনযাপনে ক্রমাগত ধাঁধা হতে থাকে। একদিন লম্বায় বউয়ের চেয়ে সামান্য সে খাটো- এটা উদ্ভাবন করে মান্নানের মাথা বিগড়ে যায়। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বউকে বাপের বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ সে জারি করে। স্বামীর এই ফরমান অন্যায্য ভেবে আদৌ পাত্তা দেয় না মেহেরুন্নেসা। যথারীতি বউটা সংসার নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে। সুলক্ষণ সদাচারের জন্য ইতোমধ্যে সে শাশুড়ি-ননদের মন পেয়েছে। কোনো বিকেলে বেড়াতে এলে ননদ বেশ আদর করে গন্ধরাজ কেশ তেল তাঁর লম্বা ঘন চুলে ঘষে খোঁপা বেঁধে দেয়। অশক্ত শরীরের শাশুড়ির হাতের কাছে বুড়ি মানুষের ব্যবহারের সব উপকরণ এগিয়ে রাখে সে। পান থেকে চুন খসার সুযোগ দিতে মেহেরুন্নেসা রাজি নয়। চোখ-কান ফোটা বয়স থেকে সে জেনে আসছে বিয়ের পর মিলেমিশে স্বামী-স্ত্রীতে সংসার। তাহলে কারণ ছাড়া সে স্বামী মান্নানকে কেন ছেড়ে যাবে? কী অপরাধ তাঁর? চোয়াল শক্ত রেখে মান্নান সুচালো নজরে দেখে, বউয়ের কোনো ভাবান্তর নেই, দিব্যি সে সংসার নিজের ভেবে নাড়াচাড়া করছে। দুই হাতের সচল গৃহস্থালির জন্য এখানে বাস তাঁর পাকা। ফন্দি বদলায় মান্নান। মা-বোনের নজর বাঁচিয়ে এবার উদ্ভট ব্যবহার সে চালু করে। মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বাক্যালাপ আগেই সে বন্ধ করেছে। সারা মুখে পাহাড়ভাঙা গাম্ভীর্য জড়ো করে যেন গভীর কোনো ভাবনায় সে মশগুল। মুখ খুললেই সব বরবাদ হবে। বউকে ভয় দেখাতে মান্নান ইট সাইজের ইংরেজি বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে চলে। ভাবখানা, বিদ্যার ওজন দিয়েই সে মেহেরুন্নেসাকে পাউডার করে দিতে পারে। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে ইংরেজি-বাংলা ডিকশনারি এনে দিনের পর দিন রুমে রেখে ফেরত সে দেয়নি। পরে লেখালেখির নামে শুরু হয় তাঁর কাগজ ছেঁড়াছেঁড়ি। তাঁর জটিল হাতের হিজিবিজি লেখা মেহেরুন্নেসাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ইচ্ছাকৃত সে মোটা স্বরে পাঠ করে। রাজধানীর মধ্য দিয়ে লম্বা একটা লেক হবে। সেখানে অনেক অনেক রাজহাঁস পুষবে সে। ভেলায় একা একা পানিতে ভেসে বেড়াবে। রাতে লেকে বসে মানুষের মাথার খুলিতে জ্যোৎস্না পান করবে। জ্যোৎস্না খাবে তাও মানুষের মাথার খুলিতে শুনে মেহেরুন্নেসার ভেতর ধস নামে। বলে কী মানুষটা! মান্নান চেয়ার-টেবিল ছেড়ে জানালার পাশে গিয়ে দেয়ালের ওপাশের বেলগাছটার উদ্দেশে খলখল হাসে আর বুক চাপড়ায়। বুঝি সে জ্যোৎস্না খেয়ে এখুনি পাগলাইভাবে বেসামাল। মেহেরুন্নেসা ভয় পেয়ে যায়। এমন ভয় সঙ্গে করে পরদিন সকালে বাপের বাড়ির দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে সে ছুটতে থাকে। শাশুড়ি পুরনো আমলের মানুষ, ভোরেই ঘুম থেকে ওঠে। একসময় তিনিও সক্রিয়ভাবে সংসার-ধর্ম পালনে নাকচোখমুখ দিয়ে সমানে শেষ রাতে অন্ধকার ঠেলতেন। পুতের বউয়ের ভয়-ব্যাকুল চেহারা দেখে হাঁসফাঁস করে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই মেহেরুন্নেসা আলুথালু ঘুমন্ত স্বামীর লক্ষ্যে আঙুল উঁচিয়ে বাইরে উধাও হয়ে যায। মান্নানের নোংরা, বউ তাড়ানো ফন্দিফিকির নিয়ে মা-বোন চরম অসন্তুষ্ট হয়। একমাত্র এই বোন বয়সে বড়, সে উত্তেজিত হয়ে মান্নানের মুখদর্শন না-করার প্রতিজ্ঞা করে। ভাইটা তাঁর স্বার্থ-গুলজারে নির্লজ্জ তেঁদড়। বোনের ব্যবসায়ী স্বামীর বুকের কলকব্জা অকেজো হলে অসময়ে তাঁর চোখের পাতা ফাইনাল বুজে যায়। দুলাভাইয়ের দাফন-কাফন, পরে কুলখানিতেও শ্যালক মান্নানকে আদৌ দেখা যায় না। অথচ দুলাভাইয়ের অর্থায়নে মান্নানের কলেজ জীবন কেটেছে। তিন ভাগনে কেউ এখন ছোট নয়- আয়ক্ষম। প্লামবিং মালামালের পাকা ব্যবসায়ী। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় নিমকহারাম মামাকে সুযোগমতো পুরান ঢাকার ম্যানহোলের উপচে পড়া পচা গাদ পানিতে তাঁরা গোলস করাবে। কিন্তু মান্নান কোথায়? দেখা গেল, নিজের রুমে দিনের বেলা টেবিল ল্যাম্পের আলোয় সে নিবিষ্ট মনে হস্তরেখার বই পড়ছে। কখনো তালুর ওপর পুরু লেন্স ধরে সূক্ষ্ম জটিল রেখা দেখে দেখে বইয়ের ছাপা ছবির সঙ্গে হাত তাঁর মিলিয়ে নিচ্ছে। সদ্য বিধবা বোন ভাইয়ের ইতর ব্যবহারে এতই অসন্তুষ্ট হয় যে মান্নান বাসায় থাকাকালে বাপের বাড়িতে মায়ের কারণে নিত্য তাঁর যাতায়াত সে বন্ধ করে দেয়। অমানুষের মুখ না-দেখাই উত্তম। মহাবিপদে পড়েন অসুস্থ বয়োবৃদ্ধা মা। পাজি ছেলে মায়ের শরীরের খোঁজখবর নেয়া তো দূর, রুমের দরজায় কস্মিনকালেও উঁকি দেয় না। ওষুধ থাকে ছোট একটা ডিব্বার মধ্যে- কোথায় ওটা। খাওয়ার জন্য পানের বাটা তালাশ করে তিনি হয়রান। খাটের নিচে থাকলে বিপদ, কুড়িয়ে আনার জন্য কোমর ভাঁজ হবে না। রাতে বাথরুমে যাওয়ার ভর দেয়া লাঠিটা বিছানার পাশে নেই। পুতের বউটা সব জোগাড় করে হাতের কাছে রাখতো। যে কোনো সময় শরীরের কাঁপুনি নিয়ে ফ্লোরে পড়ে হাড়গোড় ভেঙেচুরে মরে থাকবে সে। গর্ভধারিণীর জন্য ছেলেটার কোনো দায় নেই? না থাকলে এই সংসারে তুই আছিস কেন? শয়তানটা লক্ষ্মী বউটাকে তাড়িয়ে না-জায়েজ কাজ করেছে। পাপের মার কেমনে তুই সহ্য করবি? বোনের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহারে ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে মেহেরুন্নেসার বড় ভাই আলতাফ মান্নানকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে এখন মরিয়া। তাঁর বাহু খাম্বা সাইজের। দৈত্য কিসিমের চওড়া দুই কাঁধে দু’জন মানুষ ফেলে অবলীলায় হাঁটতে হাঁটতে বুড়িগঙ্গার পানিতে সে ফেলে আসতে পারে। তাঁর লোহার ডান্ডার মতো হাতজোড়া নিয়ে মান্নানের সন্ধানে প্রায় এদিক-সেদিক সে চক্কর দেয়। তাঁর পায়ের চাপে মান্নানদের বাসার সামনের বুড়ো সরু রাস্তা বুঝি ধসে যাবে। মুখোমুখি, কি টিনের চালের মটকায়, টংঘরে, নাশতা বিক্রির আঁটগলি- কোথাও মান্নানের চেহারা দেখা যায় না। হঠাৎ লোকমুখে জানা গেল, আজকাল মহল্লা ছেড়ে মান্নান গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররমে একা একা ঘোরে। মার্কেটিংয়ে আসা তরুণীদের ঝাঁক থেকে কোনো এক সুন্দরী মেয়ে টার্গেট করে তাঁর পেছন ধরে সে হাঁটে। ছিঃ ছিঃ- এই মাস্টারের চরিত্র। এমন মানুষের পাসের সার্টিফিকেট জাল বলে আলতাফের সন্দেহ হয়। আজকাল টাকা খরচ করলে বাঘের দুধ মেলে, গোপনে সেখানে সার্টিফিকেটের কাগজ পাওয়া অসাধ্য নয়। আরো বদ মন্দ খরব বাতাসে উড়ে এলো- বাসের হ্যান্ডেল ধরে কখনো কখনো মান্নান নিউমার্কেট যায়। সেখানে মেয়েরা আরো সুন্দরী, আরো স্বাস্থ্যবতী। শুনে আলতাফের মাথা আস্ত উনুন হয়ে যায়। আর এতে জ্বলে ওঠে বিপুল আগুন। এই আগুনের তাপে আলতাফ হাত-পা সেঁকে টগবগে একটা ঘোড়া, ধারালো একটা তলোয়ার আকাক্সক্ষা করে। ওই ঘোড়ায় চড়ে মান্নানের মু-ু কেটে বাহাদুর শাহ পার্কের মধ্যে প্রকাশ্যে সে ফুটবল খেলবে। ছোটবেলায় সে নিশাত সিনেমা হলে মোহাম্মদ আলী-জেবা অভিনীত উর্দু একটা সিনেমা দেখেছিল। ওই জোয়ানি জোশের কাহিনি আজো সাফ সাফ মনে আছে। মোহাম্মদ আলী একাই একশ; পাহাড়-পর্বত-গিরি খাদে তাগড়া সব শত্রু মেরে-কেটে সে উজাড় করে ফেলে। এমন একটা ঘোড়া আর তলোয়ার পেলে মান্নানকে মারার জন্য এখুনি সে ঢাকা চষে ফেলবে। কার বোনের সঙ্গে তোর ইতরামি- বদমাশ। দু’দিন পর মান্নান বিষয়ে প্রাণহরণের মতো আরেক খবর আলতাফের কাছে পৌঁছায়। আনোয়ার নামের পুরনো ভবঘুরে জানায়, অদৃশ্য সাংঘাতিক এক ছায়ার ত্রাসে মান্নান এখন ভীত। সর্বক্ষণ এই ছায়া নাকি তাঁর ডান-বাম-পেছন ধরে হাঁটছে। সুযোগমতো যে কোনো মুহূর্তে ছায়া তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সম্ভব হলে কারেন্টের তৈরি জামা-প্যান্ট পরে ছায়ার বিরুদ্ধে মান্নান কঠোর লড়াই করে যাবে। শুনে খানিকক্ষণ চিন্তামগ্ন থাকে আলতাফ। ছায়াটা আসলে তাঁরই। বদখাসলতের এই মহাপাপীকে আচ্ছামতো পিটুনি দিতে মান্নানের পেছনে মনে মনে সে ধাওয়া করে ফিরছে। কিন্তু ছায়াটা যদি তাঁরই হয়, মান্নানকে কেমনে সব সময় সে খেয়াল রাখছে! দুপুর থেকে সন্ধ্যা সে থাকে ধোলাইখালে তাঁর লোহালক্কড়ের দোকানে। রোজগারের জন্য পুরো মনোযোগ, খাটাখাটুনি তাঁর। মাথা থেকে মান্নান তখন আউট। আবার সতর্ক নজর ধরে রাখতে হয় রাস্তায়। হাতে-নখে ময়লা, রুগ্ণ, দাগি মুখের টোকাইরা ম্যানহোলের ঢাকনা, রড, গাড়ির গ্লাস, সাইডগ্লাস-লাইটসহ বিভিন্ন মালামাল বস্তাবন্দি করে দোকানের পেছনে এনে ঢেলে দেয়। গাড়ির তেলকালিমাখা চুরির পার্টস ঘষে ঘষে পরিষ্কারে লেগে যায় ডেইলি মজুরির ছোকরারা। লোহার ধবধবে যন্ত্রপাতির ওপর কখনো তাঁর চুমু খেতে সাধ হয়। হবে না কেন? এসব বেচেই তো মালপানি কামাই, ঘর-সংসারের ঘানি সচল রাখা। এমন টাইট অবস্থায় নিজের দম ফেলার সুযোগ যেখানে কম, মান্নান-বিষয়ক জটিলতার আসান সেখানে কীভাবে! সচরাচর সন্ধ্যা উতরে গেলে মালামালের সরবরাহ আর থাকে না। সাপ্লাইয়ারদের কাছে আলতাফ হেদায়েতমার্কা একই কথা গচ্ছিত রেখে আসছে- গোপন কাজ হবে প্রকাশ্যে, দিনের আলোয়, বুঝবেই না কেউ মাল চোরাই কি না, রাখঢাক মানেই বিপদ। কোথাও মুসিবত হয়তো ওঁত পেতে আছে। শুনে জোগানদাররা এমন পরামর্শ পাত্তা দেয় না। ঝুঁকি নিয়ে হাতসাফাই করে তাঁরা। বিনিময়ে উপযুক্ত দর না পেলে ওই সদুপদেশের আর দাম কী-দূর! এদিকে নেশা ঘন হলে আলতাফের শরীর থেকে ডাক উঠে আসে। খসখসে গলা না ভেজানো অব্দি সারা দিনের পেরেশান কাটে না, লোহালক্কড় ঘাঁটাঘাঁটির মেজাজও খোলতাই হয় না। লোহা-লক্কড়ের স্তূপের ফালি জায়গার ফাঁকে টুল-চেয়ারের পায়া বসে যায়। রঙিলা ইয়ার দোস্তরা হাজির। আসরের গ্লাস-পানি-বোতল তাঁরাই জোগাড় করে। অকাতরে খরচ আলতাফের। বাংলা শরাবের প্রতি সিপের পর গরুর গোশতের সুরুয়ায় বাখরখানি ভিজিয়ে খেতে খেতে রাত হয় পরম সখা, আরো নকশাদার। মান্নানকে সে খোঁজাখুঁজি করে কখন! ক’দিন আগে সাপ্তাহিক বন্ধে শঠ মাস্টার ভগ্নিপতিকে পাতলা পাতলা হেঁটে-চলে আলতাফ পাকড়াও করতে তৎপর ছিল। কাজের চাপে মান্নানের টিকি ধরার ব্যাপারে ক্রমশ ভাটা পড়তে থাকে। কিন্তু বোনটার বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যান লেগেই আছে। জম্পেশ নেশা নিয়ে ঘরে ফেরার পর একঘেয়ে নাকি কান্না আর অভিযোগে তাঁর মউজ চাড় খেয়ে যায। ছোট বোনের কপাল ফাটো ফাটো, শুরুতেই মেরামতে হাত না দিলে বড় ভাই কেমনতর তেজি মিস্ত্রি। বউয়ের এই চেরাই করা ঠেসবাক্যের পেছনের উদ্দেশ্য বুঝতে আলতাফের ভুল হয় না। তাঁর বউয়ের ধারণা, ভাইয়ের সংসারে এসে উঠে ননদ যদি এখানে স্থায়ী হয়ে যায়, আখেরে সুযোগ-সুবিধায় তাঁকে ভাগ দিতে হবে। আচ্ছা, বিষয়ের মধ্যে নিজেদেরও কি গলদ আছে! সন্দেহ নিরসনে এক রাতে গলা অব্দি বাংলা টেনে ঘাড় পুরো হেলে পড়ার আগে ছোট বোনকে আলতাফ পইপই জিজ্ঞাসাবাদ করে। মনমরা দুঃখীর বোনটা পরিষ্কার বলুক- স্বামীর সংসার নিয়ে সমস্যা কি তাঁর? নাকের পানি চোখের লবণ একাকার করে মেহেরুন্নেসা জানায়- মান্নান ষোলআনা অস্বাভাবিক। নিজেকে সে দিন-দুনিয়ার উত্তম প্রাণী ভেবে তাঁকে অধম জ্ঞান করে। একসঙ্গে জীবনযাপনের জন্য সে সুস্থ নয়। তাঁর কথাবার্তার পুরোটাই প্রলাপ। নিজের রুক্ষ মাথায় আঙুল চালাতে চালাতে রোজ চাঁদির চুল ছেঁড়ে। এই চুল টানাটানি, ছেঁড়াছেঁড়ির কারণে তাঁর মাথার পেছনে বাটি সাইজের টাক উঁকি দিচ্ছে। শুনে কর্কশ স্বরে ধমকে ওঠে আলতাফ। মাথার চুল রাখবে কি রাখবে না- মান্নানের নিজের ইচ্ছা। আসল সমস্যা কী? ভাইয়ের হুঙ্কার কানে নিয়ে মেহেরুন্নেসা কাঁদতে কাঁদতে অন্দরে দৌড়ে গেলে ব্যস, সব শোনাশুনি বরবাদ। পরের রাতে টিপু সুলতান রোডের ওদিকে দুই দল মাস্তানের গোলযোগে দোকানপাট আগে আগে বন্ধ হয়ে যায়। মাল খেতে খেতে নেশা যখন জমে এসেছে, হঠাৎ খেয়ালের কোন সুড়ঙ্গ দিয়ে বোনের অসহায় মেঘমুখটা উদিত হলে আলতাফ পাথুরে স্বরে দোস্তদের নিজের পাকাপাকি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়- মান্নানকে সে আর ছাড় দিচ্ছে না। কী গুরুদণ্ড দেয়া যায়? পূর্বপ্রস্তুত কোনো ব্যবস্থা আলতাফের নেই। তাৎক্ষণিকভাবে সে সাজা নির্ধারণ করে- শিশু দেয়ালাকালে মাথার তালুর যে অংশ থাকে নরম তুলতুলে, ধড়িবাজ মান্নানের মাথার ঠিক অমন জায়গাটা বেছে খোসা ছাড়ানো আস্ত একটা শুকনো সুপারি রেখে হাতুড়ি দিয়ে সে আঘাত করবে। ওই সুপারি মান্নানের মাথার পাতলা অংশে ঢুকে সব জটিলতার ফয়সালা করবে। আমোদ মশগুল দোস্তরা এমন শাস্তি মুহূর্তে খারিজ করে দেয়। তাঁদের এই দিলদার বন্ধুর মগজ বুঝি মালে টাল। এমন সাজার কারণে মেহেরুন্নেসার বিধবা হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। থানা-পুলিশ তো পরের ব্যাপার। বোন অতিষ্ঠ হয়ে ভাইয়ের কাছে চলে এসেছে, স্বামী মান্নান নিতে আসে না, তালাকও চূড়ান্ত হয়নি, কাল হয়তো মন বদলালে বউ নিতে ব্যাটা হাজির- তখন! ইবলিসটার জন্য কঠোর মারকাট সহ্যক্ষমতার মধ্যে রাখতে গ্লাসে চুমুক দিয়ে পিয়ারা সঙ্গীসাথীরা কোলাহলময় আলাপ শেষে নয়া এক উপায় বাৎলে দেয়- মান্নানের জামা-প্যান্ট খুলে টকটকে লাল একটা জাঙ্গিয়া পরানো হবে। গা খালি, দুই হাতে থাকবে মুষ্টিযোদ্ধার গ্লাভস, পায়ে একজোড়া কাঠের খড়ম। চমৎকার এই অবস্থায় তোপখানার চার রাস্তার মোড়ে সকালে কংক্রিটের স্ল্যাব তোলা শক্ত বড় লোহার একটা হ্যাঙ্গারে মান্নানকে ঝোলানো হবে। বউ-তাড়ানো মাস্টার তখন অনেক বেশি দর্শনীয় হবে। কিন্তু মান্নান গেল কই? মেহেরুন্নেসা আলতাফের বোন মানে তাদেরই বোন- গ্লাসতুতো বোন, বোতলতুতো বোন, শাস্তি বরাদ্দ করতে সবাই মান্নানকে খুঁজে পেতে উদ্যোগী হওয়ার যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গরমের মৌসুমের মধ্যে সামনে ঈদ- স্কুল বন্ধ। ক্লাস খুলবে সোয়া এক মাস পর। গলিঘুঁজিতে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে এক্কা-দোক্কার চালে হাঁটা ছিপছিপে ছেলেমেয়েদের এখন দেখা যায় না। মান্নানের হাত অলস- কাজ নেই। ষান্মাসিক স্কুল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও খাতা দেখার দায়িত্ব তাঁকে দেয়া হয়নি। মান্নানের অমনোযোগী মতিগতি উল্টা চলাফেরার অভিযোগ নিয়ে হেডস্যার মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও অন্য অধিকাংশ শিক্ষক তাঁর মাথার সুস্থতা নিয়ে সংশয়ের কথা স্কুল পরিচালনা পর্ষদের কানে তুলে দিয়েছেন। এটা শিক্ষা বাঁচানো মহৎ কর্ম বলে যাঁরা বিবেচনা করেন, তাঁদের মধ্যে মান্নানের পুরনো সহপাঠী, বর্তমানে সহকর্মী শওকতও আছে। সিদ্ধান্ত হয়: ঈদের পর স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কোনো এক ব্যবস্থা অযোগ্য মান্নানের বিপক্ষে নেয়া হবে। কোমলমতি ছাত্রদের জন্য এখন সে অনুপযুক্ত। মাথাপাগলা মাস্টারের হাতে ছাত্ররা নিরাপদও নয়। সে হিতাহিতশূন্য মানুষের খোসা মাত্র। যথোপযুক্ত একটা অ্যাকশন নেয়ার খবর রটনা হলে মান্নানের কানেও তা পৌঁছায়। সে তখন পেট পরিষ্কারের জন্য চিনি দিয়ে ঘৃতকুমারীর মজ্জা খাচ্ছিল। নিচের ঠোঁটে জিভ চেটে এমন বাজে উদ্যোগে তাঁর সম্বন্ধি আলতাফের হাত-কারসাজি-চক্রান্ত সে আবিষ্কার করে। বোনের পক্ষ হয়ে তাঁকে হেনস্তা, কি চাকরিছাড়া করতে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে আলতাফ। অতএব, উচিত শাস্তি আলতাফের প্রাপ্য। প্রথম মানের একজন মজবুত হিম্মতঅলা গুণ্ডা দিয়ে আলতাফকে গুঁড়ো বানানোর মনস্থ করে সে। কোথায় গুণ্ডা? হুঁশজ্ঞানশূন্য মান্নান একদিন পল্টন ঢুঁড়ে আজাদকে পেয়ে তাঁর সঙ্গে জোর কোলাকুলি সেরে গুণ্ডা জোগাড় করে দিতে কাকুতি-মিনতি করে। কিন্তু আজাদের নির্বাক ফ্যালফ্যাল চাহনি দেখে মনে হয় না মান্নানকে সে চিনতে পেরেছে। উপেক্ষিত মান্নান আফসোসে এবার শেষ সম্বল মহল্লার মাস্তানদের ওপর নির্ভর করার কথা ভাবে। কিন্তু মহল্লার উঠতি মাস্তান দিয়ে পিটুনি দেয়ার ফরজ কাজ অসম্ভব। এক রাতে বাসায় ফেরার কালে পাজিগুলো ফুর্তি করুম বলে তাঁর পকেটে আঙুল দিয়েছিল। ভাবখানা, তাদের রাখা টাকা তাঁরা বুঝি ফেরত নিচ্ছে। অবশ্যই দূরের গুণ্ডাই ভাড়া করা দরকার। এলাকায় এই গুণ্ডা অপরিচিত, তাঁর জন্য হাড্ডিগুড্ডি ভাঙার উন্নত কাজে সুবিধাও বেশি। সঠিক গোনাগাঁথা করে প্রতি ছুটির বিকেলে মান্নান ঢাকার বিভিন্ন মুল্লুক ঘুরে তাঁর প্রত্যাশিত গুণ্ডা খোঁজে; আর প্রতি রাতে আলতাফ বাংলা ও বাখরখানি খেতে খেতে নাগালের বাইরে মান্নানের জন্য হরেক রকম শাস্তি নির্দিষ্ট করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App