×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় স্থায়ী রূপ লাভ করবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মে ২০১৯, ০৯:০৮ পিএম

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় স্থায়ী রূপ লাভ করবে
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় স্থায়ী রূপ লাভ করবে
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন তখন ভারতের বাইরে তিনি তেমন পরিচিত ছিলেন না। বরং গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন বিতর্কিত। নিজস্ব ক্যারিশমা দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষকে আশ্চর্য করেই তিনি প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ‘সবাইকে নিয়ে ভারতকে প্রস্ফুটিত’ করার স্লোগান দিয়ে তিনি ভারত শাসন শুরু করেন। গত পাঁচ বছর ভারত শাসনের মধ্য দিয়ে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিজস্ব ইমেজ গড়ে তোলেন। তার বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অভিযোগ করেছে। কিন্তু দুর্নীতির কোনো আখ্যাই ধোপে টিকেনি। ব্যক্তিগত ক্লিন ইমেজ নিয়ে তিনি আরো বিকশিত হয়েছেন। যার ফলে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সাধারণত ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যে রোষানল (antyIncumbency) থাকে তা নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে ছিল না। বিশাল মহীরুহের ইমেজ এবং দোর্দণ্ড দাপট নিয়েই দ্বিতীয় মেয়াদে নরেন্দ্র মোদি নির্বাচিত হয়েছেন। এ জন্য এবার সরকার পরিচালনায় তাকে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। মনে রাখতে হবে ভারতের অত্যন্ত রক্ষণশীলগোষ্ঠী তার নির্বাচনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। তারা তাদের উগ্রপন্থি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে। এক্ষেত্রে রক্ষণশীল এই গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তা না হলে বিরাট বিজয় বানচাল হয়ে যাবে। ভারত যে বিশ্ব নেতৃত্বের পথে এগোচ্ছে তা বাধাগ্রস্ত হবে। অবশ্য গত পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদির বাস্তববাদী চরিত্র আমরা দেখেছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর তিনি রক্ষণশীলদের সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আমরা প্রত্যাশা করি, ভারত এখন বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হবে। নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ- বিজেপি ধর্মান্ধতা ও হিন্দুত্ববাদের বিকাশের মাধ্যমে দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তায় বিঘœ ঘটিয়েছে। ভারতের জনগণও আপাতদৃষ্টিতে তেমনটিই ভাবছেন। এই উগ্রবাদী মনোভাব থেকে জনদৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, তিনি যে বিশাল ব্যক্তিত্ব দিয়ে ভারতের জনমন জয় করেছেন সেই বিশাল ব্যক্তিত্ব দিয়েই উগ্রপন্থিদের লাগাম টেনে ধরবেন তিনি। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে তিনি বেকারত্ব নিরসন, কৃষি ও ব্যাংকিং খাতের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারেননি। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ভারত গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। এসব বিষয়ে তাকে বেশি মনোযোগী হতে হবে। গড়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ ভারতীয় চাকরির বাজারে প্রবেশ করলেও গত মেয়াদে সেই তুলনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নরেন্দ্র মোদির ঘাটতি ছিল। ২০১৭-১৮ সালে গত ৪৫ বছরের মধ্যে দেশটির বেকারত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি, ছয় দশমিক এক শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করাও তার একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও মোদির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশটির চিরবৈরী পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করাও নতুন সরকারের একটি চ্যালেঞ্জ। ভারতকে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পাকিস্তানের সঙ্গে শত্রুতা নিরসনের পাশাপাশি চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এ ছাড়া বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভসহ চীনের অব্যাহত প্রভাব এড়িয়ে দুদেশের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ভারতের নতুন সরকারের কাছে বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনেক। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুই দেশের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। এই সময়ে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়, ভারতকে সড়কপথে ট্রানজিট দেয়া, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়াসহ কয়েকটি বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে সাধারণ মানুষের আসা-যাওয়াও আগের চেয়ে বেড়েছে। নরেন্দ্র মোদির ভাষায় দুই দেশের সম্পর্কে ‘সোনালি অধ্যায়’ চলছে। বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এই সোনালি অধ্যায় স্থায়ী রূপ লাভ করবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার গুণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বর্তমান সুন্দর একটি অবস্থানে রয়েছে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না করার পরও শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশে ভারতবিরোধী কোনো আন্দোলন হয়নি। দুই দেশের অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি সমস্যা নিয়েও বাংলাদেশ ভারতবিরোধী কোনো মন্তব্য করেনি। এসবই জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফসল। দ্বিতীয় মেয়াদে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে। দ্বিতীয় মেয়াদে নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ ভারতের কাছে বাণিজ্য সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। কারণ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশাল ঘাটতি রয়েছে। ভারত যদি বাংলাদেশকে সামান্যতম বাণিজ্যিক সুবিধা দেয় তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি পরম লাভবান হবে। এতে ভারতের কোনো ক্ষতি হবে না। আশা করছি, দ্বিতীয় মেয়াদে নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠনের পর ভারতে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সুবিধা নিশ্চিত করবেন। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে অবশ্য আতঙ্কও রয়েছে। কারণ নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপি নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) অনুযায়ী, বাঙালি বিতাড়নের হুমকি দিয়েছিল। আমি মনে করি, নির্বাচনের আগের ওই হুমকি থেকে ফিরে আসবে বিজেপি। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। সামাজিক, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের এই সম্পর্ক হাজার বছরের। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। বাংলাদেশও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতকে অকুুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছে। এ পরিস্থিতিতে নাগরিক পঞ্জি দেখিয়ে আসাম থেকে বাঙালি বিতাড়ন শুরু করলে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। যা ভারতের জন্য সুখকর নয়। কারণ ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আঞ্চলিক স্বার্থে বাংলাদেশের জন্য যেমন ভারতের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, তেমনি ভারতের স্বার্থেই বাংলাদেশে স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। আমি মনে করি, দুই দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, নরেন্দ্র মোদির সরকার এমন কোনো উদ্যোগ নেবে না। আমরা প্রত্যাশা করি, নির্বাচনের আগে উগ্রবাদী যেসব আতঙ্কজনক কথাবার্তা শুনেছি, অবশ্য ২০১৪ সালেও শুনেছি। কিন্তু গত পাঁচ বছরে মোদি সরকার আতঙ্কের তেমন কিছু করেনি। আশা করছি, আগামীতেও নরেন্দ্র মোদির সরকার দুই দেশের মধ্যে নেগেটিভ কোনো বিষয় বাস্তবায়ন করবে না। বরং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, সুভাস চন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলামের ভারতবর্ষই এই অঞ্চলের আসল শক্তি। এই শক্তিই বাংলাদেশ-ভারতের ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত করেছে। নরেন্দ্র মোদি এই আত্মিক শক্তির ভারতকে, ভারতবর্ষকে আবার আবিষ্কার করবেন। ভারতকে বিশ্ব দরবারে নতুন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করবেন। লেখক : রাজনীতিবিদ, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। অনুলিখন : আতিকুর রহমান

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App