×

মুক্তচিন্তা

কেমন চলছে দেশের রাজনীতি?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৯, ০৯:১৮ পিএম

সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে যে স্থবিরতা চলছে তাতে মনে হয় না অলির ছোড়া ঢিলে বড় কোনো চাঞ্চল্য তৈরি হবে। বিএনপি বুঝে উঠতে পারছে না, কোথা থেকে আবার শুরু করবে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারায় তারা হতাশ এবং হতোদ্যম। রাজনীতিতে যে মন্দা ভাব চলছে, তা নিশ্চয়ই কেটে যাবে। আমাদের দেশে মরা গাঙে বান আসে প্রাকৃতিক নিয়মেই। জবরদস্তি করে কিছুই করা উচিত নয়। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাতে গিয়েই বিএনপি আজ রাজনৈতিক গাড্ডায় পড়েছে।
রাজনীতিতে তেমন কোনো তাপ-উত্তেজনা নেই। রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় রয়েছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল রাজনীতির হিসাব-নিকাশ উলট-পালট করে দিয়েছে। যে বিএনপি ছিল সিংহ বিক্রমে, সে বিএনপির এখন মেষ শাবকের অবস্থা। জাতীয় পার্টি সরকারের আনুকূল্য পেয়েও সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গুরুতর অসুস্থ। তার জন্য কবরের জায়গা খোঁজা হচ্ছে। তিনি দলের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন ছোট ভাই জি এম কাদেরের কাঁধে। কিন্তু এতে দলে কোন্দল বেড়েছে। এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ এটা সহজে মেনে নেননি। জি এম কাদেরের বিরোধীরা রওশনের কাছে ভিড়ে জটলা করছেন। এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টির আরেক দফা ভাঙন অনিবার্য বলে মনে করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন সব দিক দিয়েই নিরাপদ। এই দলের সামনে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। দেশে বিরোধী দল অকার্যকর। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে আপাতত কোনো বিপদ-আশঙ্কা নেই। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন। তার জীবন শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন। তিনি কাজকর্মও শুরু করেছেন। বাইরের বা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কোনো চ্যালেঞ্জ না থাকলেও আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগই। টানা লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগে কিছু ‘আবর্জনা’ জমেছে। এই আবর্জনা পরিষ্কার করতে দলটি যত দেরি করবে, দলটির জন্য সেটা তত বড় ক্ষতির কারণ হবে। দলের মধ্যে নানা ধরনের বিরোধ তৈরি হচ্ছে। পাওয়া এবং না পাওয়ার দ্বন্দ্ব বাড়ছে। আওয়ামী লীগ পরিবারের অবস্থা বোঝার জন্য ছাত্রলীগের দিকে তাকালেই চলবে। ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়েছে এক বছর আগে। সম্মেলনে কমিটি গঠন করা হয়নি। দুই মাস পর সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা হয়। আর পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করতে লাগল এক বছর। ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর দেখা দেয় ব্যাপক অসন্তোষ। বিক্ষোভ-মারামারি। বলা হচ্ছে, এই কমিটিতে অন্তত ৯৯ জন আছেন বিভিন্ন কারণে ‘বিতর্কিত’। ছাত্রলীগের কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থকদের ক্ষোভের মুখে এখন ‘বিতর্কিত’দের কমিটি থেকে বাদ দেয়ার নির্দেশও তাকেই নিতে হচ্ছে। যারা তার কাছে এই নামের তালিকা পাঠিয়েছেন তারা কি একবারও ভেবেছেন এ ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদার জন্য কতটা ক্ষতিকর? ছাত্রলীগের বিরোধ সহজে মিটবে বলে মনে হয় না। কারণ সমস্যার সমাধান না করে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালানোর প্রবণতা থাকলে সমস্যা ঝুলে থাকে। আওয়ামী লীগের সহযোগী অন্য সংগঠনগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যাবে যে প্রায় সব সংগঠনই চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। সবচেয়ে বড় সমস্যায় আছে এক সময় বড় দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি। বিএনপি গত সংসদ নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসন পেয়ে একেবারে ছোট দলে নেমে এসেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ছাড়া আর কোনো সিনিয়র নেতা জয়ী হতে পারেননি। এটা বিএনপির জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। দলটি এই নির্বাচনী বিপর্যয় মেনে নিতে পারেনি। তারা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানায়। সংসদকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে দলীয় এমপিদের শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু বিএনপি শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতেও ব্যর্থ হয়েছে। নানা ধরনের নাটকীয়তার পর বিএনপির পাঁচ এমপি শপথ নিয়ে সংসদে গিয়েছেন। তবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নিয়ে সদস্য পদ খুইয়েছেন। তার আসন শূন্য হয়েছে। বগুড়া-৬ আসনটি খালেদা জিয়ার। এই আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে। প্রার্থী কে হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। মির্জা ফখরুলও প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা গিয়েছে। আবার গণমাধ্যমে খবর এসেছে, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-৬ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী করা হতে পারে, যদি তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। মান্না নাকি এই প্রস্তাবে বিস্মিত। তিনি বিস্মিত হলেও বিএনপি তাকে ওই প্রস্তাব দিতে পেরেছে। কারণ বিএনপির মনে হয়েছে, মান্নার রাজনীতির জায়গা বিএনপি। কথাটা যখন একবার উঠেছে তখন আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে শেষ দেখার। মান্না বাম থেকে আওয়ামী লীগ হয়ে নাগরিক ঐক্যের ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে বিএনপিতে ঢুকে পড়লে খারাপ হবে না। ছোট দল থেকে বড় দল। আবার ছোট দল থেকে এক সময়ের বড় দলে যাওয়ার মধ্যে একটা অন্য রকম ব্যাপার আছে! বিএনপি মান্নাকে দলে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। ওদিকে আবার বিএনপির নেতৃত্ব দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। তিনি এক সময় বিএনপি করতেন। তারপর বিএনপি ছেড়ে নতুন দল করেন। এখন আছেন ২০ দলীয় জোটে। বড় বড় কথা বলায় অভ্যস্ত কর্নেল (অব.) অলি সম্প্রতি বলেছেন, সংসদে গিয়ে বিএনপি বর্তমান সরকারকে ‘বৈধতা’ দিয়েছে। বিএনপি সংসদে যাওয়ার আগে কি তাহলে সরকার বৈধতার সংকটে ছিল? ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা আছে, সেটা দেশের ভেতরে ও বাইরে। কিন্তু দেশের বাইরে কেউ সরকারকে ‘অবৈধ’ বলেছে কি? বিএনপি কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে সংসদে গিয়েছে সেটা অলি আহমদের অজানা নয়। বিএনপি সংসদে না গেলে সরকারের খুব ক্ষতির আশঙ্কা ছিল কি? কিন্তু বিএনপি সংসদে না গেলে দলটির আরো বড় ক্ষতির কারণ ঘটত। বাজারে কথা রটেছিল, বিএনপি এমপিরা সংসদে যাবেন এবং খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পাবেন। বিএনপি এমপিরা সংসদে গেলেন কিন্তু খালেদা জিয়া জামিন পেলেন না! তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? রটনার এক অংশ সত্য হলো, আরেক অংশ হলো না। এ ব্যাপারে অলি আহমদের বক্তব্য জানা নেই। অলি আহমদ বলছেন, ‘খালেদা জিয়ার পক্ষে জেলে থেকে আমাদের নির্দেশনা দেয়া সম্ভব নয়। তারেক রহমানের পক্ষে লন্ডন থেকে সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকাও সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি সেই দায়িত্ব নেয়ার জন্য প্রস্তুত। আপনারা নেতৃত্ব দেন, না হলে আমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করুন। বসে থাকা চলবে না।’ অলি আহমদের এই বক্তব্যকে একেবারে তাৎপর্যহীন মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তিনি এমন এক সময় ‘নেতৃত্ব’ দিতে চাইলেন যখন বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে একেবারেই বিশৃঙ্খল ও এলোমেলো অবস্থায় আছে। সত্যিকার অর্থেই বিএনপিতে চলছে নেতৃত্ব সংকট। দলের দুই শীর্ষ নেতা জেলে এবং লন্ডনে। ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির ছয়জন মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবিতদের মধ্যে সক্রিয় আছেন পাঁচ-ছয়জন। অলি আহমদ এক সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ঘরের ছেলে কি তবে আবার ঘরে ফিরতে চান? তার অবস্থান কি এখন ‘ডাকিলেই আসিবো’। তিনি কি বিএনপির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে চান? ‘আমি দায়িত্ব নেয়ার জন্য প্রস্তুত’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন? তিনি প্রস্তুত। কিন্তু বিএনপি কি তাকে দায়িত্ব তুলে দিতে ‘প্রস্তুত’? অলি আহমদ এক সময় বিএনপিকে বেকাদায় ফেলতে ঘর ভেঙেছেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সম্পর্কেও কঠোর-কটু মন্তব্য করেছেন। তাকে কি বিশ্বাসযোগ্য মনে করবেন তারেক রহমান? দলের সক্রিয় নেতারাই বা কেন অলি আহমদের নেতৃত্ব মেনে নেবেন? অলি আহমদ একটি ঢিল ছুড়লেন। তিনিও হয়তো এর প্রতিক্রিয়া দেখতে চান। তবে সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে যে স্থবিরতা চলছে তাতে মনে হয় না অলির ছোড়া ঢিলে বড় কোনো চাঞ্চল্য তৈরি হবে। বিএনপি বুঝে উঠতে পারছে না, কোথা থেকে আবার শুরু করবে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারায় তারা হতাশ এবং হতোদ্যম। খালেদা জিয়ার মুক্তির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা এখন ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তাকে কেরানীগঞ্জের নতুন কারাগারে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। বিএনপি নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার দুই হাত, কাঁধের ব্যথা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তার ডায়াবেটিসও বিপজ্জনক মাত্রায়। মুখের ভেতরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করতে পারছেন না।’ দলের চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে বিএনপি সরকারের সহানুভূতি আদায় করতে সক্ষম হবে কি? চিকিৎসকরা এখন পর্যন্ত তার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। তবে কারো শারীরিক অবস্থা যেন কোনোভাবে রাজনীতির উপাদান না হয়। রাজনীতিতে যে মন্দা ভাব চলছে, তা নিশ্চয়ই কেটে যাবে। আমাদের দেশে মরা গাঙে বান আসে প্রাকৃতিক নিয়মেই। জবরদস্তি করে কিছুই করা উচিত নয়। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাতে গিয়েই বিএনপি আজ রাজনৈতিক গাড্ডায় পড়েছে। বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App