কী নির্ভীক একটি কলম | আসাদ মান্নান
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ মে ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
অভিশপ্ত দুঃসময়ে কী নির্ভীক একটি কলম!
যে কলমে ভরা আছে কালি নয়- শব্দের আগুন;
এ আগুনে পুড়ে পুড়ে ভষ্ম হয় সত্য ও সুন্দর
বিনাশী ঘাতক আর দালালের মিথ্যা ইতিহাস।
যখন পেছনে ফিরে সময়ের কফিন উল্টাই
তখন আমার চোখে ভেসে ওঠে রূপসী বাংলার
করুণ ফ্যাকাসে মুখে শকুনের ডানার উল্লাস।
পৃথিবীর কোনো দেশে এর আগে কিংবা তারও পরে
ঘটেনি এমন আর কোনো হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা।
একাত্তরে কত যে নিরীহ লোক নারী আর শিশু
নির্বিচারে খুন করে ব্যভিচারী মাতৃগামী পশু!
আমাদের এই প্রিয় দেশটাকে সেদিন ওরাই
পরিণত করে এক নরকপুরীতে; পা বাড়ালে
গন্তব্যের বহুমুখী পথে কী এক অবাক করা
কা- ঘটে বেদনার নীল গিরি উপত্যকা খাদে:
গন্তব্য তখন আর গন্তব্যের স্বভাবে থাকেনি।
এখানে ওখানে ফোটে শাপলা ফুল হরেক রকম;
ওগুলো তো ফুল নয়, যেন রক্তের গভীর মূলে
এ যেমন মৃত্যুকে তাচ্ছিল্য করে গুচ্ছ গুচ্ছ শাপলা
আরো কত জলাফুল হাওরে-বাঁওড়ে খালে-বিলে-ঝিলে
কালো কালো রক্তে ডোবা পুকুরের জলে কী সুন্দর
গৌরবের দ্যুতিময় মুকুট মাথায় ফুটে থাকে!
কপালে থাকে না টিপ বেশিক্ষণ সুন্দরী নারীর;
বিবর্ণ যৌবনে তার চামড়া কুঁকড়ে গেলে পর
ভয় পায় সেই নারী আয়নার সামনে দাঁড়াতে।
পায়ের পাতাকে যেন মাটি নয় কত শত শত
চিহ্নহীন মর্মভেদী দৃশ্যের অতীত বধ্যভূমি
নিবিড় প্রেমের টানে খুব গাঢ় মমতার দাঁতে
কামড়ে ধরে থাকে; স্তব্ধতার পোশাক জড়িয়ে
গোপন কান্নার রোলে প্রকম্পিত তারার বাগান-
বাগান বিদীর্ণ করা মাতম ধ্বনিতে গুমরে ওঠে
শোকাচ্ছন্ন সমুদ্রের বেলাভূমি, নীরব প্রকৃতি:
শূন্যতার কারাগারে বন্দি হয়ে উন্মাদিনী চ-ী
বাতাসের ঝুটি ধরে ক্লান্তিহীন ঘূর্ণি তালে নাচে;
জালিমের আস্তানায় বেড়ে ওঠা খুনি ও ঘাতক
দুর্বিষহ দুঃশাসনে উজ্জীবিত; আপন গোত্রের
বংশ যাতে বৃদ্ধি পায় মুখোশের কঠিন আড়ালে
দিবানিশি পালা করে রতিকর্মে লিপ্ত হয় ওরা;
দেশের ইজ্জত মেরে ক্রমান্বয়ে আস্ত গিলে খায়
শহীদের রক্তদামে কেনা এই বদ্বীপ-মোহনা:
কত যে মৌ-এর চাক ঝুলে আছে গাছের শাখায়
মধুর চাকের লোভে ওঁৎ পাতে তস্কর মৌয়াল।
ক্ষমতা এমন মধু যে খায় সহজে তার দেহে
দ্রুত বাড়ে রতিশক্তি, ফিরে আসে হারানো যৌবন:
আবার নতুন নামে নেমে পড়ে গোপন মিশনে
পুরনো অস্ত্রের মুখে লুট করে কবরের মাটি;
সভ্যতা আসলে এক গরিবের নিরীহ বালিকা-
পুনঃপুনঃ ধর্ষণের চিহ্ন বুকে সে এখন মৃত।
এমন ভয়াল দিনে যাকে দেখি দুর্মর সাহসে
সত্যের সমূহ শক্তি শব্দে ধরে চারণের মতো
চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল ব্যাপ্ত এই রক্ত মাখা
দেশের মাটিকে ভালোবেসে নির্ভয়ে ছুটছেন তিনি
প্রান্ত থেকে সীমান্তের দূরান্তের আনাচে কানাচে-
খুঁজে বেড়াচ্ছেন বধ্যভূমি, গণকবরের দাগ;
এখনও যুদ্ধের মাঠে তিনি এক লড়াকু সৈনিক।
তরুণ প্রজন্মপ্রাণে অবিরাম ধ্যানে আর জ্ঞানে
যে আলো ছড়িয়ে তিনি জাগাচ্ছেন জাতির চেতনা
তাঁকে আজ ঠাঁই দেবো কোন নামে- কোন উঁচু ধামে!
এটা গল্পকথা নয়- জন্মদুঃখী মরমী বাংলার
মহাজাতি সত্তা থেকে জন্ম নেয়া তুলনারহিত
এক রত্নপুত্র তিনি- সময়ের পরশ পাথর।
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে দেশ থেকে কলঙ্কের দাগ
মুছে ফেলতে যিনি নিরলস; কথা ও কলম যাঁর
গ্রামে গঞ্জে খুুঁজে ফেরে সব বধ্যভূমি; অবলুপ্ত
বহু গণকবরের অবরুদ্ধ কান্না, হাহাকার
কী অপূর্ব কথার জাদুর টানে নিয়ত লিখেন
জনতার জনযুদ্ধে গৌরবের জনইতিহাস,
যেখানে পিতার স্বপ্নে কন্যা আজ মূল বাতিঘর।