×

মুক্তচিন্তা

মোদির কাঁধে দায়িত্বের ভার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মে ২০১৯, ০৮:৫০ পিএম

মোদির কাঁধে দায়িত্বের ভার
মোদির কাঁধে দায়িত্বের ভার
রাজনীতি সাধারণত একটা ছকে চলে। সময়ে সময়ে সেটা পাল্টায়। মোদি যদি দেশের মানুষকে তার কাজ দিয়ে খুশি রাখতে পারেন। দেশ ভবিষ্যতেও শক্তিশালী সরকার গড়ার রায় দেবে। মানুষ চায় আমাদের দেশ অন্য সবাইকে ছাপিয়ে যাক। পুরনো ঘ্যানঘ্যানানি আর পছন্দ নয়। মোদিও বলেছেন এবারের সরকারের কাজই হবে যারা ভোট দেয়নি তাদেরও খুশি করা। দেখা যাক কি হয়। মোদি যদি ডোবান তাহলে আবার নতুন পথের সন্ধান করতে হবে।
তত্ত্বে রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের উত্থানকে সাধুবাদ জানানো হলেও বাস্তবে কিন্তু অভিজাত শ্রেণি তার ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের নেতা, মন্ত্রী এবং আমলাদের অনেকেই রাজা-রাজড়া গোত্রের ছিলেন। ১৯৭৭ সালের পর থেকে সে ক্ষমতা আপাতভাবে নিম্নবর্গের লোকের হাতে গেলেও, একশ্রেণির উচ্চবর্গীয় ২০১৪ সাল অবধি তার রাশটা ধরে রেখেছিলেন। অন্তত এরা তাই ভাবতেন। ২০১৯ সালে এসে তারা চরম ধাক্কা খেলেন। সব আপত্তি, খবর দেশের এবং বিদেশের (এদের অনেকেরই এক পা বিদেশে থাকে) কাগজের দিস্তে দিস্তে লেখা, টিভিতে ইন্টারভিউ ইত্যাদি সব অগ্রাহ্য করে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি আসন ভোটের হার বাড়িয়ে, দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসীন। বলে রাখা ভালো। উচ্চবর্গীয় বলতে আমি জাত-পাত বোঝাচ্ছি না। এটা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা একটা শিক্ষিত শ্রেণি। বড় সাংবাদিকরাও এ গোত্রেই পড়েন। এতদিন ভাবা হতো এরাই জনমত তৈরি করেন। ফলে সব রাজনৈতিক দলই এদের পাত্তা দিত। মোদি এসবে পাত্তা না দিয়েও জিতে গিয়ে এদের পথে বসিয়েছেন। আসলে এটাই মোদির বিশেষত্ব। চেনা পথে উনি হাঁটেন না। তাহলে মোদি কোন পথে হাঁটেন? কেনই বা লোকে তাকে ঢেলে ভোট দেয়? সেটা বুঝতে হলে গত শনিবারে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরে সংসদের সেন্ট্রাল হলে, এনডিএ জোট সরকারের ৩৫৩ জন নবনির্বাচিত সাংসদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটা শুনতে হবে। গ্যারান্টি দিচ্ছি, আজ থেকে বহু বছর পরও ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে এ ভাষণের খোঁজ পড়বেই। খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, রাজনীতি সাধারণত একটা ছকে চলে। সময়ে সময়ে সেটা পাল্টায়। তবে রাজনীতিকরা চট করে পাল্টাতে চান না। এই ছক ভাঙার ব্যাপারগুলো বেশিরভাগ সময়েই কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টায়। যেমন ১৯৭৭ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণের জনতা পার্টির হাতে ইন্দিরা গান্ধীর পতনের পর, ভারতের রাজ্য সরকারগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, রাজনীতির ছক চিরকালের জন্য পাল্টে যায়। প্রাদেশিক দলের উদ্ভব হয়। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী সংখ্যালঘু ভোটের তাড়নায়, শাহবানু খোরপোশ মামলায় তিন তালাক প্রথার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সংসদে গায়ের জোরে উল্টে দেন। এর ফলে দেশজুড়ে হিন্দুদের ভেতর যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তা সামলাতে গিয়েই বোধহয় অযোধ্যায় বাবরি মসজিদে মন্দিরের তালাও খুলে দেন। বিজেপি পার্টি তখন সবে হয়েছে। তারপর কি হয় সবার জানা। তার ওপর আবার ১৯৯০ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং সংরক্ষণের মাধ্যমে হিন্দু ভোটকে জাতপাতের হিসেবে আলাদা করে দেন। উত্তরপ্রদেশের বিএসপি পার্টির এ সময় থেকেই রমরমা। কেন্দ্রেও তখন থেকেই কংগ্রেসের আধিপত্য শেষ, জোট রাজনীতির উত্থান। ১৯৮৪ সালের রাজীব গান্ধীর পর, এই ধারা ভেঙেছিল ২০১৪ সালে, বিজেপির নিজের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে। এই ধারা বদলের পেছনে দুটো বড় কারণ আছে। প্রথম, গোধরা পরবর্তী হিংসায় একতরফাভাবে মোদিকে আক্রমণ আর গোধরা নিয়ে নিস্তব্ধতা। মোদি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ছ-মাসের মধ্যেই অযোধ্যা ফেরত একদল করসেবককে গোধরায় ট্রেনের কামরায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। তার উত্তরে হিংসা। ২০০৪ সাল থেকে কেন্দ্রে কংগ্রেস পরিচালিত জোট সরকার মোদিকে অপদস্ত করার চেষ্টার কসুর করেনি। আদালতও যথেষ্ট কড়া ছিল। কিন্তু মোদিকে ছোঁয়া যায়নি। কিন্তু তাতে মোদি বিরোধীদের আক্রমণ থামেনি। বরং জোরদার হয়েছে। অনেকে এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। দ্বিতীয় কারণটার উদ্ভাবক মোদি নিজে। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক আক্রমণের মুখে লোকে যখন গুটিয়ে যায়। মোদি তখন গুজরাটে দুর্নীতিবিহীন, উন্নয়নমুখী সরকার গড়ে প্রচারের অভিমুখ বদলে দেন। দিল্লিতে ২০১৪ সালে সরকার গড়ার সময়ে তাই মোদির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী ভোট যেমন ছিল, তার থেকে বেশি ছিল সাধারণ মানুষের ভোট যারা চলতি রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়েছে এবং নতুন নেতা খুঁজছে। বিশ্বাস করা শক্ত হলেও পরিসংখ্যান বলছে, শুধু হিন্দু ভোট না। মোদি কম বয়সী মুসলমানদের অল্প হলেও ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৯-এ এসে দেখা যাচ্ছে মোদি সংখ্যালঘু মহিলাদের বেশ কিছু ভোট পেয়েছেন। কারণ তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইন আনার প্রতিশ্রুতি। লক্ষ করার বিষয়, তিন তালাকই হোক বা রাম মন্দির কিংবা কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা, দলের পুরনো হিন্দুত্ববাদী সমর্থকদের দাবি অগ্রাহ্য করে, মোদি ২০১৪-২০১৯ শাসনকালে আগ বাড়িয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি। ধীরে চল নীতিতে আস্থা রেখে সবটাই কোর্টের ওপর ছেড়েছেন। তিন তালাক হয়তো এবার রদ হবে। কিন্তু নিশ্চিন্ত করে বলতে পারি, রাম মন্দির ঝুলেই থাকবে, কারণ কোর্টও এসব ব্যাপারে জড়াতে চাইছে না। এগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো, খবর কাগজে যাই লেখা হোক না কেন। মোদি হিন্দুত্ববাদের ধারা ধরে এগোতে চাইছেন না। কারণটাও পরিষ্কার। মোদি আসার আগে বিজেপির ভোট ছিল মেরেকেটে ১৫ শতাংশ। এখন ৪০ শতাংশ। এই বাড়তি ভোটটা আসছে কম বয়সী বা সাধারণ অরাজনৈতিক মানুষের কাছ থেকে। রাম মন্দিরে এদের আর উৎসাহ নেই। আরেকটা কথাও ভাবা দরকার। ২০১৪-তে যদি কেউ বা কারা ধর্মের সুড়সুড়ি খেয়ে মোদিকে ভোট দিয়েও থাকেন, পাঁচ বছর পর কি তাদের আর অত উৎসাহ থাকবে? অতীতের রেকর্ড বলছে থাকে না। বিজেপিকে বেশ কসরত করে, জোট বানিয়ে ১৯৯৮ সালে ক্ষমতায় আসতে হয়েছিল, আর ২০০৪ সালে তার পতন হয়। কথাটা খুব পরিষ্কার রাজনীতিতে ফাটা রেকর্ড বাজালে, ভারতের বামদলগুলোর মতো অবস্থা হবে। ভোট কমেই যাচ্ছে। একই কথা প্রযোজ্য মোদির বিরোধীদের ক্ষেত্রেও। বিএসপির দলিত ভোটব্যাংক আর নেই। মুলায়ম, লালু এদের যাদব ভোট নেই। লালুর পার্টি এবারে একটাও সিট পায়নি। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর অবস্থাও টলোমলো। অন্তত দুটো জেলায় জানি, বিজেপি ভালোরকম সংখ্যালঘু ভোট পেয়েছে। মোদি ভোট পাচ্ছে কি করে সেটা বুঝতে গেলে সরকারের কাজের খতিয়ান দেখুন। মোদি আসার আগে ভারতে ৫৬ শতাংশ বাড়িতে রান্নার গ্যাস ছিল। ২০১৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৮০ শতাংশ। গরিবদের ভর্তুকিতে গ্যাস দেয়া হয়েছে। ভর্তুকির টাকাটা সরকার দেয়নি। মোদির ডাকে ১.২৫ কোটি পরিবার ভর্তুকি ছেড়ে বাজার দামে গ্যাস কেনা শুরু করে, যার মধ্যে এই লেখকও আছে। এ রকম অনেক উদাহরণ আছে, গরিব মানুষকে ব্যাংকের আওতায় আনা। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের মাধ্যমে গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষকে কম টাকায় বেসরকারি চিকিৎসা দেয়া। স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া প্রকল্পে কমবয়সীদের ব্যবসামুখী করে তোলা। ১৭ বছর ধরে ঝুলে থাকার পর ট্যাক্স ব্যবস্থার রদবদল আনা, যাতে ট্যাক্স চুরি আটকান যায়। ইনসলভেন্সি কোড এনে ব্যাংকের হাতে খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দেয়া। সরকারকে ঠকিয়ে পালালে বিদেশ থেকে তুলে আনার ব্যবস্থা করা। রাস্তাঘাট তৈরির কাজে জোর দেয়া। সব থেকে বড় কথা হলো এত কিছুর পরও দুর্নীতির অভিযোগ না ওঠা। কংগ্রেস রাফাল বিমান কেনা নিয়ে হইচই করেছিল। কিন্তু কোর্ট জল ঢেলে দিয়েছে। এই নির্বাচনে দুর্নীতি কোনো বিষয় ছিল না। এর সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার যোগ হয়েছে। মোদি প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি জোর গলায় বলেছেন, আমাদের দেশে বোমা ফাটিয়ে পার পাওয়া যাবে না। ‘ঘরে ঢুকে মারব।’ চল্লিশ বছর ধরে আতঙ্কবাদীরা পাকিস্তানের প্ররোচনায় ভারতে যা নয় তাই করে চলেছে। এবার মোদি পাকিস্তানে গিয়ে মেরে এসেছে। উচ্চবর্গীয়রা যা বলেন বলুন। দেশের মানুষ খুশি। এবার যদি বলেন এসব অশিক্ষিত মানুষ তাহলে তো গণতন্ত্রের গোড়া ধরেই টান মারলেন। আমার মতামতটা মানুষের ওপর চাপালে যদি গণতন্ত্র হয় তাহলে সে গণতন্ত্র রাখার মানে কি। রাজা-রাজড়ার আমলে ফিরে গেলেই হয়? সংসদে মোদি সোজাসাপ্টা ভাষায় বলেছেন, পুরনো মূল্যবোধগুলোকে ধরে রাখা জরুরি কিন্তু পুরনো ধ্যান-ধারণাগুলো পাল্টাতে হবে। অনেকদিন বাদে দেশের মানুষ তার সরকারকে বিশ্বাস করে ভোট দিয়েছে। বিরোধী প্রচার এমন তুঙ্গে উঠেছিল, যে যাতে মোদি সরকার পড়ে না যায়, তাই সাতসকালে দৌড়ে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছে। এবার ভোট পড়ার হার রেকর্ড বেশি। আর তার সঙ্গেই এসেছে দায়িত্বের চাপ। মোদি যদি দেশের মানুষকে তার কাজ দিয়ে খুশি রাখতে পারেন। দেশ ভবিষ্যতেও শক্তিশালী সরকার গড়ার রায় দেবে। মানুষ চায় আমাদের দেশ অন্য সবাইকে ছাপিয়ে যাক। পুরনো ঘ্যানঘ্যানানি আর পছন্দ নয়। মোদিও বলেছেন এবারের সরকারের কাজই হবে যারা ভোট দেয়নি তাদেরও খুশি করা। অর্থাৎ এই সরকার সংখ্যালঘুর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেবে। দেখা যাক কি হয়। মোদি যদি ডোবান তাহলে আবার নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক, ডেপুটি এডিটর, ‘দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App