অর্ধেক দিয়ে ধান কেটে ঘরে তুললেন কৃষক
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ মে ২০১৯, ১০:৫৯ এএম
শহর থেকে ৭-৮ কিলোমিটার দূরের এলাকা মহব্বত খাঁ। রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার ৭ নম্বর ওয়ার্ড হলেও পুরোটাই গ্রামীণ পরিবেশের একটি গ্রাম। আগে তপোধন ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই গ্রামটি। নগরীর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য থাকলেও এখনো কৃষির ওপরই অনেকে নির্ভরশীল। ধান চাষ, মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন অনেকেই। এমনি একজন মাঝারি ধরনের কৃষক আবুজার রহমান। ধান চাষের পাশাপাশি মাছ চাষ করেন। মহব্বত খাঁ বাজারে তার একটি ফিডের (পশু খাদ্যের) দোকানও রয়েছে। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য খুব একটা না থাকলেও অভাবও তার কাছে প্রকট নয়। কিন্তু এবার ধান চাষের পর জমি থেকে ধান ঘরে তোলা নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে।
আবুজার রহমান এবারে ধান চাষ করেছিলেন ১০ দোন জমিতে। অর্থাৎ ২৪০ শতক জমিতে। স্থানীয়ভাবে ১ দোন সমান ২৪ শতক জমি। এসব জমিতে তার ধান চাষ বাবদ এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। জমি চাষ, বীজ রোপণ, সেচ, পরিচর্যা এবং সার ও কীটনাশক বাবদ প্রতি দোনে তার খরচ হয় সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। এখন তার জমির ধান কাটার সময় হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে তিনি স্থানীয় কৃষি শ্রমিকদের কাছে ধান কাটার কথা বলছেন। প্রত্যেকেই চুক্তি হিসেবে ১০ দোন জমির ধান কাটতে মজুরি চান ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। তবে ২৫ হাজার টাকার নিচে কেউ-ই তা কাটতে চাইছেন না। বাজারে ধানের দাম কম, আবার তার হাতের অবস্থাও ভালো না। তাই অনেকটা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে স্থানীয় শ্রমিকদের তিনি ধান কাটার অনুমতি দেন শর্তসাপেক্ষে। শ্রমিকদের তিনি বলেন, ধান কেটে তোদের অর্ধেক আমার অর্ধেক। এই শর্তে রাজি হয়ে স্থানীয় শ্রমিকরা গত সপ্তাহে তার ধান কেটে ঘরে তুলে দেন। তিনি জানান, বাজারে ধানের দাম নেই। মজুর সংকটের পাশাপাশি মজুরিও বেশি। ধান চাষে তার এ পর্যন্ত ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। আবার ধান কেটে ঘরে তুলতেই যদি আরো ২৫ হাজার টাকা খরচ হয় তাহলে এ ধান ঘরে তুলে তো লাভ নেই। প্রতি দোনে যদি ধান উৎপন্ন হয় ১২ মণ। সেখানে ১০ দোন জমিতে ধান আসবে ১২০ মণ। বাজারের যে অবস্থা এই ধান এখন সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। তাতে বিক্রি হবে ৫৪-৫৫ হাজার টাকা। ধান চাষ এবং ধান কাটা মিলে খরচ হলো ৭৫ হাজার টাকা। মজুর দিয়ে ধান কেটে ঘরে তুললে তার লোকসান হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। আর লোকসান করতে চান না তিনি, সে কারণেই তিনি নাকি মজুরদের সঙ্গে এই চুক্তি করে জমির ধান কেটে নিয়েছেন। প্রতি বছর এ সময়ে ধান কাটার উৎসব থাকে রংপুরের পল্লী এলাকাগুলোতে। কিন্তু এবার সে উৎসব যেন রূপ নিয়েছে বিষাদে। ঝড়-বৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতি হলেও ধানের দাম না থাকায় চরম বিপদে পড়েছেন এখানকার কৃষক। প্রতি মণ ধান বাজারে বিক্রি করে কৃষকরা লোকসান গুনছেন ১৭৫ থেকে ২০০ টাকা। বাজারে দামের নিম্নমুখিতার কারণে কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে দারুণ হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে রংপুরে রাস্তায় ধান ফেলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন কৃষক সংগ্রাম পরিষদ ও বাসদ (মার্কসবাদী) সংগঠনের ব্যানারে সাধারণ কৃষকরা। তবে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে ধান দিতে পারলে মণপ্রতি লাভ হবে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। রংপুর জেলা থেকে এবারে ২৫ হাজার ১৯০ টন সিদ্ধ চাল, ৭৩০ টন আতপ চাল এবং ৩ হাজার ৯৯৮ টন বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে, যা মোট উৎপাদনের শতকরা ২ ভাগের কিছু বেশি। কেননা, জেলায় এবারে ১ লাখ ৩০ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন ধান।
কৃষক সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা পলাশ কান্তি নাগ বলেন, হাটে হাটে ক্রয়কেন্দ্র খুলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। সরকার ১ হাজার ৪০ টাকা মণ ঘোষণা করার পরও খোলাবাজারে কেন মূল্য বিপর্যয় ঘটেছে তা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে কৃষকরা বাঁচবে না। জেলা বাসদ সমন্বয়ক ও কৃষক ফ্রন্ট জেলা আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন বাবলু হাটে হাটে ক্রয়কেন্দ্র খুলে সরকারি উদ্যোগে খোদ কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান ক্রয় ও ধানের ন্যায্যমূল্যের দাবি করেন।
সামছুল ইসলাম ও বরকত উল্লাহসহ অন্য কৃষকরা জানান, একজন শ্রমিকের মজুরির চেয়ে এক মণ ধানের দাম এখন কম। উৎপাদন ব্যয়ের অর্ধেক তুলতে না পেরে কৃষকের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে।