×

মুক্তচিন্তা

২০২১-এর আগে তিস্তা নিয়ে অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মে ২০১৯, ০৯:০১ পিএম

২০২১-এর আগে তিস্তা নিয়ে অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ
২০২১-এর আগে তিস্তা নিয়ে অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ
সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে। বিজেপির নিজেরও আসন সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ২৮২ থেকে ৩০৩। সবমিলিয়ে বিজেপি এখন খুবই আত্মবিশ্বাসী একটা অবস্থানে আছে। তারা আর রাজ্যভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দল না, তারা এখন দেশব্যাপী অবস্থান বিস্তৃত করতে পেরেছে। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদি যখন আজ শপথ নেবেন, সেই আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ অবশ্যই থাকবে। ইতোমধ্যে তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন এবং ভারতের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর যেটা বলেছেন- তাতে অনেকটাই উদার মনের পরিচয় পাওয়া গেছে। আগের স্লোগান- সবকা সাথ, সবকা বিকাশের সঙ্গে যুক্ত করেছেন সবকা বিশ্বাস। অর্থাৎ তিনি সবার বিশ্বাস অর্জন করতে চান সেই সঙ্গে সবার ওপর বিশ্বাসও রাখতে চান। এ ধরনের ইতিবাচক বক্তব্য তখনই দেয়া যায়, যখন এত বড় একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে যাওয়া একজন নেতা আত্মবিশ্বাসী অবস্থানে থাকেন। এই আত্মবিশ্বাসের জায়গায় থেকে যখন তিনি ক্ষমতায় আসীন হবেন, তখন পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে ভারতের অবস্থান কী দাঁড়াবে সেটাই দেখার বিষয়। কারণ অনেক দিন পর এত শক্তিশালী একটি সরকার ভারতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে। ভারত কিন্তু এখন আর আঞ্চলিক একটি শক্তি নয়, বিশ্ব দরবারেই তাদের বড় ভূমিকা আছে। বিবিসির একটি পর্যালোচনায় ভারতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক রাজনীতিটা কট্টরপন্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে ইউরোপে বা যুক্তরাষ্ট্রে যে রকম কট্টরপন্থা দেখছি, ভারতে হয়তো তেমনটা নেই। কারণ ভারতের সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে সব কথা বলতে পারেন। এ ছাড়া ভারতের আরেকটা যে বড় দল রয়েছে- কংগ্রেস ততটা আসন পায়নি, কিন্তু এটি ভারতের প্রাচীনতম দল। দীর্ঘদিন ভারতে তারা সরকার পরিচালনা করেছে। জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধীর মতো নেতৃত্ব তারা ভারতকে দিয়েছে। সবকিছু মাথায় রেখে মনে হচ্ছে- অভ্যন্তরীণভাবে বিজেপির একটা চ্যালেঞ্জ থাকবে। কোনো কোনো জায়গায় তারা বেশ জোরেশোরে প্রবেশ করেছে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। দুই বছরের মাথায় ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন রয়েছে। সেখানে এবার তারা যে অবস্থানে এসেছে সেটাকে আরো দৃঢ় করার চেষ্টা করবে অবশ্যই। পশ্চিমবঙ্গের সরকার পরিচালনার লক্ষ্যও হয়তো থাকবে। অপরদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের লক্ষ্য হবে- তাদের ঘাঁটি পুনরুদ্ধার এবং রক্ষা করা। এটা মোদির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বাংলাদেশের দিক থেকে যেটা দেখার বিষয়- ভারত ও বাংলাদেশের দুই সরকারের সম্পর্ক এখন অত্যন্ত গভীর। আমাদের প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদিকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন। তার শপথে অংশ নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এই যে একটা প্রতীকী পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ, রাষ্ট্রপতিকে পাঠাচ্ছে একজন প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানে- এটা আসলে সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করার প্রয়াস। তবে সম্পর্ক তখনই শক্ত হয় যখন তা সাধারণ জনগণকে স্পর্শ করে। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো ও উষ্ণ, সব দিকেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তবে অভিন্ন নদীর পানির বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মনে এখনো ক্ষোভ রয়েছে। সাম্প্রতিককালে এসেছে রোহিঙ্গা ইস্যু। ভারত এই ইস্যুতে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এশিয়াতে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক যে লক্ষ্য রয়েছে- সেটাতে কি আপেক্ষিকভাবে মিয়ানমারের গুরুত্ব বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, নাকি ভারত এখানে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করবে। ভারসাম্য যদি আনতে চায়, আমরা আশা করব রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত কোনো একটি গঠনমূলক এবং যুগান্তকারী ভূমিকা নেবে। যা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যেতে সহায়ক হবে। কারণ এটা শুধু শরণার্থীর বিষয়ই নয়, নিরাপত্তার সঙ্গেও এর বিরাট সম্পর্ক রয়েছে। রোহিঙ্গারা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে উঠতে পারে। ইতোমধ্যেই আমরা বিভিন্ন ঘটনায় এর আভাস পাচ্ছি। আগামীতে তা আরো প্রকট হয়ে উঠতে পারে। আমরা আশা করব- রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ভারত কার্যকর ভূমিকা নেবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন সময় বলেছেন, উনি আশা করেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত সরকার কোনো একটা উদ্যোগ নেবে। আমি নিঃসন্দেহে মনে করি, আগামী ৫ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরো বেশি শক্তিশালী হবে। তবে এই বিষয়গুলো অবশ্যই মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রশ্নগুলো প্রায়ই আসে, যেমন- আমাদের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি; এ ব্যাপারে ভারত আন্তরিক হবে। নির্বাচন শেষে ভারতের নতুন সরকার আজ দায়িত্ব নেবে। এই মুহূর্তে তিস্তা চুক্তিকে তারা কতটা অগ্রাধিকার দেবে সেটা বলা মুশকিল। কারণ এশিয়া এমনকি বিশ্বের ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যান্য জিনিস অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। ইরানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের একটা সম্পর্ক আছে। ইরান থেকে ভারত তেল আমদানি করে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে ট্রাম্পের একটা শক্ত অবস্থান রয়েছে- সেটাকে ভারত কীভাবে হ্যান্ডেল করবে। তারপরে বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ; চীনের এই উদ্যোগটা নিয়ে ভারতের নীতিগতভাবে কিছু বিরোধিতা রয়েছে। ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই বিরোধিতাটা নিঃসন্দেহে যুক্তিসঙ্গত। কাশ্মিরের ওপর দিয়ে বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নেয়া হয়েছে, এটাতে ভারতের আপত্তি থাকার কথাই। একইসঙ্গে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইন্দোপ্যাসেফিক স্ট্র্যাটেজি (ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা); এই বিষয়গুলোতে ভারত সরকারের অগ্রাধিকার থাকবে বলেই আমি মনে করি। রাষ্ট্রপতি যেহেতু যাবেন, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার কথা হবে। আমি আশা করব তিস্তার বিষয়টি তিনি উল্লেখ করবেন। যদিও সমাধানটা হয়তো দ্রুত আসবে না। তবে ২০১২ কে যদি বিজেপি মাথায় রাখে, তাহলে দেখতে হবে মমতা ব্যানার্জী তিস্তার ব্যাপারে কেন এত অনড় অবস্থায় রয়েছেন। উনি মনে করেন এটা উনার জন্য একটা ভোটব্যাংক। বিজেপি যদি মনে করে, রাজ্য সরকারেও তাদের ক্ষমতায় আসতে হবে- তাহলে একই ভোটব্যাংকটা তারা ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। সেটা যদি হয়, তাহলে ২০২১ সালের আগে তিস্তার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হবে না। আমরা সময় সময় ভারতীয় সরকার ও অন্যান্য পক্ষ থেকে শুনি, শুধু তিস্তা নয় কয়েকটা নদীকে নিয়ে একটা রিভার বেসিন এপ্রোচ করার কথা ভাবা হচ্ছে। যাতে উভয় পক্ষের লাভ-লোকসানের ব্যাপার মাথায় রেখে সমাধানের দিকে এগুনো যায়। আমাদের ৫৩টা নদী এখনো ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত রয়েছে। যদিও সব নিয়ে সমস্যা নেই, ৪/৫টা নিয়েই সমস্যা। সবমিলিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে হয়তো একটা সম্মিলিত উদ্যোগ আসতে পারে। আমি মনে করি না, ভারত সরকার শুধু তিস্তা নিয়ে রাতারাতি তেমন কোনো উদ্যোগ নেবে। তবে আমরা আশা করব নরেন্দ্র মোদি সরকার তিস্তাকে এককভাবে ধরে বা রিভার বেসিন এপ্রোচ- যে পদ্ধতিতেই হোক একটা সমঝোতায় আসবে। কেননা আমি মনে করি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। যেটা অতীতের অনেক সরকারের মধ্যে ছিল। এই সদিচ্ছাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি, তাই আশা করি কোনো না কোনোভাবে একটা ইতিবাচক রেজাল্ট আসবে। লেখক : রাজনীতিবিদ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। অনুলিখন : মুকুল শাহরিয়ার

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App