×

সাময়িকী

এক ঠোঙা তারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০১৯, ০৭:২১ পিএম

এক ঠোঙা তারা
একটা ডিমের আস্ত কুসুমটা, যার রং কমলা, সেই কমলা রঙের গোল কুসুমটা ফেটে গেলে যেমন হয়, তেমন করে ফেটে গেল আকাশের সূর্যটা। সারাদিন রোদ-ঝর-বৃষ্টির খেলা খেলে প্রকৃতি এখন আকাশে রঙের খেলায় মেতেছে। কমলা কুসুম সূর্যটা কয়েক মুহূর্তে ছড়িয়ে গেল আকাশে আর আকাশটা হঠাৎ গোলাপি হয়ে গেল, যেন স্ট্রবেরি আইসক্রিম গলে গিয়ে সাদা মেঘের আকাশটাকে গোলাপি বিকেল করে দিয়েছে কেউ। যেন সায়েন্স ফিকশনের অন্য কোনো গ্রহের আকাশ এটা, তাই এর রং নীল নয় গোলাপি। আবহাওয়া, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং আবহাওয়া জানান দেয়ার স্মার্ট ফোন অ্যাপস, কোনোটারই তেমন ভরসা করা যায় না। কখন বৃষ্টি নামে, কখন ঝর আসে। সঙ্গে আজ ছাতা নেই। এই এক সমস্যা হয়েছে, যেদিন ছাতা থাকে না সাথে, ঠিক সেই দিনই কেন যেন ঝর-বৃষ্টির কবলে পড়তে হয়। এই যেমন আজ, মোহাম্মদপুর থেকে বাসে উঠেছিল হিমেল, খিলগাঁও যাবে বলে। ঠিক ৫টায় তার থাকার কথা ‘ড্রিম ওয়েডিং’-এর সামনে। একটা ওয়েডিং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। আগে অবশ্য শুধু ফটোগ্রাফির কাজ করতো। হিমেল আর সৃজন এসে যুক্ত হওয়ার পর এটাকে একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টায় আছে শাহীন। সাথে আছে সাইফুল ভাই। সাইফুল ভাই মূলত ক্যাটারিংয়ের সাথে যুক্ত, লাইটিংয়ের ব্যবস্থাও করেন। শাহীন, হিমেল, সৃজন, সাইফুল তারা চারমূর্তি চার জায়গা থেকে এসে কেমন করে যেন জুটে গেল একসাথে। শাহীন, সৃজন আর হিমেল মূলত ইউনিভার্সিটির সময় থেকেই পরিচিত ছিল। চারুকলায় হিমেল আর সৃজন একসাথে পড়তো, আর শাহীনের সাথে পরিচয় হয়েছিল, এক বন্ধুর বড় বোনের বিয়েতে। হিমেল আর সৃজন গিয়েছিল বন্ধু তমালের বড় বোনের গায়ে হলুদের স্টেজ সাজাতে, আর শাহীন সেখানেই এসেছিল ছবি তুলতে। তমালের মিউচুয়াল ফ্রেন্ড হয়েই তারা সেদিন তমালদের বাড়ির ছাদে রাতভর আড্ডায় মেতেছিল, আড্ডার বিষয় কখনো ছিল ফটোগ্রাফি, কখনো আর্ট ক্র্যাফট কালচার, কখনো ফিল্ম কখনো রাজনীতি। নিশি পানীয় যখন চড়াও হলো সবার ওপর তখন আড্ডা হলো প্রলাপ এবং যারা বিয়ে করে এবং বিবাহিত জীবনযাপন করে, তারা যে আদতে ভণ্ড এবং চুতিয়া গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে এই ব্যাপারে তারা একমত হলো এবং একমত হয়ে তমালের আম্মার খুব প্রিয় দেশি মরিচে গাছের টবের ওপর বমি করলো। সেই আড্ডায় তিনজনের পরিচয়ই শুধু হয়নি, কিছু স্বপ্নের বন্ধুত্ব হয়েছিল হয়ত। সেই বন্ধুত্ব থেকেই তিন তরুণ এবং কিছুটা কম তরুণ সাইফুল ভাইকে সাথে নিয়ে নেমেছিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজে। শুরুটা কঠিন ছিল, স্বাধীনভাবে কিছু করতে চাইলেই আসলে কাজ করা যায় না। নিজেদের ব্যবসা করতে গেলে, পুঁজি খাটাতে হয়, তাদের পুঁজি ছিল সামান্যই তবে মাথাভর্তি গিজ গিজ করতো আইডিয়া। শুরুটা কাছের মানুষদের দিয়েই হয়েছিল। খালার ননদের মেয়ের বিয়ে, ফুফুর দেবরের শালার বিয়ে, আর মাঝে মাঝে কারো আকিকা, আকদ, খৎনা, জন্মদিনেও তারা কাজ করে দিয়েছে। যা সামান্য আয় হয়েছে, কিছুটা নিজেদের পকেটে, কিছুটা বিজনেস ডেভেলপমেন্টের জন্য রেখেছে। সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে সাইফুল ভাই। সাইফুল ভাই যদি সাহায্য না করতেন, পরম স্নেহে যদি অভিভাবকের মতো পাশে না থাকতেন এসব কিছুই এতো সুন্দর করে থাকতো না। শাহবাগের কাছে প্রচণ্ড জ্যামে আটকে পড়েছে সব গাড়ি। বাসের জানালা থেকে হালকা মাথাটা একটু বের করে দেখে নিল হিমেল। নাহ আজকে আর ৫টায় পৌঁছানো যাবে না। ফোনে একটু আগে সৃজন ঝাড়ি মেরে বলেছে, “হালা ফাউল, পাঠাও এ কইরা চইলা আইতে পারলা না তুমি? তুমার অতো বাসে উডন লাগে ক্যান?” এই পাঠাও উবার আসার পর হিমেল, বাসে চড়া ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু আজ মোহাম্মদপুর থেকে যখন সিটিবাসগুলো ছাড়ছিল, খুব উঠতে ইচ্ছে হলো। সেই স্কুলের সময়ে লাফিয়ে বাসে ওঠার দিনগুলোতে, টুম্পার সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। সেদিনও একটা কেমন বৃষ্টিমাখা মায়া মায়া দিন ছিল, আকাশটাকে মনে হচ্ছিল কেউ এঁকে রেখেছে। আধভেজা স্কুল ড্রেসের অর্ধেকটা ইন করা, কলারে ময়লা। আর টুম্পার টিপ টপ স্কুল ড্রেস, চুল আঁটসাঁট করে বাঁধা, আর দুটো বাহারি রঙের পাথর বসানো চুলের ছোট ক্লিপ। টুম্পার মাথায় কেমন যেন সুন্দর লাগছিল দেখতে। সেদিন কী এক সাহসে, বাড়ির ল্যান্ড লাইন নাম্বারটা কাগজে লিখে টুম্পার হাতে দিয়েছিল। হিমেল জানে, টুম্পা সেদিন কী দেখে অবাক হয়েছিল। টুম্পা দেখেছিল হিমেলের নির্লিপ্ত দুটো চোখ। কোনো ভয় নেই, কুণ্ঠা নেই, লজ্জা নেই, কী আত্মবিশ্বাস অথচ নির্লিপ্ত একজোড়া চোখ। হিমেলের আত্মবিশ্বাসের কারণটা কি ছিল সে দিন? হিমেল দেখতে সুন্দর, সেটা? নাকি তার নিজের মধ্যে আর যাই থাকুক না কেন, তার অনুভূতির মধ্যে কোনো ভেজাল নেই এই ব্যাপারটি। হিমেল যা করে যা বলে মন থেকে একদম নিরেট সততা নিয়ে করে। সততা নিজের প্রতি, নিজের অনুভূতির প্রতি। টুম্পা ধানমন্ডি শংকরের মোড়ে নেমে গিয়েছিল সেদিন, হিমেলও নেমে গিয়েছিল টুম্পার পিছনে। এক্সকিউজ মি বলে খুব স্মার্ট একটা ভঙ্গিতে ডেকেছিল টুম্পাকে, টুম্পা ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাতেই, হিমেল বলেছিল, ‘শুধু নামটা জানতে চাই’। মৃদু স্বরে, ‘টুম্পা’ শব্দটা উচ্চারণ করেই, সেই আঁটসাঁট চুল বাঁধা, পাথর বসানো ক্লিপের মাথাটা দ্রুত পালিয়ে গেল। হিমেল সেই পলায়ন পর্ব দেখে হেসেছিল কিছুক্ষণ। হিমেলের ফর্সা গায়ের রং, টিকালো নাক, কাটা কাটা চোখ মুখ, আর মাথাভর্তি হালকা লালচে কোঁকড়া চুল, অন্যদের থেকে একটু বেশি লম্বা হওয়াটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজে দিতো। তখন হিমেল পড়ে ক্লাস নাইনে, আর টুম্পা ক্লাস সেভেনে। ওই ঘটনার তিনদিন পর, সেদিনটা ছিল শুক্রবার, সকাল দশটায় হিমেলদের বাসার ল্যান্ড লাইনটা বেজে উঠলো, হিমেলের কেন যেন মনে হলো, এমন মধুর করে আগে কোনোদিন টেলিফোনটা বেজে ওঠেনি। প্রায় দৌড়েই ফোনটা সেদিন ধরেছিল সে। হাঁপিয়ে ওঠা নিঃশ্বাসে উত্তেজনা ঢাকছিল হিমেল, ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই, হিমেল খুব মুরব্বিয়ানা গলায় বলে উঠলো, হ্যাঁ টুম্পা বল। ওপাশে রিনরিনে গলার দ্বিধায় থাকা কণ্ঠস্বরটা থমকে গেল কেমন। হিমেলের খুব মজা লেগেছিল সেদিন, মজা লেগেছিল কেননা এক বালিকাকে সেদিন চমকে দিতে পেরেছিল সে। টুম্পা খুব আস্তে করে বলেছিল, আপনি কি সেই যার সাথে সেদিন দেখা হয়েছিল? বাসে? হিমেল গলায় আরো ভারিক্কি এনে বলেছিল, হ্যাঁ আমিই সেই, কেন? কোনো সন্দেহ? তো কি খবর? পড়ালেখা কেমন চলছে? টুম্পা সেদিন দুএকটা হ্যাঁ হু করে ফোন রেখে দিয়েছিল। হিমেল ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা, একটা রোমাঞ্চ, একটা অন্যরকম অনুভূতি টের পেয়েছিল সেদিন। একজনের ওপর হঠাৎ করে কর্তৃত্ব ফলানোর মধ্যে একটা পৈশাচিক আনন্দ আছে। হিমেলের টুম্পাকে দেখে হঠাৎ এমন করে ভালো লাগার কারণ কি ছিল সেদিন? কারণটা কি এটাই যে টুম্পার সাথে শানু আপুর কোথায় যেন একটা মিল আছে। শানু আপুর সাথে হিমেলের পরিচয় হয়েছিল এই মোহাম্মদপুরে ওরা যখন বাড়ি বদলে এসেছিল তখন। শানু আপুরা থাকতো নিচতলায়, তখন হিমেলরা উঠেছিল তিনতলায়। শানু আপুর বাবা তাদের সাথে থাকতো না, ঢাকার বাইরে চাকরি করতেন, সুনামগঞ্জ না কোথায় যেন। শানু আপু পড়তো চারুকলায়। খুব সুন্দর করে সাজাতে পারতো ঘরবাড়ি। তার বাসাভর্তি নানান হাতে বানানো জিনিস, দেয়ালে তার হাতে আঁকা ছবি। হিমেলকে দেখে, হিমেলের হাত খপ করে ধরে বলেছিল, এই পুচকা এইদিকে আয়, তোর একটা ছবি তুলে দেই। হিমেল মোটেই পুচকা ছিল না, ততদিনে ঘুম ভেঙে হিমেলকে লজ্জা মেখে বাথরুমে দৌড়াতে হয়। শানু আপুর কাছে হিমেল পুচকা হলেও, হিমেল শানু আপুকে দেখতো অন্যরকম মুগ্ধতায়। কেমন সুন্দর করে সাজতো, পরিপাটি করে। সুতির শাড়ি পরতো, চোখে মোটা করে কাজল আর কপালে লাল বড় একটা টিপ। প্রায়ই নানান অনুষ্ঠানে যেতো, তখন খোঁপায় ফুল গুঁজে নিতো। কখনো বেলি, কখনো গাঁদা, গোলাপ, কখনো ঝুমকো জবা। শানু আপুর কাছে গেলেই, তার শরীর থেকে কেমন যেন মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যতো। ছুটির দিনে শানু আপুর থাকতো সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা। বৃহস্পতি আর শুক্রবার প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতো শানু আপু। নানান জায়গায় যেতো হলুদের আর বিয়ের সাজসজ্জা করতে। আশপাশের এলাকায়, অন্য পাড়ায়। মাঝে মাঝে অনেক মেয়েকে সাজিয়ে দিতো শানু আপু। যাদের পার্লারে যাওয়ার বাজেট ছিল না, তাদের জন্য শানু আপুই ছিল একমাত্র ভরসা। সেই শানু আপু একদিন হিমেলকে এসে বলেছিল, এই হিমেল যাবি আমার সাথে এক জায়গায়? বিয়ের খাট সাজাতে হবে। আমাকে সাহায্য করতো যে রুমকি ও আসতে পারবে না। তুই যাবি? তুই যদি যাস তোকে কিছু টাকা দিবো, তেমন কিছু করতে হবে না। সন্ধ্যায় যাবো, আর রাতে চলে আসবো। ওই বাসায়ই খাওয়ার ব্যবস্থা করবে, পোলাও কোর্মা খেতে পারবি, বুঝলি? সেদিন হিমেল পোলাও কোর্মার লোভে হোক, শানু আপুর সাথে থাকার লোভে হোক, কিছু টাকা আয়ের পথ খুঁজে পেয়ে গেলো। বাসর রাতের খাট সাজাতে ওকে তখন, কখনো একশ, কখনো দুইশ আবার কখনো তিনশ টাকা দিতো। মাঝে মাঝে তিন চার জায়গায় খাট সাজানোর ডাক পেতো একদিনে, অনেক চাপ পড়ে গেলেও, একটা ভালো টাকা হয়ে যেতো হিমেলের। সেই টাকা থেকে হিমেল একবার দুটো শাড়ি কিনলো একটা শানু আপুর জন্য, একটা মায়ের জন্য। মায়ের প্রথমে ঘোর আপত্তি ছিল রাতে হিমেলের এইসব বাইরে বাইরে থাকা নিয়ে, হিমেল বলতো, প্রাইভেট পড়তে যাই চন্দন দা’র কাছে। মা সন্দেহ করতো, কিন্তু কিছু বলতো না। মায়ের জন্য শাড়ি কোথা থেকে পেলো, জিজ্ঞেস করতেই হিমেল বলেছিল স্কুলে একটা কুইজ কন্টেস্ট হয়েছিল, সেই কন্টেস্ট এ প্রাইজবন্ড জিতে, সেই টাকা ভেঙে শাড়ি কিনে এনেছে। মা সেদিন কেঁদে ফেলেছিল। শৈশবে কেন জানি হিমেল বুঝে গিয়েছিল, নিজের খরচ চালানোর জন্য বাবা-মাকে চাপ দেয়ার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা তাদের পরিবারের নেই। তাই পড়ালেখার চাপ খুব বেশি না থাকলে সে শানু আপুর ডাকে যেতো। তখন হিমেল ক্লাস এইটে পড়ে। শানু আপু তখন কমিয়ে দিয়েছিল নানান অনুষ্ঠানে ঘর সাজানোর কাজে যাওয়ার ক্ষেত্রে। কারণ রাত হয়ে যেতো, আর রাতে ফেরার সময় পাড়ার হাসিব নামের ষণ্ডা মার্কা ছেলেটা তার দলবল নিয়ে নানান আজেবাজে কথা বলতো শানু আপুকে। একদিন হিমেলকে এসে শানু আপু খুব অনুরোধ করেছিল সাথে যেতে। হিমেলের সেদিন গায়ে হালকা মতো জ্বর, তবুও, শানুর অনুরোধ হিমেল কিছুতেই ফেলতে পারেনি। হিমেলকে সাথে নিয়ে যখন ফিরছিল শানু, হাসিব তাঁর দলবল নিয়ে বাজে কথা বলা শুরু করেছিল যথারীতি। এক পর্যায়ে হিমেলের সামনেই হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। হিমেল তার শরীরে যতটুকু জোর ছিল, তার সবটুকু দিয়েই ঠেলে সরিয়ে শানুকে নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল। সেদিন বাড়ি ফিরে শানু খুব কেঁদেছিল। পরদিন সন্ধ্যায় হাসিব তার দলবল নিয়ে শানুদের বাড়িতে এসে হৈচৈ করে এসে আজেবাজেভাবে কথা বলে, শানুকে তুলে নিয়ে যাবে বলে হুমকি-ধামকি দিল। শানুর মা, এলাকার চন্দনকে নিয়ে থানায় জিডি করে এসেছিল। এর বেশ কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় শানু বাড়ি ফিরেছিল, বিধ্বস্ত হয়ে। দলবল নিয়ে শানুর কাপড় টেনেহিঁচড়ে ছিঁড়েছিল হাসিব। এই ঘটনার পরদিন, হিমেলের ঘুম ভেঙেছিল, আর্তচিৎকারে। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে দেখেছে অ্যাম্বুলেন্স এসেছে এবং সেখানে তোলা হচ্ছে শানু আপুকে। শানু রাতে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। সেই সুন্দর মুখটা ফুলে ঢোল হয়ে কেমন কালো হয়ে গিয়েছিল। ঠোঁটটা পুরো কালচে নীল হয়েছিল। হিমেল হতবাক হয়ে দেখছিল সব, কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল। বাস হালকা একটু এগিয়ে গেল, কিন্তু জ্যাম ছাড়ার নাম নেই। শাহবাগের মোড়ে, ফুলের দোকানগুলো দেখে নিলো হিমেল, তার খুব করে শানু আপুর কথা মনে পড়ল। শানু আপুর মৃত্যুতে হাসিবদের কী লাভ হয়ে ছিল জানে না হিমেল। এক সপ্তাহের মধ্যেই হাসিব বিয়ে করে বউ নিয়ে সংসার শুরু করে একদম ভালো ছেলে হয়ে গিয়েছিল। আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা এখনো বোধহয় এলাকায় দাপট নিয়ে আছে। এদের মধ্যে রফিকুল তো এখন ওয়ার্ড কমিশনার। হিমেলের মোবাইল ফোনটা আবার বেজে উঠলো, এবার শাহীন ফোন দিয়েছে, শাহীন ধীরস্থির গলায় বলল, ‘ক্লায়েন্ট আসতে দেরি আছে, তুই হয়ত ওদের আসার আগেই চলে আসতে পারবি, চলে আয় সমস্যা নেই’। এই সমস্যা নেই বলাটা শাহীনের মুদ্রাদোষ, কিংবা মুদ্রাগুণ। কারণ যে কোনো পরিস্থিতিতেই সে বলবে সমস্যা নাই। সমস্যা চরম হলেও তার মুখে একই ডায়লগ, সমস্যা নাই। এই দেশে শাহীনই হয়ত একমাত্র লোক, যার সমস্যা নেই। মোবাইল পকেটে গুঁজে আবার ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যায় হিমেল। টুম্পার সাথে হঠাৎ করে বন্ধুত্ব হয়েছিল একটা। এমন এক অধিকারে টুম্পার সব খবর আদায় করতো যেন এইরকম করে খোঁজখবর নেয়া ওর মৌলিক অধিকার এবং অধিকার ক্ষুণ্ন হলে ড. কামাল হোসেন বিনা পয়সায় ওর হয়ে মামলা করে দিবেন। শানু আপুর সাথে টুম্পার তেমন কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও, হিমেলের মনে হতো কোথায় যেন মিল আছে। বেশ কয়েকমাস এইরকম ল্যান্ড লাইন ফোনে আড্ডা চলছিল হিমেল আর টুম্পার। হঠাৎ সেই যোগাযোগে বাধা পড়ে যায়। তখন টুম্পা ক্লাস এইটে উঠেছে, বৃত্তি কোচিং করতো। হিমেল গিয়েছিল সেই কোচিংয়ের সামনে। টুম্পার এক বান্ধবীর মা দেখে ফেলেছিলেন, টুম্পা আর হিমেলকে কথা বলতে। এরপর সেই আন্টি বেশ অভিযোগের সুরেই টুম্পার মাকে ঘটনাটা জানায় এবং এতে টুম্পার মা টেলিফোন লাইন কেটে দেয়াটাই উচিত কাজ মনে করেন। টুম্পা বেশ কয়েকদিন ফোন করেছিল ওই ঘটনার পর। কিন্তু হিমেলের মনে হয়েছিল, এতো বাধা বিপত্তি পার করে কথা বলার মতো প্রেমে সে পড়েনি, আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার এতে টুম্পার ক্ষতি হচ্ছে। এরপর একদিন টুম্পাকে ফোনে আর যোগাযোগ হবে না বলে বন্ধুত্বের ইতি টেনে দিয়েছিল হিমেল। এরপরও বেশ কিছুদিন পরপর ল্যান্ড লাইনটা বেজে উঠতো, হিমেলের মনে হতো ফোনটা কাঁদছে। খিলগাঁও পৌঁছে মোবাইলটা বের করে সময় দেখে নিলো হিমেল, সোয়া ছয়টা বাজে। অফিসের সামনে আসতেই শাহীনের ফোন, ক্লায়েন্ট চলে এসেছে হয়ত। হিমেল ফোন রিসিভ করে বলল, চলে এসেছি, উপরে উঠছি। যারা এসেছেন, তারা শাহীনের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হন। বাজেট, তাদের কি কি চাহিদা, ড্রিম ওয়েডিং কেমন সেবা দিতে পারবে এইসব হিসাব কিতাব শেষ করে, আরো এক দফা মিটিংয়ে বসলো তারা, ফোন করে সাইফুল ভাইকেও আসতে বললো। বিয়ের বাকি আছে তিন সপ্তাহের মতো। এখন যেমনটা হয়, ছেলেপক্ষ মেয়েপক্ষ একসাথে হবে সব কিছু। তিনটা প্রোগ্রাম করবে, সঙ্গীত সন্ধ্যা, হলুদ সন্ধ্যা, আর রিসিপশন, বিয়ের আকদ নাকি আগেই হয়ে গেছে। সঙ্গীত সন্ধ্যার কালচারটা নতুন শুরু হয়েছে, মোটামুটি কোনো ব্যান্ড বা গাইতে পারে এমন কাউকে এনে, বেশ কিছুক্ষণ গান শোনা, তারপর ডিজের মিউজিকে উদ্দাম নাচানাচি। প্রথম যে সঙ্গীতটার আয়োজন করেছিল হিমেলরা, গান গাইতে এসেছিল সৃজনের কাজিন তার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে যারা মিউজিক করে। সাথে একজন ডিজে, নাম ডিজে জজ। হিমেল ভাবতে পারেনি এই বিয়েতে এই অবস্থা হবে, কারণ মেয়ের বাবা-মা হজ করে এসেছেন, মেয়ে নিজেও হিজাব পরে। বিয়েতে লাল বেনারশির ওপর ম্যাচিং হিজাব পরে মেয়ে সাজবে, এমনটাই সৃজন তার পার্লারের বকুল ভাবিকে বলে দিয়েছিল। সেই বিয়ের সঙ্গীত সন্ধ্যায় হিজাব পরা মেয়ে আন্টিরা কী তুমুল নাচই না দিলো। হায়রে বাঙালি মুসলমানের মন। যে মেয়েটি আগে মুক্তভাবে ঘুরতো, স্কুলে কলেজে নাচ করতো, গান গাইত কিংবা খেলাধুলায় দারুণ ছিল, আজ হঠাৎ করে বদলে গিয়ে নিজের ভোল পাল্টে ফেলে হিজাব ধরেছে। তারা নাকি তাদের ভুল বুঝতে পেরে এখন সঠিক পথে এসেছে। জননী জন্মভূমি, আজ শাড়ির ওপর হিজাব চড়িয়েছেন। এগুলো নিয়ে হিমেল অবশ্য তেমন ভাবে না, তেঁতুলবাদ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এইতো কয়েকদিন আগেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাতের আঁধারে হল থেকে অনেক ছাত্রী বেরিয়ে এসেছিল। সেই মেয়েদের চট্টগ্রাম থেকে তেঁতুল বার্তা পাঠায়নি সে দিন কেউ। এর রহস্য কী? গোটা দেশটাতেই মৌলবাদের উত্থান শুরু হয়েছে। এদের রুখতে পারা যেতো যদি দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনটা শক্তপোক্ত হতো। রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা, তারাই যেখানে আপস করে সেখানে, মৌলবাদের উত্থান তো হবেই। মোটামুটি সমস্ত আয়োজন শেষ হিমেল সঙ্গীত সন্ধ্যার স্টেজ সাজিয়ে ডেকোরেশন শেষ করে দিয়েছে, একটু ওয়াশরুমে গিয়ে পোশাকটা পাল্টে নেবে। আগে পোশাক পাল্টানোর চিন্তা করতো না। কিন্তু সে দেখেছে, পোশাকের ওপর মানুষের ব্যাবহার নির্ভর করে। সৃজন দেখতে একটু ছোটখাটো, গায়ের রং শ্যামলা, তাই ও ভালো কাপড়, বডি স্প্রে নিয়ে বেশ সিরিয়াস, নইলে ওর ধারণা, লোকে নাকি ওকে কামলা ভাবে। হিমেল রেডি হয়ে বের হলো। শাহীন ক্যামেরা তাক করে টিপ্পনি কাটলো, কি হিরো? পোজটোজ দে দেখি। তোরে কতবার বললাম, মডেলিংয়ে নাইমা পড়, নাহ তুই শুনলি না, বলতে বলতে ক্যামেরায় শাট শাট করে শব্দ তুলতে লাগলো। ততক্ষণে বর কনে এসে গেছে, প্ল্যান অনুযায়ী তাদের বরণ করা হচ্ছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওয়েস্টার্ন ইন্সট্রুমেন্টাল বেজে চলেছে। এতক্ষণ ভালো করে খেয়াল করেনি হিমেল নানান ব্যস্ততায়। হঠাৎ অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো হিমেলের, কাউকে কোনোদিন বলতে বা বোঝাতে পারবে না এমন অনুভূতি। কনে কে হিমেল চেনে, কিংবা চিনতে পেরেছে আজ। কতদিন পর! টুম্পা, কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে দেখতে। বড় হয়ে গেছে। সেই টান টান চুল বাঁধা মুখটা আর ভয়ে ভয়ে তাকানোটা আজ আর নেই। কতো বদলে গেছে। হিমেল একবার ভাবলো গিয়ে পরিচিত হবে। তারপর ভাবলো থাক, কী দরকার। কত মানুষই তো হারিয়ে যায়, টুম্পা হারিয়ে গেছে হিমেলের জীবন থেকে, একদিন যেমন শানু আপুও হারিয়ে গিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষ, নানান জিনিস তদারকি করছিল হিমেল, শাহীন এসে বলল, কিরে তোর কি শরীর খারাপ লাগছে? তুই চাইলে কালকে না আসলেও চলবে, সৃজনকে বলে দিবো নতুন ছেলেটাকে সাথে নিয়ে কাজ নামিয়ে দিতে পারবে। হিমেল হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। সে আসলে জানে না তার কেমন লাগছে, কিংবা এই এতো বছর পর টুম্পাকে দেখে তার সত্যি কেমন অনুভব করা উচিত। রিকশা নিয়েছে হিমেল একটা, হালকা ঠাণ্ডা লাগছে তার। আকাশে তারার মেলা, বিছিয়ে থাকা শিউলি গাছের নিচে যেন সাদা সাদা ফুল। হিমেলের ইচ্ছে হলো, টুম্পার সাথে কথা বলতে। ওই অপরিচিত বড় হয়ে বিয়ের সাজে সেজে থাকা কনে টুম্পা নয়, সেই ক্লাস সেভেনে পড়া রিনরিনে গলার মেয়েটার সাথে। হিমেলের ইচ্ছে হলো বলতে, এই নাও, এক ঠোঙা তারা, তোমার জন্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App