×

মুক্তচিন্তা

স্বাস্থ্যকে ভালোবাসি, তামাককে নয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০১৯, ০৮:৪৫ পিএম

স্বাস্থ্যকে ভালোবাসি, তামাককে নয়
স্বাস্থ্যকে ভালোবাসি, তামাককে নয়

বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞান প্রমাণিত উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ হচ্ছে তামাক ও সিগারেট। একটি সিগারেটের তামাকে রয়েছে প্রায় ৭ হাজার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ এবং গ্যাস। যার মধ্যে ৭০টি পদার্থ ক্যান্সার বৃদ্ধির কারণ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সিগারেট বা তামাক থেকে ২৫টি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই অল্প বয়সের শিশুদের জীবনের শুরুতেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে বর্তমানে Global Adult Tobacco Survey 2017  হিসাব মতে, ৩৫.৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব) মানুষ তামাক সেবন করেন। নারীদের মধ্যে এই হার ২৫.২ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ। দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক বা গুল, জর্দা, সাদাপাতা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে নারী ২৪.৮ শতাংশ এবং পুরুষ ১৬.২ শতাংশ, যা মোটের হিসাবে ২০.৬ শতাংশ এবং ধূমপায়ী ১৮ শতাংশের মধ্যে পুরুষ ৩৬.২ শতাংশ, নারী ০.৮ শতাংশ। পরিসংখ্যানে বিশ্বের তামাক ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো অন্যতম। তামাক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের প্রকোপও দিন দিন বেড়ে চলেছে।

WHO-এর মতে বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩৮ শতাংশের, হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর ৩০ শতাংশের, ফুসফুসে যক্ষ্মার কারণে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশের এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২০ শতাংশের জন্য দায়ী ধূমপান বা তামাক। ২০০৯-এর তুলনায় ২০১৭ সালে সার্বিকভাবে তামাকের ব্যবহার ১৮.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে (গ্যাটসের গবেষণায়)। নারীদের মধ্যে হ্রাস পেয়েছে মাত্র ১২.২ শতাংশ, পুরুষদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার পুরুষদের মধ্যে ২০০৯-এর তুলনায় ২০১৭ সালে প্রায় ৩৯ শতাংশ হ্রাস পেলেও নারীদের মধ্যে হ্রাস পেয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। গবেষণায় বিগত আট বছরে তামাকের ব্যবহার কাক্সিক্ষত মাত্রায় হ্রাস পায়নি।

আইএইচএমই (ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স এন্ড ইভালুয়েশন) ২০১৩ গবেষণা অনুসারে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করে। প্রতি বছর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই দিন থেকে তামাক বা ধূমপান ছেড়ে দিয়ে তামাকমুক্ত হওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া। সেই সঙ্গে তামাক ও ধূমপানের কারণে স্বাস্থ্যের ক্ষতি ও দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা।

‘Tobacco Kills’ অর্থাৎ তামাক মৃত্যু ঘটায়। এই তামাকটি কী? এই তামাকটিই হচ্ছে- সিগারেট, বিড়ি, হুক্কা, চুরুট, জর্দ্দা, গুল, খৈনি, দোক্তা, সাদাপাতা ইত্যাদি।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ‘তামাক মৃত্যু ঘটায়’ সেই সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব স্বীকৃত FCTC অর্থাৎ Frame Work Convention on Tobacco Control-এর ১১০টিরও বেশি দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে যখন একমত হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তামাক এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ যেটা মানুষ ব্যবহৃত বদ অভ্যাস এবং যার ফলশ্রুতিতে ক্যান্সারসহ দেহের মারাত্মক ২৫টি রোগের সৃষ্টি হয়। যেহেতু এর ব্যবহার বা তামাকের অভ্যাস থেকে মানুষকে বাঁচানো প্রয়োজন সেহেতু প্রতিটি দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন জারি করা জরুরি এবং বাংলাদেশ সেই স্বাক্ষরকারী দেশের মধ্যে প্রথম দেশ। ২০০৫ সালে এ দেশে মহান জাতীয় সংসদে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়। এবং বর্তমান সরকারের সময়ে ২০১৩ সালে সেই আইনকে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়। বর্তমানে আইনের মাধ্যমে পাবলিক প্লেসে কেউ ধূমপান করলে ৩০০ টাকা জরিমানা। প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে তামাকের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। সিগারেট প্যাকেট ছবিসহ সতর্কবাণী। স্পন্সর, বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ ইত্যাদি আইন এখন বাস্তবায়িত হয়েছে। ইতোমধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং বাংলাদেশ এখন সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে কোনো ধরনের তামাক শিল্পকেই সরকারি সহযোগিতার সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সফল বাস্তবায়নের ফলে তামাকের ব্যবহারও কমে এসেছে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তামাক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ এফসিটিসি প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ও প্রথম স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয় এবং ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে আরো যুগোপযোগী করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা পাস করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রগতি নিরূপণে প্রণীত সরকারের এসডিজি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ফ্রেমওয়ার্কে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বছরভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, এসডিজির স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা তিন-এর অংশ হিসেবে এফসিটিসিকে বাংলাদেশ সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

তামাক মানুষকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। তামাকের কারণে পৃথিবীতে প্রতি বছর ৭০ লক্ষাধিক মানুষ অকালে মারা যায়। এর মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বছরে ৯ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। ধূমপানকে বলা হয় মাদকসেবনের প্রবেশপথ। তামাক সেবনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম মাদকের দিকে ধাবিত হয়ে পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

প্রতি বছর তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণে বেড়ে গেছে, যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশাল বোঝা। হিসাব করে দেখা গেছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবেও দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তামাক খাত থেকে, তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্য খাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় হয়। এভাবে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। তামাকজনিত ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি বছর তামাকের কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৩ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে। WHO ২০১৪ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায় এমন তিনটি দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের তামাকের বর্তমান কর কাঠামো বেশ জটিল। তামাক পণ্যের ধরন এবং ব্র্যান্ডভেদে সম্পূরক করের উল্লেখযোগ্য তফাৎ রয়েছে। বিড়ির ওপর ধার্য কর অত্যন্ত কম এবং তা কেবল সরকার নির্ধারিত ট্যারিফ ভ্যালুর প্রযোজ্য। দামি ব্র্যান্ডের তুলনায় সস্তা ব্র্র্যান্ডের ওপর করের মাত্রা অনেক কম। সিগারেট ক্ষেত্রে স্তরভিত্তিক যে কর কাঠামো বিদ্যমান, যা ভিন্ন ভিন্ন অ্যাড-ভ্যালোরেম কর হিসেবে খুচরা মূল্যস্তরের ওপর ধার্য রয়েছে। বাংলাদেশ সিগারেটে মিথ্যা মূল্যস্তর ঘোষণায় প্রায় ৭শ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালের ৩০-৩১ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পিকার’স সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সব মৃত্যুর শতকরা ৬৩ শতাংশ অসংক্রামক রোগ এবং তার মধ্যে একমাত্র দায়ী হচ্ছে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য। বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহার মৃত্যুর প্রতিরোধমূলক একমাত্র কারণ হিসেবে বিবেচিত এবং প্রতি ১০ জনে একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী।

বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞান প্রমাণিত উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ হচ্ছে তামাক ও সিগারেট। একটি সিগারেটের তামাকে রয়েছে প্রায় ৭ হাজার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ এবং গ্যাস। যার মধ্যে ৭০টি পদার্থ ক্যান্সার বৃদ্ধির কারণ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সিগারেট বা তামাক থেকে ২৫টি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই অল্প বয়সের শিশুদের জীবনের শুরুতেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের ফলে ফুসফুস ক্যান্সার, মুখগহ্বরের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ (সিওপিডি), ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা (পলমনারিটিউবারকুলোসিস), হাঁপানি, বার্জাজ ডিজিজ ইত্যাদি রোগে ১২ লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়, এর মধ্যে ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ অকাল পঙ্গুত্বের শিকার হয়। এবং প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তামাক চাষ জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। তামাক চাষে মাটির উর্বরতা কমে যায়। ফলে নতুন নতুন জমিতে তামাক চাষ করতে হয়।

২০০৯ সালে তামাকের ব্যবহার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ৩৫.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। রিলেটিভ রিডাকশন (জবষধঃরাব জবফঁপঃরড়হ বা আপেক্ষিক হ্রাস) বিবেচনায় নিলে ৮ বছরে তামাকের ব্যবহার কমার হার ১৮.৫ শতাংশ। তামাকের ব্যবহার কমে আসার এ প্রবণতা ইতিবাচক। এতে প্রমাণ হয়, তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। আমি মনে করি, সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং গণমাধ্যমের সম্মিলিত প্রয়াসে তামাকের ব্যবহার কমে আসছে। এই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সাল নাগাদ অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ৯টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে তামাকের ব্যবহার ৩০ শতাংশ কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করা সম্ভব হবে।

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস (মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App