×

জাতীয়

মধ্যস্বত্বভোগীর পোয়াবারো

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৯, ১০:৫২ এএম

মধ্যস্বত্বভোগীর পোয়াবারো
মধ্যস্বত্বভোগীর পোয়াবারো
ধানের ন্যায্যমূল্য নিয়ে সারা দেশে কৃষকদের মধ্যে চলছে হাহাকার। চলতি বোরো মৌসুমে ধানের দাম কম হওয়ায় প্রতি বিঘায় দুই থেকে তিন হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে, বলছেন কৃষকরা। এ নিয়ে দানা বাঁধছে ক্ষোভ। পাকা ধানের ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে নজিরবিহীন প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছেন কোনো কোনো কৃষক। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রাজনৈতিক প্রভাবে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল সরকারিভাবে না কেনা, মাঠপর্যায়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও মিলার বা মজুদদারদের কারসাজি এবং সরকারিভাবে দেরিতে ধান সংগ্রহ শুরু করায় ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না কৃষক। এই তিন কারণে ধান চাষির ন্যায্য প্রাপ্য চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পেটে। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতেই বোরো ধানের দাম স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। সারা দেশেই গড়ে প্রতি মণ ধানের বাজারদর এখন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। কোথাও কোথাও আরো কম। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বোরোর বাম্পার ফলনের কারিগর, কৃষকের এখন মাথায় হাত। সত্যিই, ধান নিয়ে এতটা বিপদে আগে কখনো পড়েননি এ দেশের কৃষক। সরকার সংগ্রহ অভিযানের ঘোষণা দিলেও খাদ্য অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে ধান ক্রয় এখনো পুরোদমে শুরুই করেনি। সরকারি সংগ্রহ মূল্য মণপ্রতি ১ হাজার ৪০ টাকা। ধানের দাম কম হওয়ার পেছনে বিভিন্ন জায়গায় মজুদদার ও মিল মালিকদের কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। চলতি বোরো মৌসুমে গত ১৪ মে সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, মাঠপর্যায়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও মিলার বা মজুদদার অপেক্ষায় আছেন আরেক দফা বৃষ্টির। তখন কৃষকরা মাঠের পাকা ধান নিয়ে বিপাকে পড়লে দাম আরো কমে যাবে। আর মিলাররা কম দামে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে চাল করে সরকারের কাছে বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ নেবেন। এরই প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে ধান-চাল সংগ্রহের প্রক্রিয়াগত সংস্কারের দাবি তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে চাল সংগ্রহের নামে মিলার-ডিলারদের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের সুযোগ করে দেয়ার পদ্ধতি বাদ দিয়ে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল কেনার তাগিদ দিচ্ছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারি সংগ্রহ মূল্য মণপ্রতি এক হাজার ৪০ টাকা খুবই ইতিবাচক। এটাকে কৃষকবান্ধব দর বলা গেলেও বাস্তবে এই দাম কৃষকের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কারণ, মিলাররা কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনছেন ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে। ফলে সরকারি দামের অর্ধেকও পান না কৃষক। ওই টাকা যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। আর মিলাররা ধান শুকানোর মানের অজুহাত তুলে কৃষককে বঞ্চিত করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি লোকজনও ধান শুকানোর মান নিয়ে কারসাজির সুযোগ করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। যশোরের অভয়নগরের কৃষক বদরউদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, এক বিঘা জমিতে পানি, সার ও অন্যান্য খরচসহ ইতোমধ্যেই ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের জন্য মণপ্রতি ১ হাজার ৪০ টাকা নির্ধারণ করলেও আমরা তা পাই না। সঠিক সময়ে ধান সংগ্রহ না করায় আমাদের টাকা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যায়। এদিকে, টাঙ্গাইলের বাসাইলে ১২ মে এবং কালিহাতি উপজেলায় ১৩ মে কৃষক পাকা ধানের ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করেন। তাদের এই ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের কৃষকদের মধ্যে। হচ্ছে অভিনব কায়দায় প্রতিবাদ। ধানের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে গত ১৩ মে রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে রাজপথে ধান ছিটিয়ে প্রতিবাদ করেছেন কয়েক শ’ ছাত্র। এমন প্রতিবাদ হয়েছে রাজশাহীসহ দেশের অন্য এলাকায়ও। এসব বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আরিফুর রহমান অপু বলেন, এখনো ধান সংগ্রহে গতি আসেনি। এরই মধ্যে মাঠপর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তাদের তাগিদ দিয়েছি তারা যেন দ্রæত মাঠে নেমে পড়েন। আমরা চাই কৃষক যেন বঞ্চিত না হয়। তাদের কাছ থেকেই আমরা সরাসরি ধান কিনতে চাই। তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রেই কিছু দুষ্ট লোকজন থাকে। এখানেও তেমন কিছু হতে পারে। মিলাররা নানা অজুহাতে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে চাল করে বিক্রির কারসাজি করার চেষ্টা করতে পারে। তবে আমরা এসব বিষয় কঠোরভাবে মনিটর করব। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইসমত আরা বেগম বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে কৃষকরা তাদের উৎপাদন মূল্য তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি বলেন, সরকারের দিক থেকে কৃষকদের ভাগ্যের উন্নয়নে সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই, প্রচুর ভালো উদ্যোগও আমরা দেখছি। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কেন যেন কিছু গলদ থাকায় মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের ভাগের লাভ খেয়ে ফেলে। আর বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক। এ ক্ষেত্রে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচির সময় সরকারের লোকজন সরাসরি যাতে কৃষকের কাছে গিয়ে ধান কিনে আনে। মাঝে যেন ডিলার বা মিলারদের কোনো প্রবেশ না থাকে। এ ছাড়া দাম নির্ধারণের সময় কৃষকদের প্রকৃত খরচ ও তাদের লাভের অংশটির কথা মাথায় রাখতে হবে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, এবার ধান কেনার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার রাজনৈতিক প্রভাব বরদাশত করা হবে না। প্রশাসনকে কড়াভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে করে প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা যায়। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকার ৩৬ টাকা কেজি দরে চাল কিনলেও সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী, মিলার ও সরকারি কর্মকর্তাদের কারণে কৃষকরা প্রকৃত দাম পাচ্ছে না। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বাজার থেকে সরাসরি কৃষকের ধান কিনতে পারছেন না বলে স্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার ক্ষেত্রে আরো সমস্যা রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, কৃষকের কাছ থেকে কেনা ধান সবসময় মানসম্পন্ন হয় না, অনেক সময় ভেজা থাকে। ভেজা ধান যদি সরকার না কেনে তাহলে সেই ধান আবার মাথায় করে কৃষককে তার বাড়ি ফেরত নিয়ে যেতে হয়। যা সত্যিই বেদনাদায়ক। তবে মিলারদের কাছ থেকে মানসম্পন্ন ধান পাওয়া যায়। সেই ধান ভেজা থাকে না। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ মার্চ এফপিএমসির সভায় চলতি বোরো মৌসুমে ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত মোট ১২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App