×

জাতীয়

আইনি জটিলতায় অনেকেই পাচ্ছে না ‘পরিবার’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ মে ২০১৯, ০২:৩৭ পিএম

আইনি জটিলতায় অনেকেই পাচ্ছে না ‘পরিবার’
ঘটনাটা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের। ঢাকার পুরনো বিমানবন্দর এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল একটি নবজাতককে। যাকে মৃত মনে করে কয়েকটি কুকুর মিলে খেতে শুরু করেছিল। কিন্তু ভাগ্য শিশুটির সহায় ছিল। কিছু মানুষ এই দৃশ্য দেখে কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে শিশুটিকে নিয়ে আসেন হাসপাতালে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর শিশুটির জায়গা হয় আজিমপুরের ছোটমণি নিবাসে। তার নাম রাখা হয় ‘ফাইজা’। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ছোটমণি নিবাস থেকে এক নিঃসন্তান দম্পত্তি দত্তক নেন ফাইজাকে। চলতি বছরের ১১ মে আশুলিয়ার মির্জানগর এলাকায় গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের প্রাচীরের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় এক নবজাতককে। এলাকার আসিফ হোসেন নামে এক ইট-খোয়া ব্যবসায়ী শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এর ৩ দিন পর ১৪ মে দুপুরে শিশু হাসপাতালের একটি বাথরুমের ভেতর থেকে ৩/৪ দিন বয়সী এক নবজাতককে (কন্যা) উদ্ধার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসা শেষে তাকেও রাখা হয় ছোটমণি নিবাসে। ‘গহীন’ নাম দেয়া ওই শিশুটিকে দত্তক নিতে ইতোমধ্যেই অসংখ্য দম্পত্তি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে নিঃসন্তান দম্পতি এবং একাধিক সন্তান আছেন এমন দম্পতিও রয়েছেন। প্রতি বছরই নাম-পরিচয়হীন এ রকম অনেক শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর তাদের স্থান হয় ছোটমণি নিবাসের মতো সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে। আদালতের মাধ্যমে এদের কাউকে কাউকে দত্তক নেন কোনো দম্পতি। ফলে সে পায় নিজের একটি পরিবার। আর বাকিরা থেকে যায় এসব প্রতিষ্ঠানেই। শূন্য থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের রাখা হয় ছোটমণি নিবাসে। আর বয়স সাত বছর হলে তাদের জায়গা হয় শিশু পরিবারগুলোতে, যেখানে তারা থাকতে পারে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত। বিভিন্ন এলাকা থেকে নবজাতকের মরদেহও উদ্ধার হচ্ছে প্রায়ই। গতকাল ২৩ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পাশের ফুটপাত থেকে একদিন বয়সের এক মেয়ে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আগের দিন ২২ মে রাজধানীর হাতিরঝিলে ময়লার স্ত‚প থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে পরিত্যক্ত অবস্থায় জীবিত কিংবা মৃত নবজাতক উদ্ধারের ঘটনা নতুন নয়। কখনো এ রকম দু-একটি উদ্ধারের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বড় বড় শিরোনাম হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ঘটনাই থেকে যায় অপ্রকাশ্য। ২৬৯টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জাতীয় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, ২০১৫ থেকে চলতি বছরের ২০ মে পর্যন্ত পরিত্যক্ত অবস্থায় জীবিত উদ্ধার হয়েছে ৭৬টি শিশু। আর নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ১৫৫টি। এর মধ্যে ২০১৫ সালে জীবিত পরিত্যক্ত নবজাত উদ্ধার হয় ২৪টি, মৃত অবস্থায় উদ্ধার হয় ৫২ নবজাতক। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা যথাক্রমে ৯ ও ২৮, ২০১৭ সালে ১৭ ও ২৪, ২০১৮ সালে ১৬ ও ৩৯ এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত এ সংখ্যা যথাক্রমে ১০ ও ১২। এর মধ্যে ছোটমনি নিবাসে রয়েছে ২০ শিশু। এদের মধ্যে পাঁচজন প্রতিবন্ধী। জানা যায়, আইনি জটিলতার কারণে অভিভাবকত্ব নেয়ায় অনাগ্রহ তৈরি হওয়ায় একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশুই রয়ে যায় ছোটমনি নিবাসে। ছোটমনি নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম রানু ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের কাছে যেসব বাচ্চা আসে আমরা শুধু তাদের দেখভাল করি। যত্নআত্তি করি। এইটুকুই। তবে এসব শিশু যদি পারিবারিক আবহে থাকত তাহলে আরো ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারত। পরিত্যক্ত অবস্থায় শিশুদের ফেলে রাখার কারণ হিসেবে মূল্যবোধের অবক্ষয়, তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি এবং বিবাহ বহির্ভূত অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্স এন্ড চাইল্ড প্রোটেকশন সেক্টরের পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে আমরা দূরে সরে এসেছি। অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক বাজারের কারণে যৌনতা নির্ভর সামাজিক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি আমরা। এর ফলে এক ধরনের যৌন চাহিদা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি প্রতিকারের মতো কোনো পদ্ধতি নেই। ফলে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। এ ছাড়া বিবাহ বহির্ভূত অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের ফলেও ‘অনাকাক্সিক্ষত’ শিশুর জন্ম হচ্ছে। যেহেতু তাদের কাছে শিশুটি ‘অনাকাক্সিক্ষত’ তাই তারা এর দায়িত্ব নিতে চান না। ফলে ওই শিশুদের তারা ডাস্টবিন, রাস্তা কিংবা যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিশু বয়স থেকেই যথাযথ যৌন শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পারিবার, অভিভাবককে এগিয়ে আসতে হবে। পরিত্যক্ত শিশুদের দায়িত্ব কার? এ প্রসঙ্গে শিশু অধিকার কর্মী ও সংগঠক অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের সমাজে একটি শিশুকে বৈধতা দিয়েছে তার বাবা-মার বিবাহের মধ্য দিয়ে। এই সম্পর্কের বাইরেও শিশুর জন্ম হচ্ছে। যাদের ‘অবৈধ’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বাবা-মার পরিচয় না থাকলেও একটি শিশু পৃথিবীতে এসেছে এটিই তার বৈধতা। এসব শিশু যাতে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে এমন একটি প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও সমাজকেই করে দিতে হবে বলে আমি মনে করি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুপ্রিম কোর্টের এক সিনিয়র আইনজীবী ভোরের কাগককে বলেন, বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা হয়েছে, ধর্ষণের ফলে যদি কারো কোনো সন্তান হয়ে থাকে তাহলে তার দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র। যে সন্তান স্বীকৃতি পাচ্ছে না অথবা বাবার পরিচয় নেই সেই শিশুর জন্য এখন পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি সরকার। তাই নবজাতকরা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকছে যেখানে সেখানে। পারিবারিক অভিভাবকত্ব আইন কিছুটা সহজ করলেই ওরাও পেতে পারে নিজের একটি পরিবার; বাবা-মা-ভাই-বোন। দেশে সন্তান দত্তক বা তার অভিভাবকত্ব ব্যবস্থা কেমন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইডের পরিচালক এডভোকেট মাকসুদা আক্তার লাইলি বলেন, সারা বিশ্বে দত্তক নেয়ার যে জনপ্রিয় ব্যবস্থা তা নিয়ে আমাদের দেশের আইন নেই। শুধুমাত্র হিন্দু পারিবারিক আইনে দত্তক নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ ও স্বামীর অনুমতি থাকলে বিধবা নারী পুত্র সন্তান দত্তক নিতে পারেন। কোনো মেয়েকে নেয়া যায় না। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধ-শিশুদের অভিভাবকত্ব দেয়ার জন্য ১৯৭২ সালে একটি অধ্যাদেশ জারি হয়। পরবর্তীতে নানা অভিযোগেরভিত্তিতে ১৯৭৮ সালে তা রহিত করা হয়। তবে কোনো আইন না থাকলেও নানাভাবে নিঃসন্তান দম্পতিরা শিশুর অভিভাবকত্ব নিচ্ছেন। সন্তান দত্তক নিচ্ছেন। কেউ নিচ্ছেন পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে, কেউ নিচ্ছেন গোপনে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App