×

মুক্তচিন্তা

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির নয়া-মেরুকরণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ মে ২০১৯, ০৮:৪৮ পিএম

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির নয়া-মেরুকরণ
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপির পরস্পরের বিতর্ক বিদ্বেষ জনগণকে ধোঁকা দেয়ার আই-ওয়াস বললে হয়তো ভুল হবে না। এবারের লোকসভা নির্বাচনে যে মেরুকরণ পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে তার কুফল ধর্মনিরপেক্ষ দাবিদার পশ্চিমবঙ্গের অতীতের সব ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিনাশ করে ছাড়বে। ধর্মান্ধতার সেই উত্তাপে আমাদের মৌলবাদীদের ইস্যু খুঁজতে বেগ পেতে হবে না। ত্রিপুরায় বিজেপির উগ্রবাদীরা বিধানসভার নির্বাচনে জয়ী হয়ে ভেঙেছিল লেনিনের ভাস্কর্য, কলকাতায়ও রেহাই পায়নি
সম্প্রতি পশ্চিম বাংলায় ঘুরে এলাম। দেখে এলাম সেখানকার ভোটের রাজনীতির নতুন কিন্তু অস্বাভাবিক মেরুকরণ। যেটি আসাম ও ত্রিপুরায় ইতোপূর্বে ঘটেছে। ওই একই ঘটনা ঘটতে চলেছে পশ্চিমবাংলায়। সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টের পর পশ্চিমবাংলা, এ ধরনের অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। কিন্তু এবার দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। সারা ভারতে পশ্চিমবঙ্গের অসাম্প্রদায়িকতার যে গর্ব-অহংকারের ঐতিহ্য ছিল, সেটি ধসে পড়েছে। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিপরীত মেরুতে পশ্চিম বাংলার অসাম্প্রদায়িক গণ-চেতনা এখন ভূলুণ্ঠিত। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির প্রতি পশ্চিম বাংলার মানুষের ঝুঁকে পড়ার পেছনে প্রধানত রাজ্যের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তৃণমূল কংগ্রেসের ভুল বা অপরাজনীতিকে দায়ী করা যায়। তৃণমূলের হাত ধরেই পশ্চিম বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবৃক্ষ ক্রমাগত বাড়-বাড়ন্ত। বিজেপি আরএসএসের পশ্চিম বাংলায় অনুপ্রবেশের পথ সৃষ্টি করে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস অর্থাৎ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অপ বা ভুল রাজনীতির কারণেই পশ্চিম বাংলা তার অতীতের সব ঐতিহ্য হারিয়ে এখন হিন্দুত্ববাদী বিজেপির শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। পশ্চিম বাংলার এই রাজনৈতিক মেরুকরণের মূলে যে কারণটি প্রধান হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে সেটি রাজ্য ক্ষমতায় থাকা তৃণমূলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চরম ফ্যাসিবাদী ভূমিকা। চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্টের পরাজয়ের পর তৃণমূল এ যাবৎ বামফ্রন্টের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের ওপর ক্রমাগত নির্যাতন, নিপীড়নসহ তাদের গৃহছাড়া করে ছেড়েছে। প্রবল চাপের মুখে বামফ্রন্টের প্রচুর সুযোগ সন্ধানীরা দলে দলে তৃণমূলে যোগ দিয়ে তাদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলে তৎপর হয়েছে। পাশাপাশি বামফ্রন্টের কর্মী, সমর্থকদের একটি অংশ আত্মরক্ষায় বিজেপির পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছে। নিজেদের জীবন রক্ষায় তারা বিজেপির পক্ষ নিয়েছে। তৃণমূলের নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অপকীর্তিতে বিজেপি পশ্চিম বাংলায় প্রসার ও বিস্তারের সুযোগের মোক্ষম মওকাটি হাতিয়ে নিয়েছে। নয়তো সম্পূর্ণ শূন্য অবস্থান থেকে বিজেপি হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ হলো কীভাবে! সারা ভারতে বিজেপির জনপ্রিয়তায় ভাটির টান পড়লেও, পশ্চিম বাংলায় ঠিক উল্টো হাওয়া কীভাবে বইছে! মোদির জোয়ারে গত লোকসভা নির্বাচনে সারা ভারত ভাসলেও, পশ্চিম বাংলা সে জোয়ারে ভিজেওনি। অথচ অবস্থা এখন ঠিক বিপরীত। তৃণমূলের ফ্যাসিবাদী ভূমিকাকে ঠেকাতে মানুষ বিকল্প হিসেবে কংগ্রেস, বামফ্রন্টকে নয় বিজেপিকেই বেছে নিয়েছে, ধর্মীয় আবেগে এবং ধর্মান্ধতায়। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বলয়ে যাতে তৃণমূলের লাগাম নিয়ন্ত্রণ করা যায় এই অভিপ্রায়ে তৃণমূল বিরোধীরা হিন্দুত্ববাদী প্রতিক্রিয়াশীল বিজেপির পেছনে শামিল হয়েছে। সারা রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী জোয়ার বইছে, সেটি অতীতের সব ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ম্লান করে। এবারের লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপিকে রুখতে সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিগ্রেট মাঠে সর্বদলীয় সমাবেশ করে সে বার্তাও দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘বিচার মানি তবে তালগাছটি আমার’ এই মনোভাবের কারণেই পশ্চিম বাংলায় বিজেপি বিরোধী জোট গঠিত হয়নি। পাশাপাশি বামপন্থিরাও জোট গড়তে পারেনি। তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন বলে ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অপরদিকে কংগ্রেস দলও ভারতব্যাপী বিজেপি বিরোধী জোট গঠনের কথা বললেও চূড়ান্তে অতি-আত্মবিশ্বাসে জোট গঠন করেনি, কোনো জোটভুক্তও হয়নি। এতে বিজেপি বিরোধী ভোট বিভক্তির সুযোগে বিজেপির পাল্লাই ভারী হয়েছে। সর্বভারতীয় নির্বাচনী প্রভাবের বাইরে থাকা পশ্চিম বাংলায় এবার মোদির বিজেপির চমকপ্রদ উত্থান যে ঘটবে সে আলামতই প্রত্যক্ষ করেছি কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে। তৃণমূল আওয়াজ তুলেছে ‘চৌদ্দশ ছাব্বিশ তৃণমূলের বিয়াল্লিশ’। অর্থাৎ ১৪২৬ বঙ্গাব্দে পশ্চিম বাংলার ৪২টি সংসদীয় আসন তৃণমূলেরই। অন্য কোনো দলের নয়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে মেরে-কেটে, জোর-জবরদস্তিতে পার-পাওয়ার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লোকসভা নির্বাচনেও একই কায়দায় সব আসন দখলে নেবে, সে ফন্দি তারা এঁটেছিল। তবে তৃণমূলের সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। তৃণমূলের ঘুম কেড়ে নিয়েছে মোদি এবং বিজেপি। সারা রাজ্য চষে বেড়াচ্ছে মমতা। মোদি এবং বিজেপির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনায় মুখর মমতা। অপর দিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়ায় নরেন্দ্র মোদি আদা-জল খেয়ে নেমেছে। তিনিও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল চষে বেড়িয়ে মমতাকে তুলোধোনা করে যাচ্ছেন। ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ ধরনের অধপতন, কাদা ছোড়াছুড়ি অতীতে এত নগ্ন ও ব্যাপক মাত্রায় প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। রাজ্যের বিরোধীদের তৃণমূল দমন-পীড়নে সফল হলেও বর্তমানের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে আমলে নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তাই বলে বামফ্রন্টের ওপর দলটির ক্রমাগত খড়গ হস্ত চালাতে কসুর করছে না। তৃণমূলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের বিরুদ্ধে বিশেষ করে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ক্রমাগত নির্যাতন-নিপীড়ন জারি রাখার কারণেই তৃণমূল বিরোধী শূন্যতার ফাঁক গলিয়ে অনায়াসে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং অতি দ্রুততায় বিকশিত হতে পেরেছে। তৃণমূলের ফ্যাসিবাদী আচার-আচরণের বিরুদ্ধে নিরুপায়ে বিরোধীরা বিজেপির পতাকাতলে শামিল হয়েছে। বামফ্রন্টের হাজার-হাজার নির্যাতিত, নিগৃহীত কর্মী-সমর্থকেরা প্রাণ বাঁচাতে বিজেপির আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই রাজনৈতিক মেরুকরণ শুভ ফল বয়ে আনবে না। বরং অশুভেরই ইঙ্গিত উপলব্ধি করতে পারছি। পরিণাম হবে ভয়ঙ্কর এবং ভয়াবহ। সারা ভারতের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতার নজির স্থাপনকারী পশ্চিমবঙ্গ এখন সাম্প্রদায়িকতার বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী ধর্মান্ধ উন্মাদনায় ভাসছে, অতীতের সমস্ত গৌরব-অহংকার বিসর্জন দিয়ে। আর এর দায় তৃণমূলেই। অতীতে বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করে বিজেপি-জোট সরকারের কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ধর্মনিরপেক্ষ বামফ্রন্ট সরকারকে ঠেকাতে বা উচ্ছেদে হিন্দুত্ববাদী প্রতিক্রিয়াশীল আরএসএস, সংঘ পরিবারকে পশ্চিমবঙ্গে ঘর-গোছানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ সেটা বুমেরাং হয়ে মমতার অস্তিত্বকেই টেনে ধরেছে। ধর্ম নিয়ে বিজেপি যেমন রাজনীতির খেলা খেলছে, তেমনি তৃণমূলও। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে। বিজেপি বিরোধী জোট তৃণমূলের অনিচ্ছার কারণেই হয়নি। এক্ষেত্রে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের গোপন আসন-রফার বিষয়টিও উপেক্ষা করা যাবে না। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বিজেপি-তৃণমূলের আসন রফার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশ পেয়েছে। ধারণা করা যায় পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসন তৃণমূল, বিজেপির মধ্যেই মূলত ভাগাভাগি হবে। অবশিষ্ট নগণ্য ক’টি কংগ্রেস, বামফ্রন্ট পেলেও পেতে পারে। বাস্তবে যদিও দুই দলই একে অপরের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশে বিষোদগার প্রয়োগ করতে ছাড়ছে না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এরূপ ব্যক্তিগত বিদ্বেষ-হুঙ্কার অতীতে দেখা যায়নি। কিন্তু এবার অত্যন্ত স্থূল ভাবে একে-অপরের বিরুদ্ধে ক্রমাগত রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে বিজেপি ও তৃণমূল, সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে কংগ্রেস এবং বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপির পরস্পরের বিতর্ক বিদ্বেষ জনগণকে ধোঁকা দেয়ার আই-ওয়াস বললে হয়তো ভুল হবে না। এবারের লোকসভা নির্বাচনে যে মেরুকরণ পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে তার কুফল ধর্মনিরপেক্ষ দাবিদার পশ্চিমবঙ্গের অতীতের সব ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিনাশ করে ছাড়বে। ধর্মান্ধতার সেই উত্তাপে আমাদের মৌলবাদীদের ইস্যু খুঁজতে বেগ পেতে হবে না। ত্রিপুরায় বিজেপির উগ্রবাদীরা বিধানসভার নির্বাচনে জয়ী হয়ে ভেঙেছিল লেনিনের ভাস্কর্য, কলকাতায়ও রেহাই পায়নি বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্য, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের এই হীন রাজনৈতিক মেরুকরণ আমাদের মৌলবাদীদের চাঙ্গা হবার পথ সুগম করে দেবে। সেটা আমাদের জন্য নিশ্চয় শুভফল বয়ে আনবে না। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App