×

মুক্তচিন্তা

বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০১৯, ০৯:০৮ পিএম

বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী
বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী
কঙ্গোর খুব বিপদসঙ্কুল পরিবেশে বিমানবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আইভরিকোস্টে রাজনৈতিক জটিল অবস্থায় একমাত্র বাংলাদেশ বিমানবাহিনী অব্যাহতভাবে আকাশপথে পরিবহন সেবা প্রদান করে। বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাবাহী বিএএফ এয়ারক্রাফট যখন দুর্গত জনগণকে বহন করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়, আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে কোনো হাসপাতালে পৌঁছে দেয় এবং জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিদের পরিবহন সেবা প্রদান করে তখন বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে প্রথম অংশ নেয় ১৯৯৩ সালে বসনিয়া-হারজেগোভিনায় ২৬ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণের মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিমানবাহিনী ১৯৯৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর দুটি বেল-২১২সহ প্রথমবারের মতো একটি এয়ার কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করে ইউনিকম, কুয়েতে (United Nations Iraq-Kuwait Observer Mission-UNIKOM)। সেখানে প্রথম দলে ছিলেন ১৭ জন বিএএফ সদস্য। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাক যুদ্ধ শুরু পর্যন্ত বিমানবাহিনীর কন্টিনজেন্ট সেখানে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। সেখানে বিমানবাহিনী কন্টিনজেন্টের কার্যক্রম উন্নত মান ও শ্রেষ্ঠ উড্ডয়ন নিরাপত্তা রেকর্ডের কারণে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। ২০০৩ সালের ২৫ অক্টোবর পূর্ব তিমুরেও বিমানবাহিনী দুটি বেল-২১২ ও ৭১ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণ করে। এই মিশন ৭ জুন ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিল। পূর্ব তিমুরে বিএএফ সদস্যরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করে। তাদের অসাধারণ সাফল্যের জন্য জাতিসংঘ বিএএফ কন্টিনজেন্টকে সার্টিফিকেট অব এক্সিলেন্স প্রদান করে। তা ছাড়া তিনজন কর্মকর্তা ও দুজন বিএএফ সদস্য ফোর্স কমান্ডারের কমেন্ডেশন সনদপত্র লাভ করেন। বিমানবাহিনী ২০০৩ সালে কঙ্গোতে এয়ার ফিল্ড সাপোর্ট ইউনিট ও ইউটিলিটি এভিয়েশন ইউনিট পাঠায়। এ সময় বিমানবাহিনী সেখানে ৫টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টারও মোতায়েন করে। বর্তমানে ৩৭৬ শান্তিরক্ষীসহ ৬টি হেলিকপ্টার ও একটি সি-১৩০ পরিবহন বিমান সেখানে মোতায়েন রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, কঙ্গোর খুব বিপদসঙ্কুল পরিবেশে বিমানবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দায়িত্ব পালনকালে হেলিকপ্টার ও এর পাইলটের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বিদ্রোহী আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে বিএএফ কন্টিনজেন্টের কার্যক্রম কঙ্গোর শান্তিরক্ষায় একটি ব্র্যান্ড নাম হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। কঙ্গোতে বিএএফ এয়ারক্রাফট সাধারণত ইতুরি ব্রিগেডকে আকাশপথে পরিবহন সুবিধা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাবাহী বিএএফ এয়ারক্রাফট যখন দুর্গত জনগণকে বহন করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়, আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে কোনো হাসপাতালে পৌঁছে দেয় এবং জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিদের পরিবহন সেবা প্রদান করে তখন বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালে বিমানবাহিনী চাদে ৩টি বেল-২১২ হেলিকপ্টার মোতায়েন করে। তবে জাতিসংঘ ও চাদ কর্তৃপক্ষে অসম্মতির কারণে এ মিশন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। চাদের মিশন সমাপ্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আইভরিকোস্টে তিনটি বেল-২১২ হেলিকপ্টার মোতায়েন করে। আইভরিকোস্টে রাজনৈতিক জটিল অবস্থায় একমাত্র বাংলাদেশ বিমানবাহিনী অব্যাহতভাবে আকাশপথে পরিবহন সেবা প্রদান করে। এ পর্যন্ত বিমানবাহিনীর ৬ হাজার ৬০৮ জন শান্তিরক্ষী ২৭টি দেশে শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছেন। এসব দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বসনিয়া, সোমালিয়া, মোজাম্বিক, রুয়ান্ডা, হাইতি, লাইবেরিয়া, ডিআর কঙ্গো, ইরাক, সিয়েরা লিওন, কুয়েত, আইভরিকোস্ট, সাউথ সুদান, মধ্য আফ্রিকা, চাদ, পশ্চিম সাহারা, লেবানন ও মালি। বর্তমানে ৭টি দেশের শান্তিরক্ষা মিশনে বিমানবাহিনীর মোট ৪৯৯ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত আছে। এগুলো হচ্ছে- ডিআর কঙ্গো, লেবানন, ওয়েস্ট সাহারা, মধ্য আফ্রিকা, সাউথ সুদান, দারফুর ও মালি। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মোট ৮০ জন মহিলা অফিসার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছেন এবং ১৪ জন মহিলা অফিসার বর্তমানে মিশনে কর্মরত আছেন। এ পর্যন্ত বিমানবাহিনীর পাঁচজন শান্তিরক্ষী জাতিসংঘ মিশনে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় শহীদ হয়েছেন এবং পাঁচজন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো দুজন মহিলা পাইলট জাতিসংঘ মিশনে প্রেরণ করে। এ দুজন পাইলট বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসে প্রথম সামরিক বৈমানিক। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পথিকৃৎ মহিলা বৈমানিকদ্বয় হলেন- ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাঈমা হক (বর্তমানে স্কোয়ার্ড্রন লিডার) এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না-ই-লুৎফী। শান্তিরক্ষা মিশনে প্রথমবারের মতো মহিলা বৈমানিক প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী নারীর ক্ষমতায়নে শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিক পরিম-লেও এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। স্কোয়ার্ড্রন লিডার নাঈমা হক এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না-ই-লুৎফী কঙ্গোতে তাদের এক বছরের মিশন সম্পন্ন করে দেশে ফিরেছেন। এই দুই নারী বৈমানিক উভয়েই এক বছরের মিশন চলাকালে প্রত্যেকে প্রায় ১৫০ ঘণ্টা করে উড্ডয়ন করেছেন। কঙ্গোতে দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে তারা তাদের হেলিকপ্টারে করে শান্তিরক্ষীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহন, মেডিকেল ইভাকুয়েশন, নির্বাচন কর্মকর্তা, নির্বাচন সামগ্রী প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়া ইত্যাদি কাজ করতেন। তা ছাড়া তারা হেলিকপ্টারে করে জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেখানে সড়ক যোগাযোগ সেখানে পৌঁছে দিতেন এবং উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজেও তাদের হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হতো। কখনো কখনো তাদের হেলিকপ্টারে বিপজ্জনক গোলাবারুদ পরিবহন করা হতো। তারা দুজনই এসব কাজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্পন্ন করেছেন এবং সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন। কঙ্গোতে তাদের মূল ঘাঁটি ছিল বুনিয়াতে। কাজের প্রয়োজনে তাদের বুনিয়া থেকে প্রায় ৩০০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত ফরোয়ার্ড বেস ডুঙ্গুতে ফ্লাই করতে হতো। দুর্গম ডুঙ্গুতে তারা কখনো কখনো দুই মাসের অধিক সময়কাল পর্যন্ত অবস্থান করতেন। এ ছাড়া এখান থেকে প্রয়োজনে তাদের দৈনিক দুটি পর্যন্ত উড্ডয়ন মিশন পরিচালনা করতে হতো। এ উড্ডয়ন মিশনের ব্যাপ্তি ছিল দুই-তিন ঘণ্টা। এখানে বাংলাদেশের সমতল ভূমির মতো উড্ডয়ন মিশন পরিচালনা এত সহজ ছিল না। কঙ্গোতে তারা উড্ডয়ন মিশন পরিচালনা করেছেন বিদ্রোহীদের আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে এবং বৈরী পরিবেশে। তারা উড্ডয়ন করতেন ঘন বনভূমি ও সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গের ওপর দিয়ে। বুনিয়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। অতি উচ্চতার কারণে কঙ্গোর আকাশে দমকা হওয়া প্রবাহিত হয় এবং গতিবেগ থাকে অত্যন্ত বেশি। ফলে হেলিকপ্টার উড্ডয়ন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উড্ডয়ন করেছেন। স্কোয়ার্ড্রন লিডার নাঈমা হক বলেন, ‘বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করার সুযোগ আমার জন্য খুবই গৌববের।’ তিনি আরো বলেন, মহিলা অফিসার হিসেবে এমন একটি অঞ্চলে কাজ করেছি যেখানে মহিলারা জীবনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখানে মহিলা শান্তিরক্ষী হিসেবে যে কাজ করেছি তা তাদের উৎসাহিত করবে বলে মনে করি এবং তারা এটাকে রোল মডেল হিসেবে অনুসরণ করতে পারবে। তা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশে মহিলাদের সক্ষমতা সম্পর্কে যে প্রথাগত ভুল ধারণা রয়েছে আমাদের দেখে সে ধারণাও বদলে যাবে বলে আমি আশা করি। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না-ই-লুৎফী বলেন, আমি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মহিলা বৈমানিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পেরে খুবই আনন্দিত। আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের ফলে যখন দুর্গত নারী, পুরুষ ও শিশুর মুখে হাসি ফুটে উঠে তখন আমার মন গর্বে ভরে ওঠে। যদিও আমাকে প্রায় দীর্ঘ এক বছর পরিবারের আপনজনের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। সবশেষে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না-ই-লুৎফী বলেন, নারী-পুরুষ বলে কোনো কথা নয়, চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব সফলভাবে পালন করার জন্য দরকার সাহস, পেশাগত উৎকর্ষতা, আস্থা এবং দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি। এগুলো থাকলে অবশ্যই যে কোনো অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। নূর ইসলাম হাবিব : সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App