×

মুক্তচিন্তা

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অপশক্তি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ মে ২০১৯, ১০:০২ পিএম

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অপশক্তি

করপোরেট বিশ্বে আমাদের জীবন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমরা যে কখন নিজের মাথাটাই করপোরেট মেধার কাছে সমর্পণ করছি, নিজেই টের পাচ্ছি না; যখন টের পাচ্ছি, তখন আর মাথাটা নিজের নিয়ন্ত্রণে, নিজের কাছে নেই। করপোরেট বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট যখন আমার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ নিজ দায়িত্বে তুলে নিতে চায় তখন সামান্য কটি কথা বলার আবশ্যিকতা হয়ে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে ‘শিল্প-সাহিত্যে পদকবাণিজ্য’ বিষয়ে নানান গুঞ্জরণ শোনা যাচ্ছে; বিষয়টি নিয়ে বেশ ক’বছর আগেই আমি লিখেছিলাম; যে শঙ্কার কথা আমি দশ বছর আগেই বলেছিলাম, আজ সে শঙ্কা দৈত্য হয়ে আমাদের গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে; সে রাহুর গ্রাস থেকে শিল্পী-সাহিত্যিক সমাজকে পরিত্রাণ দিতে কেউ কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে শুনিনি। না সরকার, না কোনো শিল্প-সাহিত্যের মোর্চা বা সংগঠন। দশ বছর আগে যখন লিখেছিলাম তখন ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ ধারণাটি আমার পরিচিত ছিল না; সাম্প্রতিক সময়ে মনে হচ্ছে এটি নতুন মোড়কে এসেছে আমাদের জীবনে; যেন কিছুটা পলিসড হয়ে এসেছে ‘রাহু’ আর ‘কেতু’ আমাদের গিলে খেতে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতিকর্মী; হয়তো অর্থলিপ্সা, লোভ আর মোহ তাদের মননের সুস্থতাকে নষ্ট করে দিয়েছে। ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ কথাটা আমাদের জীবনে খুব পুরনো নয়, সাম্প্রতিক সময়ে কথাটা বেশ শুনতে পাচ্ছি। আসলে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ধারণাটা কী? স্থূল মেধায় আমি নিজে যা বুঝি, সেটা বলি, যদি ভুল হয় সংশোধন করে দেবেন। ধরা যাক, আপনি একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন, হতে পারে সেটা আপনার মেয়ের বিয়ে অথবা আপনার বাড়ির রি-মডেলিং, গুণীজন সম্মাননা অনুষ্ঠান অথবা ইফতার আয়োজন; আমন্ত্রণপত্র মুদ্রণ থেকে সাজসজ্জা-আবাসন, আপ্যায়ন ইত্যাদি সবই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আপনার পক্ষে করে দেবে কমিশনের বিনিময়ে। যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের জীবনে এ আর নতুন কী? বহু যুগ ধরেই প্রয়োজনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঠিকাদারি চলছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন যখন প্যাকেজ প্রোগ্রাম চালু করে, তার যে প্রক্রিয়া, আজ বুঝি সেটাও এক ধরনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টই ছিল। পার্টি সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার নামে যেসব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দেশে দাপটের সঙ্গে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাকেও তো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বলেই আখ্যা দিতে পারি। ১৯৭০-এর ১ সেপ্টেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র উত্তম কুমার-তনুজা অভিনীত ‘রাজকুমারী’ নামে যে ছবি দেখেছিলাম, আমি তার কথা বলছি। খুব ভালো একটা ছবি, ছবিতে ছায়া দেবী, পাহাড়ী সান্ন্যাল, তরুণ কুমার, অসিতবরণ, দীপ্তি রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়সহ অনেকেই অভিনয় করেছিলেন। ছবির কাহিনী-চিত্রনাট্য-সংলাপ রচনা ও পরিচালনায় ছিলেন সলিল সেন; গীতিকার, গৌরীপসন্ন মজুমদার; সুরকার রাহুল দেব বর্মন আর গানের শিল্পী ছিলেন কিশোর কুমার এবং আশা ভোঁসলে। স্মরণে আনার জন্য ছবির কয়েকটি গানের কথা মনে করছি- আজ গুন গুন গুন গুন যে আমার এ-কি গুঞ্জরণ গানের সুরে পেলাম এ কার প্রাণের নিমন্ত্রণ।

বন্ধ দ্বারের অন্ধকারে থাকব না মনকে তো আর বন্দি করে রাখব না।

এ কী হলো কেন হলো জানি না জানি না। ইত্যাদি বেশ ক’টি জনপ্রিয় গানও ছিল ছবিটিতে। তনুজা, যিনি হাল আমলের হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা কাজলের মা; তার চরিত্রটি ছিল রাজকুমারী-মঞ্জরী। মা ছায়া দেবীর কঠোর অনুশাসনে বেড়ে উঠছিলেন, কিন্তু ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চাকুরে উত্তম কুমারের (নির্মল) সঙ্গে রাজকুমারীর পরিচয়, অতঃপর প্রণয়। মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজকুমারী বিয়ে করতে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে, কিন্তু ঘটনাচক্রে বিয়েটা হয়নি; ইত্যাদি। সেই ছবির একটা দৃশ্যে আছে, উত্তম কুমার বিয়ে সম্পাদনের জন্য কোনো একটা সোসাইটির ম্যানেজারের কাছে গেছেন, সেখানে দুজনের সংলাপ : উত্তম : আপাতত এইটে রাখুন, যদি আরো কিছু টাকাকড়ি লাগে, পরে দেয়া যাবে। তবে দেখবেন, যেন বিয়েটা ঠিক সুষ্ঠুভাবে হয়ে যায়; বুঝলেন তো আমার লোকবল বলতে বিশেষ কিছু নেই, মেয়ের তো কেউই নেই! ম্যানেজার : ঠিক আছে ঠিক আছে, আপনি কিচ্ছু ভাববেন না নির্মলবাবু, সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক থাকবে। আমাদের সোসাইটির মেম্বাররা সব উপস্থিত থাকবেন। আর বিয়ে? সব শাস্ত্র-মতো হবে। তবে কী, সোমবার মানে ৮টায় লগ্নের একটু আগে আপনারা সব এসে উপস্থিত হবেন; তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কনসেপ্টটা বাঙালির জীবনে নতুন নয় এবং খারাপ কিছুও নয়। তাহলে ও নিয়ে কথা বলার আবশ্যিকতা কী? সামান্য আবশ্যিকতা আছে বৈকি। করপোরেট বিশ্বে আমাদের জীবন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমরা যে কখন নিজের মাথাটাই করপোরেট মেধার কাছে সমর্পণ করছি, নিজেই টের পাচ্ছি না; যখন টের পাচ্ছি, তখন আর মাথাটা নিজের নিয়ন্ত্রণে, নিজের কাছে নেই। আমি কী খাব, কী পরব, কি সে চড়ব, কোন পথে হাঁটব, কোন গান গাইব, কার সঙ্গে মিশব, কোথায় ঘুমাব, সবই নির্ধারিত হবে করপোরেটের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে। করপোরেট বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট যখন আমার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ নিজ দায়িত্বে তুলে নিতে চায় তখন সামান্য কটি কথা বলার আবশ্যিকতা হয়ে যায়। বিশেষ করে নিজেকে সচেতন করতে বাস্তবতাটা সামনে এনে দেখে নিতে চাই। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, কোথায়-কখন-কীভাবে আমার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর হাতে চলে গেল? আমরা তো দেখতে পাচ্ছি, কবিরাই কবিতা লিখছেন, শিল্পীরাই ছবি আঁকছেন, গান গাইছেন, নাচছেন, আবৃত্তি করছেন; তাহলে ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর হাতে চলে গেল কীভাবে? আমার কথাটা সেখানেই। হ্যাঁ এ কথা সত্যি, যারা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করছেন, সমাজে তারা কবি-শিল্পী-সংস্কৃতজন হিসেবেই পরিচিত; কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন এরা ক’জন সত্যি আর ক’জন ছদ্মবেশী। যিনি কাব্যচর্চায় নেই, তিনিই যখন কবিতার সংগঠনের নেতৃত্বে বসে কবিদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খান, যখন একজন সন্ত্রাসী-অর্থলিপ্সু নাট্যমোর্চার নেতৃত্বে বসে থাকেন, নৃত্যশিল্পীদের নিয়ন্ত্রণ করেন, প্রশাসন এবং নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের পক্ষে দেন-দরবার করেন এবং সুযোগ পেলেই নিজের আখের গুছিয়ে নেন; তেমন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার কী বলা উচিত? আমি অবশ্য ওইসব ক্ষমতা ও অর্থলিপ্সুদের এককভাবে দোষী করছি না, পাশাপাশি শিল্পী-সাহিত্যিকদের যারা কোনাকুনি পথে হেঁটে সাফল্য পাওয়ার মোহে নিজেদের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাছে সমর্পণ করেন, তাদেরও অপরাধী বলছি। আমরাই তো ঈর্ষায়, হিংসায়, প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার জন্য নিজেদের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাছে সমর্পণ করছি। নিজেদের আমরা সমাজের প্রাগ্রসর শ্রেণি দাবি করে যখন নিজেরাই অপরিণামদর্শিতার স্বাক্ষর রাখি, তখন ধান্দাবাজদের বিপক্ষে কথা বলে কী হবে? আমি বরং বলি, আসুন আমরা সচেতন হই, যে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট আমাকে উন্মুল করে দিতে চায়, আমাকে আমার সংস্কৃতির মূল ধারা থেকে বিচ্যুত করতে চায়, নিজেকে ছদ্মাবরণে রেখে বাঙালির ইতিহাসকে বিপন্ন করতে চায়, ৩০ লাখ মানুষের রক্তঋণের কথা বিস্মৃত করাতে চায়, বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নানান অপকৌশলে খর্ব করতে চায়; আসুন আমরা তাদের প্রতিহত করি। তাদের মিষ্টি-কুশলী কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে আসুন আত্মমর্যাদাশীল হয়ে উঠি; আসুন যত্নের সঙ্গে চিনে নিই সুবেশ-মুখোশধারীদের এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অশুভ অংশকে প্রতিহত করি। তবে মনে রাখতে হবে কাজটা কিন্তু আজ সহজ নয়; কারণ আজকের দুরাচারীদের অনেকেই সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে পরিচিত, কেউ কেউ ‘সংস্কৃতজন’ হিসেবে সমাজে যথেষ্ট পরিচিত। কারো মুকুটে আছে সাংবাদিকতার পালক, কারো আছে সমাজসেবীর পালক, কারো আবার রাজনীতিক বা সমাজে সম্মানিতজনের পালক; সুতরাং ‘ঠগ বাছতে গাঁও উজাড়’ হওয়ার সম্ভাবনা যেমন আছে তেমনি আছে, ‘সমাজে আর আছে কেডা? আমরা, মামুরা আর চাচা জ্যাডা’ সামনে এসে দাঁড়াতে পারে; আর আজই যদি পরিত্রাণের উদ্যোগ না নেয়া হয়, তাহলে কিছুকাল পর নিশ্চয়ই অবস্থা দাঁড়াবে, ‘লুম্বা বাছলে কম্বলের কী আর থাহে?’ অতএব শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনের সচেতন বন্ধুরা, আসুন আজই সতর্ক হই, সচেতন হই এবং সোচ্চার হই।

ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও প্রাবন্ধিক, সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App