×

জাতীয়

চবির উপাচার্য পদে নিয়োগে তদবিরই প্রধান যোগ্যতা!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ মে ২০১৯, ০১:২৯ পিএম

চবির উপাচার্য পদে নিয়োগে তদবিরই প্রধান যোগ্যতা!
আগে দেখেছি উচ্চশিক্ষিত, সজ্জন, প্রশাসনিকভাবে কঠোর অথচ গ্রহণযোগ্য শিক্ষকরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে তো বটেই, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের কাছেও তারা ছিলেন সম্মানিত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে যা দেখছি তাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ওপর সাধারণ নাগরিক তো দূরের কথা, শিক্ষক-ছাত্ররাও কোনো আস্থা বা সম্মান রাখতে পারছেন না। কারণ নানা ধরনের অনিয়ম-একনায়কতন্ত্র-নিয়োগ বাণিজ্য-টেন্ডারবাজি-সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের তোষণ করে উপাচর্যের পদটিকেই বিতর্কিত করে তোলা হয়েছে। তা ছাড়া উপাচার্য নিয়োগে এখন তদবির এবং তোষামোদই বড় যোগ্যতা হয়ে উঠেছে। আক্ষেপের সঙ্গেই এসব কথা বললেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন শিক্ষক। চবির বিভিন্ন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানিয়েছেন, ১৯৮৯ সালের পর থেকে দীর্ঘ ৩০ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্ষদ সিনেটে উপাচার্য প্যানেলে কোনো নির্বাচন হয়নি। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেট সদস্যরা উপাচার্য প্যানেলের জন্য ৩ জনকে নির্বাচিত করে তাদের মধ্য থেকে উপাচার্য পদে ৪ বছরের জন্য নিয়োগের জন্য আচার্য অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবেন। কিন্তু প্রায় ৩ দশক ধরে অনির্বাচিত শিক্ষকরাই উপাচার্যের পদে থেকেছেন। নেই কোনো রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন, নেই ছাত্রদের কোনো প্রতিনিধিত্ব। ফলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যই সর্বেসর্বা অর্থাৎ তিনিই যেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তারা আরো জানিয়েছেন, ১৯৮৯ সালে অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দীন সিনেটের সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হয়ে চ্যান্সেলরের আদেশক্রমে ভিসি হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার তাকে জোর করে সরিয়ে দেয়। সেই যে শুরু হলো অনির্বাচিতদের উপাচার্য হওয়া বা নিয়োগ পাওয়ার প্রবণতা, তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ফলে যেসব শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তারা নিজেদেরই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে ভেবে পরিচালনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য পদের জন্য ৫ জনের দৌড় : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৫ জুন। এই পদে পুনঃনিয়োগ পেতে জোর লবিং শুরু করেছেন তিনি। এ ছাড়া আরো অন্তত ৪ জন শিক্ষক এই পদে নিয়োগের জন্য নানামুখী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে এমন প্রার্থীও রয়েছেন, যিনি নারী ও পরীক্ষা কেলেঙ্কারির জন্য ৫ বছর পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন (এ সংক্রান্ত নথিপত্র ভোরের কাগজের কাছে রয়েছে)। অপরদিকে বর্তমান ভিসি ড. ইফতেখার উদ্দিনের বিরুদ্ধে নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অনিয়ম এবং সন্ত্রাসী তোষণের অভিযোগ রয়েছে। ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী ছাড়া যে ৪ জন শিক্ষক উপাচার্য হওয়ার জন্য নানাভাবে তদবির করছেন তারা হলেন বর্তমান উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরিণ আখতার, শাহজালাল হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া শিক্ষক ও হলুদ দলের আহ্বায়ক সুলতান আহমদ, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের বর্তমান ডিন অধ্যাপক ড. সেকান্দর চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের বর্তমান ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, এই ৫ জনের মধ্যে বর্তমান উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এবং সমাজবিজ্ঞান অনুষদের বর্তমান ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত। তাই উপাচার্য নিয়োগের ইঁদুর দৌড় থেকে ছিটকে পড়তে পারেন এই ২ জন। অধ্যাপক ড. শিরিণ আখতার : বর্তমানে উপউপাচার্যের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. শিরিণ আখতার উপাচার্য পদের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রার্থী বলে মনে করা হচ্ছে। পারিবারিক সুপরিচিতি, মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রগতিশীল মনোভাবসহ বিভিন্ন কারণে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন তিনি। তা ছাড়া তাকে যদি চবির ভিসি পদে নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে তিনিই হবেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য। বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। এ ব্যাপারে ড. শিরিণ আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করবে সরকার। সরকার যদি আমাকে যোগ্য মনে করে উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়, তবে আমি তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছি। আমার সবটুকু দিয়ে সততা-নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকব। অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন : বর্তমান উপাচার্যের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী দ্বিতীয় মেয়াদে আবারো দায়িত্ব নিতে রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। তবে গত চার বছর ধরে নিয়োগ বাণিজ্য, ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ হত্যার আসামিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং বঙ্গবন্ধু চেয়ার দখলসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন তিনি। এরপরও বর্তমান দায়িত্ব আরো এক বছর বাড়াতে নানা ধরনের তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহলে ড. ইফতেখার সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক তথ্য রয়েছে। নতুন মেয়াদে উপাচার্য পদ পাওয়ার ব্যাপারে ড. ইফতেখার উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, আমি দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। নানা সমালোচনা ও অভিযোগের বিষয়গুলো বরাবরের মতো অস্বীকার করে তিনি দাবি করেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অন্ধকারের গুহায় পড়েছিল, আমি উদ্ধার করেছি। অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ : উপাচার্যের দৌড়ে থাকা অপেক্ষাকৃত তরুণ এই প্রার্থী চরমভাবে বিতর্কিত। নারী কেলেঙ্কারি ও পরীক্ষার ফলাফল বদলে নিজের বোনকে সুবিধা দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ প্রমাণের পর সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে দণ্ডিত তিনি। ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত ৪৫০তম সিন্ডিকেট সভায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে বিভাগীয় সভাপতির পদ থেকে পদচ্যুত করা হয় এই শিক্ষককে। সেই সঙ্গে বিভাগের সব ধরনের পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ থেকে ৫ বছরের জন্য বিরত রাখা হয়। অধ্যাপক ড. ফরিদ চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার মতো গুরুতর অপরাধ করলেও বিএনপি-জামায়াত আমলের উপাচার্য অধ্যাপক বদিউল আলমের এলাকার (কক্সবাজার) হওয়ায় তাকে লঘুদণ্ড দেয়া হয়। তা ছাড়া অধ্যাপক ড. ফরিদ বর্তমান উপাচার্যের ‘নিয়োগ সিন্ডিকেট’-এর অন্যতম সদস্য। উপাচার্য পদে নিয়োগের প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফরিদ ভোরের কাগজকে বলেন, এটি সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়। বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি উল্টো বলেন, যারা উপাচার্য হওয়ার জন্য লবিং, চেষ্টা-তদবির করছেন, তারাই আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করছেন। আমি নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করেছি। আমার দ্বারা কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি। অধ্যাপক সুলতান আহমদ : উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে থাকা আরেক শিক্ষক অধ্যাপক সুলতান আহমদ বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীল শিক্ষকদের সংগঠন হলুদ দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। ক্যাম্পাসে কথিত আছে ‘প্রশাসন পরিবর্তন হয় কিন্তু অধ্যাপক সুলতান আহমদের ক্ষমতার পরিবর্তন হয় না।’ তবে তিনি উপাচার্য পদের দৌড়ে থাকায় ভিসি ইফতেখার তাকে কৌশলে শাহজালাল হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেট থেকেও ছিটকে যান তিনি। তারপরও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে ধরনা দিয়ে তদবির অব্যাহত রেখেছেন তিনি। তবে ধরনা দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে উপাচার্য পদে নিয়োগের ব্যাপারে তিনি বলেন, সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে এবং অভিজ্ঞতার বিচারে উপাচার্য হওয়ার প্রার্থী তালিকায় অনেক শিক্ষকের মুখে আমার নাম শোনা যাচ্ছে। যদি সরকার আমাকে যোগ্য মনে করেন তাহলে আমি আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। অধ্যাপক ড. সেকান্দর চৌধুরী : ক্যাম্পাসের সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত এবং মিষ্টভাষী। উপাচার্য পদটি বাগিয়ে নিতে তিনিও ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার কাছে ধরনা দিয়েছেন। প্রয়াত চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবেও পরিচিত। তবে বর্তমান উপাচার্যের বঙ্গবন্ধু চেয়ার দখলের পেছনে তিনি জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি ৩২ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি ২ বার, ডিনের দায়িত্ব পালন করেছি। সরকার যদি আমাকে যোগ্য মনে করে উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়, তাহলে তা সাদরে গ্রহণ করব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App